গৌতমের সূত্রনিচয় আমাদের সমালোচ্য নহে। নূতন টীকা ও তাহার বাংলা ভাষার ব্যাখ্যা সমালোচ্য হইলেও ন্যায় বিষয়ে অল্পাধিকার থাকায় আমরা ওই দুই অংশের যথোচিত সমালোচনা অর্থাৎ গুণদোষ বিচার করিতে অক্ষম। তবে পুস্তক পাঠে যাহা বোধগম্য হইয়াছে তাহা সাধারণ সমক্ষে ব্যক্ত করা দোষাবহ নহে বিবেচনায় ওই দুই বিষয়ে অল্প কিছু বলিলাম।
কোনো গভীর বিষয় সংক্ষেপে লিখিতে গেলে যে দোষের সম্ভাবনা থাকে সে দোষ ব্যতীত অন্য কোনো দোষ প্রাপ্ত ন্যায়দর্শনের নূতন টীকায় লক্ষিত হইল না। নূতন টীকার ভাষাটি বিশেষ সুখবোধ্য হইয়াছে। বাংলা ব্যাখ্যাও বিশেষ মনোরম ও নির্দোষ হইয়াছে । প্রাচীন টীকাকারেরা যে রীতিতে শব্দ বিন্যাস করিতেন, ন্যায়দর্শনের টীকা যেরূপ হওয়া উচিত, সেরূপ না হইলেও সাধারণত এই বলা যাইতে পারে যে, নূতন টীকাটি মন্দ হয় নাই। কেননা, কোথাও পদার্থের বৈপরীত্য ঘটনা হয় নাই । চতুরস্রা বুদ্ধির অথবা বহুদর্শনের অভাবে যে-সকল গুণের অভাব হইয়াছে। তাহার একটি এই–
টীকালেখক প্রথম সূত্রর টীকায় “প্রমাণ প্রমেয়াদীনাং ষোড়শ পদার্থানাং তত্ত্বজ্ঞানাৎ অসাধারণধর্ম্মপ্রকারেণাবধারণাৎ নিঃশ্রেয়সাবিগমঃ মোক্ষপ্রাপ্তির্ভবতীত্যর্থঃ” এই মাত্র লিখিয়াছেন। এই স্থানে অন্তত এরূপ একটা কথা লেখা উচিত ছিল যে, বস্তুতত্ত্ব আত্মতত্ত্বজ্ঞানাদেব মোক্ষঃ। কেননা, আত্মাতিরিক্ত প্রমেয়ের জ্ঞানে মোক্ষ হয় না, এ কথা বোধ হয় সকল লোকেই জানে। দেখুন উক্ত সূত্রের প্রাচীন ব্যাখ্যায় কেমন সুসমঞ্জস কথা আছে।
“যদি পুনঃ প্রমাণাদিপদার্থতত্ত্বজ্ঞানাৎ নিঃশ্রেয়সংস্যাৎ ন মোক্ষ্যমাণা মোক্ষায় ঘটেরন্। নহি কস্যচিৎ ক্কচিচ্চ তত্ত্বজ্ঞানং নাস্তীতি। তস্মাৎ আত্মাদ্যেব প্রমেয়ং মুমুক্ষুণা জ্ঞেয়ম ইতি।”– বার্ত্তিক ।
ভাষ্যকার বাৎসায়ন অতি সমঞ্জসরূপে ওই কথার সংগতার্থ প্রদর্শন করিয়াছেন । যথা–
“তদিদং তত্ত্বজ্ঞানং নিঃশ্রেয়সার্থং যথাবিদ্যং বেদিতবাম্। ইহ তু অধ্যাত্ম বিখ্যায়াং আত্মাদি তত্ত্বজ্ঞানাৎ নিঃশ্রেয়সাধিগমঃ অপবর্গঃ।
বার্ত্তিককার ঐ ভাষ্যের আরও অধিক বিশদ ব্যাখ্যা করিয়াছেন যথা–
“সর্বাসু বিদ্যাসু তত্ত্বজ্ঞানমস্তি নিঃশ্রেয়সাধিগমশ্চেতি। ত্রয্যাং তাবৎ কিং তত্ত্বজ্ঞানং কশ্চ নিঃশ্রেয়সাধিগম ইতি? তত্ত্বজ্ঞানং তাবৎ অগ্নিহোত্রাদিসাধনা নাঃ সাধ্যত্বাদিপরিজ্ঞানঃ অনুপহতত্ত্বাদিপরিজ্ঞানঞ্চ। নিঃশ্রেয়সাধিগমোপি স্বর্গপ্রাপ্তি। তথাহ্যত্র। স্বর্গঃফলং শ্রূয়তে। অথ বার্ত্তায়াং কিং তত্ত্বজ্ঞানং কশ্চ নিঃশ্রেয়সাধিগম ইতি? ভূম্যাদিপরিজ্ঞানং তত্ত্বজ্ঞানং কৃষ্যাদ্যধিগমশ্চনিঃশ্রেয়সমিতি তৎফলত্বাৎ। দণ্ডনীত্যাং কিং তত্ত্বজ্ঞানকেশ্চ নিঃশ্রেয়সাধিগম ইতি? সামদানদণ্ডভেদানাং যথাকালং যথাদেশং যথাশক্তি বিনিয়োগস্তত্ত্বজ্ঞানং নিঃশ্রেয়সং পৃথিবীজয়াদি। ইহ তু অধ্যাত্মবিদ্যায়াং আত্মজ্ঞানং তত্ত্বজ্ঞানং নিঃশ্রেয়সমপবর্গ ইতি।”
নিঃশ্রেয়স শব্দের মোক্ষ অর্থ গ্রহণকালে অন্যান্য পদার্থের তত্ত্বজ্ঞান কারণ কোটিতে পরিত্যক্ত হয়। কেননা একমাত্র আত্মতত্ত্ব জ্ঞানই মোক্ষের কারণ। নিঃশ্রেয়স শব্দের মঙ্গল সাধারণতার্থ গ্রহণকালে অন্যান্য পদার্থের তত্ত্বজ্ঞান সেই সেই প্রকারে উন্নয়ন করিতে হয়। কেননা, বিশেষ বিশেষ পদার্থের তত্ত্বজ্ঞানের বিশেষ বিশেষ ফল নির্দিষ্ট আছে।
এইরূপ ত্রুটি আরও কতিপয় স্থানে লক্ষিত হয়, সে-সকল পরিহৃত হইলে পুস্তকখানি বিশেষ উপকারী হইতে পারে।
কাতন্তব্যাকরণম্ ভাবসেনত্রৈবিদ্যবিরচিতরূপমালা প্রক্রিয়াসহিতম্ ।
ব্যাকরণমিদং বাঙ্গৈঃ পণ্ডিতৈঃ কলাপব্যাকরণমিত্যাখ্যায়তে। স্বীকুবন্তি চাস্য ব্যাকরণস্যোৎকৃষ্টত্বং পণ্ডিতাঃ ক্রান্তি চাস্য হেতুরুৎকৃষ্টত্বে সারল্যমিতি। বয়মপাস্য সুষ্ঠুতাং অবগচ্ছামঃ। যৎকারণং অনেনৈব ব্যাকরণেন সুকুমারমতিকুমারাণাং স্বল্পায়াসেন ব্যাকরণপদপদার্থজ্ঞান জায়ত ইতি। সন্তি হি বহুনি ব্যাকরণানি সিদ্ধান্তকৌমুদীপ্রমুখানি। পরন্তু তেষামতি দুরূহত্বাৎ ন যোগ্যানি বালানম্। ব্যাকরণস্যৈতস্য দুর্গসিংহকৃতা বৃত্তির্বঙ্গে প্রচরদ্রূপা ন তু ভাবসেনত্রৈবিদ্যদেববিরচিত রূপমালা। ইয়ং সমীচীনতমা রূপমালা প্রক্রিয়া দুষ্প্রাপ্য আসীৎ। সম্প্রতি তু তদন্বিতং কৃত্বা কাতন্ত্র সূত্রমুদ্রণেন মহানুপকারোজাত ইতি মন্যামহে। এতদেব ব্যাকরণং রূপমালা প্রক্রিয়া সহিতং চেৎ পাঠশালায়াং প্রচরদ্রূপং ভবেৎ তর্হি বালানাং ব্যাকরণজ্ঞানং সহজেনোপায়েন সম্পৎস্যুত ইত্যুশাস্মহে বয়্ম। অস্য চ মুদ্রণকার্য সর্বাঙ্গ সুন্দরংজাতমিত্যপরঃ পরিতোষহেতুরস্মাকং। কিং বহুনা, এতৎ প্রকাশকার শ্রীহীরাচন্দ্র নিমিচন্দ্র শ্রেষ্ঠনে মুম্বয্যবাসিনে বয়ং প্রশংসাবাদং উদীরয়াম ইতিশম্।
কাতন্ত্র ব্যাকরণ বঙ্গদেশে কলাপ ব্যাকরণ নামে প্রসিদ্ধ। এই ব্যাকরণ অন্যান্য ক্ষুদ্র ব্যাকরণ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। ইহার অনেকগুলি বৃত্তি ও ব্যাখ্যা বিদ্যমান আছে। তন্মধ্যে দুর্গসিংহকৃত ব্যাখ্যা বঙ্গদেশে প্রচলিত। দুর্গসিংহের ব্যাখ্যা অপেক্ষা ভাবসেন ত্রৈবিদ্য দেবের “রূপমালা প্রক্রিয়া” নাম্নী ব্যাখ্যা অনেক অংশে উৎকৃষ্ট। কিন্তু তাহা এ পর্যন্ত এদেশে নিতান্ত দুষ্প্রাপ্য ছিল। সম্প্রতি বরোদা রাজ্যের অন্তর্গত ব্রহ্মণগ্রামোৎপন্ন বুম্বাপুরানিবাসী পণ্ডিত শ্রীনাথরামশাস্ত্রী ও বুম্বাইনিবাসী শ্রীহীরাচন্দ্র নেমিচন্দ্র শ্রেষ্ঠী এই দুই মহানুভব উক্ত ব্যাখ্যার সহিত (রূপমালার সহিত) কাতন্ত্র সূত্র মুদ্রিত করিয়া সংস্কৃত শিক্ষার্থীদিগের সমূহ উপকার করিয়াছেন। পুস্তকের অক্ষর, মুদ্রাঙ্কণ, কাগজ, সমস্তই উত্তম এবং পরিশুদ্ধতায় অনবদ্য। মূল্য এক টাকা সুতরাং অধিক নহে। বলা বাহুল্য যে, এই পুস্তক মুগ্ধবোধের পরিবর্তে ব্যবহৃত হইলে ব্যাকরণ শিক্ষা সহজসাধ্য হইতে পারে।