“জগৎ মাতা,
শিখাও গো দুহিতারে জননীর প্রেম।
ছিন্ন অন্য ডুরি,
প্রেমে বাঁধা রেখো মা সংসারে;
ওরে, কে অভাগা এসেছে জঠরে?”
অতি সুন্দর হইয়াছে।
“যবে গভীরা যামিনী, বসি দ্বারে।
শিশুদুটি ঘুমায় কুটিরে,
চাঁদ পানে চাহি কাঁদি সই,
চাঁদ মুখ পড়ে মনে।”
এই সরল কথায় সীতার বেশ একটি চিত্র দেওয়া হইয়াছে। অধিক উদ্ধৃত করিবার স্থান নাই, উদ্ধৃত করিলাম না।
লক্ষ্মণ-বর্জন বিষয়টি অতি মহান, কিন্তু তাহা দৃশ্যকাব্য রচনার উপযোগী কি না সন্দেহ। লেখক রামচরিত্রের অর্থ, রাম চরিত্রের মর্ম ইহাতে নিবিষ্ট করিয়াছেন। রামের সমস্ত কার্য, সমস্ত বীরত্ব-কাহিনীকে তিনি দুইটি অক্ষরে পরিণত করিয়াছেন। সে দুইটি অক্ষর– প্রেম। এই সংক্ষেপ দৃশ্যকাব্যখানিতে লেখক একটি মহান কাব্যের রেখাপাত মাত্র করিয়াছেন। ইহাতে লক্ষ্মণের মহত্ত্ব অতি সুন্দর হইয়াছে। কবি যাহা বলেন, তাহার মর্ম এই, যে, বীরত্ব নামক গুণ স্বাবলম্বী গুণ নহে, উহা পরমুখাপেক্ষী গুণ। যেখানে বীরত্ব দেখা যাইবে, সেইখানে দেখিতে হইবে, সে বীরত্ব কাহাকে আশ্রয় করিয়া আছে, সে বীরত্বের বীরত্ব কী লইয়া। কে কত মানুষ খুন করিয়াছে, তাহা লইয়া বীরত্ব বিচার করা উচিত নহে, কাহাকে কিসে বীর করিয়া তুলিয়াছে, তাহাই লইয়া বীরত্বের বিচার। কেহ বা আত্মরক্ষার জন্য বীর, কেহ বা পরের প্রাণ রক্ষার জন্য বীর। জননী সন্তান-স্নেহের জন্য বীর, দেশ-হিতৈষী স্বদেশ-প্রেমে বীর। তেমনি লক্ষ্মণও বীর বলিয়াই বীর নহেন, তিনি বীর হইয়া উঠিয়াছিলেন। কিসে তাঁহাকে বীর করিয়া তুলিয়াছিল? প্রেমে। রামের প্রেমে। অনেকে প্রেমকে হৃদয়ের দুর্বলতা বলেন, কিন্তু সেই প্রেমের বলেই লক্ষ্মণ বীর। যখন সত্যের অনুরোধে রাম লক্ষ্মণকে ত্যাগ করিলেন, তখন লক্ষ্মণ কহিলেন,
” সেবা মম পূর্ণ এত দিনে,
আত্ম-বিসর্জনে পূজা করি সম্পূরণ!
ত্যাগ-শিক্ষা মোরে শিখাইলা দয়াময়,
করি আপনা বঞ্চন,
রঘুমণি,
সেই প্রেম স্মরি, সেই প্রেমবলে
জিনি অবহেলে পুরন্দর-জয়ী অরি,
পঙ্গু আমি লঙ্ঘিনু সুমেরু!
সেই প্রেম বলে
না টলিনু শক্তি-শেল হেরি,
উচ্চ-হৃদে পেতে নিনু শেল
রাম-প্রেমে শেলে পাইনু ত্রাণ!”
রাম ও লক্ষ্মণ, হিংসা, ঘৃণা, যশোলিপ্সা বা দুরাকাঙক্ষার বলে বীর নহেন, তাঁহারা প্রেমের বলে বীর। তাঁহাদের বীরত্ব সর্বোচ্চ-শ্রেণীর বীরত্ব। এই মহান ভাব এই সংক্ষেপ দৃশ্যকাব্যখানির মধ্যে নিহিত আছে।
মুক্তি ও সাধন সম্বন্ধে হিন্দু-শাস্ত্রের উপদেশ। শ্রীবিপিন বিহারী ঘোষাল প্রণীত।
পুস্তকখানির জন্য আমরা গ্রন্থকারকে প্রাণের সহিত ধন্যবাদ দিতেছি। ইহাতে গ্রন্থকর্তার অসাধারণ অনুসন্ধান, বিস্তৃত সংগ্রহ ও সরল অনুবাদের ভাষায় আমরা নিতান্ত প্রীত হইয়াছি। বাংলায় এ শ্রেণীর পুস্তক আমরা যতগুলি দেখিয়াছি, তন্মধ্যে এখানি সর্বোৎকৃষ্ট।
কুসুম-কানন। প্রথম ভাগ। শ্রীকায়কোবাদ প্রণীত।
এই গ্রন্থখানিতে দুটি-একটি মিষ্ট কবিতা আছে।
সরলা। শ্রীযোগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রণীত।
প্রায়শ্চিত্ত। শ্রীহরিপদ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত।
এই দুইখানি গ্রন্থ ক্ষুদ্রায়তন সরল সামাজিক উপন্যাস। ইহাদের সম্বন্ধে বিশেষ বক্তব্য কিছুই নাই।
আদর। (প্রিয়তমার প্রতি)। শ্রীকল্পনাকান্ত গুহ প্রণীত।
ইহা পড়িয়া প্রিয়তমা সন্তুষ্ট হইতে পারেন, কিন্তু পাঠকেরা সন্তুষ্ট হইবেন না।
ঊর্মিলা-কাব্য। শ্রীদেবেন্দ্রনাথ সেন প্রণীত। মূল্য চারি আনা।
এই কাব্যখানির বিষয় নূতন ও কবিতাপূর্ণ। ইহাতে ঊর্মিলার দুঃখ বর্ণিত হইয়াছে। ঊর্মিলা বনবাসিনী সীতাকে পত্র লিখিতেছেন। এই ক্ষুদ্র পত্রখানিতে ঊর্মিলার চরিত্র ও ঊর্মিলার মনোভাব সুন্দর বিকশিত হইয়াছে। বিরহিণী ঊর্মিলা প্রসাদের উদ্যানে বিচরণ করিতে করিতে কল্পনা-কুহকে নিজের চারি দিকে নানাবিধ মায়াজাল রচনা করিতেছেন ও ভাঙিতেছেন, এ ভাবটি সুন্দর হইয়াছে। স্থানে স্থানে ইহাতে সুন্দর কবিতা আছে।
সাদরে চিবুক মোর ধরি বীরবর
অধরে চুম্বিলা দেবী, হায় সে চুম্বন–
নিচল যমুনাজলে চন্দ্র-কর-লেখা
পড়ে গো নিঃশব্দে যথা, অথবা যেমতি
ঊষার মুকুট শোভা কুসুমের শিরে
নিশির শিশির পাত; নীরব, মৃদুল!
পত্র শেষ করিয়া পত্র সম্বন্ধে ঊর্মিলা কহিতেছেন–
পাঠ করি মনোসাধে, পরম কৌশলে
নিদ্রিত নাথের বক্ষে নিঃশব্দে চরণে–
রাখিয়া আসিয়ো দিদি করি গো বিনতি।
…
নিদ্রান্তে চকিতে যবে হেরিয়া এ লেখা,
শুধাবেন “কে আনিল!” কহিয়ো তাঁহারে,
“স্বর্গ হতে ফেলেছেন বুঝি রতিদেবী
চেতাইতে সুকঠিন অপ্রেমিক জনে,
নহে মানবের কাজ, দেবের এ লীলা।”
দাও গো বিদায় তবে আসিছে মন্থরা।
ভক্তিপূর্ণ নমস্কার জানায়ো শ্রীরামে,
কহিয়ো তাঁহারে দেবি, “দেব রঘুমণি
ফিরিয়া আসিলে ঘরে, ব্যাপিকা ঊর্মিলা,
পূর্বের কৌতুক আর করিতে নারিবে,
হাসিতেন রঘুবর সে ব্যঙ্গ কৌতুকে।
সে আমোদ হাসিমুখ ভুলিয়া গিয়াছে।”
…
আর জানাইয়ো দিদি তোমার দেবরে–
কী জানাবে? জানাবার কি গো আর আছে?
জানাইয়ো ঊর্মিলার নিষ্ফল প্রণয়,
জানাইয়ো ঊর্মিলার নয়নের বারি,
জানাইয়ো, প্রিয় দিদি, জানাইয়ো তারে,
অযোধ্যার রাজপুরে কি নিশি দিবসে,
ঊর্ধ্বমুখে, কখনো বা অবনত মুখে,
বিগলিত কেশপাশ পাণ্ডুর অধরা,
একটি রমণী মূর্তি ঘোরে অবিরত!