Site icon BnBoi.Com

আধুনিক সাহিত্য – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আধুনিক সাহিত্য - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আর্যগাথা

আর্যগাথা। দ্বিতীয় ভাগ। শ্রীদ্বিজেন্দ্রলাল রায়-প্রণীত

গ্রন্থখানি সংগীতপুস্তক, এইজন্য ইহার সম্পূর্ণ সমালোচনা সম্ভবে না। কারণ, গানে কথার অপেক্ষা সুরেরই প্রাধান্য। সুর খুলিয়া লইলে অনেক সময়ে গানের কথা অত্যন্ত শ্রীহীন এবং অর্থশূন্য হইয়া পড়ে এবং সেইরূপই হওয়া উচিত। কারণ, সংগীতের দ্বারা যখন আমরা ভাব ব্যক্ত করিতে চাহি তখন কথাকে উপলক্ষমাত্র করাই আবশ্যক; কথার দ্বারাই যদি সকল কথা বলা হইয়া যায় তবে সংগীত সেখানে খর্ব হইয়া পড়ে। কথার দ্বারা আমরা যাহা ব্যক্ত করিয়া থাকি তাহা বহুলপরিমাণে সুস্পষ্ট সুপরিস্ফুট– কিন্তু আমাদের মনে অনেক সময় এমন-সকল ভাবের উদয় হয় যাহা নামরূপে নির্দেশ বা বর্ণনায় প্রকাশ করিতে পারি না, যাহা কথার অতীত, যাহা অহৈতুক– সেই-সকল ভাব, অন্তরাত্মার সেই-সমস্ত আবেগ-উদ্‌বেগগুলি সংগীতেই বিশুদ্ধ রূপে ব্যক্ত হইতে পারে। হিন্দুস্থানি গানে কথা এতই যতসামান্য যে, তাহাতে আমাদের চিত্তকে বিক্ষিপ্ত করিতে পারে না– ননদিয়া, গগরিয়া, চুনরিয়া, আমরা কানে শুনিয়া যাই মাত্র কিন্তু সংগীতের সহস্রবাহিনী নির্ঝরিণী সেই-সমস্ত কথাকে তুচ্ছ উপলখণ্ডের মতো প্লাবিত করিয়া দিয়া আমাদের হৃদয়ে এক অপূর্ব সৌন্দর্য্যবেগ, এক অনির্বচনীয় আকুলতার আন্দোলন সঞ্চার করিয়া দেয়। সামান্যত পাথরের নুড়ি বালকের খেলনা মাত্র, হিন্দি গানের কথাও সেইরূপ ছেলেখেলা– কিন্তু নির্ঝরের তলে সেই নুড়িগুলি ঘাতে-প্রতিঘাতে জলস্রোতকে মুখরিত করিয়া তোলে, বেগবান প্রবাহকে বিবিধ বাধা দ্বারা উচ্ছ্বসিত করিয়া অপরূপ বৈচিত্র্য দান করে। হিন্দি গানের কথাও সেইরূপ সুরপ্রবাহকে বিচিত্র শব্দসংঘর্ষ এবং বাধার দ্বারা উচ্ছ্বসিত ও প্রতিধ্বনিত করিয়া তোলে, অর্থগৌরব বা কাব্যসৌন্দর্যের দ্বারা তাহাকে অতিক্রম করিতে চেষ্টা করে না। ছন্দ-সম্বন্ধেও এ কথা খাটে। নদী যেমন আপনার পথ আপনি কাটিয়া যায় গানও তেমনি আপনার ছন্দ আপনি গড়িয়া গেলেই ভালো হয়। অধিকাংশ স্থলে হিন্দি গানের কথায় কোনো ছন্দ থাকে না– সেইজন্যেই ভালো হিন্দি গানের তালের গতিবৈচিত্র্য এমন অভাবিতপূর্ব ও সুন্দর– সে ইচ্ছামত হ্রস্বদীর্ঘের সামঞ্জস্য বিধান করিতে করিতে চলে, স্বাধীনতার সহিত সংযমের সমন্বয় সাধন করিতে করিতে বিজয়ী সম্রাটের ন্যায় গুরুগম্ভীর ভেরীধ্বনি-সহকারে অগ্রসর হইতে থাকে। তাহাকে পূর্বকৃত বাঁধা ছন্দের মধ্য দিয়া চালনা করিয়া লইয়া গেলে তাহার বৈচিত্র্য এবং গৌরবের হানি হইয়া থাকে। কাব্য স্বরাজ্যে একাধিপত্য করিতে পারে কিন্তু সংগীতের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করিতে গেলে তাহার পক্ষে অনধিকার চর্চা হয়।

বিশুদ্ধ কাব্য এবং বিশুদ্ধ সংগীত স্ব স্ব অধিকারের মধ্যে স্বতন্ত্রভাবে উৎকর্ষ লাভ করিয়া থাকে, কিন্তু বিদ্যাদেবীগণের মহল পৃথক হইলেও তাঁহারা কখনো কখনো একত্র মিলিয়া থাকেন। সংগীতে ও কাব্যে মধ্যে মধ্যে সেরূপ মিলন দেখা যায়। তখন উভয়েই পরস্পরের জন্য আপনাকে কথঞ্চিৎ সংকুচিত করিয়া লন, কাব্য আপন বিচিত্র অলংকার পরিত্যাগ করিয়া নিরতিশয় স্বচ্ছতা ও সরলতা অবলম্বন করেন, সংগীতও আপন তালসুরের উদ্দাম লীলাভঙ্গকে সম্বরণ করিয়া সখ্যভাবে কাব্যের সাহচর্য করিতে থাকেন।

হিন্দুস্থানে বিশুদ্ধ সংগীত প্রাবল্য লাভ করিয়াছে কিন্তু বঙ্গদেশে কাব্য ও সংগীতের সম্মিলন ঘটিয়াছে। গানের যে-একটি স্বতন্ত্র উদ্দেশ্য, একটি স্বাধীন পরিণতি তাহা এ দেশে স্থান পায় নাই। কাব্যকে অন্তরের মধ্যে ভালো করিয়া ধ্বনিত করিয়া তুলিবার জন্যই এ দেশে সংগীতের অবতারণা হইয়াছিল। কবিকঙ্কণ চণ্ডী, অন্নদামঙ্গল প্রভৃতি বড়ো বড়ো কাব্যও সুরসহকারে সর্বসাধারণের নিকট পঠিত হইত। বৈষ্ণব কবিদিগের গানগুলিও কাব্য– কেবল চারিদিকে উড়িয়া ছড়াইয়া পড়িবার জন্য সুরগুলি তাহাদের ডানাস্বরূপ হইয়াছিল। কবিরা যে কাব্য রচনা করিয়াছেন সুর তাহাই ঘোষণা করিতেছে মাত্র।

বঙ্গদেশের কীর্তনে কাব্য ও সংগীতের সম্মিলন এক আশ্চর্য আকার ধারণ করিয়াছে; তাহাতে কাব্যও পরিপূর্ণ এবং সংগীতও প্রবল। মনে হয় যেন ভাবের বোঝাই-পূর্ণ সোনার কবিতা, ভরা সুরের সংগীত-নদীর মাঝখান দিয়া বেগে ভাসিয়া চলিয়াছে। সংগীত কেবল-যে কবিতাটিকে বহন করিতেছে তাহা নহে তাহার নিজেরও একটা ঐশ্বর্য এবং ঔদার্য এবং মর্যাদা প্রবলভাবে প্রকাশ পাইতেছে।

আমাদের সমালোচ্য গ্রন্থখানিতে উভয় শ্রেণীরই গান দেখা যায়। ইহার মধ্যে কতকগুলি গান আছে যাহা সুখপাঠ্য নহে, যাহার ছন্দ ও ভাববিন্যাস সুরতালের অপেক্ষা রাখে, সেগুলি সাহিত্যসমালোচকের অধিকার-বহির্ভূত। আর-কতকগুলি গান আছে যাহা কাব্য হিসাবে অনেকটা সম্পূর্ণ– যাহা পাঠমাত্রেই হৃদয়ে ভাবের উদ্রেক ও সৌন্দর্যের সঞ্চার করে। যদিচ সে-গানগুলির মাধুর্যও সম্ভবত সুরসংযোগে অধিকতর পরিস্ফুটতা, গভীরতা এবং নূতনত্ব লাভ করিতে পারে তথাপি ভালো এনগ্রেভিং হইতে তাহার আদর্শ অয়েলপেন্টিঙের সৌন্দর্য যেমন অনেকটা অনুমান করিয়া লওয়া যায় তেমনি কেবলমাত্র সেই-সকল কবিতা হইলে গানের সমগ্র মাধুর্য আমরা মনে মনে পূরণ করিয়া লইতে পারি। উদাহরণস্বরূপ “একবার দেখে যাও দেখে যাও কত দুখে যাপি দিবানিশি’ কীর্তনটির প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে ইচ্ছা করি। ইহা বেদনায় পরিপূর্ণ, অনুরাগে অনুনয়ে পরিপ্লুত। পাঠ করিতে করিতে সঙ্গে সঙ্গে ইহার আকুতিপূর্ণ সংগীতটি আমাদের কল্পনায় ধ্বনিত হইতে থাকে। সম্ভবত যে সুরে এই গান বাঁধা হইতেছে তাহা আমাদের কল্পনার আদর্শের সহিত তুলনীয় হইতে পারে না। না হইবারই কথা। কারণ, এই কবিতাটি কিঞ্চিৎ বৃহৎ এবং বিচিত্র; এবং আমাদের সংগীত সাধারণত একটিমাত্র সংক্ষিপ্ত স্থায়ী ভাব, অবলম্বন করিয়া আত্মপ্রকাশ করে; ভাব হইতে ভাবান্তরে বিচিত্র আকারে ও নব নব ভঙ্গিতে অভিব্যক্ত হইয়া উঠে না। এইজন্য আমাদের বক্ষ্যমাণ কবিতাটির উপযুক্ত রাগিণী আমরা সহজে প্রত্যাশা করিতে পারি না। কিন্তু কোনো সুর না থাকিলেও ইহাকে আমরা গান বলিব – কারণ, ইহাতে আমাদের মনের মধ্যে গানের একটা আকাঙক্ষা রাখিয়া দেয়– যেমন ছবিতে একটা নির্ঝরিণীর আঁকা দেখিলে তাহার গতিটি আমরা মনের ভিতর হইতে পূরণ করিয়া লই। গান এবং কবিতার প্রভেদ আমরা এই গ্রন্থ হইতেই তুলনার দ্বারা দেখাইয়া দিতে পারি।

সে কে? — এ জগতে কেহ আছে, অতি উচ্চ মোর কাছে
যার প্রতি তুচ্ছ অভিলাষ;
সে কে? — অধীন হইয়ে, তবু রহে যে আমার প্রভু;
প্রভু হয়ে আমি যার দাস;
সে কে? — দূর হতে দূরাত্মীয়, প্রিয়তম হতে প্রিয়,
আপন হইতে যে আপন;
সে কে? — লতা হতে ক্ষীণ তারে বাঁধে দৃঢ় যে আমারে,
ছাড়াতে পারি না আজীবন;
সে কে? — দুর্বলতা যার বল, মর্মভেদী অশ্রুজল;
প্রেম-উচ্চারিত রোষ যার;
সে কে? — যার পরিতোষ মম সফল জনমসম;
সুখ-সিদ্ধি সব সাধনার;
সে কে? — হলে কঠিন চিক শিশুসম স্নেহভীত
যার কাছে পড়ি গিয়া নুয়ে;
সে কে? — বিনা দোষে ক্ষমা চাই যার; অপমান নাই
শতবার পা দুখানি ছুঁয়ে;
সে কে? — মধুর দাসত্ব যার, লীলাময় কারাগার;
শৃঙ্খল নূপুর হয়ে বাজে;
সে কে? — হৃদয় খুঁজিতে গিয়া নিজে যাই হারাইয়া
যার হৃদি-প্রহেলিকা মাঝে।
ইহা কবিতা, কিন্তু গান নহে। সুরসংযোগে গাহিলেও ইহাকে গান বলিতে পারি না। ইহাতে ভাব আছে এবং ভাবপ্রকাশের নৈপুণ্যও আছে কিন্তু ভাবের সেই স্বতউচ্ছ্বসিত সদ্য-উৎসারিত আবেগ নাই যাহা পাঠকের হৃদয়ের মধ্যে প্রহত তন্ত্রীর ন্যায় একটা সংগীতের কম্পন উৎপাদন করিয়া তোলে।

ছিল বসি সে কুসুমকাননে।
আর অমল অরুণ উজল আভা
ভাসিতেছিল সে আননে।
ছিল এলায়ে সে কেশরাশি (ছায়াসম হে);
ছিল ললাটে দিব্য আলোক, শান্তি
অতুল গরিমারাশি।
সেথা ছিল না বিষাদভাষা (অশ্রুভরা গো);
সেথা বাঁধা ছিল শুধু সুখের স্মৃতি
হাসি, হরষ, আশা;
সেথা ঘুমায়ে ছিলরে পুণ্য, প্রীতি,
প্রাণভরা ভালোবাসা।
তার সরল সুঠাম দেহ (প্রভাময় গো, প্রাণভরা গো);
যেন যা-কিছু কোমল ললিত তা দিয়ে
রচিয়াছে তাহে কেহ;
পরে সৃজিল সেথায় স্বপন, সংগীত,
সোহাগ শরম স্নেহ।
যেন পাইল রে উষা প্রাণ (আলোময়ী রে);
যেন জীবন্ত কুসুম, কনকভাতি
সুমিলিত, সমতান।
যেন সজীব সুরভি মধুর মলয়
কোকিলকূজিত গান।
শুধু চাহিল সে মোর পানে (একবার গো);
যেন বাজিল বীণা মুরজ মুরলী
অমনি অধীর প্রাণে;
সে গেল কী দিয়া, কী নিয়া, বাঁধি মোর হিয়া
কী মন্ত্রগুণে কে জানে।
এই কবিতাটির মধ্যে যে রস আছে তাহাকে আমরা গীতরস নাম দিতে পারি। অর্থাৎ লেখক একটি সুখস্মৃতি এবং সৌন্দর্যস্বপ্নে আমাদের মনকে যেরূপভাবে আবিষ্ট করিয়া তুলিতে চাহেন তাহা সংগীত দ্বারা সাধিত হইয়া থাকে এবং যখন কোনো কবিতা বিশেষ মন্ত্রগুণে অনুরূপ ফল প্রদান করে তখন মনের মধ্যে যেন একটি অব্যক্ত গীতধ্বনি গুঞ্জরিত হইতে থাকে। যাঁহারা বৈষ্ণব পদাবলী পাঠ করিয়াছেন, অন্যান্য কবিতা হইতে গানের কবিতার স্বাতন্ত্র্য তাঁহাদিগকে বুঝাইয়া দিতে হইবে না।

আমরা সামান্য কথাবার্তার মধ্যেও যখন সৌন্দর্যের অথবা অনুভবের আবেগ প্রকাশ করিতে চাহি তখন স্বতই আমাদের কথার সঙ্গে সুরের ভঙ্গি মিলিয়া যায়। সেইজন্য কবিতায় যখন বিশুদ্ধ সৌন্দর্যমোহ অথবা ভাবের উচ্ছ্বাস ব্যক্ত হয় তখন কথা তাহার চিরসঙ্গী সংগীতের জন্য একটা আকাঙক্ষা প্রকাশ করিতে থাকে।–

এসো এসো বঁধু এসো, আধো আঁচরে বসো,
নয়ন ভরিয়া তোমায় দেখি!
এই পদটিতে যে গভীর প্রীতি এবং একান্ত আত্মসমর্পণ প্রকাশ পাইয়াছে তাহা কি কথার দ্বারা হইয়াছে? না, আমরা মনের ভিতর হইতে একটা কল্পিত করুণ সুর সংযোগ করিয়া উহাকে সম্পূর্ণ করিয়া তুলিয়াছি? ঐ দুটি ছত্রের মধ্যে যে-কটি কথা আছে তাহার মতো এমন সামান্য এমন সরল এমন পুরাতন কথা আর কী হইতে পারে ? কিন্তু উহার ঐ অত্যন্ত সরলতাই শ্রোতাদের কল্পনার নিকটহইতে সুর ভিক্ষা করিয়া লইতেছে। এইজন্য ঐ কবিতার সুর না থাকিলেও উহা গান। এইজন্যেই–

হরষে বরষ পরে যখন ফিরি রে ঘরে,
সে কে রে আমারি তরে আশা ক’রে রহে বলো;
স্বজন সুহৃদ সবে উজল নয়ন যবে,
কার প্রিয় আঁখি দুটি সব চেয়ে সমুজ্জ্বল!
ইহা কানাড়ায় গীত হইলেও গান নহে, এবং–

চাহি অতৃপ্ত নয়নে তোর মুখপানে
ফিরিতে চাহে না আঁখি;
আমি আপনা হারাই, সব ভুলে যাই
অবাক হইয়ে থাকি!
ইহাতে কোনো রাগিণীর নির্দেশ না থাকিলে ইহা গান।

সর্বশেষে আমরা আর্যগাথা হইতে একটি বাৎসল্য রসের গান উদ্‌ধৃত করিয়া দিতেছি। ইহাতে পাঠকগণ স্নেহের সহিত কৌতুকের সংমিশ্রণ দেখিতে পাইবেন।

একি রে তার ছেলেখেলা বকি তায় কি সাধে–
যা দেখবে বলবে, “ওমা, এনে দে, ওমা, দে।’
“নেব নেব’ সদাই কি এ?
পেলে পরে ফেলে দিয়ে
কাঁদতে গিয়ে হেসে ফেলে, হাসতে গিয়ে কাঁদে
এত খেলার জিনিস ছেড়ে,
বলে কি না দিতে পেড়ে —
অসম্ভব যা– তারায় মেঘে বিজলিরে চাঁদে!
শুনল কারো হবে বিয়ে,
ধরলো ধুয়ো অমনি গিয়ে
“ও মা, আমি বিয়ে করব’ — কান্নার ওস্তাদ এ!
শোনো কারো হবে ফাঁসি
অমনি আঁচল ধরল আসি–
“ও মা, আমি ফাঁসি যাব’– বিনি অপরাধে!

আষাঢ়ে

লেখক তাঁহার নাম প্রকাশ করেন নাই। সুতরাং আমরাও তাঁহার নাম উল্লেখ করিতে পারিলাম না। কিন্তু ইহা নিশ্চয়, বাংলা-পাঠকসমাজে তাঁহার নাম গোপন থাকিবে না।

“আষাঢ়ে’ কতকগুলি হাস্যরসপ্রধান কবিতা। তাহার অনেকগুলিই গল্প-আকারে রচিত। গল্পগুলিকে “আষাঢ়ে’ আখ্যা দিয়া গ্রন্থকার পাঠকদিগকে পূর্ব হইতেই প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছেন। কারণ, আমরা বাঙালি পাঠকেরা অত্যন্ত গম্ভীর প্রকৃতির লোক। বেরসিক বর যেমন বাসরঘরের অপ্রত্যাশিত রসিকতায় খাপা হইয়া উঠে আমরাও তেমনি ছাপার বই খুলিয়া হঠাৎ আদ্যোপান্ত কৌতুক দেখিতে পাইলে ছিব্‌লামি সহ্য করিতে পারি না।

বইখানির মধ্যে গায়ে বাজে এমনতরো কৌতুকও আছে। ইহার শেষ কবিতার নাম “কর্ণবিমর্দন’। কিন্তু এই মর্দন-ব্যাপারটি সকল কবিতাতেই কিছু-না-কিছু আছে। গল্পপ্রসঙ্গে সামাজিক কপটতার যে-অংশটাই কবির হাতের কাছে আসিয়াছে সেইখানেই তিনি একটুখানি সহাস্য টিপ্পনী প্রয়োগ করিয়াছেন।

এরূপ প্রকৃতির রহস্য-কবিতা বাংলা সাহিত্যে সম্পূর্ণ নূতন এবং “আষাঢ়ে’র কবি অপূর্ব প্রতিভাবলে ইহার ভাষা, ভঙ্গি, বিষয় সমস্তই নিজে উদ্‌ভাবন করিয়া লইয়াছেন।

ভাষা ও ছন্দ সম্বন্ধে গ্রন্থকার ভূমিকায় লিখিয়াছেন —

“এ কবিতাগুলির ভাষা অতীব অসংযত ও ছন্দোবদ্ধ অতীব শিথিল। ইহাকে সমিল গদ্য নামেই অভিহিত করা সংগত। কিন্তু যেরূপ বিষয় সেইরূপ ভাষা হওয়া বিধেয় মনে করি। হরিনাথের শ্বশুরবাড়ি-যাত্রা বর্ণনা করিতে মেঘনাদবধের দুন্দুভিনিনাদের ভাষা ব্যবহার করিলে চলিবে কেন?

ভাষা সম্বন্ধে কবি যাহা লিখিয়াছেন সে ঠিক কথা। কিন্তু ছন্দ সম্বন্ধে তিনি কোনো কৈফিয়ত দেন নাই এবং দিলেও আমরা গ্রহণ করিতে পারিতাম না। পদ্যকে সমিল গদ্যরূপে চালাইবার কোনো হেতু নাই। ইহাতে পদ্যের স্বাধীনতা বাড়ে না, বরঞ্চ কমিয়া যায়। কারণ কবিতা পড়িবার সময় পদ্যের নিয়ম রক্ষা করিয়া পড়িতে স্বতই চেষ্টা জন্মে, কিন্তু মধ্যে মধ্যে যদি স্খলন হইতে থাকে তবে তাহা বাধাজনক ও পীড়াদায়ক হইয়া ওঠে।

বায়রনের ডন জুয়ানে কবি অবলীলাক্রমে যথেচ্ছ কৌতুকের অবতারণা করিয়াছেন। কিন্তু নির্দোষ ছন্দের সুকঠিন নিয়মের মধ্যেই সেই অনায়াস অবলীলাভঙ্গি পাঠককে এরূপ পদে পদে বিস্মিত করিয়া তোলে।

ইন্‌গোল্‌ডস্‌বি কাহিনী প্রভৃতি অপেক্ষাকৃত নিম্নশ্রেণীর কৌতুক-কাব্যেও ছন্দের অস্খলিত পারিপাট্য বিশেষরূপে লক্ষিত হয়।

বস্তুত, ছন্দের শৈথিল্য হাস্যরসের নিবিড়তা নষ্ট করে। কারণ হাস্যরসের প্রধান দুইটি উপাদান, অবাধ দ্রুতবেগ এবং অভাবনীয়তা। যদি পড়িতে গিয়া ছন্দে বাধা পাইয়া যতিস্থাপন সম্বন্ধে দুই-তিনবার দুই-তিন রকম পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হয় তবে সেই চেষ্টার মধ্যে হাস্যের তীক্ষ্ণতা আপন ধার নষ্ট করিয়া ফেলে।

অবশ্য কোনো নূতন ছন্দ প্রথম পড়িতে কষ্ট হয়, এবং যাঁহাদের ছন্দের স্বাভাবিক কান নাই তাঁহারা পরের উপদেশ ব্যতীত তাহা কোনো কালেই পড়িতে পারেন না। কিন্তু আলোচ্য ছন্দের প্রধান বাধা তাহার নূতনত্ব নহে। তাহার সর্বত্র এক নিয়ম বজায় থাকে নাই এইজন্য পড়িতে পড়িতে আবশ্যকমত কোথাও টানিয়া কোথাও ঠাসিয়া কমবেশি করিয়া চলিতে হয়। এমন করিয়া বরঞ্চ মনে মনে পড়া চলে, কিন্তু কাহাকেও পড়িয়া শুনাইতে হইলে পদে পদে অপ্রতিভ হইতে হয়।

অথচ শোনাইবার যোগ্য এমন কৌতুকাবহ পদার্থ বঙ্গসাহিত্যে আর নাই। আজকাল বাংলা কবিতা আবৃত্তির দিকে একটা ঝোঁক পড়িয়াছে। আবৃত্তির পক্ষে কৌতুক-কবিতা অত্যন্ত উপাদেয়। অথচ “আষাঢ়ে’র অনেকগুলি কবিতা ছন্দের উচ্ছৃঙ্খলতাবশত আবৃত্তির পক্ষে সুগম হয় নাই বলিয়া অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয় হইয়াছে।

অথচ ছন্দ এবং মিলের উপর গ্রন্থকারের যে আশ্চর্য দখল আছে তাহাতে সন্দেহ নাই। উত্তপ্ত লৌহচক্রে হাতুড়ি পড়িতে থাকিলে যেমন স্ফুলিঙ্গবৃষ্টি হইতে থাকে, তাঁহার ছন্দের প্রত্যেক ঝোঁকের মুখে তেমনি করিয়া মিল বর্ষণ হইয়াছে। সেই মিলগুলি বন্দুকের ক্যাপের মতো আকস্মিক হাস্যোদ্দীপনায় পরিপূর্ণ। ছন্দের কঠিনতাও যে কবিকে দমাইতে পারে না তাহারও অনেক উদাহরণ আছে। কবি নিজেই তাঁহার অপেক্ষাকৃত পরবর্তী রচনাগুলিকে নিয়মিত ছন্দের মধ্যে আবদ্ধ করিয়া তাহাদিগকে স্থায়িত্ব এবং উপযুক্ত মর্যাদা দান করিয়াছেন। তাঁহার “বাঙালি মহিমা’, “ইংরেজস্তোত্র’, “ডিপুটি কাহিনী’ ও “কর্ণবিমর্দন’ সর্বত্র উদ্‌ধৃত, পঠিত ও ব্যবহৃত হইবার পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল হইয়াছে। এই লেখাগুলির মধ্যে যে সুনিপুণ হাস্য ও সুতীক্ষ্ণ বিদ্রূপ আছে তাহা শাণিত সংযত ছন্দের মধ্যে সর্বত্র ঝক্‌ঝক্‌ করিতেছে।

প্রতিভার প্রথম উদ্দাম চেষ্টা, আরম্ভেই একটা নূতন পথের দিকে ধাবিত হয়, তাহার পর পরিণতিসহকারে পুরাতন বন্ধনের মধ্যে ধরা দিয়া আপন মর্মগত নূতনত্বকে বহিঃস্থিত পুরাতনের উপর দ্বিগুণতর উজ্জ্বল আকারে পরিস্ফুট করিয়া তুলে। “আষাঢ়ে’র গ্রন্থকর্তা যতগুলি কবিতা লিখিয়াছেন, সকলেরই মধ্যে তাঁহার প্রতিভার স্বকীয়ত্ব প্রকাশ পাইতেছে, কিন্তু যে কবিতাগুলি তিনি ছন্দের পুরাতন ছাঁচের মধ্যে ঢালিয়াছেন, তাহাদের মধ্যে নূতনত্বের উজ্জ্বলতা ও পুরাতনের স্থায়িত্ব উভয়ই একত্র সম্মিলিত হইয়াছে। আমাদের বিশ্বাস, কবিও তাহা অন্তরের মধ্যে উপলব্ধি করিয়াছেন এবং তাঁহার হাস্যসৃষ্টির নীহারিকা ক্রমে ছন্দোবন্ধে ঘনীভূত হইয়া বঙ্গসাহিত্যে হাস্যালোকের ধ্রুব নক্ষত্রপুঞ্জ রচনা করিবে।

শুদ্ধমাত্র অমিশ্র হাস্য ফেনরাশির মতো লঘু এবং অগভীর। তাহা বিষয়পুঞ্জের উপরিতলের অস্থায়ী উজ্জ্বল বর্ণপাত মাত্র। কেবল সেই হাস্যরসের দ্বারা কেহ যথার্থ অমরতা লাভ করে না। রুপালির পাতের মধ্যে শুভ্রতা ও উজ্জ্বলতা আছে বটে, কিন্তু তাহার লঘুত্ব ও অগভীরতাবশত তাহার মূল্যও অল্প ও তাহার স্থায়িত্ব সামান্য। সেই উজ্জ্বলতার সঙ্গে রৌপ্যপিণ্ডের কাঠিন্য ও ভার থাকিলে তবেই তাহার মূল্য বৃদ্ধি করে। হাস্যরসের সঙ্গে চিন্তা এবং ভাবের ভার থাকিলে তবে তাহার স্থায়ী আদর হয়। সমালোচ্য গ্রন্থে “বাঙালি মহিমা’, “কর্ণবিমর্দনকাহিনী’ প্রভৃতি কবিতায় যে হাস্য প্রকাশ পাইতেছে, তাহা লঘু হাস্য মাত্র নহে, তাহার মধ্যে কবির হৃদয় রহিয়াছে, তাহার মধ্য হইতে জ্বালা ও দীপ্তি ফুটিয়া উঠিতেছে। কাপুরুষতার প্রতি যথোচিত ঘৃণা এবং ধিক্‌কারের দ্বারা তাহা গৌরববিশিষ্ট।

তাহা ছাড়া, সাময়িক পত্রে মধ্যে মধ্যে “আষাঢ়ে’-রচয়িতার এমন-সকল কবিতা বাহির হইয়াছে যাহাতে হাস্যে এবং অশ্রুরেখা, কৌতুক এবং কল্পনা, উপরিতলের ফেনপুঞ্জ এবং নিম্নতলের গভীরতা একত্র প্রকাশ পাইয়াছে। তাহাই তাঁহার কবিত্বের যথার্থ পরিচয়। তিনি যে কেবল বাঙালিকে হাসাইবার জন্য আসেন নাই সেইসঙ্গে তাহাদিগকে যে ভাবাইবেন এবং মাতাইবেন এমন আশ্বাস দিয়াছেন।

অগ্রহায়ণ ১৩০৫

 ঐতিহাসিক চিত্র

আমরা “ঐতিহাসিক চিত্র’ নামক একখানি ঐতিহাসিক পত্রের মুদ্রিত প্রস্তাবনা প্রাপ্ত হইয়াছি। শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয়ের সম্পাদকতায় তাহা প্রকাশিত হইবে।

এই প্রস্তাবনায় লিখিত হইয়াছে– “আমাদের ইতিহাসের অনেক উপকরণ বিদেশীয় পরিব্রাজকগণের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ; তাহা বহুভাষায় লিখিত বলিয়া আমাদের নিকট অপরিজ্ঞাত ও অনাদৃত। মুসলমান বা ইউরোপীয় সমসাময়িক ইতিহাস লেখকগণ যে-সকল বিবরণ লিখিয়া গিয়াছেন, তাহারও অদ্যাপি বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয় নাই। পুরাতন রাজবংশের কাগজপত্রের মধ্যে যে সকল ঐতিহাসিক তত্ত্ব লুক্কায়িত আছে তাহার অনুসন্ধান লইবারও ব্যবস্থা দেখা যায় না।

“নানা ভাষায় লিখিত ভারতভ্রমণকাহিনী ও ইতিহাসাদি প্রামাণ্য গ্রন্থের অনুবাদ, অনুসন্ধানলব্ধ নবাবিষ্কৃত ঐতিহাসিক তথ্য, আধুনিক ইতিহাসাদির সমালোচনা এবং বাঙালি রাজবংশ ও জমিদারবংশের পুরাতত্ত্ব প্রকাশিত করাই (এই প্রস্তাবিত পত্রের) মুখ্য উদ্দেশ্য।’

প্রাচীন গ্রীস রোম এবং আধুনিক প্রায় সকল সভ্যদেশেই ইতিহাসের প্রতি, পক্ষপাত যেরূপ প্রকাশ পাইয়াছে ভারতবর্ষে কখনো তেমন ছিল না, ইহাতে বোধ করি দুই মত হইবে না। মান্ধাতার সমকালে আমাদের দেশে হয়তো সবই ছিল– তখন টেলিগ্রাফ, রেলগাড়ি, বেলুন, ম্যাক্‌সিম বন্দুক, ডারউইনের অভিব্যক্তিবাদ, এবং গ্যানো-রচিত প্রকৃতিবিজ্ঞান ছিল এমন অনেকে আভাস দিয়া থাকেন– কিন্তু, তখন ইতিহাস ছিল না। থাকিলে এমন-সকল কথা অল্প শুনা যাইত।

কিন্তু আধুনিক ভারতবর্ষে, যে সময়ে রাজপুতদের জনবন্ধন দৃঢ় ছিল তখন তাহাদের মধ্যে, উপযুক্ত মাটিতে উপযুক্ত চাষের মতো, ইতিহাস আপনি উদ্‌ভিন্ন হইয়া উঠিত।

আধুনিক ভারতে যখন হইতে মারাঠারা শিবাজীর প্রতিভাবলে এক জনসম্প্রদায়রূপে বজ্রের মতো বাঁধিয়া গিয়াছিল এবং সেই বজ্র যখন জীর্ণ মোগল সাম্রাজ্যের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বিদ্যুৎ-বেগে ভাঙিয়া পড়িতেছিল, তখন হইতে তাহাদের ইতিহাস রচনার স্বাভাবিক কারণ ঘটে। তাহাদের “বখর’ নামধারী ইতিহাসগুলি প্রাচীন মহারাষ্ট্র সাহিত্যের প্রধান অঙ্গ।

শিখদের ধর্মগ্রন্থ এবং তাহাদের জনসম্প্রদায়গঠনের ইতিহাস একত্র সম্মিলিত। তাহাদের ধর্মমতে একেশ্বরবাদের মহান ঐক্য স্বভাবতই জাতীয় ঐক্যের কারণ হইয়াছিল। তাহারা যেমন ধর্মে এক, তেমনি কর্মে এক, তেমনি বলে এক হইয়া উঠিয়াছিল। তাহাদের ধর্মগ্রন্থ একই কালে পুরাণ এবং ইতিহাস।

আসল কথা এই যে, জীবের ধর্ম যেমন বর্তমানে জীবনরক্ষা এবং ভবিষ্যতে বংশানুক্রমে আপনাকে স্থায়ী করিবার চেষ্টা, তেমনি যখন বহুসংখ্যক বিচ্ছিন্ন লোককে কোনো একটি বিশেষ মত বা ভাব বা ধারাবাহিক স্মৃতিপরম্পরা এক জীবন দিয়া এক জীব করিয়া তোলে তখন সে বহিঃশত্রুর আক্রমণে খাড়া হইয়া দাঁড়াইতে পারে এবং ভবিষ্যৎ-অভিমুখে আপন ব্যক্তিত্ব, আপন সম্প্রদায়গত ঐক্যকে প্রেরণ করিবার জন্য যত্নবান হইয়া উঠে। ইতিহাস তাহার অন্যতম উপায়। এইজন্য কীটসমাজের পক্ষে বংশানুক্রমে প্রবালশৈলরচনার ন্যায় বিশেষ ঐক্যবদ্ধ জনসম্প্রদায়ের পক্ষে ইতিহাসরচনা প্রকৃতিগত ধর্ম।

শাস্ত্র পুরাণ জনসমাজের সম্পূর্ণ ইতিহাস না হইলেও তাহা ধর্মসমাজের ইতিহাস। ধর্মমণ্ডলী আপন ধর্মের মহত্ত্ব সৌন্দর্য প্রাচীনতা সাধুদৃষ্টান্তমালা পুরাণে শাস্ত্রে গ্রথিত করিয়া ধর্মমতপ্রবাহকে অখণ্ড আকারে কাল হইতে কালান্তরে সঞ্চারিত করিয়া রাখে এবং সেই পুরাতন ঐক্যসূত্রে আপন সম্প্রদায়কে দূরকালবদ্ধ বৃহৎ এবং সুদৃঢ় করিয়া তোলে।

এইজন্য ঘটনার তথ্যতা রক্ষা করা পুরাণের উদ্দেশ্য নহে। তাহা কেবল ধর্মমত-ধর্মবিশ্বাসের ইতিবৃত্ত। তাহার কাল্পনিক অমূলক উক্তিসকলও বর্ণিত ধর্মনীতির আদর্শকেই ব্যক্ত করে। সাময়িক ঘটনাবলীর প্রকৃত বিবরণ তাহার লক্ষ্যের মধ্যে পড়ে না।

কিন্তু লোকেরা যখন কেবল ধর্মসম্প্রদায় বলিয়া নহে, জনসম্প্রদায় বলিয়া আপনার ঐক্য অনুভব করে, কেবল ধর্মরক্ষা নহে জনগত আত্মরক্ষা তাহাদের পক্ষে স্বাভাবিক হইয়া উঠে, তখন তাহারা কেবল বিশেষ মত বা বিশ্বাস নহে পরন্তু আপনাদের ক্রিয়াকলাপকীর্তি সুখদুঃখ ও সাময়িক ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করিতে থাকে।

যখন আর্যগণ প্রথম ভারতবর্ষে আসিয়াছিলেন, যখন উদাসীন স্বাতন্ত্র্য তাঁহাদের আদর্শ ছিল না, যখন প্রাকৃতিক বাধা ও আদিম অনার্যের সহিত সংগ্রামে তাঁহাদিগকে সচেষ্ট দলবদ্ধ হইতে হইয়াছিল, যখন বীরপুরুষগণের স্মৃতি তাঁহাদিগকে বীর্যে উৎসাহিত করিত, তখন তাঁহাদের লিপিহীন সাহিত্যে ইতিহাসগাথার প্রাদুর্ভাব ছিল সন্দেহ নাই। সেই-সকল অতিপুরাতন খণ্ড-ইতিহাস বহুযুগ পরে মহাভারতে ও রামায়ণে নানা বিকারসহকারে একত্র সংযোজিত হইয়াছিল।

কিন্তু প্রতিপদক্ষেপে যখন আর বন ছিল না এবং বনে যখন আর রাক্ষস ছিল না, যক্ষরক্ষকিন্নরগণ যখন দুর্গম পর্বতে নির্বাসিত হইয়া জনপ্রবাদে ক্রমশ অলৌকিক আকার ধারণ করিল, অর্জুনবিজয়ী কিরাতেশ্বর ধূর্জটি যখন দেবপদে উত্তীর্ণ হইলেন, প্রতিকূল প্রকৃতি এবং মানবের সংঘাত যখন দূর হইয়া গেল, যখন সুদীর্ঘ শান্তিকালে সূর্যকরোতপ্ত ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণ সকলের প্রধান হইয়া আপন ঔদাস্যধর্মের বিপুলজাল হিমালয় হইতে কুমারিকা পর্যন্ত নিক্ষেপ করিল, তখন হইতে আর ইতিহাস রহিল না। ব্রাহ্মণের ধর্ম শত শত নব নব পুরাণে গ্রথিত হইতে লাগিল কিন্তু জনসংঘ ক্রমে শিথিলীভূত হইয়া কোথায় ছড়াইয়া পড়িল, তাহাদের আর কোনো কথাই নাই। অতীত হইতেও তাহারা বিচ্যুত হইল, ভবিষ্যতের সহিতও তাহাদের যোগ রহিল না।

আসল কথা, ঐক্যের ধর্ম প্রাণধর্মের ন্যায়। সে জড়ধর্মের ন্যায় কেবল একাংশে বদ্ধ থাকে না। সে যদি এক দিকে প্রবেশ লাভ করে তবে ক্রমে আর-এক দিকেও আপনার অধিকার বিস্তার করিতে থাকে। সে যদি দেশে ব্যাপ্ত হইতে পায় তবে কালেও ব্যাপ্ত হইতে চায়। সে যদি নিকট এবং দূরের মধ্যে বিচ্ছেদ পূরণ করিতে পারে তবে অতীত এবং ভবিষ্যতের সঙ্গেও আপন বিচ্ছিন্নতা দূর করিতে চেষ্টা করে।

এই অখণ্ডতার চেষ্টা এত প্রবল যে, অনেক সময়ে তাহা কল্পনার দ্বারা ইতিহাসের অভাব পূরণ করিয়া ইতিহাসকে ব্যর্থ করিয়া দেয়। এইজন্যই সুদীর্ঘ কল্পনাজাল বিস্তার করিয়া রাজপুতগণ চন্দ্রসূর্যবংশের সহিত আপন সংযোগ সাধন করিয়াছিল।

আমরাও বর্ণ এবং কূল-মর্যাদা একটি সূক্ষ্ম সূত্রের মতো অনেকদিন হইতে টানিয়া লইয়া চলিয়াছে। তাহার শ্রেণী-গোত্র-গাঁই-মেল সম্বন্ধীয় সংক্ষিপ্ত সাহিত্যে ভাটেদের মুখে উত্তরোত্তরে বাড়িয়া চলিয়াছে। ইহা আমরা ভুলিতে দিতে পারি না। কারণ আমাদের সমাজে যে ঐক্য আছে তাহা প্রধানত বর্ণগত। সেই সূত্র আমরা স্মরণাতীত কাল হইতে টানিয়া আনিতে এবং অনন্ত ভবিষ্যতের সহিত বাঁধিয়া রাখিতে চাই।

কিন্তু আমাদের মধ্যে যদি জনগত ঐক্য থাকিত, যদি পরস্পর সংলগ্ন হইয়া জয়ের গৌরব, পরাজয়ের লজ্জা, উন্নতির চেষ্টা আমরা এক বৃহৎ হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিতে পারিতাম, তবে সেই জনমণ্ডলী স্বভাবতই ঊর্ণনাভের মতো আপনার ইতিহাসতন্তু প্রসারিত করিয়া দূর-দূরান্তরে আপনাকে সংযুক্ত করিত। তাহা হইলে আমাদের দেশের ভাটেরা কেবল গাঁই-গোত্র-প্রবরের শ্লোক আওড়াইত না, কথকেরা কেবল পুরাণ ব্যাখ্যা করিত না, ইতিহাসগাথকেরা পূর্বকালের সহিত সুখদুঃখগৌরবের যোগ বংশানুক্রমে স্মরণ করাইয়া রাখিত।

এক্ষণে আমাদের বিশেষ আনন্দের কারণ এই যে, সম্প্রতি বঙ্গসাহিত্যে যে একটি ইতিহাস-উৎসাহ জাগিয়া উঠিয়াছে, তাহার মধ্যে সার্বজনীন সুলক্ষণ প্রকাশ পাইতেছে। তাহাকে আমরা আকস্মিক এবং ক্ষণস্থায়ী একটা বিশেষ ধরনের সংক্রামক রচনা-কুণ্ডু বলিয়া স্থির করিতে পারি না। আজকাল সমস্ত ভারতবর্ষের মধ্যে শিক্ষা এবং আন্দোলনের যে জীবনশক্তি নানা আকারে কার্য করিতেছে এই ইতিহাসক্ষুধা তাহারই একটি স্বাভাবিক ফল।

ইহাতে এই প্রমাণ হয় যে, কন্‌গ্রেস প্রভৃতির বিক্ষোভ যে আমাদের দেশে বাহ্যিক তাহা নহে। এক-এক সময়ে মনে আশঙ্কা জন্মে যে, রাজদরবারে প্রতিবৎসর একঘেয়ে দরখাস্ত পেশ করিবার এই যে-সকল বিপুল আয়োজন ইহা ব্যর্থ। কারণ, সরকারে নিকট ইহা প্রতিষ্ঠাভাজন হইতে পারে নাই, এবং দেশের অন্তরের মধ্যেও ইহার স্থায়ী প্রভাব প্রবেশ করিতেছে না।

কিন্তু আমাদের অন্তরের মধ্যে শক্তিপুঞ্জ কেমন করিয়া অলক্ষ্যে কাজ করিতেছে তাহাই আমরা সর্বাপেক্ষা অল্প জানি। যখন অঙ্কুর বাহির হইয়া পড়ে তখনই বুঝিতে পারি, বাতাসে কখন বীজ উড়িয়া আসিয়া মনের উর্বর প্রদেশে স্থানলাভ করিয়াছিল।

এই ইতিহাসবুভুক্ষা, ইহা একটি অঙ্কুর। বুঝিতেছি যে, কন্‌গ্রেস বৎসর বৎসর কেবল রাজপ্রাসাদে কতকগুলি বিফল দরখাস্ত বর্ষণ করে নাই, ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশগুলিকে ক্রমশই ঘনিষ্ঠতর করিয়া আনিয়া আমাদের অন্তঃকরণের মধ্যে ভাবের বীজ বপন করিতেছে।

দেশব্যাপী বৃহৎ হৃৎস্পন্দন কিছুদিন হইতে আমরা যেন অনুভব করিতে আরম্ভ করিয়াছি। ব্যক্তিগত পল্লীগত বিচ্ছিন্নতা ঘুচিয়া গিয়া আমাদের সুখদুঃখ, আমাদের মান-অপমান, আমাদের চিন্তা, আমাদের চেষ্টা ক্রমেই বৃহৎ পরিধি আশ্রয় করিতেছে। জড়ীভূতা অহল্যা রামচন্দ্রের স্পর্শে যেমন ভূমিতল হইতে মূর্তি ধারণ করিয়া দণ্ডায়মান হইয়াছিল, সেইরূপ একেশ্বর ইংরাজশাসনের সংস্পর্শে আমাদের ভারতবর্ষ বিমিশ্র অস্পৃষ্ট বিচ্ছিন্ন জড়পুঞ্জমধ্য হইতে ক্রমশ এক মূর্তি গ্রহণ করিয়া দাঁড়াইয়া উঠিতেছে। জনহৃদয়ে সঞ্চরমাণ সেই-যে ঐক্যের বেগ, প্রাণের উচ্ছ্বাস, প্রীতির বন্ধনমুক্তি, ও কর্তব্যের উদারতাজনিত আনন্দ, তাহাই আমাদের উদ্যমকে জাগ্রত করিয়া তুলিয়াছে।

এখন আমরা বোম্বাই-মাদ্রাজ-পঞ্জাবকে যেমন নিকটে পাইতে চাই, তেমনি অতীত ভারতবর্ষকেও প্রত্যক্ষ করিতে চাহি। নিজের সম্বন্ধে সচেতন হইয়া এক্ষণে আমরা দেশে এবং কালে এক রূপে এবং বিরাট রূপে আপনাকে উপলব্ধি করিতে উৎসুক। এখন আমরা মোগল-রাজত্বের মধ্য দিয়া পাঠান রাজত্ব ভেদ করিয়া সেন-বংশ পাল-বংশ গুপ্ত-বংশের জটিল অরণ্যমধ্যে পথ করিয়া পৌরাণিক কাল হইতে বৌদ্ধ কাল এবং বৌদ্ধ কাল হইতে বৈদিক কাল পর্যন্ত অখণ্ড আপনার অনুসন্ধানে বাহির হইয়াছি। সেই মহৎ আবিষ্কারব্যাপারের নৌযাত্রায় “ঐতিহাসিক চিত্র’ একটি অন্যতম তরণী। যে-সকল নির্ভীক নাবিক ইহাতে সমবেত হইয়াছেন ঈশ্বর তাঁহাদের আশীর্বাদ করুন, দেশের লোক তাঁহাদের সহায় হউন এবং বাধাবিঘ্ন ও নিরুৎসাহের মধ্যেও অনুরাগপ্রবৃত্ত মহৎ কর্তব্যসাধনের নিষ্কাম আনন্দ তাঁহাদিগকে ক্ষণকালের জন্য পরিত্যাগ না করুক।

এ কথা কেহ না মনে করেন, গৌরব অনুসন্ধানের জন্য পুরাবৃত্তের দুর্গম পথে প্রবেশ করিতে হইবে। সে দিকে গৌরব না থাকিতেও পারে — অনেক পরাভব, অনেক অবমাননা, অনেক পতন ও বিকারের মধ্য দিয়া বাঁকিয়া বাঁকিয়া ভারতবর্ষের সুদীর্ঘ ইতিহাস বহিয়া আসিয়াছে। অনেক স্থলে সেই একহাঁটু পঙ্কের ভিতর দিয়া আমাদিগকে হাঁটিতে হইবে। তবু আমাদিগকে এই পঙ্কিল জটিল বক্রপথের দিকে আকর্ষণ করিতেছে কে? জাতীয় আত্মশ্লাঘা নহে, স্বদেশের প্রতি নবজাগ্রত প্রেম। আমরা দেশকে প্রকৃতরূপে প্রত্যক্ষরূপে সম্পূর্ণরূপে জানিতে চাই — তাহার সমস্ত দুঃখদুর্দশাগতির মধ্যেও তাহাকে লক্ষ্য করিতে চাই– আপনাকে ভুলাইতে চাই না।

তথাপি আমার দৃঢ়বিশ্বাস, ইতিহাসের পথ বাহিয়া ভারতবর্ষকে যদি আমার সমগ্রভাবে দেখিতে পাই, আমাদের লজ্জা পাইবার কারণ ঘটিবে না। তাহা হইলে আমরা এমন একটি নিত্য আদর্শ লাভ করিব যাহা ভারতবর্ষের আদর্শ, যাহা সকল পরাভব ও অবমাননার ঊর্ধ্বে আপন উচ্চশির অম্লান রাখিতে পারিয়াছে।

গ্রীক ও রোমকেরা বীর জাতি ছিল, বিজয়ী জাতি ছিল, তাহারা বহুকাল নির্ভয়ে প্রাণের মমতা ত্যাগ করিয়া দেশজয় ও দেশরক্ষা করিয়া আসিয়াছিল। রাজনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষা তাহাদের জাতীয় লক্ষ্য ও গৌরব ছিল। কিন্তু সেই দৃঢ় আদর্শ, সেই বহুকালের সফলতা ও মহদ্দৃষ্টান্ত তাহাদিগকে পতনের ও পরাভবের হস্ত হইতে রক্ষা করিতে পারে নাই।

ভারতবর্ষ নিজেকে যে পথে লইয়া গিয়াছিল তাহা কোনো কালেই দেশরক্ষা ও দেশজয়ের পথ নহে। অতএব বহিঃশত্রুর বাহুবলের নিকট ভারতবর্ষের যে পরাভব সে তাহার আত্ম-আদর্শের পরাভব নহে। অবশ্য বাহিরের উপপ্লবের, শক গ্রীক আরব মোগল ও ভারতবর্ষীয় অনার্যদের সংঘাতে ভারতবর্ষের তপোভঙ্গ হইয়াছিল; যে আদর্শের ঐক্য ক্রমশ অভিব্যক্ত হইয়া, বিক্ষিপ্ততা হইতে ক্রমশ সংক্ষিপ্ত ও দৃঢ় হইয়া হিন্দুজাতিকে একটি বিশেষ ভাবে ও গঠনে, শোভায় ও সামঞ্জস্যে সৃজন করিয়া তুলিতে পারিত, তাহা বারম্বার ছিন্ন বিচ্ছিন্ন বিকীর্ণহইয়া গিয়াছে, তথাপি নানা বিচ্ছেদের মধ্য দিয়াও সেই মূলসূত্রটি অনুসরণ করিতে পারিলে হয়তো বুঝিতে পারিব বর্তমান য়ুরোপের আদর্শ-দ্বারা ভারতবর্ষের ইতিহাস পরিমেয় নহে।

য়ুরোপের আদর্শ য়ুরোপকে কোথায় লইয়া যাইতেছে তাহা আমরা কিছুই জানি না; তাহা যে স্থায়ী নহে, তাহার মধ্যে যে অনেক বিনাশের বীজ অঙ্কুরিত হইয়া উঠিতেছে তাহা স্পষ্ট দেখা যায়। ভারতবর্ষ প্রবৃত্তিকে দমন করিয়া শত্রুহস্তে প্রাণত্যাগ করিয়াছে– য়ুরোপ প্রবৃত্তিকে লালন করিয়া আত্মহত্যার উদ্‌যোগ করিতেছে। নিজদেশ এবং পরদেশের প্রতি আমাদের আসক্তি ছিল না বলিয়া বিদেশীর নিকট আমরা দেশকে বিসর্জন দিয়াছি– নিজদেশ ও পরদেশের প্রতি আসক্তি সযত্নে পোষণ করিয়া য়ুরোপ আজ কোন্‌ রক্তসমুদ্রের তীরে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে! অস্ত্রে শস্ত্রে সর্বাঙ্গ কন্টকিত করিয়া তুলিয়া তাহার এ কী বিকটমূর্তি! কী সন্দেহ ও কী আতঙ্কের সহিত য়ুরোপের প্রত্যেক রাজশক্তি পরস্পরের প্রতি ক্রূর কটাক্ষপাত করিতেছে! রাজমন্ত্রিগণ টিপিয়া টিপিয়া পরস্পরের মৃত্যুচাল চালিতেছে; রণতরীসকল মৃত্যুবাণে পরিপূর্ণ হইয়া পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্রে যমদৌত্যে বাহির হইয়াছে। আফ্রিকায় এসিয়ায় য়ুরোপের ক্ষুধিত লুব্ধগণ আসিয়া ধীরে ধীরে এক-এক পা বাড়াইয়া একটা থাবার মাটি আক্রমণ করিতেছে এবং আর-একটা থাবা সম্মুখের লোলুপ অভ্যাগতের প্রতি উদ্যত করিতেছে। য়ুরোপীয় সভ্যতার হিংসা ও লোভে অদ্য পৃথিবীর চারি মহাদেশ ও দুই মহাসমুদ্র ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে। ইহার উপর আবার মহাজনদের সহিত মজুরদের, বিলাসের সহিত দুর্ভিক্ষের,দৃঢ়বদ্ধ সমাজনীতির সহিত সোশ্যালিজ্‌ম্‌ ও নাইহিলিজ্‌মের দ্বন্দ্ব য়ুরোপের সর্বত্রই আসন্ন হইয়া রহিয়াছে। প্রবৃত্তির প্রবলতা, প্রভুত্বের মত্ততা। স্বার্থের উত্তেজনা কোনো কালেই শান্তি ও পরিপূর্ণতায় লইয়া যাইতে পারে না, তাহার একটা প্রচণ্ড সংঘাত, একটা ভীষণ রক্তাক্ত পরিণাম আছেই। অতএব য়ুরোপের রাষ্ট্রনৈতিক আদর্শকে চরম আদর্শ বিবেচনাপূর্বক তদ্বারা ভারতবর্ষকে মাপিয়া খাটো করিয়া ক্ষোভে পাইবার হয়তো প্রয়োজন নাই। একটা কথা আছে, জীর্ণমন্নং প্রশংসীয়াৎ।

যেমন করিয়াই হউক এখন ভারতবর্ষকে আর পরের চোখে দেখিয়া আমাদের সান্ত্বনা নাই। কারণ, ভারতবর্ষের প্রতি যখন আমাদের প্রীতি জাগ্রত হইয়া উঠে নাই তখন ভারতবর্ষের ইতিহাসকে আমরা বাহির হইতে দেখিতাম; তখন আমরা পাঠান-রাজত্বের ইতিহাস মোগল-রাজত্বে পাঠ করিতাম। এখন সেই মোগল-রাজত্ব পাঠান-রাজত্বের মধ্যে ভারতেরই ইতিহাস অনুসরণ করিতে চাহি। ঔদাসীন্য অথবা বিরাগের দ্বারা তাহা কখনো সাধ্য নহে। সেই সমগ্র ধারণা কেবল বিচার ও গবেষণার দ্বারাও হইতে পারে না; কল্পনা এবং সহানুভূতি আবশ্যক।

বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলীকে এক করিতে ও মৃততথ্যগুলিতে জীবনসঞ্চার করিতে যখন কল্পনা ও সহানুভূতি নিতান্তই চাই তখন সে বিষয়ে আমরা পরের উপর নির্ভর করিলে চলিবে না। সংগ্রহকার্যে পরের সহায়তা লইতে আপত্তি নাই কিন্তু সৃজনকার্যে আপনার শক্তি প্রয়োগ করিতে হইবে। ভারতবর্ষীয়ের দ্বারা ভারতবর্ষের ইতিহাস রচিত হইলে পক্ষপাতের আশঙ্কা আছে, কিন্তু পক্ষপাত অপেক্ষা বিদ্বেষে ও সহানুভূতির অভাবে ইতিহাসকে ঢের বেশি বিকৃত করে। তাহা ছাড়া এক দেশের আদর্শ লইয়া আর-এক দেশে খাটাইবার প্রবৃত্তি বিদেশীর লেখনীমুখে আপনি আসিয়া পড়ে, তাহাতেও শুভ হয় না।

হউক বা না-হউক, আমাদের ইতিহাসকে আমরা পরের হাত হইতে উদ্ধার করিব, আমাদের ভারতবর্ষকে আমরা স্বাধীনদৃষ্টিতে দেখিব, সেই আনন্দের দিন আসিয়াছে। আমাদের পাঠকবর্গকে লেথব্রিজ সাহেবের চটির মধ্য হইতে বাহির করিয়া ইতিহাসের উন্মুক্ত ক্ষেত্রের মধ্যে আনিয়া উপস্থিত করিব; এখানে তাঁহারা নিজের চেষ্টায় সত্যের সঙ্গে সঙ্গে যদি ভ্রমও সংগ্রহ করেন সেও আমাদের পক্ষে পর-লিখিত পরীক্ষাপুস্তকের মুখস্থ বিদ্যা অপেক্ষা অনেক গুণে শ্রেয়, কারণ সেই স্বাধীন চেষ্টার উদ্যম আর-একদিন সেই ভ্রম সংশোধন করিয়া দিবে। কিন্তু পরদত্ত চোখের ঠুলি চিরদিন বাঁধারাস্তায় ঘুরিবার যতই উপযোগী হউক, পরীক্ষার ঘানিবৃক্ষের তৈলনিষ্কাশনকল্পে যতই প্রয়োজনী হউক, নূতন সত্য অর্জন ও পুরাতন ভ্রম বিবর্জনের উদ্দেশে অব্যবহার্য।

“ঐতিহাসিক চিত্র” ভারত-ইতিহাসের বন্ধনমোচন-জন্য ধর্মযুদ্ধের আয়োজনে প্রবৃত্ত। আশা করি ধর্ম তাহার সহায় হইয়া তাহাকে রক্ষা ও তাহার উদ্দেশ্য সুসম্পন্ন করিবেন। অথবা ধর্মযুদ্ধে মৃতোবাপি তেন লোকত্রয়ং জিতম্‌।

ভাদ্র ১৩০৫

কৃষ্ণচরিত্র

প্রথম ইংরাজি শিক্ষা পাইয়া আমরা যখন রাজনীতির সমালোচনা আরম্ভ করিয়া দিলাম, সমাজনীতি এবং ধর্মনীতিও সেই নিষ্ঠুর পরীক্ষার হস্ত হইতে নিষ্কৃতি প্রাপ্ত হয় নাই। তখন ছাত্রমাত্রেরই মনে আমাদের সমাজ ও ধর্ম সম্বন্ধে একটা অসন্তোষ ও সংশয়ের উদ্রেক হইয়াছিল।

বিচারের পর কাজের পালা। মতের দ্বারা ভালোমন্দ স্থির করা কঠিন নহে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তদনুসারে আপন কর্তব্য নিয়মিত করা অত্যন্ত দুরূহ। রাজ্যতন্ত্র সম্বন্ধে আমাদের নিজের কর্তব্য অতি যৎসামান্য; কারণ, রাজত্বের অধিকার আমাদের হস্তে কিছুই নাই। এইজন্য পোলিটিকাল সমালোচনা এখনো অত্যন্ত তীব্র ও প্রবলভাবেই চলিতেছে, তৎসম্বন্ধে কোনোপ্রকার দ্বিধা অথবা বাধা অনুভব করিবার কোনো কারণ ঘটে নাই। কিন্তু সমাজ ও ধর্ম-সম্বন্ধীয় কর্তব্য আমাদের নিজের হাতে; অতএব ধর্ম ও সমাজনীতি সম্বন্ধে বিচারে যাহা স্থির হয় কাজে তাহার প্রয়োগ না হইলে সেজন্য আপনাকে ছাড়া আর কাহাকেও দোষী করা যায় না। মানুষ বেশিক্ষণ আপনাকে দোষী করিয়া বসিয়া থাকিতে পারে না; এবং নিজের প্রতি দোষারোপ করিয়া অম্লানবদনে বসিয়া থাকাও তাহার পক্ষে মঙ্গলজনক নহে। এইজন্য সমাজ ও ধর্ম সম্বন্ধে এক-একটি কৈফিয়ত বাহির করিয়া আমরা মনকে সান্ত্বনা দিতে আরম্ভ করিলাম; অবশেষে এমন হইল যে, আমাদের যাহা-কিছু আছে তাহাই সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ ইহা আমরা কিছু অধিক উচ্চস্বরে এবং প্রাণপণ বল-সহকারে ঘোষণা করিতে প্রবৃত্ত হইলাম।

এরূপ ব্যবহার যে কপট ও কৃত্রিম আমি তাহা বলি না। বস্তুত, সমাজ ও ধর্মের মূল জাতীয় প্রকৃতির এমন গভীরতম দেশে অনুপ্রবিষ্ট যে, তাহাতে হস্তক্ষেপ করিতে গেলে নানা দিক হইতে নানা গুরুতর বাধা আসিয়া পড়ে এবং পুরাতন অমঙ্গলের স্থলে নূতন অমঙ্গল মাথা তুলিয়া দাঁড়ায়। এমন স্থলে শঙ্কিতচিত্তে পুনরায় নিশ্চেষ্টতা অবলম্বন করিতে প্রবৃত্তি হয় এবং সেই নিশ্চেষ্টতার পথে প্রত্যাবর্তন করিবার সময় কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত স্পর্ধার সহিত আস্ফালন করাও অস্বাভাবিক নহে– বুক ফুলাইয়া সর্বসাধারণকে বলিতে ইচ্ছা করে, ইহা আমাদের হার নহে, জিত।

আমাদের বঙ্গসমাজের এইরূপ উল্‌টারথের দিনে বঙ্কিমচন্দ্রের “কৃষ্ণচরিত্র’ রচিত হয়। যখন বড়ো-ছোটো অনেক মিলিয়া জনতার স্বরে স্বর মিলাইয়া গোলে হরিবোল দিতেছিলেন তখন প্রতিভার কণ্ঠে একটা নূতন সুর বাজিয়া উঠিল– বঙ্কিমচন্দ্রের”কৃষ্ণচরিত্র’ গোলে হরিবোল নহে। ইহাতে সর্বসাধারণের সমর্থন নাই, সর্বসাধারণের প্রতি অনুশাসন আছে।

যে সময়ে “কৃষ্ণচরিত্র’ রচিত হইয়াছে সেই সময়ের গতি এবং বঙ্কিমের চতুর্দিকবর্তী অনুবর্তিগণের ভাবভঙ্গি বিচার করিয়া দেখিলে এই “কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থে প্রতিভার একটি প্রবল স্বাধীন বল অনুভব করা যায়।

সেই বলটি আমাদের একটি স্থায়ী লাভ। সেই বলটি বাঙালির পরম আবশ্যক। সেই বল স্থানে স্থানে ন্যায় এবং শিস্টতার সীমা লঙ্ঘন করিয়াছে তথাপি তাহা আমাদের ন্যায় হীনবীর্য ভীরুদের পক্ষে একটি অভয় আশ্রয়দণ্ড।

যখন আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকেরাও আত্মবিস্মৃত হইয়া অন্ধভাবে শাস্ত্রের জয়ঘোষণা করিতেছিলেন তখন বঙ্কিমচন্দ্র বীরদর্পসহকারে “কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থে স্বাধীন মনুষ্যবুদ্ধির জয়পতাকা উড্ডীন করিয়াছেন। তিনি শাস্ত্রকে ঐতিহাসিক যুক্তিদ্বারা তন্নতন্নরূপে পরীক্ষা করিয়াছেন এবং চিরপ্রচলিত বিশ্বাসগুলিকেও বিচারের অধীনে আনয়নপূর্বক অপমানিক বুদ্ধিবৃত্তিকে পুনশ্চ তাহার গৌরবের সিংহাসনে রাজপদে অভিষিক্ত করিয়া দিয়াছেন।

আমাদের মতে “কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থের নায়ক কৃষ্ণ নহেন, তাহার প্রধান অধিনায়ক, স্বাধীন বুদ্ধি, সচেষ্ট চিত্তবৃত্তি। প্রথমত বঙ্কিম বুঝাইয়াছেন, জড়ভাবে শাস্ত্রের অথবা লোকাচারের অনুবর্তী হইয়া আমরা পূজা করিব না, সতর্কতার সহিত আমাদের মনের উচ্চতম আদর্শের অনুবর্তী হইয়া পূজা করিব। তাহার পরে দেখাইয়াছেন, যাহা শাস্ত্র তাহাই বিশ্বাস্য নহে, যাহা বিশ্বাস্য তাহাই শাস্ত্র। এই মূল ভাবটিই “কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থের ভিতরকার অধ্যাত্মশক্তি, ইহাই সমস্ত গ্রন্থটিকে মহিমান্তিত করিয়া রাখিয়াছে।

বর্তমান গ্রন্থে কৃষ্ণচরিত্রের শ্রেষ্ঠতা এবং ঐতিহাসিকতা প্রমাণের বিষয়। গ্রন্থের প্রথমাংশে লেখক ইতিহাস আলোচনা করিয়াছেন।

কৃষ্ণচরিত্রে রীতিমত ইতিহাস-সমালোচনা এই প্রথম। ইতিপূর্বে কেহ ইহার সূত্রপাত করিয়া যায় নাই, এইজন্য ভাঙিবার এবং গড়িবার ভার উভয়ই বঙ্কিমকে লইতে হইয়াছে। কোন্‌টা ইতিহাস তাহা স্থির করিবার পূর্বে কোন্‌টা ইতিহাস নহে তাহা নির্ণয় করা বিপুল পরিশ্রমের ও বিচক্ষণতার কাজ। আমাদের বিবেচনায় বর্তমান গ্রন্থে বঙ্কিম সেই ভাঙিবার কাজ অনেকটা পরিমাণে শেষ করিয়াছেন– গড়িবার কাজে ভালো করিয়া হস্তক্ষেপ করিবার অবসর পান নাই।

মহাভারতকেই বঙ্কিম প্রধানত আশ্রয় করিয়াছেন। কিন্তু তিনি নিঃসংশয়ে প্রমাণ করিয়াছেন যে, মহাভারতের মধ্যে বিস্তর প্রক্ষিপ্ত অংশ আছে। অথচ ঠিক কোন্‌টুকুযে মূল মহাভারত তাহা তিনি স্থাপনা করিয়া যান নাই। তিনি স্বয়ং বলিয়াছেন–

“প্রচলিত মহাভারত আদিম বৈয়াসিকী সংহিতা নহে। ইহা বৈশম্পায়ন-সংহিতা বলিয়া পরিচিত, কিন্তু আমরা প্রকৃত বৈশম্পায়ন-সংহিতা পাইয়াছি কি না তাহা সন্দেহ। তার পরে প্রমাণ করিয়াছি যে, ইহার প্রায় তিন ভাগ প্রক্ষিপ্ত।’

বঙ্কিম মহাভারতের তিনটি স্তর আবিষ্কার করিয়াছেন। প্রথম স্তরের রচনা উদার ও উচ্চকবিত্বপূর্ণ; দ্বিতীয় স্তরের রচনা অনুদার এবং কাব্যাংশে কিছু বিকৃতিপ্রাপ্ত এবং তৃতীয় স্তর বহুকালের বহুবিধ লোকের যদৃচ্ছামৃত রচনা।

এ কথা পাঠকদিগকে বলা বাহুল্য যে, কাব্যাংশের উৎকর্ষ ও অপকর্ষ বিচার করিয়া স্তরনির্ণয় করা নিতান্তই আনুমানিক। রুচিভেদে কবিত্ব ভিন্নলোকের নিকট ভিন্নরূপে প্রতীয়মান হয়। আবার, একই কবির রচনার ভিন্ন ভিন্ন অংশের কবিত্ব হিসাবে আকাশ-পাতাল তফাত হয় এমন দৃষ্টান্ত দুর্লভ নহে। অতএব ভাষার প্রভেদ ঐতিহাসিকের প্রধান সমালোচ্য বিষয়, কবিত্বের প্রভেদ নহে। মহাভারতের মধ্যে এই ভাষার অনুসরণ করিয়া ভিন্ন ভিন্ন কবির রচনা নির্ণয় করা এবং মূল মহাভারত নির্বাচন করা প্রভূত শ্রমসাধ্য।

দ্বিতীয় কথা এই যে, ভালো কবির রচনায় ভালো কাব্য থাকিতে পারে কিন্তু ঐতিহাসিকতা কবিত্বের উপর নির্ভর করে না। কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধবিবরণ সম্বন্ধে প্রাচীন ভারতে নানা স্থানের নানা লোকের মুখে নানা গল্প প্রচলিত ছিল। কোনো উৎকৃষ্ট কবি সেই-সকল গল্পের মধ্য হইতে তাঁহার কবিত্বের উপযোগী উপকরণ সংগ্রহ ও সংগঠন করিয়া লইয়া একটি সুসংগত সুন্দর কাব্য রচনা করিয়া থাকিতে পারেন এবং অনেক অকবি ও কুকবিবর্গ তাঁহার সেই কাব্যের মধ্যে তাঁহাদের নিজের জানা ইতিহাস জুড়িয়া দিতে পারেন। সে স্থলে সুকাব্যের অপেক্ষা অকাব্য ঐতিহাসিক হিসাবে অধিকতর নির্ভরযোগ্য হইতে পারে। এ কথা কাহারো অবিদিত নাই যে, কাব্যহিসাবে সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ করিতে হইলে সমগ্র ইতিহাসকে অবিকৃতভাবে গ্রহণ করা যায় না। শেক্‌স্‌পীয়ারের কোনো ঐতিহাসিক নাটকে যদি পরবর্তী সত্যপ্রিয় ব্যক্তিগণ ঐতিহাসিক অসম্পূর্ণতা পূরণ করিয়া দিবার জন্য নিজ নিজ রচনা নির্বিচারে প্রক্ষিপ্ত করিয়া দিতে থাকেন তবে তাহাতে কাব্যের কত ত্রুটি, মূলের সহিত কত অসামঞ্জস্য এবং শেক্‌স্‌পীয়ার-বর্ণিত চরিত্রের সহিত কত বিরোধ ঘটিতে থাকে তাহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে; সে স্থলে কাব্যসমালোচক কবিত্ব বিচার করিয়া শেক্‌স্‌পীয়ারের মূলনাটক উদ্ধার করিতে পারেন, কিন্তু ইতিহাস-সমালোচক ইতিহাস-উদ্ধারের জন্য একমাত্র শেক্‌স্‌পীয়ারের মূল গ্রন্থের উপরেই নির্ভর করিবেন এমন কথা বলিতে পারি না।

যাহা হউক, মহাভারতে যে নানা লোকের রচনা আছে তাহা স্বীকার্য; কিন্তু তাহাদিগকে পৃথক করিয়া তাহাদের রচনাকাল ও তাহাদের আপেক্ষিক সত্যাসত্য নির্ণয় যে কেমন করিয়া সাধিত হইতে পারে তাহা এখনো আবিষ্কৃত হয় নাই।

কেবল, বঙ্কিমবাবু অনৈতিহাসিকতার একটি-যে লক্ষণ নির্ণয় করিয়াছেন সে সম্বন্ধে কাহারো মতভেদ থাকিতে পারে না; তাহা অনৈসর্গিকতা। প্রথমত, যাহা অনৈসর্গিক তাহা বিশ্বাসযোগ্য নহে। দ্বিতীয়ত, ইতিহাসের যে অংশে অনৈসর্গিকতা দেখা যায়, সে অংশ যে ঘটনাকালের বহু পরে রচিত তাহা মোটামুটি বলা যাইতে পারে।

বঙ্কিমবাবু অনৈতিহাসিকতার আর-একটি যে লক্ষণ স্থির করিয়াছেন তাহাও প্রণিধানযোগ্য। যে অংশে কোনো ঐতিহাসিক মহৎ ব্যক্তি দেবতা বলিয়া পূজিত হইয়াছেন সে অংশও যে পরবর্তী কালের যোজনা তাহা সুনিশ্চিত।

অতএব বঙ্কিম যে-সকল স্থলে কৃষ্ণচরিত্র হইতে অতিপ্রাকৃত অমানুষিক অংশ বর্জন করিয়াছেন সে স্থলে কোনো ঐতিহাসিকের মনে বিরুদ্ধ তর্ক উদয় হইতে পারে না। কিন্তু যেখানে তিনি মহাভারতের একাংশের সহিত অসংগত বলিয়া কিছু পরিত্যাগ করিয়াছেন সেখানে পাঠকের মন নিঃসংশয় হইতে পারে না। কারণ একটা বড়ো লোক এবং বড়ো ঘটনা সম্বন্ধে দেশে বিচিত্র জনশ্রুতি প্রচলিত থাকে। সেই-সকল জনশ্রুতি বর্জন এবং মার্জন-পূর্বক ভিন্ন কবি আপন আদর্শ অনুযায়ী ভিন্নরূপ কাব্য রচনা করিতে পারেন। কেহ-বা শ্রীকৃষ্ণকে পরম ধর্মশীল দেবপ্রকৃতির মানুষ বলিয়া গড়িতে পারেন, কেহ-বা তাঁহাকে কূটবুদ্ধি রাজনীতিজ্ঞ চক্রীরূপে চিত্রিত করিতে পারেন। সম্ভবত উভয়েরই চিত্র অসম্পূর্ণ। এবং পরস্পরবিরোধী হইলেও সম্ভবত উভয়ের রচনাতেই আংশিক সত্য আছে। বস্তুত নির্ণয় করিয়া বলা কঠিন, ইতিহাস হিসাবে কে বেশি নির্ভরযোগ্য।

এই হেতু বঙ্কিম মহাভারতবর্ণিত কৃষ্ণের প্রত্যেক উক্তি এবং মত যতটা বিস্তারিত ব্যাখ্যার সহিত আলোচনা করিয়াছেন এবং তাহা হইতে যে ঐতিহাসিক চরিত্র গঠন করিয়াছেন তাহা আমাদের মতে যথেষ্ট তথ্যমূলক নহে। বঙ্কিমবাবুও মধ্যে মধ্যে বলিয়াছেন যে, মহাভারতে কৃষ্ণের মুখে যত কথা বসানো হইয়াছে সবই যে কৃষ্ণ বাস্তবিক বলিয়াছিলেন তাহা নহে, তদ্‌দ্বারা কৃষ্ণসম্বন্ধে কবির কিরূপ ধারণা ছিল তাহাই প্রমাণিত হইতেছে। কিন্তু কবির আদর্শকে সর্বতোভাবে ঐতিহাসিক আদর্শের অনুরূপ বলিয়া স্বীকার করিতে হইলে কবির কাব্য ব্যতীত অন্যান্য অনুকূল প্রমাণের আবশ্যক। আমরা একটি উদাহরণ উদ্‌ধৃত করি। বঙ্কিমবাবু বলিতেছেন–

“কুন্তী পুত্রগণ ও পুত্রবধুর দুঃখের বিবরণ স্মরণ করিয়া কৃষ্ণের নিকট অনেক কাঁদাকাটা করিলেন। উত্তরে কৃষ্ণ যাহা তাঁহাকে বলিলেন তাহা অমূল্য। যে-ব্যক্তি মনুষ্যচরিত্রের সর্বপ্রদেশ সম্পূর্ণরূপে অবগত হইয়াছে সে ভিন্ন আর কেহই সে কথার অমূল্যত্ব বুঝিবে না। মূর্খের তো কথাই নাই। শ্রীকৃষ্ণ বলিতেছেন, “পাণ্ডবগণ নিদ্রা তন্দ্রা ক্রোধ হর্ষ ক্ষুধা পিপাসা হিম রৌদ্র পরাজয় করিয়া বীরোচিত সুখে নিরত রহিয়াছেন। তাঁহারা ইন্দ্রিয়সুখ পরিত্যাগ করিয়া বীরোচিত সুখে সন্তুষ্ট আছেন; সেই মহাবলপরাক্রান্ত মহোৎসাহসম্পন্ন বীরগণ কদাচ অল্পে সন্তুষ্ট হয়েন না। বীর ব্যক্তিরা হয় অতিশয় ক্লেশ, না-হয় অত্যুৎকৃষ্ট সুখ সম্ভোগ করিয়া থাকেন; আর ইন্দ্রিয়সুখাভিলাষী ব্যক্তিগণ মধ্যাবস্থাতেই সন্তুষ্ট থাকে; কিন্তু উহা দুঃখের আকর; রাজ্যলাভ বা বনবাস সুখের নিদান।”

বঙ্কিমবাবু মহাভারত হইতে কৃষ্ণের যে উক্তি উদ্‌ধৃত করিয়াছেন তাহা সুগভীর ভাবগর্ভ উপদেশে পূর্ণ। কিন্তু ইহা হইতে ঐতিহাসিক কৃষ্ণের চরিত্রনির্ণয়ের বিশেষ সাহায্য পাওয়া যায় এমন আমরা বিশ্বাস করি না। ইহাতে মহাভারতকার কবির মানবচরিত্রজ্ঞতা এবং হৃদয়ের উচ্চতা প্রকাশ করে। উদ্যোগপর্বের নবতিতম অধ্যায়ে কৃষ্ণের এই উক্তি বর্ণিত আছে; ইহার প্রায় চল্লিশ অধ্যায় পরেই কুন্তীর মুখে বিদুলা-সঞ্জয়সংবাদ-নামক একটি পুরাতন কাহিনী সন্নিবেশিত হইয়াছে; তাহাতে তেজস্বিনী বিদুলা তাঁহার যুদ্ধচেষ্টাবিমুখ পুত্র সঞ্জয়কে ক্ষত্রধর্মে উৎসাহিত করিবার জন্য যে কথাগুলি বলিয়াছেন কৃষ্ণের পূর্বোদ্‌ধৃত উক্তির সহিত তাহার কিছুমাত্র প্রভেদ নাই। বিদুলা বলিতেছেন–

“এখনো পুরুষোচিত চিন্তাভার বহন করো। অল্পদ্বারা পরিতৃপ্ত রাখিয়া অপরিমেয় আত্মাকে অনর্থক অবমানিত করিয়ো না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিম্নগাসকল যেমন অল্প জলেই পরিপূর্ণা হয় এবং মূষিকের অঞ্জলি যেমন অল্প দ্রব্যেই পূর্ণ হইয়া উঠে সেইরূপ কাপুরুষেরাও অত্যল্পমাত্রে পরিতৃপ্ত হওয়ায় সহজেই সন্তুষ্ট হইতে থাকে। চিরকাল ধূমিত হওয়া অপেক্ষা মুহূর্তকাল জ্বলিত হওয়াও শতগুণে শ্রেষ্ঠ। … ইহসংসারে প্রজ্ঞাবান্‌ পুরুষ অত্যল্প বস্তুকে অপ্রিয় বোধ করেন; অত্যল্প বস্তু যাহার প্রিয় হয়, তাহার সেই অল্প বস্তুই নিশ্চয় অনিষ্টকর হইয়া থাকে। ||| যাহারা ফলের অনিত্যত্ব স্থির করিয়াও কর্মের অনুষ্ঠানে পরাঙ্‌মুখ না হয় তাহাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হইতেও পারে, না হইতেও পারে; কিন্তু অনিশ্চিত বোধে যাহারা একেবারেই অনুষ্ঠানে বিরত হয় তাহারা আর কস্মিন্‌কালেও কৃতকার্য হইতে পারে না।’

ইহা হইতে এই দেখা যাইতেছে যে, কর্তব্যপরায়ণতা সম্বন্ধে মহাভারতের কবিত্ব আদর্শ অত্যন্ত উচ্চ ছিল, এবং সেই আদর্শ তিনি নানা উদাহরণের দ্বারা নানা স্থানে প্রচার করিয়াছেন। মহাভারত ভালো করিয়া পর্যালোচনা করিয়া দেখিলে এমন কল্পনা করাও অসংগত হয় না যে, এক সময়ে ভারতে কর্মধর্মের শ্রেষ্ঠতা ঘোষণার উদ্দেশে কবি লোকবিখ্যাত কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধবৃত্তান্ত মহাকাব্যে গ্রথিত করিয়াছেন। কৃষ্ণ, অর্জুন, ভীষ্ম, কর্ণ, দ্রোণ প্রভৃতি মহাভারতের প্রধান নায়কগুলিমাত্রেই কর্মবীরের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্তস্থল; এমন-কী, গান্ধারী এবং দ্রৌপদীও কর্তব্যনিষ্ঠার মহিমায় দীপ্তিমতী। সেইজন্য গান্ধারী দুর্যোধনকে ত্যাগ করিবার প্রস্তাব করিয়াছিলেন এবং দ্রৌপদী বলিয়াছিলেন, “অবধ্য ব্যক্তিকে বধ করিলে যে পাপ হয়, বধ্য ব্যক্তিকে বধ না করিলেও পাপ হয়, বধ্য ব্যক্তিকে বধ না করিলেও সেই পাপ হইয়া থাকে।’

অতএব বঙ্কিম যাহা বলিতেছেন তাহাতে যদি প্রমাণের কোনো ত্রুটি না থাকে তবে তদ্‌দ্বারা ইহাই স্থির হইয়াছে যে, কোনো-একটি অজ্ঞাতনামা কবির মনে মহত্ত্বের আদর্শ অতি উচ্চ ছিল; এবং তাঁহার সেই উচ্চতম আদর্শ-সৃষ্টিই মহাভারতের কৃষ্ণ। কৃষ্ণ ঐতিহাসিক হইতে পারেন কিন্তু মহাভারতের কৃষ্ণ যে সর্বাংশে ঐতিহাসিক কৃষ্ণের প্রতিরূপ তাহার কোনো প্রমাণ নাই। ইহাও দেখা যাইতেছে যে, এই মহাভারতেই ভিন্ন লোক ভিন্ন আদর্শের কৃষ্ণ সংগঠন করিয়াছেন।

যেখানে এক সাক্ষী বিরোধী কথা কহিতেছে সেখানে অন্যান্য সাক্ষী ডাকিয়া সত্য সংগ্রহ করিতে হয়। কিন্তু বঙ্কিমবাবু দেখাইয়াছেন, মহাভারতে কৃষ্ণের জীবনের যে অংশ বর্ণিত হইয়াছে অন্য কোনো পুরাণেই তাহা হয় নাই; সুতরাং ভিন্ন ভিন্ন সাক্ষীর সাক্ষ্য তুলনা করিয়া সত্য উদ্ধারের যে উপায় আছে, এ স্থলে তাহাও নাই।

অতএব বঙ্কিমবাবুর প্রমাণমতে দেখিতে পাইতেছি, ব্যাসরচিত মূল মহাভারত বর্তমান নাই। এখন যে মহাভারত পাওয়া যায় তাহা ব্যাসের মুখ হইতে বৈশম্পায়ন, বৈশম্পায়নের মুখ হইতে উগ্রশ্রবার পিতা, পিতার মুখ হইতে উগ্রশ্রবা, এবং উগ্রশ্রবার মুখ হইতে অন্য কোনো-একজন কবি সংগ্রহ করিয়াছেন। দ্বিতীয়ত, এ মহাভারতের মধ্যেও কালক্রমে নানা লোকের রচনা মিশ্রিত হইয়াছে; তাহা নিঃসংশয়ে বিশ্লিষ্ট করিবার কোনো নির্ভরযোগ্য উপায় আপাতত স্থির হয় নাই। তৃতীয়ত, অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থ হইতে তুলনা-দ্বারা মহাভারতের ঐতিহাসিকতা প্রমাণ করিবারও পথ নাই।

বঙ্কিম প্রধানত কৃষ্ণচরিত্রকেই উপলক্ষ করিয়া কেবল প্রসঙ্গক্রমে মহাভারতের ঐতিহাসিকতা বিচার করিয়াছেন; কিন্তু প্রথমে প্রমাণ ও বিচার প্রয়োগপূর্বক প্রধানত সমস্ত মহাভারতের ইতিহাস-অংশ বাহির করিলে পর, তবে কৃষ্ণচরিত্রের ঐতিহাসিকতা সন্তোষজনকরূপে প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে।

উদাহরণস্বরূপে বলিতে পারি, দ্রৌপদীর পঞ্চপতিগ্রহণ প্রামাণিক সত্য কি না, সে বিষয়ে বঙ্কিম সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছেন; অতএব দেখা আবশ্যক, বঙ্কিম যাহাকে মূল মহাভারত বলিতেছেন তাহার সর্বত্র হইতেই দ্রৌপদীর পঞ্চপতিগ্রহণ বর্জন করা যায় কি না, এবং বঙ্কিম মহাভারতের যে যে অংশ হইতে কৃষ্ণচরিত্রের ইতিহাস সংকলন করিয়াছেন, সেই সেই অংশে দ্রৌপদীর পঞ্চপতিচর্যা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত নাই কি না। বঙ্কিম মহাভারতবর্ণিত যে-সকল ঘটনাকে অনৈতিহাসিক মনে করেন সে-সমস্ত যদি তিনি তাঁহার কল্পিত মূল মহাভারত হইতে প্রমাণসহকারে দূর করিয়া দিতে পারেন তবে আমরা তাঁহার নির্বাচিত অংশকে বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাসরূপে গ্রহণ করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে পারি। কিন্তু মহাভারতের ঠিক কতটুকু মূল ঐতিহাসিক অংশ তাহা বঙ্কিম সুস্পষ্টরূপে নির্দিষ্টত করেন নাই, তিনি কেবলমাত্র কৃষ্ণচরিত্রের ধারাটি অনুসরণ করিয়া গিয়াছেন। তিনি এক স্থানে বলিয়াছেন–

“আমিও বিশ্বাস করি না যে, যজ্ঞের অগ্নি হইতে দ্রুপদ কন্য পাইয়াছিলেন, অথবা সেই কন্যার পাঁচটি স্বামী ছিল। তবে দ্রুপদের ঔরসকন্যা থাকা অসম্ভব নহে, এবং তাঁহার স্বয়ংবর বিবাহ হইয়াছিল, এবং সেই স্বয়ংবরে অর্জুন লক্ষ্যবেধ করিয়াছিলেন, ইহা অবিশ্বাস করিবারও কারণ নাই। তার পর, তাঁহার পাঁচ স্বামী হইয়াছিল, কি এক স্বামী হইয়াছিল, সে কথার মীমাংসায় আমাদের কোনো প্রয়োজন নাই।’

প্রয়োজন যথেষ্ট আছে। কারণ, বঙ্কিম মহাভারতকে ইতিহাস বলিয়া জ্ঞান করেন এবং সেইজন্যেই মহাভারতবর্ণিত কৃষ্ণচরিত্রকে তিনি ঐতিহাসিক বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন। দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীবিবাহ ব্যাপারটি তুচ্ছ নহে; কিন্তু এতবড়ো ঘটনাটি যদি মিথ্যা হয়, এবং সেই মিথ্যা যদি বঙ্কিমের নির্বাচিত মহাভারতেও স্থান পাইয়া থাকে তবে তদ্‌দ্বারা সেই মহাভারতে প্রামাণিকতা হ্রাস ও সেই মহাভারতবর্ণিত কৃষ্ণচরিত্রের ঐতিহাসিকতা খর্ব হইয়া আসে। সাক্ষী যখন একমাত্র, তখন তাহার সাক্ষ্যের কোনো-এক বিশেষ অংশ সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিতে গেলে সাক্ষ্যের অপরাংশে মিথ্যাসংস্রব না থাকা আবশ্যক।

কিন্তু এত আয়োজন করিয়া অগ্রসর হইতে গেলে সম্ভবত “কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থখানি বাঙালি পাঠকের অদৃষ্টে জুটিত না। সমুচিত পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া সমস্ত মহাভারতের সমূলক অংশ উদ্ধার করা একজন লোকের জীবিতকালে সম্ভব কি না সন্দেহ। অতএব মহাভারতের বিস্তীর্ণ গহন অরণ্যের মধ্যে বঙ্কিম যে এক সংকীর্ণ পথের সূচনা করিয়া দিয়াছেন তাহা আমাদের পক্ষে পরম সৌভাগ্যের কথা, এবং অল্প বিস্ময়ের বিষয় নহে। আমাদের কেবল বক্তব্য এই যে, তাঁহার কার্য পরিসমাপ্ত হয় নাই। বঙ্কিমের প্রতিভা আমাদিগকে যেখানে উপনীত করিয়াছেন সেইখানেই যে আমাদিগকে সন্তুষ্ট চিত্তে বসিয়া থাকিতে হইবে, তাহা নহে। তিনি আমাদিগকে অসন্তোষের উদাহরণ দেখাইয়া গিয়াছেন, তাহাই আমাদিগকে অনুসরণ করিতে হইবে; সচেষ্টভাবে সত্যের রাজ্য বিস্তার করিতে হইবে। তিনি আমাদের হাতে মুক্তাটি দিয়া যান নাই, দৃষ্টান্তসহকারে এই শিক্ষা দিয়াছেন যে, যদি মুক্তা চাও তো সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে হইবে। খুব সম্ভবত আমরা নমস্কার করিয়া বলিব, আমাদের মুক্তায় কাজ নাই, আমরা সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে পারিব না।

বঙ্কিম, মেকলে কার্লাইল লামার্টিন খুকিদিদীস প্রভৃতি উদাহরণ দেখাইয়া মহাভারতকে কবিত্বময় ইতিহাস বলিতে চাহেন; আমরা মহাভারতকে ঐতিহাসিক কাব্য বলিয়া গণ্য করি। কিন্তু কৃষ্ণচরিত্রের আদর্শ আমরা ইতিহাস হইতে পাই, অথবা কাব্য হইতে পাই, অথবা কাব্য-ইতিহাসের মিশ্রণ হইতে পাই তাহা লইয়া অধিক তর্ক করিতে চাহি না। ফলত ইতিহাস যে বেদবাক্য তাহা নহে; সকলেই জানেন একটা উপস্থিত ঘটনাস্থলেও প্রকৃত বৃত্তান্ত প্রকৃতরূপে গ্রহণ করিতে এবং প্রকৃতরূপে বর্ণনা করিতে অতি অল্প লোকই পারে। খণ্ড খণ্ড বৃত্তান্ত হইতে একটি সমগ্র মানবচরিত্র ও ইতিহাস রচনা করা আরো অল্প লোকের সাধ্যায়ত্ত। সকলেই জানেন আত্মীয় সম্বন্ধেও আত্মীয়ের ভ্রম হয় এবং বন্ধুকেও বন্ধু অনেক বিষয়ে বিপরীতভাবে বুঝিয়া থাকেন। অসাধারণ লোককে প্রকৃতভাবে জানা আরো কঠিন; দূর হইতে এবং অতীত বৃত্তান্ত হইতে তাহার যথার্থ প্রতিকৃতি-নির্মাণ বহুলপরিমাণে কাল্পনিক, তাহার আর সন্দেহ নাই। প্রমাণে এবং অনুমানে মিশ্রিত করিয়া একই লোকের এত বিভিন্নপ্রকার মূর্তি গড়িয়া তোলা যায় যে তাহার মধ্যে কোন্‌টা মূলের অনুরূপ তাহা প্রকৃতিভেদে ভিন্ন লোকে ভিন্ন ভাবে বিশ্বাস করেন। ইতিহাসমাত্রই যে বহুল পরিমাণে লেখকের অনুমান ও পাঠকের বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে তাহাতে সন্দেহ নাই। এরূপ স্থলে কবির অনুমান ঐতিহাসিকের অনুমানের অপেক্ষা প্রকৃত ইতিহাসের অনেক কাছাকাছি যাওয়া কিছুই অসম্ভব নহে। ফস্টার সাহেব স্ট্র৻াফোর্ডের যে জীবনী প্রকাশ করিয়াছেন, জনশ্রুতি এই যে, তাহা কবি ব্রাউনিঙের স্বরচিত বলিলেই হয়, কিন্তু উক্ত কবি অনতিকাল পরে স্ট্র৻াফোর্ড নামক যে নাটক লিখিয়াছেন, তাহা তাঁহার ইতিহাসের অপেক্ষা অধিকতর সত্য বলিয়া পরে প্রমাণিত হইয়াছে। সেইরূপ, পুরাকালে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধবৃত্তান্তসম্বন্ধে যে-সকল কিম্বদন্তী বিক্ষিপ্তভাবে প্রচলিত ছিল, মহাভারতের কবি কল্পনাবলে তাহাদের অসম্পূর্ণতা পূরণ করিয়া তাহাদিগকে যে-একটি সমগ্র চিত্তে প্রতিফলিত করিয়া তুলিয়াছেন তাহা যে ঐতিহাসিকের ইতিহাস অপেক্ষা অল্প সত্য হইবেই এমন কোনো কথা নাই।

তথ্য, যাহাকে ইংরাজিতে ফ্যাক্ট কহে, সত্য তদপেক্ষা অনেক ব্যাপক। এই তথ্যস্তূপ হইতে যুক্তি এবং কল্পনাবলে সত্যকে উদ্ধার করিয়া লইতে হয়। অনেক সময় ইতিহাসে শুষ্ক ইন্ধনের ন্যায় রাশীকৃত তথ্য পাওয়া যাইতে পারে, কিন্তু সত্য কবির প্রতিভাবলে কাব্যেই উদ্‌ভাসিত হইয়া উঠে। অতএব এত দীর্ঘকাল পরে মহাভারতের কবিবর্ণিত কৃষ্ণচরিত্রের ঐতিহাসিক প্রমাণ লইতে বসা আমরা দুঃসাধ্য এবং উদ্দেশ্যসিদ্ধির পক্ষে বাহুল্য বোধ করি। সুবিখ্যাত পুরাতত্ত্ববিৎ ফ্রড সাহেব বলিয়াছেন “যথার্থ মহৎ ব্যক্তির অকৃত্রিম এবং স্বাভাবিক মহত্ত্ব গদ্যের আয়ত্তের বাহিরে; তাহা কেবলমাত্র কবির লেখনী দ্বারাই বর্ণনসাধ্য। ইহার কারণ যাহাই হউক, ফলত ইহা সত্য। কবিতার এই সঞ্জীবনীশীক্তি আছে এবং গদ্যের তাহা নাই; এবং সেই কারণেই কবিই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক।’

আমরা ফ্রডের উপরি-উক্ত কথার এই অর্থ বুঝি যে, মহৎ ব্যক্তির কার্যবিবরণ কেবল তথ্যমাত্র, তাঁহার মহত্ত্বটাই সত্য; সেই সত্যটি পাঠকের মনে উদিত করিয়া দিতে ঐতিহাসিকের গবেষণা অপেক্ষা কবিপ্রতিভার আবশ্যকতা অধিক।

সে হিসাবে দেখিতে গেলে মহাভারতের কবিবর্ণিত কৃষ্ণচরিত্রের প্রত্যেক তথ্যটি প্রকৃত না হইতে পারে; কৃষ্ণের মুখে যত কথা বসানো হইয়াছে এবং তাঁহার প্রতি যত কার্যকলাপের আরোপ হইয়াছে তাহার প্রত্যেক ক্ষুদ্র বৃত্তান্তটি প্রামাণিক না হইতে পারে, কিন্তু কৃষ্ণের যে মাহাত্ম্য তিনি পাঠকদের মনে মুদ্রিত করিয়া দিয়াছেন তাহাই সর্বাপেক্ষা মহামূল্য সত্য। কৃষ্ণের যদি ইতিহাস থাকিত তবে সম্ভবত তাহাতে এমন সহস্র ঘটনার উল্লেখ থাকিত যাহা কৃষ্ণ-কর্তৃক অনুষ্ঠিত হইলেও তাহার কোনো স্থায়ী মূল্য নাই অর্থাৎ যে-সকল কাজ কৃষ্ণের কৃষ্ণত্ব প্রকাশ করে না– এমনকি, শেষ পর্যন্ত সকল কথা জানা সম্ভব নহে বলিয়া তাহার অনেকগুলি কৃষ্ণের যথার্থ স্বভাবের বিরোধী বলিয়াও মনে হইতে পারিত। প্রত্যেক মানুষে অনেক কাজে নিজের যথার্থ প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করিয়াও থাকে। মহাভারতের কৃষ্ণচরিত্রে নিশ্চয়ই সেই-সকল অনাবশ্যক এবং আকস্মিক তথ্যগুলি বর্জিত হইয়া কেবল প্রকৃত স্বরূপগত সত্যগুলি নির্বাচিত হইয়াছে– এমন-কি, কৃষ্ণ যে কথা বলেন নাই কিন্তু যে কথা কেবল কৃষ্ণই বলিতে পারিতেন, সেই কথা কৃষ্ণকে বলাইয়া, কৃষ্ণ যে কাজ করেন নাই কিন্তু যে কাজ কেবল কৃষ্ণই করিতে পারিতেন সেই কাজ কৃষ্ণকে করাইয়া কবি বাস্তবিক-কৃষ্ণ অপেক্ষা তাঁহার কৃষ্ণকে অধিকতর সত্য করিয়া তুলিয়াছেন।

অর্থাৎ, বাস্তব-পক্ষে স্বভাবতই অকৃষ্ণ যাহা ছিল তাহা দূরে রাখিয়া এবং বাস্তব-কৃষ্ণ নিজের চরিত্রগুণে কবির মনে যে আদর্শের উদয় করিয়া দিয়াছেন পরন্তু নানা বাহ্য কারণে যাহা কার্যে সর্বত্র ধারাবাহিক পরিস্ফুটভাবে ও নির্বিরোধে প্রকাশ হইতে পারে নাই, সেই আদর্শকে সর্বত্র পরিপূর্ণভাবে প্রস্ফুট করিয়া কবি বাস্তবিক ইতিহাস হইতে সত্যতম নিত্যতম কৃষ্ণকে উদ্ধার করিয়া লইয়াছেন।

অতএব, বঙ্কিম যখন কৃষ্ণচরিত্রের মাহাত্ম্য বাঙালি পাঠকদিগের মনে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহেন তখন কবির কাব্য হইতে তাহা উদ্‌ধৃত করিয়া লওয়াই তাঁহার উপযুক্ত কার্য হইয়াছে। দুর্ভাগ্যক্রমে মহাভারত নানা কালের নানা লোকের রচনার মধ্যে চাপা পড়িয়াছে; কবির মূল আদর্শটি বাহির করা সহজ ব্যাপার নহে। সমস্ত জঞ্জাল দূর করিতে পারিলে, কেবল কৃষ্ণ নহে, ভীষ্ম কর্ণ অর্জুন দ্রৌপদী প্রভৃতি সকলেই উজ্জ্বলতর সম্পূর্ণতর আকারে আমাদের নিকট প্রকাশিত হইবেন। মহাভারতের আদিকবির মূল রচনাটি উদ্ধার করা হইলে মানবজাতির একটি পরমতম লাভ হইবে।

কিন্তু, মহাভারতের আদিকবির আদর্শ কৃষ্ণচরিত্র কিরূপ ছিল বঙ্কিম নিজের আদর্শ অনুসারে তাহা আবিষ্কারে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন; তাহাতে কৃতকার্য হইয়াছেন কি না তাহা নিঃসংশয়ে বলিবার পূর্বে অষ্টাদশপর্ব পারাবার হইতে মূল মহাভারতটিকে মন্থন করিয়া লওয়া আবশ্যক। আপাতত কেবল একটি বিষয়ে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করিতে ইচ্ছা করি।

বঙ্কিম যাঁহাকে মহাভারতের প্রথম স্তরের কবি বলেন, তিনি কৃষ্ণের ঈশ্বরত্বে বিশ্বাস করিতেন না, এ কথা বঙ্কিম স্বীকার করিয়াছেন। এমন-কি, এই তথ্যটি তাঁহার মতে প্রথম স্তর নির্ণয় করিবার একটি প্রধান উপায়।

কিন্তু বঙ্কিম কৃষ্ণের ঈশ্বরত্বে বিশ্বাস করিতেন। এই মহৎ প্রভেদবশত মহাভারতগত প্রথম স্তরের কবির আদর্শ কৃষ্ণচরিত্র তাঁহার পক্ষে নির্বাচন করিয়া লওয়া সহজ ছিল না। তিনি যে-কৃষ্ণের অন্বেষণে নিযুক্ত ছিলেন সে-কৃষ্ণ তাঁহার নিজের মনের আকাঙক্ষাজাত। সমস্ত চিত্তবৃত্তির সম্যক্‌ অনুশীলনে সম্পূর্ণতাপ্রাপ্ত একটি আদর্শ তিনি ব্যাকুলচিত্তে সন্ধান করিতেছিলেন, তাঁহার ধর্মতত্ত্বে যাহাকে তত্ত্বভাবে পাইয়াছিলেন ইতিহাসে তাহাকেই সজীব সশরীর -ভাবে প্রত্যক্ষ করিবার জন্য নিঃসন্দেহ তাঁহার নিরতিশয় আগ্রহ ছিল। মনের সে অবস্থায় অন্য কোনো কবির আদর্শকে অবিকলভাবে উদ্ধার করা মনুষ্যের পক্ষে সহজ নহে।

উত্তরে কেহ বলিতে পারেন যে, বঙ্কিম যদিও কৃষ্ণকে ঈশ্বর বলিয়া বিশ্বাস করিতেন তথাপি তিনি বারম্বার বলিয়াছেন যে, ঈশ্বর যখন অবতাররূপে নরলোকে অবতীর্ণ হন তখন তিনি সম্পূর্ণ মানুষ-ভাবেই প্রকাশ পাইতে থাকেন, কোনোপ্রকার অলৌকিক কাণ্ডদ্বারা আপনাকে দেবতা বলিয়া প্রচার করেন না। অতএব বঙ্কিম দেবতা-কৃষ্ণকে নহে, মানুষ-কৃষ্ণকেই মহাভারত হইতে আবিষ্কার করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন।

কিন্তু যে-মানুষকে বঙ্কিম খুঁজিতেছিলেন তাহার কোথাও কোনো অসম্পূর্ণতা নাই, তাহার সমস্ত চিত্তবৃত্তি সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপ্রাপ্ত। অর্থাৎ সে একটি মূর্তিমান থিয়োরি। কিন্তু সম্ভবত মহাভারতকারের কৃষ্ণ দেবতা নহেন, অনুশীলনপ্রাপ্ত চিত্তবৃত্তি নহেন, তিনি কৃষ্ণ।

মহাভারতকার এমন-একটি মানুষের সৃষ্টি করেন নাই, যিনি মনুষ্য-আকারধারী তত্ত্বকথা বা নীতিসূত্র মাত্র। সেই তাঁহার অত্যুচ্চ কবিপ্রতিভার পরিচায়ক। তিনি তাঁহার বড়ো বড়ো বীরদিগকেও অনেক সময় এমন সকল অযোগ্য কাজে প্রবৃত্ত করাইয়াছেন যাহা ছোটো কবিদের সাহসে কুলাইত না। ছোটো কবিদের সৃজনশক্তি নাই, নির্মাণশক্তি আছে; তাহারা যাহা গড়ে তাহার আদ্যোপান্ত নিয়ম অনুসারে গড়ে– কোথাও তাহার মধ্যে ব্যতিক্রম বা আত্মবিরোধ রাখিতে পারে না। প্রকৃত বড়ো জিনিসের অসম্পূর্ণতাও তাহার বড়োত্ব সূচনা করে; প্রকৃতি একটা পর্বতকে নিখুঁত মণ্ডলাকার করিবার আবশ্যক বোধ করে না– তাহার সমস্ত ভাঙাচোরা– তাহার সমস্ত অযত্ন-অবহেলা লইয়াও সে অভ্রভেদী রাজগৌরবগর্বিত। সে আপন অপূর্ণতাগুলি এমন অনায়াসে বহন করিতে পারে যে, তাহার অপূর্ণতার দ্বারা তাহার প্রকাণ্ড সম্পূর্ণতার পরিমাপ হইয়া থাকে। ক্ষুদ্র বস্তুতে সামান্য অপূর্ণতা মারাত্মক– তাহার প্রতি দৃষ্টি এবং শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিতে হইলে তাহাকে নিখুঁত করাই আবশ্যক হইয়া পড়ে।

মহাভারতকার কবি যে-একটি বীরসমাজ সৃষ্টি করিয়াছেন তাঁহাদের মধ্যে একটি সুমহৎ সামঞ্জস্য আছে কিন্তু ক্ষুদ্র সুসংগতি নাই। খুব সম্ভব, আধুনিক খ্যাত-অখ্যাত অনেক আর্য বাঙালি লেখকই সরলা বিমলা দামিনী যামিনী -নামধেয়া এমন-সকল সতীচরিত্রের সৃষ্টি করিতে পারেন যাঁহারা আদ্যোপান্তসুসংগত অপূর্ব নৈতিকগুণে দ্রৌপদীকে পদে পদে পরাভূত করিতে পারেন, কিন্তু তথাপি, মহাভারতের দ্রৌপদী তাঁহার সমস্ত অপূর্ণতা অসংকোচে বক্ষে বহন করিয়া এই-সমস্ত নব্য বল্মীকরচিত ক্ষুদ্র নীতিস্তূপগুলির বহু উর্ধ্বে উদার আদিম অপর্যাপ্ত প্রবল মাহাত্ম্যে নিত্যকাল বিরাজ করিতে থাকিবেন। মহাভারতের কর্ণ সভাপর্বে পাণ্ডবদের প্রতি যে-সকল হীনতাচরণ করিয়াছেন আমাদের নাটক-নভেলের দীনেশ রমেশ গণেশ ধনেশ -বর্গকখনোই তাহা করেন না, তাঁহারা সময়ে-অসময়ে স্থানে-অস্থানে অনায়াসেই আত্ম-বিসর্জন করিয়া থাকেন, তথাপি মহাভারতের কবি বিনা চেষ্টায় কর্ণকে যে অমরলোকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিয়াছেন এই দীনেশ রমেশ গণেশ ধনেশ -বর্গ সমালোচক-প্রদত্ত সমস্ত ফার্স্ট ক্লাস টিকিট এবং নৈতিক পাথেয় লইয়াও তাহার নিম্নতম সোপান পর্যন্ত পৌঁছিতে পারে কি না সন্দেহ।

সেই কারণেই বলিতেছিলাম, প্রথম স্তরের মহাভারতকার কবি যদি কৃষ্ণকে দেবতা বলিয়া মানিতেন না ইহা সত্য হয়, তবে তিনি যে তাঁহাকে নীতিশিক্ষার অখণ্ড উদাহরণ-স্বরূপ গড়িয়াছিলেন ইহা আমাদের নিকট সম্ভবপর বোধ হয় না। বঙ্কিম মহাভারতের প্রথমস্তর-রচয়িতাকে শ্রেষ্ঠ কবি বলিয়া স্থির করিয়াছেন, অনেক স্থলে সেই শ্রেষ্ঠত্বের দোহাই দিয়া তিনি কৃষ্ণচরিত্র হইতে সমস্ত অসংগতি-অসম্পূর্ণতা বাদ দিয়াছেন। কিন্তু আমরা বলিতেছি, সেই শ্রেষ্ঠতার লক্ষণ যে সংগতি তাহা নহে। এ পর্যন্ত হ্যাম্‌লেট চরিত্রের সংগতি কেহ সন্তোষজনকরূপে আবিষ্কার করিতে পারে নাই, কিন্তু কাব্যজগতের মধ্যে হ্যাম্‌লেট যে একটি পরম স্বাভাবিক সৃষ্টি সে বিষয়ে কেহ সন্দেহ প্রকাশ করে নাই।

অতএব, বঙ্কিম মহাভারতের কৃষ্ণচরিত্র হইতে সমস্ত মন্দ অংশ বাদ দিয়া যে আদিম মহাভারতকারের আদর্শ কৃষ্ণকেই আবিষ্কার করিয়াছেন, সে বিষয়ে আমাদের সম্পূর্ণ সন্দেহ আছে।

এক্ষণে কথা এই যে, মহাভারতকারের আদর্শ না-হইল, বঙ্কিমের আদর্শ যদি যথার্থ মহৎ হয় তবে সেও বঙ্গীয় পাঠকদের পক্ষে পরম লাভ বলিতে হইবে।

বঙ্কিমের আদর্শ যে মহৎ এবং “কৃষ্ণচরিত্র’ যে বঙ্গসাহিত্যের পরম লাভ সে বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নাই।

কিন্তু সেইজন্যই “কৃষ্ণচরিত্র’ পাঠ করিতে সর্বদাই মনে এই খেদ উপস্থিত হয় যে, সাহিত্যে যে প্রণালীতে আদর্শের প্রতিষ্ঠা করিতে হয় বঙ্কিম সে প্রণালী অবলম্বন করেন নাই।

ফ্রড যে বলিয়াছেন, মহং লোকের মাহাত্ম্য ইতিহাস যথার্থরূপে প্রকাশ করিতে পারে না, কাব্য পারে, সে কথা সত্য। কারণ, মাহাত্ম্য পদার্থটি পাঠকের মনে অখণ্ডভাবে সজীবভাবে সঞ্চার করিয়া দিবার জিনিস। তাহা তর্কদ্বারা যুক্তিদ্বারা ক্রমশ খণ্ড খণ্ড আকারে মনের মধ্যে কিয়দংশে প্রমাণিত হইতে পারে, কিন্তু তর্কযুক্তি তাহাকে হৃদয়ের মধ্যে সর্বাংশে সঞ্চারিত করিয়া দিতে পারে না।

বঙ্কিম গ্রন্থের প্রারম্ভ হইতেই তরবারি হস্তে সংগ্রাম করিতে করিতে অগ্রসর হইয়াছেন; কোথাও শান্তভাবে তাঁহার কৃষ্ণের সমগ্র মূর্তি আমাদের সম্মুখে একত্র ধরিবার অবসর পান নাই।

সেজন্য তাঁহাকে দোষ দেওয়াও যায় না। কারণ, ভক্তসম্প্রদায়ের বাহিরে এমন-কি, ভিতরেও কৃষ্ণচরিত্র যেরূপ কৃষ্ণবর্ণে চিত্রিত ছিল তাহাতে প্রথমত সেই পূর্বসংস্কার ঘুচাইবার জন্য তাঁহাকে বিপুল প্রয়াস পাইতে হইয়াছে। যেখানে তাঁহার দেবপ্রতিমা প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে সেখানকার জঙ্গল সাফ করিবার জন্য তাঁহাকে কুঠার ধারণ করিতে হইয়াছিল। কৃষ্ণ সম্বন্ধে আমাদের সংস্কার এবং বিশ্বাসযোগ্য প্রকৃত কৃষ্ণ যে অনেক বিভিন্ন, বঙ্কিমের “কৃষ্ণচরিত্র’ হইতে তাহা আমরা শিক্ষা করিয়াছি।

কিন্তু বঙ্কিম এই গ্রন্থে অনাবশ্যক যে-সকল কলহের অবতারণা করিয়াছেন আমাদের নিকট তাহা অত্যন্ত পীড়াজনক বোধ হইয়াছে। কারণ, যে আদর্শ হৃদয়ে স্থির রাখিয়া বঙ্কিম এই গ্রন্থখানি রচনা করিয়াছেন, সেই আদর্শের দ্বারাই সমস্ত ভাষা এবং ভাব অনুপ্রাণিত হইয়া উঠিলে তবেই সে আদর্শের মর্যাদা রক্ষা হয়। বঙ্কিম যদি তুচ্ছ বিরোধ এবং অনুদার সমালোচনার অবতারণাপূর্বক চাঞ্চল্য প্রকাশ করেন তবে সেই চাঞ্চল্য তাঁহার আদর্শের নিত্য নির্বিকারতা দূর করিয়া ফেলে। অনেক ঝগড়া আছে যাহা সাপ্তাহিক পত্রের বাদপ্রতিবাদেই শোভা পায়, যাহা কোনো চিরস্মরণীয় চিরস্থায়ী গ্রন্থে স্থান পাইবার একেবারে অযোগ্য।

“পাশ্চাত্য মুর্খ’ অর্থাৎ য়ুরোপীয় পণ্ডিতগণের প্রতি লেখক অজস্র অবজ্ঞা বর্ষণ করিয়াছেন। প্রথমত সে-কাজটাই গর্হিত; দ্বিতীয়ত এমন গ্রন্থে সেটা অত্যন্ত অশোভন হইয়াছে। মান্যজনের সমক্ষে অন্য কাহারো প্রতি অযথা দুর্ব্যবহার কেবল দুর্ব্যবহার মাত্র নহে, তাহা মান্য ব্যক্তির প্রতিও অশিষ্টতা। বঙ্কিম যাঁহাকে মানবশ্রেষ্ঠ বলিয়া জ্ঞান করেন, যিনি একাধারে ক্ষমা ও শৌর্যের আধার, যিনি সক্ষম হইয়াও অকারণে, এমন-কি, সকারণে অস্ত্র ধারণ করিতে অনেক সময়েই বিরত হইয়াছেন, তাঁহারই চরিত্র-প্রতিষ্ঠা-স্থলে তাঁহারই আদর্শের সম্মুখে উপবিষ্ট হইয়া মতভেদ-উপলক্ষে চপলতা প্রকাশ করা আদর্শের অবমাননা। কেবল য়ুরোপীয় পণ্ডিতগণের প্রতি নহে, সাধারণত য়ুরোপীয় জাতির প্রতিই লেখক স্থানে অস্থানে তীব্র বৈরিতা প্রকাশ করিয়াছেন। দুই-একটা দৃষ্টান্ত উদ্‌ধৃত করি।

শিশুপালের গালি “শুনিয়া ক্ষমাগুণের পরমাধার পরমযোগী আদর্শপুরুষ কোনো উত্তর করিলেন না। কৃষ্ণের এমন শক্তি ছিল যে তদ্দণ্ডেই তিনি শিশুপালকে বিনষ্ট করিতে সক্ষম– পরবর্তী ঘটনায় পাঠক তাহা জানিবেন। কৃষ্ণও কখনো যে এরূপ পরুষবচনে তিরষ্কৃত হইয়াছিলেন এমন দেখা যায় না। তথাপি তিনি এ তিরস্কারে ভ্রুক্ষেপও করিলেন না। য়ুরোপীয়দের মতো ডাকিয়া বলিলেন না, “শিশুপাল, ক্ষমা বড়ো ধর্ম, আমি তোমায় ক্ষমা করিলাম।” নীরবে শত্রুকে ক্ষমা করিলেন।’

শ্রীকৃষ্ণের ক্ষমাগুণের বর্ণনাস্থলে অকারণে য়ুরোপীদের প্রতি একটা অন্যায় খোঁচা দেওয়া যে কেবল অনাবশ্যক হইয়াছে তাহা নহে; ইহাতে মূল উদ্দেশ্যটি পর্যন্ত নষ্ট হইয়াছে। পাঠকদের চিত্তকে যেরূপভাবে প্রস্তুত করিয়া তুলিলে তাহারা কৃষ্ণের ক্ষমাশক্তির মাহাত্ম্য হৃদয়ে গ্রহণ করিতে পারিত তাহা ভাঙিয়া দেওয়া হইয়াছে। “কৃষ্ণচরিত্রে’র ন্যায় গ্রন্থ কেবল আধুনিক হিন্দুদের জন্য লিখিত হওয়া উচিত নহে, তাহা সর্বকালের সর্বজাতির জন্যই রচিত হওয়া কর্তব্য। পাঠকেরা অনায়াসেই বুঝিতে পারিবেন এই অংশ পাঠকালে একজন য়ুরোপীয় পাঠকের মনে কিরূপ বিদ্রোহী ভাবের উদয় হওয়া সম্ভব। বিশেষত, ক্ষমা করিবার সময় ক্ষমাধর্মের মহিমাকীর্তন যে য়ুরোপীয়দের জাতীয় প্রকৃতি এরূপ সাধারণ কথা লেখক কোথা হইতে সংগ্রহ করিলেন বলা কঠিন। আমাদের শাস্ত্রে এরূপ উদাহরণ ভুরি ভুরি আছে– যখন বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠের গাভী বলপূর্বক হরণ করিয়া লইয়া যাইতেছিলেন এবং নন্দিনী অতিশয় তাড়িত হইয়া আর্তরবে বশিষ্ঠের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন তখন বশিষ্ঠ কহিলেন, “হে ভদ্রে নন্দিনী, তুমি পুনঃপুনঃ রব করিতেছ, তাহা আমি শুনিতেছি; কিন্তু হে ভদ্রে, যখন রাজা বিশ্বামিত্র তোমাকে বলপূর্বক হরণ করিতেছেন তখন আমি কী করিব! যেহেতু আমি ক্ষমাশীল ব্রাহ্মণ।’ পুনশ্চ নন্দিনী তাঁহার নিকট কাতরতা প্রকাশ করিলে তিনি কহিলেন, “ক্ষত্রিয়ের বল তেজ এবং ব্রাহ্মণের বল ক্ষমা; অতএব আমি ক্ষমাগুণে আকৃষ্ট হইতেছি।’

“ইন্দ্রিসুখাভিলাষী ব্যক্তিগণ মধ্যাবস্থাতেই সন্তুষ্ট থাকে; কিন্তু উহা দুঃখের আকর; রাজ্যলাভ বা বনবাস সুখের নিদান।’

শ্রীকৃষ্ণের এই মহদুক্তি উদ্‌ধৃত করিয়া বঙ্কিম বলিতেছেন–

“হিন্দু পুরাণেতিহাসে এমন কথা থাকিতে আমরা কিনা, মেমসাহেবদের লেখা নবেল পড়িয়া দিন কাটাই, না-হয় সভা করিয়া পাঁচ জনে জুটিয়া পাখির মতো কিচিরমিচির করি।’

ক্ষণে ক্ষণে লেখকের এরূপ ধৈর্যচ্যুতি “কৃষ্ণচরিত্রে’র ন্যায় গ্রন্থে অতিশয় অযোগ্য হইয়াছে। গ্রন্থের ভাষায় ভাবে ও ভঙ্গিতে সর্বত্রই একটি গাম্ভীর্য, সৌন্দর্য ও ঔদার্য রক্ষা না করাতে বর্ণনীয় আদর্শচরিত্রের উজ্জ্বলতা নষ্ট হইয়াছে।

বঙ্কিম সামান্য উপলক্ষমাত্রেই য়ুরোপীয়দের সহিত, পাঠকদের সহিত এবং ভাগ্যহীন ভিন্নমতাবলম্বীদের সহিত কলহ করিয়াছেন। সেই কলহের ভাবটাই এ গ্রন্থে অসংগত হইয়াছে; তাহা ছাড়া প্রসঙ্গক্রমে তিনি বিস্তর অবান্তর তর্কের উত্থাপন করিয়া পাঠকের মনকে অনর্থক বিক্ষিপ্ত করিয়া দিয়াছেন। প্রথমত, যখন তিনি কৃষ্ণকে মনুষ্যশ্রেষ্ঠ বলিয়া দাঁড় করাইয়াছেন, তখন ঈশ্বরের অবতারত্ব সম্ভব কি না এ প্রশ্নের উত্থাপন করিয়া কেবল পাঠকের মনে একটা তর্ক উঠাইয়াছেন, অথচ তাহার ভালোরূপ মীমাংসা করেন নাই। নিরাকার ঈশ্বর আকার ধারণ করিবেন কী করিয়া, এরূপ আপত্তি যাঁহারা করেন বঙ্কিম তাঁহাদিগকে এই উত্তর দিয়াছেন যে, যিনি সর্বশক্তিমান তিনি আকার গ্রহণ করিতে পারেন না ইহা অসম্ভব। যাঁহারা আপত্তি করেন যে, যিনি সর্বশক্তিমান তাঁহার দেহ ধারণ করিবার প্রয়োজন কী, তিনি তো ইচ্ছামাত্রেই রাবণ কুম্ভকর্ণ অথবা কংস শিশুপাল বধ করিতে পারেন, তাঁহাদের কথার উত্তরে বঙ্কিম বলেন যে, রাবণ অথবা শিশুপাল -বধ করিবার জন্যই যে ঈশ্বর দেহ ধারণ করেন তাহা নহে, মনুষ্যের আদর্শ স্থাপন করাই তাঁহার অবতার হইবার উদ্দেশ্য। তিনি দেবতার ভাবে যদি দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন করেন তবে তাহাতে মানুষের কোনো শিক্ষা হয় না; পরন্তু তিনি যদি মনুষ্য হইয়া দেখাইয়া দেন মনুষ্যের দ্বারা কতদূর সম্ভব তবেই তাহা আমাদের স্থায়ী কল্যাণের কারণ হয়। এক্ষণে তৃতীয় আপত্তি এই উঠিতে পারে যে, ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান হন এবং মনুষ্যের নিকট মনুষ্যত্বের আদর্শ স্থাপন করাই যদি তাঁহার অভিপ্রায় হয়, তবে তিনি কি আদর্শরূপী মনুষ্যকে অভিব্যক্ত করিয়া তুলিতে পারেন না– তাঁহার কি নিজেই মনুষ্য হইয়া আসা ছাড়া গত্যন্তর নাই? এইখানেই কি তাঁহার শক্তির সীমা? বঙ্কিম এই আপত্তি উত্থাপনও করেন নাই, এই আপত্তির উত্তরও দেন নাই।

পরন্তু, সমস্ত গ্রন্থের উদ্দেশ্যের সহিত এই তর্কের কিঞ্চিৎ যোগ আছে। বঙ্কিম নানা স্থলেই স্বীকার করিয়াছেন যে, মানুষের আদর্শ যেমন কার্যকারী এমন দেবতার আদর্শ নহে। কারণ, সর্বশক্তিমানের অনুকরণে আমাদের সহজেই উৎসাহ না হইতে পারে। যারা মানুষে সাধন করিয়াছে তাহা আমরাও সাধন করিতে পারি এই বিশ্বাস এবং আশা অপেক্ষাকৃত সুলভ এবং স্বাভাবিক। অতএব কৃষ্ণকে দেবতা প্রমাণ করিতে গিয়া বঙ্কিম তাঁহার মানব-আদর্শের মূল্য হ্রাস করিয়া দিতেছেন। কারণ, ঈশ্বরের পক্ষে সকলই যখন অনায়াসে সম্ভব তখন কৃষ্ণচরিত্রে বিশেষরূপে বিস্ময় অনুভব করিবার কোনো কারণ দেখা যায় না।

বঙ্কিম এই গ্রন্থের অনেক স্থলেই যে-সকল সামাজিক তর্ক উত্থাপন করিয়াছেন তাহাতে গ্রন্থের বিষয়টি বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে মাত্র, আর কোনো ফল হয় নাই।

“কৃষ্ণের বহুবিবাহ’ শীর্ষক অধ্যায়ে রুক্ষ্ণিণী ব্যতীত কৃষ্ণের অন্য স্ত্রী ছিল না ইহাই প্রমাণ করিয়া লেখক সর্বশেষে তর্ক তুলিয়াছেন যে, পুরুষের বহুবিবাহ সকল অবস্থাতেই অধর্ম এ কথা ঠিক নহে। তিনি বলিয়াছেন–

“সচরাচর অকারণে পুরুষের একাধিক বিবাহ অধর্ম। কিন্তু সকল অবস্থাতে নহে। যাহার পত্নী কুষ্ঠগ্রস্ত বা এরূপ রুগ্‌ণ যে সে কোনোমতেই সংসারধর্মের সহায়তা করিতে পারে না, তাহার যে দারান্তর পরিগ্রহ পাপ, এমন কথা আমি বুঝিতে পারি না। যাহার স্ত্রী ধর্মভ্রষ্টা কুলকলঙ্কিনী, সে যে কেন আদালতে না গিয়া দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করিতে পারিবে না তাহা আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আসে না। যাহার উত্তরাধিকারীর প্রয়োজন, কিন্তু স্ত্রী বন্ধ্যা, সে যে কেন দারান্তর গ্রহণ করিবে না, তাহা বুঝিতে পারি না। যদি য়ুরোপের এ কুশিক্ষা না হইত, তাহা হইলে, বোনাপার্টিকে জসেফাইনের বর্জনরূপ অতি ঘোর নারকী পাতকে পতিত হইতে হইত না; অষ্টম হেনরিকে কথায় কথায় পত্মীহত্যা করিতে হইত না। য়ুরোপে আজি কালি সভ্যতার উজ্জ্বলালোকে এই কারণে অনেক পত্নীহত্যা, পতিহত্যা হইতেছে। আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বিশ্বাস যাহাই বিলাতি তাহাই চমৎকার, পবিত্র, দোষশূন্য, ঊর্ধ্বাধঃ চতুর্দশ পুরুষের উদ্ধারের কারণ। আমার বিশ্বাস, আমরা যেমন বিলাতের কাছে অনেক শিখিতে পারি, বিলাতও আমাদের কাছে অনেক শিখিতে পারে। তাহার মধ্যে এই বিবাহতত্ত্ব একটা কথা।’

কৃষ্ণ যখন একাধিক বিবাহ করেন নাই তখন বিবাহসম্বন্ধীয় এই তর্ক নিতান্তই অনাবশ্যক; তাহা ছাড়া তর্কটারই বা কী মীমাংসা হইল। প্রথম স্থির হইল, যাহার স্ত্রী রুগণ অথবা ভ্রষ্টা অথবা বন্ধ্যা সে দ্বিতীয়বার বিবাহ করিতে পারে। কিন্তু য়ুরোপে রুগণা, ভ্রষ্টা এবং বন্ধ্যার স্বামী সহজে দারান্তর পরিগ্রহ করিতে পারে না বলিয়াই যে, সেখানকার সভ্যতার উজ্জ্বলালোকে এত পত্নীহত্যা হইতেছে তাহা নহে; অনেক সময় পত্নীর প্রতি বিরাগ ও অন্যের প্রতি অনুরাগ বশত হত্যা ঘটনা অধিকতর সম্ভবপর। যদি সে হত্যা নিবারণ করিতে হয় তবে অন্য স্ত্রীর প্রতি অনুরাগ সঞ্চারকেও দ্বিতীয় স্ত্রী-গ্রহণের ধর্মসংগত বিধান বলিয়া স্থির করিতে হয়। তাহা হইলে “সচরাচর অকারণে পুরুষের একাধিক বিবাহ অধর্ম এ কথাটার এই তাৎপর্য দাঁড়ায় যে, যখন দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করিতে যাইবে তখন যেন একটা কোনো কারণ থাকে, কাজটা যেন অকারণে না হয়। অর্থাৎ যদি তোমার স্ত্রী রুগ্‌ণ অক্ষম হয় তবে তুমি বিবাহ করিতে পার, অথবা যদি অন্য স্ত্রী বিবাহ করিতে তোমার ইচ্ছা বোধ হয় তাহা হইলেও তুমি বিবাহ করিতে পার; কারণ, সেইরূপ ইচ্ছার বাধা পাইয়া ইংলণ্ডের অষ্টম হেনরি পত্নীহত্যা করিয়াছিলেন। কিন্তু কোনো কারণ না থাকিলে বিবাহ করিয়ো না। জিজ্ঞাস্য এই যে, স্বামীকে যে যুক্তি অনুসাযে যে-সকল স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী করা হইল, ঠিক সেই যুক্তি অনুসারে অনুরূপ স্থলে স্ত্রীর প্রতি অনুরূপ ক্ষমতা অর্পণ করা যায় কি না, এবং আমাদের সমাজে স্ত্রীর সেই-সকল স্বাধীন ক্ষমতা না থাকাতে স্ত্রী “অতি ঘোর নারকী পাতকে পতিত’ হয় কি না।

ইহার অনতিপরেই সুভদ্রাহরণ কার্যটা যে বিশেষ দোষের হয় নাই ইহাই প্রতিপন্ন করিতে গিয়া লেখক, “মালাবারী’ নামক এক পারসি– সম্ভবত যাঁহার খ্যাতিপুষ্প বর্তমান কালের গুটিকয়েক সংবাদপত্রপুটের মধ্যেই কীটের দ্বারা জীর্ণ হইতে থাকিবে– তাঁহার প্রতি একটা খোঁচা দিয়া আর-একটা সামাজিক তর্ক তুলিয়াছেন। সে তর্কটারও মীমাংসা কিছুমাত্র সন্তোষজনক হয় নাই, অথচ লেখক অধীরভাবে অসহিষ্ণু ভাষায় অনেকের সঙ্গে অনর্থক একটা কলহ করিয়যাছেন।

বঙ্কিম যদি কৃষ্ণকে দেবতা না মনে করিতেন এবং কৃষ্ণের সমস্ত চিত্তবৃত্তির সর্বাঙ্গীণ উৎকর্ষ সম্বন্ধে তাঁহার কোনোরূপ থিয়োরি না থাকিত তাহা হইলে এ-সমস্ত তর্ক-বিতর্কের কোনো প্রয়োজন থাকিত না, এবং তিনি সর্বত্র সংযম রক্ষা করিয়া চলিতে পারিতেন। তাহা হইলে তিনি নিরপেক্ষ নির্বিকারচিত্তে মহাভারতকার কবির আদর্শ কৃষ্ণকে অবিকলভাবে উদ্ধার করিয়া পাঠকদের সম্মুখে উপনীত করিতেন– এবং পাছে কোনো অবিশ্বাসী সংশয়ী পাঠক তাঁহার কৃষ্ণচরিত্রের কোনো অংশে তিলমাত্র অসম্পূর্ণতা দেখিতে পায় এজন্য আগেভাগে তাহাদের প্রতি রোষ প্রকাশ করিয়া তাঁহার গ্রন্থ হইতে উচ্চসাহিত্যের লক্ষ্যগত অচঞ্চল শান্তি দূর করিয়া দিতেন না।

যেমন প্রকাশ্য রঙ্গমঞ্চের উপরে নেপথ্যবিধান করিতে আরম্ভ করিলে অভিনয়ের রসভঙ্গ হয়, কাব্যসৌন্দর্য সমগ্রভাবে শ্রোতৃবর্গের মনের মধ্যে মুদ্রিত হয় না, সেইরূপ বঙ্কিমের কৃষ্ণচরিত্রে পদে পদে তর্কযুক্তি বিচার উপস্থিত হইয়া আসল কৃষ্ণচরিত্রটিকে পাঠকের হৃদয়ে অখণ্ডভাবে প্রতিষ্ঠিত হইতে বাধা দিয়াছে। কিন্তু বঙ্কিম বলিতে পারেন, “কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থটি স্টেজ নহে; উহা নেপথ্য; স্টেজ-ম্যানেজার আমি নানা বাধাবিঘ্নের সহিত সংগ্রাম করিয়া, নানা স্থান হইতে নানা সাজসজ্জা আনয়নপূর্বক কৃষ্ণকে নরোত্তমবেশে সাজাইয়া দিলাম– এখন কোনো কবি আসিয়া যবনিকা উত্তোলন করিয়া দিন, অভিনয় আরম্ভ করুন, সর্বসাধারণের মনোহরণ করিতে থাকুন। তাঁহাকে শ্রমসাধ্য চিন্তাসাধ্য বিচারসাধ্য কাজ কিছুই করিতে হইবে না।

মাঘ-ফাল্গুন, ১৩০১

জুবেয়ার

রসজ্ঞ ম্যাথ্যু আর্নলড্‌ ফরাসি ভাবুক জুবেয়ারের সহিত ইংরাজি-পাঠকদের পরিচয় করাইয়া দেন।

যখন যাহা মনে আসিত জুবেয়ার তাহা লিখিতেন কিন্তু প্রকাশ করিতেন না। তাঁহার রচনা প্রবন্ধরচনা নহে, এক-একটি ভাবকে স্বতন্ত্ররূপে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখা। পদ্যে যেমন সনেট, যেমন শ্লোক, গদ্যে এই লেখাগুলি তেমনি।

জুবেয়ারের বাক্সে দেরাজে এই লেখা কাগজসকল স্তূপাকার হইয়া ছিল; তাঁহার মৃত্যুর চোদ্দ বৎসর পরে এগুলি ছাপা হয়; তাহাও পাঠকসাধারণের জন্য নহে, কেবল বাছা বাছা অল্প গুটিকয়েক সমজদারের জন্য।

জুবেয়ার নিজের রচনার সম্বন্ধে লিখিয়াছেন–

“আমি কেবল বপন করি, নির্মাণ বা পত্তন করি না।’

অর্থাৎ তিনি ভাবগুলিকে পরস্পর গাঁথিয়া কিছু-একটা বানাইয়া তোলেন না,সজীব ভাবের বীজকে এক-একটি করিয়া বপন করেন।

কোনো কোনো মনস্বী আপনার মনটিকে ফলের বাগান করিয়া রাখেন, তাঁহারা বিশেষ বিশেষ চিন্তা ও চর্চার দ্বারা চিত্তকে আবৃত করেন, চতুর্দিকের নিত্যবীজবর্ষণ তাঁহাদের মনের মধ্যে অনাহূত ও অবারিতভাবে স্থান পায় না।

জুবেয়ারের মন সে শ্রেণীর ছিল না, তাঁহার চিত্ত ফলের বাগান নহে, ফসলের ক্ষেত্র।

সে ফসল নানাবিধ। ধর্ম কর্ম কলারস সাহিত্য কত কী তাহার ঠিক নাই।

অদ্য আমরা সাহিত্য ও রচনাকলা সম্বন্ধে এক অঞ্জলি সংগ্রহ করিয়া পাঠকগণকে উপহার দিতে ইচ্ছা করি।–

জুবেয়ার নিজের সম্বন্ধে বলেন —

“যাহা জানিবার ইচ্ছা ছিল তাহা শিক্ষা করিতে বৃদ্ধবয়সের প্রয়োজন হইল, কিন্তু যাহা জানিয়াছি তাহা ভালোরূপে প্রকাশ করিতে যৌবনের প্রয়োজন অনুভব করি।’

অর্থাৎ জ্ঞানের জন্য চেষ্টাজাত অভিজ্ঞতা চাই কিন্তু প্রকাশের জন্য নবীনতা আবশ্যক। লেখার বিষয়টির মধ্যে চিন্তার পরিচয় যত থাকে ততই তাহার গৌরব বাড়ে কিন্তু রচনার মধ্যে চেষ্টার লক্ষণ যত অল্প থাকিবে তাহার প্রকাশশক্তি ততই অধিক হইবে।

জুবেয়ার নিজে যে রচনাকলা অবলম্বন করিয়াছিলেন সে সম্বন্ধে বলিতেছেন,

“তোমরা কথার ধ্বনির দ্বারা যে ফল পাইতে চাও আমি কথার অর্থ-দ্বারা সেই ফল ইচ্ছা করি; তোমরা কথার প্রাচুর্যের দ্বারা যাহা চাও আমি কথা নির্বাচনের দ্বারা তাহা চাই, তোমরা কথার সংগতির দ্বারা যাহা চাও আমি কথার পৃথক্‌করণের দ্বারা তাহা লাভ করিতে প্রয়াসী। অথচ সংগতিও (harmony) ইচ্ছা করি কিন্তু তাহা স্বভাবসিদ্ধ যথাযোগ্য সংগতি; জোড়া-বাঁধার নৈপুণ্যমাত্রের দ্বারা যে সংগতি রচিত তাহা চাই না।’

বস্তুত প্রতিভাসম্পন্ন লেখক ও লিপিকুশল লেখকের প্রভেদ এই যে, একজনের রচনায় সংগতি এমন স্বাভাবিক এবং অখণ্ড যে, তাহা বিশ্লেষণ করাই শক্ত, অপরের রচনায় সংগতি ইঁটের উপর ইঁটের ন্যায় গাঁথা ও সাজানো। প্রথমটি অজ্ঞাতসারে মুগ্ধ করে, দ্বিতীয়টি বিন্যাসনৈপুণ্যে বাহবা বলায়।

তর্কযুদ্ধ সম্বন্ধে জুবেয়ার বলেন —

“তর্কবিতর্কের প্রয়োজনীয়তা যতটুকু তাহার ঝঞ্ঝাট তদপেক্ষা অনেক বেশি। বিরোধমাত্রেই চিত্তকে বধির করিয়া ফেলে। যেখানে অন্য-সকলে বধির আমি সেখানে মূক।’

জুবেয়ার বলেন —

“কোনো কোনো চিত্ত নিজের জমিতে ফসল জন্মাইতে পারে না কিন্তু জমির উপরিভাগে যে সার ঢালা থাকে সেইখান হইতেই তাহার শস্য উঠে।’

আমাদের কথা মনে পড়ে। আজকাল আমাদের দ্বারা যাহা উৎপন্ন হইতেছে সে কি যথার্থ আমাদের মনের ভিতর হইতে– না, ইংরাজি য়ুনিবার্সিটি গাড়ি বোঝাই করিয়া আমাদের প্রকৃতির উপরিভাগে যে সার বিছাইয়া দিয়াছে সেইখান হইতে? এ সম্বন্ধে তর্ক তুলিলে বিরোধের সৃষ্টি হইতে পারে, অতএব মূক থাকাই ভালো।

সমালোচনা সম্বন্ধে জুবেয়ারের কতকগুলি মত নিম্নে অনুবাদ করিয়া দিতেছি।

“পূর্বে যাহা সুখ দেয় নাই তাহাকে সুখকর করিয়া তোলা একপ্রকার নূতন সৃজন।’

এই সৃজনশক্তি সমালোচকের।

“লেখকের মনের সহিত পরিচয় করাইয়া দেওয়াই সমালোচনার সৌন্দর্য। লেখায় বিশুদ্ধ নিয়ম রক্ষা হইয়াছে কি না তাহারই খবরদারি করা তাহার ব্যবসাগত কাজ বটে কিন্তু সেইটেই সব চেয়ে কম দরকারি।’

“অকরুণ সমালোচনায় রুচিকে পীড়িত করে এবং সকল দ্রব্যের স্বাদে বিষ মিশাইয়া দেয়।’

“যেখানে সৌজন্য এবং শান্তি নাই সেখানে প্রকৃত সাহিত্যই নাই। সমালোচনার মধ্যে দাক্ষিণ্য থাকা উচিত — না থাকিলে তাহা যথার্থ সাহিত্যশ্রেণীতে গণ্য হইতে পারে না।’

“ব্যবসাদার সমালোচকরা আকাটা হীরা বা খনি হইতে তোলা সোনার ঠিক দর যাচাই করিতে পারে না। ট্যাঁকশালের চলতি টাকাপয়সা লইয়াই তাহাদের কারবার। তাহাদের সমালোচনায় দাঁড়িপাল্লা আছে কিন্তু নিকষপাথর অথবা সোনা গলাইয়া দেখিবার মুচি নাই।’

“সাহিত্যের বিচারশক্তি অতি দীর্ঘকালে জন্মে এবং তাহার সম্পূর্ণ বিকাশ অত্যন্ত বিলম্বে ঘটে।’

“রুচি লইয়া সমালোচকদের উন্মত্ত উৎসাহ, তাহাদের আক্রোশ-উত্তেজনা উত্তাপ হাস্যকর। কাব্যসম্বন্ধে তাহারা এমনভাবে লেখে, কেবল ধর্মনীতি সম্বন্ধেই যাহা শোভা পায়। সাহিত্য মনোরাজ্যের জিনিস, তাহার সহিত মনোরাজ্যের আচার অনুসারেই চলা উচিত; রোষের উদ্দীপনা, পিত্তের দাহ সেখানে অসংগত।’

রচনাবিদ্যার সম্বন্ধে জুবেয়ারের উপদেশগুলি নিম্নে লিখিত হইল।

“অধিক ঝোঁক দিয়া বলিবার চেষ্টাতেই নবীন লেখকদের লেখা নষ্ট হয়, যেমন অধিক চড়া করিয়া গাহিতে গেলে গলা খারাপ হইয়া যায়। বেগ কণ্ঠ ক্ষমতা এবং বুদ্ধির মিতপ্রয়োগ করিতে শেখাই রচনাবিদ্যা, এবং উৎকর্ষলাভের সেই একমাত্র রাস্তা।’

“সাহিত্যে মিতাচরণেই বড়ো লেখককে চেনা যায়। শৃঙ্খলা এবং অপ্রমত্ততা ব্যতীত প্রাজ্ঞতা হইতে পারে না এবং প্রাজ্ঞতা ব্যতীত মহত্ত্ব সম্ভবপর নহে।’

“ভালো করিয়া লিখিতে গেলে স্বাভাবিক অনায়াসতা এবং অভ্যস্ত আয়াসের প্রয়োজন।’

পূর্বোক্ত কথাটার তাৎপর্য এই যে, ভালো লেখকের লিখনশক্তিটা স্বাভাবিক, কিন্তু সেই শক্তিটাকে বিচারের দ্বারা পদে পদে নিয়মিত করাটা অভ্যাসসাধ্য। সেই স্বাভাবিক শক্তির সঙ্গে যখন এই অভ্যস্ত শক্তির সম্মিলন হয় তখনই যথার্থ ভালো লেখা বাহির হয়। ভালো লেখক অনায়াসেই লিখিতে পারে, কিন্তু লিখিবার জন্য পদে পদে আয়াস স্বীকার করিয়া থাকে।

“প্রাচুর্যের ক্ষমতাটা লেখকের থাকা চাই, অথচ তাহা ব্যবহার করিয়া যেন সে অপরাধী না হয়। কারণ, কাগজ ধৈর্যশীল, পাঠক ধৈর্যশীল নহে; পাঠকদের ক্ষুধা অপেক্ষা পাঠকের মুখ মরিয়া যাওয়াকেই বেশি ভয় করা উচিত।’

“প্রতিভা মহৎকার্যের সূত্রপাত করে কিন্তু পরিশ্রম তাহা সমাধা করিয়া দেয়।’

“একটা ভালো বই রচনা করিতে তিনটি জিনিসের দরকার– ক্ষমতা, বিদ্যা এবং নৈপুণ্য। অর্থাৎ স্বভাব, পরিশ্রম এবং অভ্যাস।’

“লিখিবার সময় কল্পনা করিতে হইবে যেন বাছা বাছা কয়েকজন সুশিক্ষিত লোকের সম্মুখে উপস্থিত আছি অথচ তাঁহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া লিখিতেছি না।’

অর্থাৎ লেখা কেবল বাছা বাছা লোকের পড়িবার যোগ্য হইলে হইবে না; তাহা জনসাধারণের উপযুক্ত হইবে অথচ বিশি্‌ষ্ট মণ্ডলীর পছন্দসই হওয়া চাই।

“ভাবকে তখনই সম্পূর্ণ বলা যায় যখন তাহা হাতের কাছে প্রস্তুত হইয়া আসে– অর্থাৎ যখন তাহাকে যেমন ইচ্ছা পৃথক করিয়া লওয়া এবং যেখানে ইচ্ছা স্থাপন করা যায়।

অধিকাংশ লোকেরই মনে অধিকাংশ ভাব জড়িত-মিশ্রিত অবস্থায় থাকে, তাহাদিগকে আকারবদ্ধ ও পৃথক করিয়া লইতে না পারিলে বিশেষ কাজে লাগানো যায় না। জুবেয়ার নিজে সর্বদাই তাঁহার ভাবগুলিকে আকার ও স্বাতন্ত্র্য দান করিয়া তাহাদের প্রত্যেকটিকে যেন ব্যবহারযোগ্য করিয়া রাখিয়াছিলেন। এইরূপে তাঁহার মনের প্রত্যেক ভাবের সহিত স্পষ্ট পরিচয় স্থাপন করাই তাঁহার কাজ ছিল।

“রচনাকালে, আমরা যে কী বলিতে চাই তাহা ঠিকটি জানি না, যতক্ষণ না বলিয়া ফেলি। বস্তুত কথাই ভাবকে সম্পূর্ণতা এবং অস্তিত্ব দান করে।’

“ভালো সাহিত্যগ্রন্থে উন্মত্ত করে না, মুগ্ধ করে।’

“যাহা বিস্ময়কর তাহা একবার মাত্র বিস্মিত করে, যাহা মনোহর তাহার মনোহাহিত উত্তরোতর বাড়িতে থাকে।’

লেখার স্টাইল সম্বন্ধে জুবেয়ারের অনেকগুলি বচন আছে। কিন্তু স্টাইলকে বাংলায় কী বলিব?

চলিত শব্দ হইলেই ভালো হয়, আলংকারিক পরিভাষা সর্বদা ব্যবহারযোগ্য হয় না। বাংলা “ছাঁদ’ কথা স্টাইলের মোটামুটি প্রতিশব্দ বলা যাইতে পারে। কিন্তু তাহার দোষ এই যে, শুধু ছাঁদ কথাটা ব্যবহার বাংলায় রীতি নহে। বলিবার ছাঁদ, লিখিবার ছাঁদ ইত্যাদি না বলিতে কথাটা সম্পূর্ণ হয় না।

সংস্কৃত ভাষায় স্থলবিশেষে রীতি শব্দে স্টাইল বুঝায়। যথা মাগধী রীতি বৈদর্ভী রীতি ইত্যাদি। মগধে যে বিশেষ স্টাইল প্রচলিত তাহাই মাগধী রীতি, বিদর্ভের প্রচলিত স্টাইল বৈদর্ভী রীতি। এইরূপ, ব্যক্তিবিশেষের লেখায় তাঁহার একটি স্বকীয় রীতিও থাকিতে পারে — য়ুরোপীয় অলংকারে সেই স্টাইলের বহুল আলোচনা দেখা যায়।

তথাপি অনুবাদ করিতে বসিলে দেখা যাইবে, রীতি অথবা ছাঁদ সর্বত্রই স্টাইলের প্রতিশব্দরূপে প্রয়োগ করিলে ভাষার প্রথা-বিরুদ্ধ হইয়া পড়ে। একটি উদাহরণ দিই ; জুবেয়ার বলিয়াছেন, স্টাইলের চালাকিতে ভুলিয়ো না (আনংতক্ষন ষপ ঢ়ক্ষভদযড় ষপ ড়ঢ়ঁরন)। এ স্থলে “রীতি’ অথবা “ছাঁদ’ ঠিক এ ভাবে চলে না। কিন্তু একটু ঘুরাইয়া বলিলে কাজ চালানো যায় — লেখার ছাঁদের মধ্যে যদি চালাকি থাকে তাহা দেখিয়া ভুলিয়ো না– অথবা, লিখনরীতির চাতুরীতে ভুলিয়ো না। কিন্তু যেখানে স্টাইল কথাটা ব্যবহার করিলে সুবিধা পাওয়া যাইবে সেখানে আমরা প্রতিশব্দ বসাইবার চেষ্টা করিব না।

“ডুসোল্ট্‌ বলেন, মনের অভ্যাস হইতে স্টাইলের উৎপত্তি। কিন্তু অন্তঃপ্রকৃতির অভ্যাস হইতে যাহাদের স্টাইল গঠিত তাহারাই ধন্য।’

অনুবাদে আমরা সাহস করিয়া “প্রকৃতি’ শব্দটা ব্যবহার করিয়াছি। মূলে যে কথা আছে তাহার ইংরাজি প্রতিশব্দ “ড়ষয়র’। এ স্থলে “আত্মা’ কথা বলা যায় না, তাহার দার্শনিক অর্থ অন্যপ্রকার। এখানে “সোল’ শব্দের অর্থ এই যে, তাহা মনের ন্যায় আংশিক নহে। মন তাহার অধীন। মন হৃদয় ও চরিত্র তাহার অঙ্গ– এই “সোল’ শব্দ দ্বারা মানসিক সমগ্রতা প্রকাশ হইতেছে। “অন্তঃপ্রকৃতি’ শব্দ দ্বারা যদি এই অখণ্ড মানসতন্ত্রের ঐক্যটি না বুঝায় তবে পাঠকেরা উপযুক্ত শব্দ ভাবিয়া লইবেন। জুবেয়ারের কথাটার তাৎপর্য এই যে, মন তো চিন্তার যন্ত্র, তাহার চালনা দ্বারা কৌশল শিক্ষা হইতে পারে, কিন্তু সর্বাঙ্গীণ মানুষটির দ্বারা যে স্টাইল গঠিত হয় তাহাই স্টাইল বটে। সেই লিখনরীতির মধ্যে কেবল চিন্তার প্রভাব নহে, সমস্ত মানুষের একটি সম্পূর্ণ প্রভাব পাওয়া যায়।

“মনের অভ্যাস হইতে নৈপুণ্য, প্রকৃতির অভ্যাস হইতে উৎকর্ষ এবং সম্পূর্ণতা।’

ভালো লেখকমাত্রেরই একটি স্বকীয় লিখনরীতি থাকে– কিন্তু বড়ো লেখকের সেই রীতিটি পরিষ্কার ধরা শক্ত। তাহার মধ্যে একটি বৃহৎ অনির্দিষ্টতা থাকে। এ সম্বন্ধে জুবেয়ার লিখিতেছেন–

“যাহাদের ভাবনা ভাষাকে ছাড়াইয়া ছায় না, যাহাদের দৃষ্টি ভাবনাকে অতিক্রম করে না, তাহাদেরই লিখনরীতি অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট হইয়া থাকে।’

মহৎ লেখকদের ভাষা অপেক্ষা ভাবনা বড়ো হইয়া থাকে এবং তাঁহাদের মানসদৃষ্টি ভাবনাকে অতিক্রম করিয়া যায়। তাঁহারা যুক্তিতর্কচিন্তাকে লঙ্ঘন করিয়া অনেক জিনিস সহজে গ্রহণ করিয়া থাকেন। সেইজন্য তাঁহাদের রীতি বাঁধাছাঁদা কাটাছাঁটা নহে, তাহার মধ্যে একটি অনির্দেশ্যতা অনির্বচনীয়তা থাকিয়া যায়।

“সুকথিত রচনার লক্ষণ এই যে, ঠিক যেটুক আবশ্যক তার চেয়ে সে অধিক বলে অথচ যেটি বলিবার নিতান্ত সেইটিই বলে; ভালো লেখায় একই কালে প্রচুর এবং পরিমিত, ছোটো এবং বড়ো মিশ্রিত থাকে। এক কথায়, ইহার শব্দ সংক্ষিপ্ত, অর্থ অসীম।’

“অতিমাত্রায় ঠিকঠাকের ভাবটা ভালো নয়, কি সাহিত্যে কি আচরণে শ্রীরক্ষা করিয়া চলিতে গেলে এই নিয়ম স্মরণ রাখা আবশ্যক।’

“কোনো কোনো রচনারীতির একপ্রকার পরিষ্কার খোলাখুলি ভাব আছে,লেখকের মেজাজ হইতে তাহার জন্ম। সেটা আমাদের ভালো লাগিতে পারে কিন্তু সেটা চাইই চাই এমন কথা বলা যায় না।’

“ভল্টেয়ারের লেখার এই গুণ, কিন্তু পুরাতন লেখকদের রচনায় ইহা দেখা যায় না। অতুলনীয় গ্রীক সাহিত্যের স্টাইলে সত্য সুষমা এবং সৌহার্দ্য ছিল কিন্তু এই খোলাখুলি ভাবটা ছিল না। সৌন্দর্যের কতকগুলি মুখ্য উপাদানের সঙ্গে এই গুণটি ঠিক মিশে না। প্রবলতার সঙ্গে ইহা খাপ খাইতে পারে কিন্তু মর্যাদার সঙ্গে নহে। এই গুণটির মধ্যে একপ্রকার সাহসিকতা ও স্পর্ধা আছে বটে কিন্তু তেমনি ইহার মধ্যে একটা খাপছাড়া খিট্‌খিটে ভাবও আছে।’

“যাহারা অর্ধেক বুঝিয়াই সন্তুষ্ট হয় তাহারা অর্ধেক প্রকাশ করিয়াই খুশি থাকে; এমনি করিয়াই দ্রুত রচনার উৎপত্তি।’

“নবীন লেখকেরা মনটাকে টহলায় বেশি কিন্তু খোরাক অতি অল্পই দেয়।’

“কাচ যেমন, হয় দৃষ্টিকে সাহায্য করে নয় ঝাপসা করিয়া দেয়, কথা জিনিসটিও তেমনি।’

“একপ্রকারের কেতাবি স্টাইল আছে যাহার মধ্যে কাগজেরই গন্ধ পাওয়া যায়, বিশ্বসংসারের গন্ধ নাই; পদার্থের তত্ত্ব যাহার মধ্যে দুর্লভ, আছে কেবল লেখকিয়ানা।’

বই জিনিসটা ভাব-প্রকাশ ও রক্ষার একটা আধারমাত্র। কিন্তু অনেক সময় সে’ই নিজে সর্বেসর্বা হইয়া উঠে। তখন সে বই পড়িয়া মনে হয় এ কেবল বই পড়িতেছি মাত্র, এগুলা কেবল লেখা। ভালো বই পড়িবার সময় মনে থাকে না বই পড়িতেছি; ভাব এবং তত্ত্বের সহিত মুখামুখি পরিচয় হয়, মধ্যস্থ পদার্থটা চোখেই পড়ে না।

“অনেক লেখক আপনার স্টাইলটাকে ঝম ঝম্‌ করিয়া বাজাইতে থাকে, লোককে জানাইতে চায় তাহার কাছে সোনা আছে বটে।’

“দুর্লভ আশাতীত স্টাইল ভালো, যদি জোটে, কিন্তু আমি পছন্দ করি যে স্টাইলটিকে ঠিক প্রত্যাশা করা যায়।’

এ কথাটির মধ্যে গভীরতা আছে। অভাবনীয় আশাতিরিক্ত সৌন্দর্যকে ভালো বলিতেই হইবে, তথাপি তাহা মনের ভাবস্বরূপ, তাহাতে শ্রান্তি আনে। কিন্তু যেখানে যেটি আশা করা যায় ঠিক সেইটি পাইলেই মন শান্তি ও স্বাস্থ্য অনুভব করে, তাহাকে বিস্ময় বা সুখের ধাক্কায় বারম্বার আহত করিয়া ক্ষুব্ধ করে না। বাংলায় যে বচন আছে,”সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো’ তাহারও এই অর্থ। স্বস্তির মধ্যে যে শান্তি ও গভীরতা, ব্যাপ্তি ও ধ্রুবত্ব আছে, সুখের মধ্যে তাহা নাই। এইজন্য বলা যাইতে পারে সুখ ভালো বটে কিন্তু স্বস্তি তাহার চেয়েও প্রার্থনীয়।

বৈশাখ ১৩০৮

পরিশিষ্ট – নিরাকার উপাসনা

চারি সহস্র বৎসর পূর্বে ভারতে প্রশ্ন উঠিয়াছিল — অশব্দমস্পর্শমরূপমব্যয়ং তথারসং নিত্যমগন্ধবচ্চ যৎ– যাঁহাতে শব্দ নাই, স্পর্শ নাই, রূপ নাই, রস নাই, গন্ধ নাই, এমন যে নিত্য পরব্রহ্ম, তাঁহাকে আমরা শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধের মধ্যে থাকিয়া লাভ করিতে পারি কি না? তপোবনে অরণ্যচ্ছায়াতলে সেদিন তাহার এক সুগম্ভীর উত্তর ধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছিল —

বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তং, আমি সেই মহান্‌ পুরুষকে জানিয়াছি।

তাঁহাকে পাওয়া যায় কি না এ প্রশ্নের ইহা অপেক্ষা সুস্পষ্ট এবং সরল উত্তর আর কী হইতে পারে যে, আমি তাঁহাকে পাইয়াছি। যিনি জানিতে চাহিয়াছিলেন তিনি তাঁহাকে জানিয়াছেন, যিনি পাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন তিনি তাঁহাকে পাইয়াছেন, ইহাই আমাদের আশার কথা। ইহার উপরে আর তর্ক নাই। তর্কের দ্বারা যদি কেহ প্রমাণ করিত যে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় তবে তর্কের দ্বারা তাহার খণ্ডন সম্ভব হইতে পারিত, কিন্তু অনেক সহস্র বৎসর পূর্বে নির্জন ধ্যানাসন হইতে দণ্ডায়মান হইয়া ব্রহ্মবাদী মহর্ষি বিশ্বলোককে আহ্বানপূর্বক এই এক মহাসাক্ষ্য ঘোষণা করিয়াছেন যে —

বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তং, আমি সেই মহান্‌ পুরুষকে জানিয়াছি।

সেই সত্যবাণী আজিও সমস্ত দেশকালকে অতিক্রম করিয়া সমস্ত তর্কসংশয়কে অভিভূত করিয়া দিব্যধামবাসী অমৃতের পুত্রগণের নিকট উত্থিত হইতেছে।

অদ্যকার ভারতবর্ষে আমাদের মধ্যেও মাঝে মাঝে এ তর্ক উঠিয়া থাকে যে, নিরাকার ব্রহ্মকে কি পাওয়া যাইতে পারে? প্রাচীন ভারতের মহাসাক্ষ্যবাণী আজিও লয়প্রাপ্ত হয় নাই; সেই প্রশান্ত তপোভূমি হইতে অমৃত আশ্বাসবাক্য আজিও আমাদের বিক্ষুব্ধ কর্মভূমিতে আসিয়া উপনীত হইতেছে — এই অনিত্য সংসারের রূপ-রস-গন্ধ-ব্যূহ ভেদ করিয়া স্বাধীন আত্মার সনাতন জয়শঙ্খধ্বনি বাজিয়া উঠিতেছে, ব্রহ্মবিদাপ্নোতি পরম্‌–ব্রহ্মবিৎ পরম পুরুষকে পাইয়া থাকেন– তবু আমরা প্রশ্ন তুলিয়াছি নিরাকার পরব্রহ্মকে কি পাওয়া যায়? অদ্য তেমন সবল গভীর কন্ঠে, তেমন সরল সতেজ চিত্তে এমন সুষ্পষ্ট উত্তর কে দিবে —

বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তং, আমি সেই মহান্‌ পুরুষকে জানিয়াছি।

আজ সেই প্রশ্নের উত্তরে কেবল সংশয়ধূলিসমাচ্ছন্ন তর্ক উঠিয়াছে– ইহা কি কখনো সম্ভব হয়? নিরাকার পরব্রহ্মকে কি কখনো পাওয়া যাইতে পারে?

কিন্তু পাওয়া কাহাকে বলে?

আমরা কোন্‌ জিনিসটাকে পাই? যে-সকল পদার্থকে আমার পাইয়াছি বলিয়া কল্পনা করি তাহাদের উপরে আমাদের কতটুকু অধিকার? আলোককে আমরা চোখে দেখি মাত্র, তাহাকে স্পর্শ করিতে পারি না, তবু বলি আলোক পাইলাম; উত্তাপকে আমরা স্পর্শ দ্বারা জানি কিন্তু চোখে দেখিতে পাই না, তবু বলি আমরা উত্তাপ লাভ করিলাম। গন্ধকে আমরা দেখিও না স্পর্শও করি না তবু গন্ধ আমরা যে পাই ইহাতে কোনো সংশয় বোধ করি না।

দেখা যাইতেছে ভিন্ন ভিন্ন দ্রব্য পাইবার ভিন্ন ভিন্ন পথ আছে। কোনোটা দৃষ্টিতে পাই, কোনোটা স্পর্শে পাই, কোনোটা কর্ণে শুনি, কোনোটা ঘ্রাণে লাভ করি, কোনোটা-বা দুই-তিন ইন্দ্রিয়শক্তির একত্রযোগেও পাইয়া থাকি। সংগীতকে কেহ যদি চক্ষু দিয়া পাইবার চেষ্টা করে তবে সে চেষ্টাকে লোকে বাতুলতা বলিবে এবং পুষ্পকে কেহ যদি গানের মতো লাভ করিবার ইচ্ছা করে তবে সে ইচ্ছা নিতান্তই ব্যর্থ হয়।

কেবল তাহাই নহে। আমাদের ইন্দ্রিয়শক্তি সীমাবদ্ধ, এইজন্য ইন্দ্রিয় দ্বারা আমরা কোনো বস্তুকে যতটুকু পাই তাহাও অত্যন্ত অসম্পূর্ণ। আমরা যখন কোনো বস্তুর এক পিঠ দেখি তখন অন্য পিঠ দেখিতে পাই না, যখন বাহিরটা দেখি তখন ভিতরটা আমাদের অগোচর থাকে। অধিকক্ষণ কিছু অনুভব করিতে গেলে আমাদের ইন্দ্রিয় ক্লান্ত, আমাদের স্নায়ুশক্তি অসাড় হইয়া আসে।

কিন্তু তথাপি জড়বস্তুসকলকে আমরা পাইলাম বলিয়া সন্তুষ্ট আছি; এবং যে বস্তুকে যে উপায়ে যে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা পাওয়া সম্ভব সেই উপায়ে সেই ইন্দ্রিয়ের দ্বারাই তাহাকে লাভ করিবার চেষ্টা করিয়া থাকি।

লৌকিক বস্তু সম্বন্ধেই যখন এরূপ তখন নিরাকার ব্রহ্মকে পাওয়ারই কি কোনো বিশেষত্ব নাই? তাঁহাকে চোখে দেখিলাম না বলিয়াই কি তাঁহাকে পাইলাম না?

এ কথা আমরা কেন না মনে করি যে, স্বরূপতই তিনি যখন চোখে দেখার অতীত তখন তাঁহাকে চোখে দেখার চেষ্টা করাই মূঢ়তা। আমরা যদি আলোককে সংগীতরূপে ও সংগীতকে গন্ধরূপে পাইবার কল্পনাকেও দুরাশা বলিয়া জ্ঞান করি তবে নিরাকারকে সাকাররূপে লাভ না করিলে তাঁহাকে লাভ করাই হইল না এ কথা কেমন করিয়া মনে স্থান দিই?

আমরা যখন টাকা হাতে পাই তাহাকে কি আমাদের অন্তরাত্মার মধ্যে তুলিয়া রাখিতে পারি? যে ব্যক্তি তাহাকে অত্যন্ত নিজের করিয়া রাখিতে চেষ্টা করে সে তাহাকে মাটিতে পুতিয়া ফেলে, লোহার সিন্দুকে পুরিয়া রাখে, নিজের করিতে গিয়া নিজের কাছ হইতে দূরেই তাহাকে রাখিতে হয়। কিন্তু একান্ত চেষ্টাতেও সে টাকাকে কৃপণ আপনার অন্তরের মধ্যে রাখিতে পারে না; বাহিরের টাকা বাহিরেই পড়িয়া থাকে এবং মৃত্যুকালে ধূলির সহিত তাহার কোনো প্রভেদ থাকে না। কৃপণ তবুও তো জানে টাকা আমার, টাকা আমি পাইয়াছি। বাহিরের ধনকে অন্তরে না পাইয়াও আমরা তাহাকে পাইলাম বলিয়া স্বীকার করি; আর যিনি আমাদের একমাত্র ধন, যিনি অন্তরের অন্তরতম, তাঁহাকে বস্তুরূপে মূর্তিরূপে মনুষ্যরূপে বাহিরে না পাইলে কি আমাদের পাওয়া হইল না? যিনি চক্ষুষশ্চক্ষুঃ, চক্ষুর চক্ষু, তাঁহাকে কি চক্ষুর বাহিরে দেখিব? যিনি শোত্রস্য শ্রোত্রং, কর্ণের কর্ণ, তাঁহাকে কি কর্ণের বাহিরে শুনিব? যাঁহার সম্বন্ধে ঋষি বলিয়াছেন —

ন সন্দৃশে তিষ্ঠতি রূপমস্য

ন চক্ষুষা পশ্যতি কশ্চনৈনং।

হৃদা মনীষা মনসাভিক্‌প্তো

য এনমেবং বিদুরমৃতাস্তে ভবন্তি॥

ইহার স্বরূপ চক্ষুর সম্মুখে স্থিত নহে, ইহাকে কেহ চক্ষুতে দেখে না– হৃদিস্থিত বুদ্ধি দ্বারা ইনি কেবল হৃদয়েই প্রকাশিত, ইঁহাকে যাঁহারা এইরূপেই জানেন তাঁহারা অমর হন– এমন-যে আত্মার অন্তরাত্মা তাঁহাকে বহির্বস্তুর মতো বাহিরে পাইতে গেলেই তাঁহাকে পাওয়া যায় না এ কথা আমরা কেন না স্মরণ করি?

যাঁহারা ঈশ্বরকে পাইবার চেষ্টা করিয়াছেন তাঁহারা কী বলিয়াছেন? তাঁহারা বলেন —

ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্র তারকাং

নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোইয়মগ্নিঃ।

সূর্য তাঁহাকে প্রকাশ করিতে পারে না, চন্দ্রতারাও তাঁহাকে প্রকাশ করিতে পারে না, এই বিদ্যুৎসকলও তাঁহাকে প্রকাশ করিতে পারে না, তবে এই অগ্নি তাঁহাকে কী প্রকারে প্রকাশ করিবে?

তাঁহারা বলেন —

তমাত্মস্থং যে অনুপশ্যন্তি ধীরাঃ

তেষাং শান্তিঃ শাশ্বতী নেতরেষাম্॥

যে ধীরেরা তাঁহাকে আত্মস্থ করিয়া দেখেন তাঁহারাই নিত্য শান্তি লাভ করেন আর কেহ নহে। আর আমরা ঈশ্বরকে পাইবার কোনো চেষ্টা কোনো সাধনা না করিয়া এমন কথা কোন্‌ স্পর্ধায় বলিয়া থাকি যে, নিরাকার ব্রহ্মকে আত্মার মধ্যে না দেখিয়া, মূর্তির মধ্যে, অগ্নির মধ্যে, বাহ্যবস্তুর মধ্যেই দেখিতে হইবে, কারণ তাঁহাকে আর কোনো উপায়ে আমাদের পাইবার সামর্থ্য নাই। এ কথা কেন মনে করি না যে, একমাত্র যে উপায়ে তাঁহাকে পাওয়া যাইতে পারে– অর্থাৎ আত্মার দ্বারা আত্মার মধ্যে– তাহা ছাড়া তাঁহাকে পাইবার উপায়ান্তর মাত্র নাই।

কেন করি না তাহার কারণ, আমরা তর্ক করি, কিন্তু ঈশ্বরকে চাহি না।

আমরা ব্রহ্মকে কখন চাই? যখন দেখিতে পাই সংসারের পরিমিত পদার্থমাত্রই পরিবর্তনশীল– যখন এই চঞ্চল ঘূর্ণ্যমান বিষয়াবর্তের মধ্যে একটি নির্বিকার ধ্রুব অবলম্বনের জন্য আমাদের আত্মা ব্যাকুল হইয়া উঠে। তখন যিনি সকল আকার বিকার এবং সীমার অতীত সহজেই তাঁহাকেই চাই। যিনি– নিত্যোইত্যানাং, অনিত্য সকলের মধ্যে নিত্য, চেতনশ্চেতনানাং, সমস্ত চেতনার চেতয়িতা, তাঁহাকে সেই নিত্যরূপে, সেই চেতয়িতারূপেই পাইতে চাই। তখন এ সংকল্প মনে উদয় হইতেই পারে না যে, নিরাকারকে আমরা কৌশলপূর্বক সাকাররূপে লাভ করিতে চেষ্টা করিব। যখন কারাগারের পাষাণভিত্তি আমাদিগকে ক্লিষ্ট করে তখন নূতন প্রাচীর গাঁথিয়া আমরা মুক্তি কল্পনা করিতে পারি না। অসৎ যখন আমাদিগকে পীড়িত করে, যখন কাতর অন্তঃকরণ হইতে প্রার্থনা ধ্বনিত হইয়া উঠে, অসতো মা সদ্‌গময়, অসৎ হইতে আমাকে সত্যে লইয়া যাও, তখন কি নবতর অসত্যপাশ আমাদিগকে প্রলুব্ধ করিতে পারে?

আমরা ব্রহ্মকে কখন চাই? একদিন যখন উপলব্ধি করি আমাদের প্রবৃত্তি আমাদের বাসনা মুহূর্তে মুহূর্তে অসৎ সংসারের ধূলিকর্দম আহরণ করিয়া আমাদের আলোকের পথ অবরুদ্ধ করিয়াছে; আমরা সেই নিবিড় মোহান্ধকারে মণি বলিয়া যাহা সংগ্রহ করিতেছি তাহা মুষ্টির মধ্যে ধূলি হইয়া যাইতেছে, সুখ বলিয়া যাহা আলিঙ্গন করিতেছি তাহা সহস্রশিখা জ্বালারূপে আপাদমস্তক দগ্ধ করিতেছে, জল বলিয়া যাহা পান করিতেছি তাহা তৃষাহুতাশনে আহুতি-স্বরূপে বর্ষিত হইতেছে; তখন পাপের বিভীষিকায় ভয়াতুর হইয়া যাঁহাকে ডাকিয়া বলি “তমসো মা জ্যোতির্গময়’ তিনি কি আমাদেরই মতো বাসনা-প্রবৃত্তির দ্বারা জড়িত সুখদুঃখপীড়িত পুরাণকল্পিত তমসাচ্ছন্ন দেবতা?

আমরা ব্রহ্মকে কখন চাই? যখন আমাদের আত্মা ব্রহ্মবাদিনী মৈত্রেয়ীর ন্যায় সমস্ত সংসারকে এক পার্শ্বে সরাইয়া দিয়া বলিয়া উঠে, যেনাহং নামৃতা স্যাম্‌ কিমহং তেন কুর্যাম্‌, যাহার দ্বারা আমি অমর না হইব তাহা লইয়া আমি কী করিব? আমরা সংসারের যত সুখ যত ঐশ্বর্য তাহার নিকট আহরণ করি সে বলিতে থাকে, এ তো আমার মৃত্যুর উপকরণ! সে আপন ক্ষুধার অন্ন পিপাসার জল চাহিয়া উচ্চকণ্ঠে ডাকিয়া উঠে। মৃত্যোর্মামৃতং গময়, মৃত্যু হইতে আমাকে অমৃতে লইয়া যাও। মৃত্যুপীড়িত আত্মার সেই অমৃতস্বরূপ কে? —

সত্য জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম আনন্দরূপমমৃতং যদ্‌বিভাতি।

সত্যস্বরূপ জ্ঞানস্বরূপ অনন্তস্বরূপ ব্রহ্ম, যিনি আনন্দরূপে অমৃতরূপে প্রকাশ পাইতেছেন।

অতএব, যখন আমরা যথার্থরূপে তাহাকে চাই তখন ব্রহ্ম বলিয়াই তাঁহাকে চাই। তিনি যদি সত্যস্বরূপ জ্ঞানস্বরূপ অনন্তস্বরূপ না হইতেন তবে এই অসৎ সংসার, এই অন্ধকার হৃদয়, এই মৃত্যুবীজসংকুল সুখসম্পদের মধ্যে থাকিয়া তাঁহাকে চাহিতাম না। কেন তবে আমরা তর্ক করিয়া থাকি যে, আমরা অপূর্ণ জীব এবং তিনি সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম, অতএব তাঁহাকে আমরা পাইতেই পারি না। এবং সেইজন্য অসত্য অজ্ঞান এবং অন্ধবিশিষ্ট আমরা আকারকে কেন তাঁহার স্থানে আরোপ করি? আমরা অপূর্ণ বলিয়াই সেই পূর্ণস্বরূপকে আমাদের একান্তই চাই, আমরা অপূর্ণ বলিয়াই সেই সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্মই আমাদের একমাত্র আনন্দ– একমাত্র মুক্তি। আমরা অপূর্ণ বলিয়াই আমরা অপূর্ণের পূজা করিব না; অপূর্ণের উপরে আমাদের অমর আত্মার, আমাদের অনন্ত জীবনের প্রতিষ্ঠা স্থাপন করিব না; আমরা এই অসৎ, এই অন্ধকার, এই মর্তবিষয়পুঞ্জের মধ্যস্থলে “শান্তোদান্ত উপরতস্তিতিক্ষুঃ সমাহিতোভূত্বা’ সাধনা করিতে থাকিব যতদিন না বলিতে পারি–

বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তং আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।

মাঘ ১৩০৫

 পরিশিষ্ট – শোকসভা

বঙ্কিমের মৃত্যু উপলক্ষে শোকপ্রকাশ করিবার জন্য যাঁহারা সাধারণ সভা আহ্বানের চেষ্টা করিয়াছেন, শুনা যায়, তাঁহারা একটি গুরুতর বাধা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন; সে বাঁধা সর্বাপেক্ষা বিস্ময়জনক এবং তাহা পূর্বে প্রত্যাশা করা যায় নাই।

যাঁহারা বঙ্কিমের বন্ধুত্ব সম্পর্কে আপনাদিগকে গৌরবান্বিত জ্ঞান করেন এমন অনেক খ্যাতনামা লোক সভাস্থলে শোকপ্রকাশ করা কৃত্রিম আড়ম্বর বলিয়া তাহাতে যোগদান করিতে অসম্মত হইয়াছেন এবং সভার উদ্‌যোগিগণকে ভৎর্সনা করিতেও ক্ষান্ত হন নাই। এরূপ বিয়োগ উপলক্ষে আপন অন্তরের আবেগ প্রকাশ্যে ব্যক্ত করাকে বোধ করি তাঁহারা পবিত্র শোকের অবমাননা বলিয়া জ্ঞান করেন।

বিশেষত আমাদের দেশে কখনো এমন প্রথা প্রচলিত ছিল না,সুতরাং শোকের দিনে একটা অনাবশ্যক বিদেশী আড়ম্বরে মাতিয়া ওঠা কিছু অশোভন এবং অসময়োচিত বলিয়া মনে হইতে পারে।

যখন আমাদের দেশের অনেক শ্রদ্ধেয় লোকের এইরূপ মত দেখা যাইতেছে তখন এ সম্বন্ধে আলোচনা আবশ্যক হইয়াছে।

সাধারণের হিতৈষী কোনো মহৎ ব্যক্তির মৃত্যু হইলে সাধারণ সভায় তাঁহার গুণের আলোচনা করিয়া তাঁহার নিকটে কৃতজ্ঞতা স্বীকারপূর্বক শোকপ্রকাশ করার মধ্যে ভালোমন্দ আর যাহাই থাক্‌, তাহা যে য়ুরোপীয়তা-নামক মহদ্দোষে দুষ্ট সে কথা স্বীকার করিতেই হইবে। কিন্তু সেইসঙ্গে এ কথাও ভাবিয়া দেখিতে হইবে যে, য়ুরোপীয়দের সংসর্গবশতই হউক বা অন্যান্য নানা কারণে ইচ্ছাক্রমে ও অনিচ্ছাক্রমে আমাদের বাহ্য অবস্থা এবং মনের ভাবের কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটিতেছে; কেবল রাগ করিয়া অস্বীকার করিয়া বিরক্ত হইয়া তাহাকে লোপ করা যায় না। নূতন আবশ্যকের জন্য নূতন উপায়গুলি অনভ্যাসবশত প্রথম-প্রথম যদি বা কাহারো চক্ষে অপরিচিত অপ্রিয় বলিয়া বোধ হয় তথাপি বিবেচক ব্যক্তি ভালোরূপ বিচার না করিয়া তাহার নিন্দা করেন না।

সহৃদয় লোকের নিকট কৃত্রিমতা অতিশয় অসহ্য হইয়া থাকে এ কথা সর্বজনবিদিত। কিন্তু কৃত্রিমতার অনেক প্রকারভেদ আছে। একপ্রকার কৃত্রিমতা ভিত্তিস্বরূপে সমাজকে ধারণ করিয়া রাখে, আর-একপ্রকার কৃত্রিমতা কীটের স্বরূপে সমাজকে জীর্ণ করিয়া ফেলে।

সমাজের প্রতি আমাদের যে-সকল কর্তব্য আছে তাহা পালন করিতে গেলেই কথঞ্চিৎ কৃত্রিমতা অবলম্বন করিতে হইবে। কারণ প্রত্যেকেই যদি নিজের রুচি ও হৃদয়াবেগের পরিমাণ অনুসারে স্বরচিত নিয়মে সামাজিক কর্তব্য পালন করে তবে আর উচ্ছৃঙ্খলতার সীমা থাকে না। সে স্থলে সর্বজনসম্মত একটা বাঁধা নিয়ম আশ্রয় করিতে হয়। যেমন সৃষ্টিকর্তা এই পৃথিবীকে কেবল বিশুদ্ধ ভাবরূপে রাখিয়া দেন নাই কিন্তু ভাবকে ভূরিপরিমাণ ধূলিরাশি দ্বারা ব্যক্ত করিয়াছেন, তেমনি, যাহা-কিছু কেবলমাত্র একাকীর নহে, যাহাকেই সর্বসাধারণের সেব্য এবং যোগ্য করিতে হইবে, তাহাকেই অনেকটা জড় কৃত্রিমতার দ্বারা দৃঢ় আকারবদ্ধ করিয়া লইতে হইবে। অরণ্যের অকৃত্রিম সৌন্দর্য সহৃদয় কবিগণ যতই ভালো বলুন, কৃত্রিম ইষ্টককাষ্ঠরচিত মহানগর লোকসমাজের বাসের পক্ষে যে তদপেক্ষা অনেকাংশে উপযোগী তাহা অস্বীকার করিবার কারণ দেখি না। তরুর প্রত্যেক অংশ সজীব এবং স্বতোবর্ধিত, তাহার শোভা হৃদয়তৃপ্তিকর, তথাপি মনুষ্য আপন সনাতন পূর্বপুরুষ শাখামৃগের প্রতি ঈর্ষা প্রকাশ না করিয়া স্বহস্তরচিত অট্টালিকায় আশ্রয়গ্রহণপূর্বক যথার্থ মনুষ্যত্ব প্রকাশ করিয়াছে।

যে-সকল ভাব প্রধানত নিজের, যেখানে বহিঃসমাজের কোনো প্রবেশাধিকার নাই, যেখানে মনুষ্যের হৃদয়ে স্বাধীনতা আছে, সেখানে কৃত্রিমতা দোষাবহ। কিন্তু মনুষ্যসমাজ এতই জটিল যে, কতটুকু আমার একাকীর এবং কতখানি বাহিরের সমাজের তাহার সীমানির্ণয় অনেক সময় দুরূহ হইয়া পড়ে এবং অনেক সময় বাধ্য হইয়া আমার নিজস্ব অধিকারের মধ্য দিয়াও সমাজ-মুনিসিপ্যালিটির জন্য রাস্তা ছাড়িয়া দিতে হয়।

একটা দৃষ্টান্তের উল্লেখ করি। সহজেই মনে হইতে পারে, পিতৃশোক সন্তানের নিজের। সমাজের সে সম্বন্ধে আইন বাঁধিবার কোনো অধিকার নাই। সকল সন্তান সমান নহে, সকল সন্তানের শোক সমান নহে, এবং মনের প্রকৃতি অনুসারে শোকপ্রকাশের ভিন্ন উপায়ই স্বাভাবিক, তথাপি সমাজ আসিয়া বলে, তোমার শোক তোমারই থাক্‌, অথবা না থাকে যদি সে সম্বন্ধেও কোনো প্রশ্নোত্তরের আবশ্যক নাই, কিন্তু শোকপ্রকাশের আমি যে বিধি করিয়া দিয়াছি, সৎ এবং অসৎ, গুরুশোকাতুর এবং স্বল্পশোকাতুর, সকলকেই তাহা পালন করিতে হইবে। পিতৃবিয়োগে শোক পাওয়া বা না পাওয়া লইয়া কথা নহে, সমাজ বলে, আমার নিকট শোকপ্রকাশ করিতে তুমি বাধ্য এবং তাহাও আমার নিয়মে করিতে হইবে।

কেন করিতে হইবে? কারণ, পিতার প্রতি ভক্তি সমাজের মঙ্গলের পক্ষে একান্ত আবশ্যক। যদি মৃত্যুর ন্যায় এমন গুরুতর ঘটনাতেও স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তিবিশেষের ব্যবহারে পিতৃভক্তির অভাব প্রকাশ পায় অথবা সাধারণের নিকট সে ভক্তি গোপন থাকে তবে সেই দৃষ্টান্ত সমাজের মূলে গিয়া আঘাত করে। সে স্থলে আত্মরক্ষার্থে ব্যক্তিগত শোক এবং ভক্তি-প্রকাশকেও সমাজ নিয়মের দ্বারা বাঁধিয়া দিতে বাধ্য হয়। এবং সর্বসাধারণের জন্য যে নিয়ম বাঁধিতে হয় তাহাতে ব্যক্তিবিশেষের প্রকৃতি-বৈচিত্র্যের পরিমাপ কখনোই রক্ষিত হইতে পারে না। এইজন্য অকৃত্রিম প্রবল শোকের পক্ষে সাধারণ নিয়ম অনেক সময় কঠিন পীড়াদায়ক হইতে পারে তথাপি সমাজের প্রতি কর্তব্যের অনুরোধে গুরুতর শোকের সময়ও অনুষ্ঠানবিধির প্রত্যেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঙ্গপ্রত্যঙ্গও সযত্নে রক্ষা করিয়া চলিতে হয়।

সকলেই স্বীকার করিবেন, ঈশ্বরের সহিত ভক্তের সম্বন্ধ সর্বাপেক্ষা নিগূঢ় সম্বন্ধ। তাহা দেশকালে বিচ্ছিন্ন নহে। পিতা মাতা স্ত্রী পুত্র স্বামী কেহই আমাদের চিরদিনের নহে এরূপ বৈরাগ্যসংগীত ভারতবর্ষের পথে পথে ধ্বনিত হইয়া থাকে– অতএব যাহাদের সহিত কেবল আমাদের ইহজীবনের সামাজিক সম্পর্ক, সমাজ তাঁহাদের সম্বন্ধে আমাদিগকে সর্বপ্রকার নিয়মের দ্বারা বাধ্য করিতে পারে, কিন্তু যাঁহার সহিত আমাদের অনন্তকালের ঘনিষ্ঠ যোগ, তাঁহাতে-আমাতে স্বতন্ত্র স্বাধীন সম্বন্ধ থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের সমাজ তাহাতেও আমাদের স্বাধীনতা দেয় নাই। ঈশ্বরকে কী মূর্তিতে কী ভাবে কী উপায়ে পূজা করিতে হইবে তাহা কেবল উপদেশ দিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, অনুশাসনের দ্বারা বদ্ধ করিয়া দিয়াছে। কোন্‌ ফুল উপহার দিতে হইবে এবং কোন্‌ ফুল দিতে হইবে না তাহাও তাহার আদেশ অনুসারে পালন করিতে হইবে। যে মন্ত্রের দ্বারা পূজা করিতে হইবে তাহা না বুঝিলেও ক্ষতি নাই কিন্তু নিজের হৃদয়ের অনুবর্তী হইয়া সে মন্ত্রের পরিবর্তন করিলে চলিবে না। অতএব, আমাদের জীবনের যে অংশ একেবারে অন্তরতম, যাহা সমাজ এবং সংসারের অতীত সেই অর্ন্তযামী পুরুষের উদ্দেশে একান্তভাবে উৎসর্গীকৃত, সাধারণ-মঙ্গলের উপলক্ষ করিয়া সমাজ সেখানেও আপনার সংকীর্ণ শাসন স্থাপন করিয়াছে।

সর্বত্রই সমাজের অপ্রতিহত ক্ষমতা ভালো কি মন্দ সে তর্ক এখানে উত্থাপন করা অপ্রাসঙ্গিক। আমি দেখাইতে চাই যে, ভ্রমক্রমেই হউক বা সুবিচারপূর্বকই হউক, সমাজ যেখানেই আবশ্যক বোধ করিয়াছে সেখানে ব্যক্তিগত হৃদয়ের ভাবকে নিজের বিধি অনুসারে প্রকাশ করিতে সমাজস্থ ব্যক্তিগণকে বাধ্য করিয়াছে। তাহাতে সমাজের অনেক কার্য সরল হইয়া আসে এবং তাহার অনেক সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়।

আমাদের সমাজ গার্হস্থ্যপ্রধান সমাজ। পিতামাতা এবং গৃহের কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তিদিগের প্রতি অক্ষুণ্ন ভক্তি ও নির্ভর এই সমাজের প্রধান বন্ধন– এই কারণে গুরুজনের বিয়োগে শোকপ্রকাশ কেবল ব্যক্তিগত নহে, তাহা সমাজগত নিয়মের অধীন। এ সমাজ অনাবশ্যকবোধে পুত্রশোকের প্রতি কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করে নাই।

সম্প্রতি এই গার্হস্থ্যপ্রধান সমাজের কিছু রূপান্তর ঘটিয়াছে। ইহার মধ্যে একটা নূতন বন্যার জল প্রবেশ করিয়াছে। তাহার নাম পাব্লিক।

পদার্থটিও নূতন, তাহার নামও নূতন। বাংলা ভাষায় উহার অনুবাদ অসম্ভব। সুতরাং পাব্লিক শব্দ এবং তাহার বিপরীতার্থক প্রাইভেট শব্দ বাংলায় প্রচলিত হইয়াছে, কেবল এখনো জাতে উঠিয়া সাহিত্য-সভায় স্থান পায় নাই; তাহাতে তাহাদের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নাই, সাহিত্যেরই সমূহ অসুবিধা। যখন কথাটা বলিবার দরকার নয় তখন শব্দটা কোনোমতে উচ্চারণ না করিয়া ভাবে ভঙ্গিতে ইশারায় ইঙ্গিতে সাধু সাহিত্যকে বহু কষ্টে কাজ চালাইতে হয়। কিন্তু এই বিদেশী শব্দটা যখন সাধারণের বোধগম্য হইয়াছে তখন আর এ-প্রকার দুরূহ ব্যায়ামের আবশ্যক দেখি না।

এক্ষণে আমাদের সমাজে যখন, কেবল গৃহ নহে, পাব্লিকের অস্তিত্বও ক্রমশ দীপ্যমান হইয়া উঠিয়াছে, তখন এখানে ক্রমে ক্রমে এক-একটি করিয়া পাব্লিক-কর্তব্যের আবির্ভাবও অবশ্যম্ভাবী।

যেমন আমাদের দেশে পিতৃশ্রাদ্ধ প্রকাশ্য সভায় অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে এবং প্রত্যেক পিতৃহীন ব্যক্তির পিতৃশোক ব্যক্ত করা প্রকাশ্য কর্তব্যস্বরূপে গণ্য হয় তেমনি পাব্লিকের হিতৈষী কোনো মহৎ ব্যক্তির মৃত্যুতে প্রকাশ্য সভায় শোকজ্ঞাপন একটা সামাজিক কর্তব্যের মধ্যে গণ্য হওয়া উচিত। গার্হস্থ্যপ্রধান সমাজে প্রায় প্রত্যেক পিতাই বীর। তাঁহাদিগকে বিচিত্র কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে হয় এবং সমস্ত পরিবারের জন্য পদে পদে ত্যাগস্বীকার করিয়া আত্মসুখ বিসর্জনপূর্বক চলিতে হয়। যাহাদের হিতের জন্য তাঁহারা ধৈর্যের সহিত বীর্যসহকারে আমৃত্যুকাল সংসারের কঠিন কর্তব্যসকল সাবধানে পালন করিয়া চলেন তাহারা সর্বসমক্ষে সেই আত্মসুখে উদাসীন হিতব্রত গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি প্রদর্শন করিবে ইহা সমাজের শাসন। তেমনি, যাঁহারা কেবল আপনার ঘরের জন্য নহে, পরন্তু পাব্লিকের হিতের জন্য আপন জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন, মৃত্যুর পরে তাঁহাদের প্রতি প্রকাশ্য ভক্তি স্বীকার করা কি পাব্লিকের কর্তব্য নহে? এবং প্রকাশ্যে ভক্তি স্বীকার করিতে গেলেই কি ব্যক্তিগত শোককে সংযমে আনা আবশ্যক হয় না। এবং একজন বিশেষ বন্ধু রুদ্ধদ্বার গৃহের মধ্যে যেরূপ ভাবে শোকোচ্ছ্বাসকে মুক্ত করিয়া থাকেন সাধারণের নিকট কি কখনো সেরূপ শোকপ্রকাশ প্রত্যাশা করা যায়? এবং সাধারণের পক্ষে সেরূপ শোক সম্ভব নহে বলিয়াই কি সাধারণ শোকের কোনো মূল্য নাই এবং তাহা নিন্দনীয়?

এ কথা আমি অস্বীকার করি না যে, আমাদের দেশের পাব্লিক আমাদের দেশীয় মহাত্মা লোকের বিয়োগে যথোচিত শোক অনুভব করে না। আমাদের এই অল্পবয়স্ক পাব্লিক অনেকটা বালক-স্বভাব। সে আপনার হিতৈষীদিগকে ভালো করিয়া চেনে না, যে উপকারগুলি পায় তাহার সম্পূর্ণ মূল্য বুঝে না, বন্ধুদিগকে অতিশীঘ্রই বিস্মৃত হয় এবং মনে করে আমি কেবল গ্রহণ করিব মাত্র কিন্তু তাহার পরিবর্তে আমার কোনো কর্তব্য নাই।

আমি বলি, এইরূপ পাব্লিকেরই শিক্ষা আবশ্যক এবং সভা আহ্বান ও সেই সভায় আলোচনাই শিক্ষার প্রধান উপায়। যাঁহারা চিন্তাশীল সহৃদয় ভাবুক ব্যক্তি তাঁহারা যদি লোকহিতৈষী মহোদয় ব্যক্তিদিগের বিয়োগশোককে নিজের হৃদয়ের মধ্যে আবদ্ধ রাখিয়া দেন, তাহাকে যদি সাধারণ শোকের উদার বৃহত্ত্ব দান না করেন, তাঁহারা যদি সাধারণকে ক্ষুদ্র ও চপল বলিয়া ঘৃণা করিয়া দেশের বড়ো বড়ো ঘটনার সময় শিক্ষাদানের অবসরকে অবহেলা করেন, এমন-কি, যখন দেশের লোক সুসময়ে দুঃসময়ে তাঁহাদের দ্বারে গিয়া সমাগত হয় তখন বিমুখ হইয়া তাহাদিগকে নিরাশ ও নিরস্ত করিতে চেষ্টা করেন এবং সেই তিরস্কৃত সম্প্রদায় নিজের স্বল্প বুদ্ধি ও সামর্থ্য অনুসারে তাঁহাদের বিনা সাহায্যে যাহা-কিছু করে তাহাকে তুচ্ছ বলিয়া ধিক্‌কার করেন, তবে তাঁহারা আমাদের বর্তমান সমাজকে বর্তমানকালোপযোগী একটি প্রধান শিক্ষা হইতে বঞ্চিত করিয়া থাকেন।

বিশেষত আমাদের দেশে সাহিত্য-সমাজ নাই এবং সমাজের মধ্যে সাহিত্যের চর্চা নাই। য়ুরোপে যেরূপভাবে সামাজিকতার চর্চা হয় তাহাতে যশস্বী লোকেরা নানা উপলক্ষে নানা সভায় উপস্থিত হন। তাঁহারা কেবলমাত্র আপন পরিবার এবং গুটিকতক বন্ধুর নিকটেই প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত নহেন। তাঁহারা নিয়তই সাধারণের সমক্ষে অবস্থিতি করিতেছেন। তাঁহারা স্বদেশীয় নরনারীর নিকটবর্তী, সম্মুখবর্তী, দৃষ্টিগোচর। এইজন্য তাঁহারা যখন লোকান্তরিত হন তখন তাঁহাদের মৃত্যুর ছায়া গোধূলির অন্ধকারের মতো সমস্ত দেশের উপর আসিয়া পড়ে। তাঁহাদের বিচ্ছেদজনিত অভাব সমাজের মধ্যে অত্যন্ত স্পষ্টরূপে দৃশ্যমান হইতে থাকে।

আমাদের সমাজ সেরূপ ঘন নহে। কর্তব্যপরম্পরায় আকৃষ্ট হইয়া পরিবারের বাহিরে বিচরণ করিতে কেহ আমাদিগকে বাধ্য করে না। এবং আমাদের বহিঃসমাজে রমণীদের স্থান না থাকাতে সেখানে সামাজিকতা অত্যন্ত অসম্পূর্ণ। এরূপ অবস্থায় আমাদের দেশের বড়োলোকেরা আপন ঘরের বাহিরে যথেষ্ট এবং যথার্থ-রূপে পরিচিত ও নানা সম্বন্ধে বদ্ধ হইতে পারেন না। তাঁহারা সর্বদাই অন্তরালে থাকেন।

মানুষকে বাদ দিয়া কেবল মানুষের কাজটুকু গ্রহণ করা সাধারণের পক্ষে বড়ো দুঃসাধ্য। উপহারের সঙ্গে সঙ্গে যদি একটি স্নেহহস্ত দেখা যায় তবে সেই উপহারের মূল্য অনেক বাড়িয়া যায় এবং তাহার স্মৃতি হৃদয়ে মুদ্রিত হইয়া যায়। মানুষের পক্ষে মানুষ বড়ো আদরের বড়ো আকাঙক্ষার ধন। মানবহৃদয় ও মানবজীবনের সহিত মিশ্রিত হইয়া যাহা আমাদের নিকট উপস্থিত হয় তাহা অতি সহজে এবং সানন্দে আমরা গ্রহণ করিতে পারি। যখন একটি সজীব মানবকণ্ঠ মধুরস্বরে গান করে তখন সেই গানের সৌন্দর্যের মধ্যে একটি ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মানবহৃদয়ের জীবন্ত সম্পর্ক অনুভব করিয়া আমরা প্রবলতর আনন্দ সম্ভোগ করি– যন্ত্রের মধ্য হইতে অবিকল সেই সংগীত শ্রবণ করিলে আনন্দের অনেকটা হ্রাস হয়। তখন আমরা যন্ত্রবাদককে অথবা সংগীতরচয়িতাকে গানের ভাবোচ্ছ্বাসের সহিত জড়িত করিয়া থাকি। যেমন করিয়া হউক, কর্মের সহিত কর্তাকে অব্যবহিতভাবে দেখিলে কর্মটি সজীব সচেতন হইয়া উঠে এবং আমাদের চেতনার সহিত সহজে মিশ্রিত হয়।

এইজন্য কোনা কার্য আমাদের মনোরম বোধ হইলে তাহার কর্তার সহিত পরিচিত হইবার জন্য আমাদের আগ্রহ জন্মে। নতুবা আমাদের হৃদয় যেন তাহারা পুরা খাদ্যটি পায় না। তাহার অর্ধেক ক্ষুধা থাকিয়া যায়।

আমাদের দেশে সমাজ ভিন্ন ভিন্ন, জাতি ভিন্ন ভিন্ন পরিবার এবং অন্তঃপুর ও বহির্ভবনে বিচ্ছিন্নভাবে বিভক্ত হওয়াতে আমরা মানুষকে নিকটস্থ করিয়া দেখিতে পাই না; তাহার উপহার এবং উপকারগুলি দূর হইতে আমাদের প্রতি নিক্ষিপ্ত হইতে থাকে– আমাদের প্রীতি ও কৃতজ্ঞতা কোনো-একটি সজীব মূর্তিকে অবলম্বন করিয়া আপনাকে সর্বদা সজাগ রাখিতে পারে না।

আমাদের দেশের মহৎ ব্যক্তিদিগকে যাঁহারা বন্ধুভাবে জানেন তাঁহারাই আমাদের এই আকাঙক্ষা তৃপ্ত, এই অভাব দূর করিতে পারেন। তাঁহারাই আমাদের আনন্দকে সম্পূর্ণতা দান করিতে পারেন। তাঁহারা উপকারের সহিত উপকারীকে একত্র করিয়া আমাদের সম্মুখে ধরিতে পারেন এবং সেই উপায়ে আমাদের কৃতজ্ঞতাকে সজীব করিয়া আমাদের হৃদয়ের গ্রহণশক্তি ধারণাশক্তিকে সতেজ করিয়া তুলিতে পারেন। কেবল শুষ্ক সমালোচন, কেবল সভাস্থলে ভাষার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করিয়া কর্তব্যপালন নহে, মহাত্মা ব্যক্তির সহিত সর্বসাধারণের পরিচয়-সাধন করাইয়া দেওয়া একমাত্র বন্ধুর দ্বারাই সম্ভব। অর্থ এবং উৎসাহাভাবে আমাদের দেশের বড়োলোকদের প্রস্তরমূর্তি প্রতিষ্ঠা হয় না বলিয়া মনে আক্ষেপ হয় কিন্তু তদপেক্ষা আক্ষেপের বিষয় এই যে, যাঁহারা তাঁহাদিগকে প্রস্তরমূর্তির অপেক্ষা সজীবতরভাবে আমাদের হৃদয়ে স্থাপিত করিতে পারেন তাঁহারা সে কর্তব্যকে যথেষ্ট গুরুতর মনে করেন না।

মৃত্যুর পরে এই বন্ধুকৃত্য অবশ্যপালনীয় ।

সভাস্থলে মৃতবন্ধুর সম্বন্ধে আলোচনা করা অত্যন্ত কঠিন কার্য। এবং সে কর্তব্য-পালনে যদি কেহ কুণ্ঠিত হন তবে তাঁহাকে দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু লেখায় সে আপত্তি থাকিতে পারে না। যেমন আকারে হউক আমরা প্রিয়বন্ধুর হস্ত হইতে পাব্লিক-বন্ধুর প্রতিমূর্তি প্রত্যাশা করি।

জীবনের যবনিকা অনেক সময় মনুষ্যকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে। মৃত্যু যখন এই যবনিকা ছিন্ন করিয়া দেয় তখন মানুষ সমগ্রভাবে আমাদের নিকট প্রকাশ হয়। প্রতিদিন এবং প্রতিমুহূর্তের ভিতর দিয়া যখন আমরা তাহাকে দেখি তখন তাহাকে কখনো ছোটো কখনো বড়ো, কখনো মলিন কখনো উজ্জ্বল দেখিতে হয়। কিন্তু মৃত্যুর আকাশ ধূলিহীন স্বচ্ছ, নিমেষে নিমেষে তাহার পরিবর্তন নাই। সেই মৃত্যুর মধ্যে স্থাপন করিয়া দেখিলে মানুষকে কতকটা যথার্থভাবে দেখা যাইতে পারে।

যাঁহারা জ্যোতিষ্ক পর্যবেক্ষণ করিয়া থাকেন তাঁহারা বলেন, আমাদের চতুর্দিক্‌বর্তী বায়ুস্তর এই পর্যবেক্ষণের পক্ষে অত্যন্ত বাধাজনক। বিশেষত বায়ুর নিম্নস্তরগুলি সর্বাপেক্ষা অস্বচ্ছ। এইজন্য পর্বতশিখর জ্যোতিষ্ক পর্যবেক্ষণের পক্ষে অনুকূল স্থান।

মানব-জ্যোতিষ্ক পর্যবেক্ষণ্যে আমাদের চতুর্দিকস্থ বায়ুস্তরে অনেক বিঘ্ন দিয়া থাকে। আবর্তিত আলোড়িত সংসারে উড্ডীয়মান বিচিত্র অণুপরমাণু দ্বারা এই বায়ু সর্বদা আচ্ছন্ন। ইহাতে মহত্ত্বের আলোকরশ্মিকে স্থানভ্রষ্ট পরিমাণভ্রষ্ট করিয়া দেখায়। বর্তমানের এই আবিল বায়ুতে অনেক সময়ে কিরণরেখা অযথা বৃহৎ দেখিতেও হয়, কিন্তু সে বৃহত্ত্ব বড়ো অপরিস্ফুট — কিরণটিকে যথাপরিমাণে দেখিতে পাইলে হয়তো তাহার হ্রাস হইতে পারিত কিন্তু তাহার প্রস্ফুটতা উজ্জ্বলতা অনেক পরিমাণে বৃদ্ধি পাইত।

মৃত্যু পর্বতশিখরের ন্যায় আমাদিগকে এই ঘন বায়ুস্তর হইতে স্বচ্ছ আকাশে লইয়া যায়, যেখানে মহত্ত্বের সমস্ত রশ্মিগুলি নির্মল অব্যাহতভাবে আমাদের দৃষ্টিপথে আসিয়া পড়ে।

এই মৃত্যুশিখরে বন্ধুদিগের সাহায্যে আমাদের জ্যোতিষ্কদিগের সহিত আমরা পরিচিত হইতে চাহি। পরিচিত ব্যক্তিকে অন্যের নিকট পরিচিত করা কার্যটি তেমন সহজ নহে। জীবনের ঘটনার মুখ্য-গৌণ নির্বাচন করা বড়ো কঠিন। যিনি আমাদের নিকট সুপরিচিত তাঁহার কোন্‌ অংশ অন্যের নিকট পরিচয়সাধনের পক্ষে সর্বাপেক্ষা উপযোগী তাহা বাহির করা দুরূহ। অনেক কথা অনেক ঘটনাকে সহসা সামান্য মনে হইতে পারে, পরিচয়ের পক্ষে যাহা সামান্য নহে। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের অনেক ক্ষমতাশালী বন্ধু আছেন যাঁহাদের সমালোচনশক্তি নির্বাচনশক্তি গঠনশক্তি সামান্য নহে। সাহিত্যক্ষেত্রে বঙ্কিমের প্রতিমূর্তি স্থাপনের ভার তাঁহাদের লওয়া কর্তব্য। স্বভাবত কৃতঘ্ন বলিয়াই যে আমাদের পাব্লিক অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তাহা নহে, সে ভালো করিয়া বোঝে না, সম্পূর্ণ রূপে জানে না বলিয়াই তাহার কৃতজ্ঞতা জাগ্রত হইয়া উঠে না। মৃত ব্যক্তির কার্যগুলি ভালো করিয়া দেখাইয়া দিতে হইবে এবং তাঁহাকে আমাদের মধ্যে আনিয়া উপস্থিত করিতে হইবে। লেখক বলিয়া নহে , কিন্তু স্নেহপ্রীতিসুখদুঃখে মনুষ্যভাবে তাঁহার লেখার সহিত এবং আমাদের সহস্রের সহিত তাঁহাকে সংযুক্ত করিয়া দিতে হইবে। তাঁহাকে কেবল দেবতা বলিয়া পূজা করা নহে, কিন্তু স্বজাতীয় বলিয়া আমাদের আত্মীয় করিয়া দিতে হইবে।

আমার আমাদের মহৎব্যক্তিদিগকে দেবলোকে নির্বাসিত করিয়া দিই। তাহাতে আমাদের মনুষ্যলোক দরিদ্র এবং গৌরবহীন হইয়া যায়। কিন্তু তাঁহারা যদি রক্তমাংসের মনুষ্যরূপে সুনির্দিষ্ট-পরিচিত হন, সহস্র ভালোমন্দের মধ্যেও আমরা যদি তাঁহাদিগকে মহৎ বলিয়া জানিতে পারি তবেই তাঁহাদের মনুষ্যত্বের অন্তর্নিহিত সেই মহত্ত্বটুকু আমরা যথার্থ অন্তরের সহিত গ্রহণ করিতে পারি, তাঁহাকে ভালোবাসি এবং বিস্মৃত হই না।

এ কাজ কেবল বন্ধুরাই করিতে পারেন। এবং বন্ধুগণ যখন প্রস্তরমূর্তিস্থাপনে উদাসীন পাব্লিককে অকৃতজ্ঞ বলিয়া তিরস্কার করিতেছেন তখন পাব্লিকও তাঁহাদের প্রতি অকৃতজ্ঞতার অভিযোগ আনিতে পারেন। কারণ, তাঁহারা বঙ্কিমের নিকট হইতে কেবলমাত্র উপকার পান নাই, বন্ধুত্ব পাইয়াছেন, তাঁহারা কেবল রচনা পান নাই, রচয়িতাকে পাইয়াছেন। অর্থ থাকিলে প্রস্তরমূর্তি স্থাপন করা সহজ, কিন্তু বঙ্কিমকে বন্ধুভাবে মনুষ্যভাবে মনুষ্যলোকে প্রতিষ্ঠিত করা কেবল তাঁহাদেরই প্রীতি এবং চেষ্টা-সাধ্য। তাঁহাদের বন্ধুকে কেবল তাঁহাদের নিজের স্মরণের মধ্যে আবদ্ধ করিয়া রাখিলে যথার্থ বন্ধুঋণ শোধ করা হইবে না।

জ্যৈষ্ঠ ১৩০১

ফুলজানি

ফুলজানি । শ্রীশ্রীশচন্দ্র মজুমদার-প্রণীত

শহরে বিচিত্র জটিল ঘটনা, লোকজনের গতিবিধি, গাড়িঘোড়া-কলকারখানায় সমস্ত মানুষ ছোটো হইয়া যায়; শহরে কে বাঁচিল কে মরিল, কে খাইল কে না খাইল তাহার খবর কেহ রাখে না। সেখানে বড়োলাট-ছোটোলাটের কীর্তি, চীনে জাপানে লড়াই, অথবা একটা অসামান্য ঘটনা নহিলে সর্বসাধারণের কানেই উঠিতে পারে না।

কিন্তু পল্লীগ্রামে ছোটোবড়ো সকল মানুষ এবং মনুষ্যজীবনের প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত পরিস্ফুট হইয়া উঠে; এমন-কি, নদীনালা পুষ্করিণী মাঠঘাট পশুপক্ষী রৌদ্রবৃষ্টি সকালবিকাল সমস্তই বিশেষরূপে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেখানকার লোকালয়ে সুখ-দুঃখের সামান্যতম লহরীলীলা পর্যন্ত গণনার বিষয় হয়, এবং প্রকৃতির মুখশ্রীর সমস্ত ছায়ালোকসম্পাত একটি ক্ষুদ্র দিগন্তসীমার মধ্যে মহৎ প্রাধান্য লাভ করে।

উপন্যাসের মধ্যেও সেইরূপ শহর-পল্লীগ্রামের প্রভেদ আছে। কোনো উপন্যাসে অসাধারণ মানবপ্রকৃতি, জটিল ঘটনাবলী এবং প্রচণ্ড হৃদয়বৃত্তির সংঘর্ষ বর্ণিত হইয়া থাকে– সেখানে সাধারণ মনুষ্যের প্রাত্যহিক সুখদুঃখ অণু আকারে দৃষ্টির অতীত হইয়া যায়; আবার কোনো উপন্যাস উন্মত্ত ঘটনাবর্তের কোলাহল হইতে, উত্তুঙ্গ কীর্তিস্তম্ভমালার দিগন্তপ্রসারিত ছায়া হইতে, ঘনজনতাবন্যার সর্বগ্রাসী প্রলয়বেগ হইতে বহুদূরে ধুলিশূন্য নির্মল নীলাকাশতলে, শস্যপূর্ণ শ্যামল প্রান্তরপ্রান্তে ছায়াময় বিহঙ্গকূজিত নিভৃত গ্রামের মধ্যে আপন রঙ্গভূমি স্থাপন করে, যেখানে মানবসাধারণের সকল কথাই কানে আসিয়া প্রবেশ করে এবং সকল সুখদুঃখই মমতা আকর্ষণ করিয়া আনে।

শ্রীশবাবুর “ফুলজানি’ এই শেষোক্ত শ্রেণীর উপন্যাস। ইহার স্বচ্ছতা, সরলতা, ইহার ঘটনার বিরলতাই ইহার প্রধান সৌন্দর্য। এবং পল্লীর বাগানের উপর প্রভাতের স্নিগ্ধ সূর্যকিরণ যেমন করিয়া পড়ে; কোথাও-বা চিকন পাতার উপরে ঝিক্‌ঝিক্‌ করিয়া উঠে, কোথাও-বা পাতার ছিদ্র বাহিয়া অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে চুম্‌কি বসাইয়া দেয়, কোথাও-বা জীর্ণ গোয়ালঘরের প্রাঙ্গণের মধ্যে পড়িয়া মলিনতাকে ভূষিত করিতে চেষ্টা করে, কোথাও-বা ঘনছায়াবেষ্টিত দীর্ঘিকাজলের একটিমাত্র প্রান্তে নিকষের উপর সোনার রেখা কষিয়া দেয়– তেমনি এই উপন্যাসের ইতস্তত যেখানে একটু অবকাশ পাইয়াছে সেইখানেই লেখকের একটি নির্মল স্নিগ্ধহাস্য সকৌতুকে প্রবেশ করিয়া সমস্ত লোকালয়দৃশ্যটিকে উজ্জ্বলতায় অঙ্কিত করিয়াছে।

শ্রীশবাবু আমাদিগকে বাংলাদেশের যে-একটি পল্লীতে লইয়া গিয়াছেন সেখানে আমরা সকলের খবর রাখিতে চাই, সকল লোকের সহিত আলাপ করিতে চাই, বিশ্রদ্ধভাবে সকল স্থানে প্রবেশ করিতে চাই, তদপেক্ষা গুরুতর কিছুই প্রত্যাশা করি না। আমরা অভ্রভেদী এমন একটা-কিছু ব্যাপার চাহি না যাহাতে আর-সকলকেই তুচ্ছ করিয়া দেয়, যাহাতে একটি বিস্তীর্ণ শান্তিময় শ্যামল সমগ্রতাকে বিদীর্ণ ও খর্ব করিয়া ফেলে। এখানে সুশুনির মা এবং নিস্তারিণী, ফনুশেখ এবং নায়েবমহাশয় সকলেই আমাদের প্রতিবেশী– পরস্পরের মধ্যে ছোটোবড়ো ভেদ যতই থাক্‌, তথাপি সকলেরই ঘরের কথা আমাদের জিজ্ঞাস্য, প্রতিদিনের সংবাদ আমাদের আলোচ্য বিষয়। এরূপ উপন্যাস সুপরিচিত স্থানের ন্যায় আমাদের মনের পক্ষে অত্যন্ত বিরামদায়ক; এখানে অপ্রত্যাশিত কিছু নাই, মনকে কিছুতে বিক্ষিপ্ত করিয়া দেয় না, প্রত্যেক পদক্ষেপে এক-একটা দুরূহ সমস্যা জাগ্রত হইয়া উঠে না, সৌন্দর্যরস এত সহজে সম্ভোগ করা যায় যে, তাহার জন্য কোনোরূপ কৃত্রিম মালমসলার আবশ্যক করে না।

কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে গ্রন্থকার নিজের প্রতিভায় নিজে সন্তুষ্ট নহেন; তিনি আপনাকে আপনি অতিক্রম করিতে চেষ্টা করেন। অরসিকদের চক্ষে যাহা সহজ তাহা তুচ্ছ; গ্রন্থকার ক্ষমতাশীল লেখক হইয়াও সেই অরসিকমণ্ডলীর নিকট প্রতিপত্তির প্রলোভনটুকু কাটাইতে পারেন নাই। তিনি হঠাৎ এক সময় আপন প্রতিভার স্বাভাবিক গতিকে বলপূর্বক প্রতিহত করিয়া তাহাকে অসাধারণ চরিত্র ও রোমহর্ষণ ঘটনাবলীর মধ্যে অসহায়ভাবে নিক্ষেপ করিয়াছেন। পরিচিত সহজ সৌন্দর্যের সহিত সুন্দরভারে সহজে পরিচয় সাধন করাইয়া দেওয়া অসামান্য ক্ষমতার কাজ; বাংলার লেখকসম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রীশবাবুর সেই অসামান্য ক্ষমতাটি আছে, কিন্তু তিনি তদপেক্ষা আরো অধিক ক্ষমতা প্রকাশ করিয়া পাঠককে চমৎকৃত করিতে চাহেন এবং সেই কাজ করিতে গিয়া নিজের প্রতিভার মধ্যে অনর্থক একটা আত্মবিরোধ বাধাইয়া বসেন। প্রতিভাবর্হিগামী এই দুরাশায় তাঁহার প্রথম-চরিত উপন্যাস “শক্তিকাননে’র মাঝখানে দাবানল জ্বালাইয়া ছারখার করিয়া দিয়াছে এবং দ্বিতীয় গ্রন্থ “ফুলজানি’-রও একটি প্রান্তভাগে তাহার একটি শিখা আপন প্রলয়রসনা বিস্তার করিয়াছে– সৌভাগ্যক্রমে সম্পূর্ণ গ্রাস করিতে পারে নাই।

সার্বভৌম-মহাশয়ের মেয়েটির নাম কালী, তাহার স্বভাবটি যেমন মিষ্ট তেমনি দুষ্ট, তেমনি স্বাভাবিক; গ্রন্থের নায়িকা ফুলকুমারীর প্রতি তাহার যে সুদৃঢ় ভালোবাসা সেও বড়ো স্বাভাবিক; কারণ, ফুল নিতান্ত নিরুপায় ভীরুস্বভাব — এত অধিক নির্জীব যে, পাঠকের হৃদয়াকর্ষণে সে সম্পূর্ণ সক্ষম নহে; কিন্তু এইরূপ নির্ভরপরায়ণ সামর্থ্যহীনেরর জন্যই বলিষ্ঠ তেজস্বী স্বভাব আপনাকে একান্ত বিসর্জন করিয়া থাকে। ফুলকুমারী যদিও গ্রন্থের নায়িকা, কিন্তু তাহাকে একটি শূন্যপটের মতো অবলম্বন করিয়া তাহার উপরে গ্রন্থকার কালীকেই অঙ্কিত করিয়া তুলিয়াছেন। এই সামান্য পল্লীর কালো মেয়েটি অসাধারণ হয় নাই, কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে কখন যে স্থায়িত্ব লাভ করিয়াছে তাহা জানিতেও পারা যায় না। বোসেদের ফুলবাগানের মধ্যে, তালপুকুরের ধারে এই দুটি ক্ষুদ্র বালিকার সখিত্ব আমরা সস্নেহে আনন্দে নিরীক্ষণ করিতেছিলাম; তাহার মধ্যে পাঠশালার ছেলেদের দৌরাত্ম্য-কোলাহল, বালকবিদ্বেষী উত্যক্ত বাগ্‌দিবুড়ির অভিশাপমন্ত্র, মধ্যাহ্নে পক্ষীনীড়লুন্ঠক ছাত্রবৃন্দকর্তৃক আন্দোলিত ঘন আম্রবনের ছায়া এবং নিভৃত দীর্ঘিকার সন্তরণাকুল অগাধশীতল জলের তরঙ্গভঙ্গ মিশ্রিত হইয়া একটি মনোহর সৌন্দর্য সৃষ্টি করিয়াছিল। আমরা পাঠকবর্গ ইহাতেই সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট ছিলাম, ইহার অধিক আর কিছুই প্রার্থনা করি নাই, এমন সময় হরিশপুর পল্লীর সেই স্নিগ্ধ আম্রবনচ্ছায়ার মধ্যে একটুখানি অলৌকিকের ছায়া আসিয়া পড়িল। ফুল স্বপ্নে দেখিল যে, তাহার আসন্ন বিবাহ শুভ হইবে না, এবং বাগ্‌দিবুড়ির মুখেও যেন সেই অভিশাপ শুনিতে পাইল, এবং বটবৃক্ষের শাখা হইতেও সেই অভিশাপ ধ্বনিত হইতে লাগিল। তখনই বুঝিলাম, ফুলকুমারীর বিবাহও সুখের হইবে না, এবং পাঠকের কাব্যরস-সম্ভোগের আনন্দেও অভিশাপ লাগিয়াছে। কিছুকাল পরে ফুলকুমারীও তাহার দুঃস্বপ্ন ভুলিয়া গেল, পাঠকও পুনশ্চ ক্ষুদ্র পল্লীর লোকসমাজে প্রবেশ করিয়া ভুলিয়া গেলেন যে তাঁহার একটা ফাঁড়া আছে।

সেখানে প্রবেশ করিয়া নায়েব মহেশ্বর ঘোষের সহিত সাক্ষাৎ হইল। শান্তিসৌন্দর্যময় পল্লীটির মধ্যে ইনিই রুদ্ররসের অবতারণা করিয়াছেন। রৌদ্রীশক্তিতে গৃহিণী জগদ্ধাত্রী আবার স্বামীকেও অভিভূত করিয়াছেন। দেখিয়া মনে হয় যে, প্রজাবর্গ অসহায় হস্তীর ন্যায় পড়িয়া আছে; নায়েব সিংহের ন্যায় তাহাদের স্কন্ধের উপর চড়িয়া রুধির শোষণ করিতেছেন এবং গৃহিণী জগদ্ধাত্রী, দেবী জগদ্ধাত্রীর ন্যায় এই প্রচণ্ড সিংহের স্কন্ধে পা রাখিয়া বসিয়া আছেন।

ছেলেটির নাম পুরন্দর। যদিচ তিনিই এই গ্রন্থের নায়ক, তথাপি সাধারণ ছেলের মতো পাঠশালা হইতে পলায়ন করিয়া থাকেন, বটগাছে চড়িয়া কাকের ছানা পাড়িয়া আমোদ অনুভব করেন, গাছের ডাল হইতে ঝুপ করিয়া দিঘির জলের মধ্যে পড়িয়া ফুৎকারে আকাশে জলক্ষেপ করিতে করিতে চিতসাঁতার কাটেন– দেখিয়া আমাদের বড়ো আশা হইয়াছিল পাঠকের কপালগুণে ছেলেটি আর যাহাই হউক অসাধারণ হইবে না। কিন্তু “আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায় তাই ভাবি মনে’। কিন্তু সে কথা পরে হইবে।

শান্ত মধুর অথচ দৃঢ়স্বভাব নিস্তারিণীর চরিত্র সুন্দর অঙ্কিত হইয়াছে। এই নিস্তারিণীর কন্যা ফুলকুমারীর সহিত যথাকালে নায়েবমহাশয়ের পুত্র পুরন্দরের বিবাহ সম্পন্ন হইয়া গেল। কিন্তু নায়েবমহাশয় এবং তাঁহার স্ত্রী জগদ্ধাত্রী তাঁহাদের বেহাইনের প্রতি প্রসন্ন ছিলেন না। বিবাহের পর উভয় বৈবাহিক পক্ষে ছোটোখাটো পল্লীযুদ্ধ চলিতে লাগিল। নায়েবমহাশয় পুত্র পুরন্দরকে তাঁহার বেহাইনের প্রভাব হইতে দূরে রাখিবার জন্য সঙ্গে করিয়া আপন কর্মস্থানে লইয়া গেলেন।

এইখানে আসিয়া মৌলভির নিকট হাফেজ পড়িয়া এবং পণ্ডিতের নিকট শাস্ত্রাধ্যয়ন করিয়া পুরন্দর একটা নূতনতর মানুষ হইয়া উঠিল। মানুষের পরিবর্তন কিছুই অসম্ভব নহে এবং পুরন্দরের স্বভাবে পরিবর্তনের প্রচুর কারণও ছিল। কিন্তু আমরা যে গ্রামদৃশ্য, যে সরল লোকসমাজ, যে অনতিতরঙ্গিত ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে এতক্ষণ কালযাপন করিতেছিলাম নূতনীকৃত পুরন্দর তাহাকে যেন অত্যন্ত অতিক্রম করিবার উপক্রম করিল। পুরন্দর ভালো ছেলে হউক, সে ভালো; তাহার দানধ্যানে মতি হউক, হরিনামে প্রীতি হউক, শাস্ত্রে বুৎপত্তি এবং হাফেজে অনুরাগ বাড়িতে থাক্‌, আমাদের দেশে সচরাচর যেরূপ ভাবে অনেক লোকের মনে সংসার-বৈরাগ্যের উদয় হইয়া থাকে, পুরন্দরের হৃদয়েও সেইরূপ বৈরাগ্যের সঞ্চার হউক তাহাতে আমাদের আপত্তি নাই। কিন্তু তাহার বেশি কিছু হইতে গেলে তাহাকে আর সহ্য করা যায় না। কারণ, “ফুলজানি’ উপন্যাসকে সম্পূর্ণতা দেওয়াই পুরন্দরচরিত্রের একমাত্র সার্থকতা। অসাধারণ মহত্ত্ব প্রকাশ করিতে গিয়া যদি তিনি উপন্যাস নষ্ট করেন তবে আমরা তাহাকে মার্জনা করিতে পারিব না। প্রথম পরিচ্ছেদের আরম্ভ হইতে “ফুলজানি’তে যে-এক স্বচ্ছ সুন্দর সারল্য-স্রোত প্রবাহিত হইয়া আসিতেছিল পুরন্দর হঠাৎ অসাধারণ উচ্চ হইয়া উঠিয়া তাহাকেই প্রতিহত করিয়া দিয়াছে। গ্রন্থকর্তা পুরন্দর সম্বন্ধে লিখিতেছেন–

“বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাহার মনে যে পরিবর্তন ঘটিতেছিল তাহার গতি এবং প্রকৃতি বিষাদের দিকে। মানুষ সংসারে, যে কারণেই হউক, দুঃখকষ্ট সহিতে আসিয়াছে, এই রকম তাহার মনের ভাব। আত্মজীবনের একটা লক্ষ্য তাহার কখনো স্থির হয় নাই কিন্তু আপনার বিষয়ে ভাবিতে বসিলেই তাহার মনে হইত, অতিঘোর আঁধারে তাহার ভবিষ্যৎ সমাচ্ছন্ন। মনের এই অবস্থায় আনন্দের ভিতরেও সে মনশ্চক্ষে দেখিত, যে কেহ তাহার সঙ্গে সম্বন্ধবিশিষ্ট সকলেরই জীবন অল্পবিস্তর দুঃখযন্ত্রণাময়।’

পুরন্দরের এই অনাসৃষ্টি দুঃখভাবের গূঢ় কারণ অনতিপরেই একটি ঘটনায় প্রকাশ পাইয়াছে। একদা তিনি এবং তাঁহার বন্ধু ব্রজ বেড়াইতে গিয়া দেখিলেন গঙ্গাতীরে এক শালিকের কোটরের নিকট এক বিষধর সাপের সহিত শুকদম্পতির যুদ্ধ চলিতেছে। সেই পক্ষীদের নিরীহ শাবকগুলি এখনই সর্পের কবলস্থ হইবে মনে করিয়া পুরন্দরের চক্ষে এক ফোঁটা জল আসিল। তাহার সঙ্গী ব্রজ অসাধারণ বালক নহে, এইজন্য সে এক ফোঁটা জল না ফেলিয়া একখণ্ড লোষ্ট্র নিক্ষেপ করিল। তাহাতে অধিক কাজ হইল, আহত সর্পটা জলে পড়িয়া গেল। ব্রজ পুনশ্চ তাহার প্রতি লোষ্ট্রবর্ষণ করাতে পুরন্দর তাহা সহিতে পারিল না, বারণ করিল। —

“সে ভাবিতেছিল খাদ্য-খাদকের অহি নকুলের যে বিষম বিদ্বেষ ভাব, ইহার জন্য কে দায়ী? ভগবানের সংসার প্রেমময় না হইয়া কেন এমন হিংসাদ্বেষসংকুল হইল?

ইত্যাদি ইত্যাদি। এই-সকল বক্তৃতা শুনিয়া —

“ব্রজ সহসা কোনো উত্তর দিতে পারিল না, কিন্তু তাহার প্রিয় সুহৃদের হৃদয়ে ব্যথা কোন্‌খানে, বুঝিতে পারিল। বুঝিল, পুরনের দুঃখ ব্যক্তিগত নহে।’

টার্পিন তেল মালিশ করিলে যে-সকল ব্যথা সারে, অভাব মোচন হইলে যে-সকল দুঃখ দূর হয়, উপস্থিতক্ষেত্রে সেই-সকল ব্যথা এবং সেই-সকল দুঃখই ভালো। প্রচলিত প্রবাদে গরিবের ছেলের ঘোড়ারোগকে যেরূপ অনর্থের হেতু বলিয়াছে, বাংলাদেশীয় পল্লীর ছেলের এ-সকল বড়ো বড়ো ব্যথা এবং উঁচুদরের দুঃখও সেইরূপ সর্বনাশের কারণ।

পুরন্দরের পিতা পুরন্দরকে লইয়া বাড়ি ফিরিবার সময় পথিমধ্যে অসন্তুষ্ট প্রজাগণ কর্তৃক নিহত হইলেন, তাঁহার স্ত্রী জগদ্ধাত্রী সহমৃতা হইলেন। পুরন্দর এই আঘাতে পীড়িত হইয়া বাড়ি গেলেন, সেখানে তাহার স্ত্রীর শুশ্রূষায় জীবন লাভ করিলেন, এবং তাঁহাদিগকে সংসারে প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিয়া বিধবা নিস্তারিণী শ্রীক্ষেত্রে চলিয়া গেলেন।

এইখানে গ্রন্থ শেষ হইল, কিন্তু গ্রন্থকার ক্ষান্ত হইলেন না, তিনি আবার শেষকে নিঃশেষ করিতে বসিলেন। অকস্মাৎ একদল যবন এবং যবনী মিলিয়া কালী এবং ফুলকে চুরি করিয়া লইয়া গেল– কালী জলে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া মরিল– ফুল সিরাজউদ্দৌলার অন্তঃপুরে প্রবেশ করিল, পুরন্দর তাহাকে উদ্ধার করিতে গেল এবং উভয়ে ঘাতকহস্তে বিনষ্ট হইল।

এ-সমস্ত কেন? আগাগোড়া গল্পের সহিত ইহার কী যোগ? প্রথম হইতে এমন কী সকল অনিবার্য কারণ একত্র হইয়াছিল যাহাতে গ্রন্থের এই বিচিত্র পরিণাম অবশ্যম্ভব হইয়া উঠিয়াছিল? গ্রন্থকার যদি বলিতেন “গ্রামে হঠাৎ একটা মড়ক হইল এবং সকলেই মরিয়া গেল’ তবে কাব্য-হিসাবে তাহার সহিত ইহার প্রভেদ কী? ১৬৬ পাতায় বইখানি সমাপ্ত। ১২২ পাতায় নিস্তারিণী তীর্থে গেলেন। তাহার পর ৪৪টি পত্রে গ্রন্থকার হঠাৎ একটা সম্পূর্ণ নূতন কাণ্ড ঘটাইয়া পাঠকগণকে চমৎকৃত করিয়া দিলেন। পূর্বে ইহার কোনো সূত্রপাত ছিল না, ফুলকুমারীর চরিত্রের সঙ্গেও ইহার কোনো যোগ ছিল না। এতক্ষণ গ্রন্থকার ১২২ পৃষ্ঠায় যে একটি সুন্দর সরল সমগ্র কাব্য গড়িয়া তুলিয়াছিলেন, অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাসবশত শেষের ৪৪ পৃষ্ঠায় অতি সংক্ষেপে একটি আকস্মিক বজ্র নির্মাণ করিয়া তাহার মস্তকে নিক্ষেপ করিলেন ।

অগ্রহায়ণ ১৩০১

বঙ্কিমচন্দ্র

যেকালে বঙ্কিমের নবীনা প্রতিভা লক্ষ্মীরূপে সুধাভাণ্ড হস্তে লইয়া বাংলাদেশের সম্মুখে আবির্ভূত হইলেন তখনকার প্রাচীন লোকেরা বঙ্কিমের রচনাকে সসম্মান আনন্দের সহিত অভ্যর্থনা করেন নাই।

সেদিন বঙ্কিমকে বিস্তর উপহাস গ্লানি সহ্য করিতে হইয়াছিল। তাঁহার উপর একদল লোকের সুতীব্র বিদ্বেষ ছিল, এবং ক্ষুদ্র যে লেখকসম্প্রদায় তাঁহার অনুকরণের বৃথা চেষ্টা করিত তাহারাই আপন ঋণ গোপন করিবার প্রয়াসে তাঁহাকে সর্বাপেক্ষা অধিক গালি দিত।

আবার এখনকার যে নূতন পাঠক ও লেখক-সম্প্রদায় উদ্‌ভূত হইয়াছেন তাঁহারাও বঙ্কিমের পরিপূর্ণ প্রভাব হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিবার অবকাশ পান নাই তাঁহারা বঙ্কিমের গঠিত সাহিত্যভূমিতেই একেবারে ভূমিষ্ঠ হইয়াছেন, বঙ্কিমের নিকট যে তাঁহারা কতরূপে কতভাবে ঋণী তাহার হিসাব বিচ্ছিন্ন করিয়া লইয়া তাঁহারা দেখিতে পাইতেছেন না।

কিন্তু বর্তমান লেখকের সৌভাগ্যক্রমে আমাদের সহিত যখন বঙ্কিমের প্রথম সাক্ষাৎকার হয় তখন সাহিত্যপ্রভৃতিসম্বন্ধে কোনোরূপ পূর্বসংস্কার আমাদের মনে বদ্ধমূল হইয়া যায় নাই এবং বর্তমান কালের নূতন ভাবপ্রবাহও আমাদের নিকট অপরিচিত অনভ্যস্ত ছিল। তখন বঙ্গসাহিত্যেরও যেমন প্রাতঃসন্ধ্যা উপস্থিত আমাদেরও সেইরূপ বয়ঃসন্ধিকাল। বঙ্কিম বঙ্গসাহিত্যে প্রভাতের সূর্যোদয় বিকাশ করিলেন, আমাদের হৃৎপদ্ম সেই প্রথম উদ্‌ঘাটিত হইল।

পূর্বে কী ছিল এবং পরে কী পাইলাম তাহা দুই কালের সন্ধিস্থলে দাঁড়াইয়া আমরা এক মুহূর্তেই অনুভব করিতে পারিলাম। কোথায় গেল সেই অন্ধকার,সেই একাকার, সেই সুপ্তি, কোথায় গেল সেই বিজয়-বসন্ত, সেই গোলেবকাগুলি, সেই-সব বালক-ভুলানো কথা– কোথা হইতে আসিল এত আলোক, এত আশা, এত সংগীত, এত বৈচিত্র্য। বঙ্গদর্শন যেন তখন আষাঢ়ের প্রথম বর্ষার মতো “সমাগতো রাজবদুন্নত-ধ্বনিঃ’। এবং মুষলধারে ভাববর্ষণে বঙ্গসাহিত্যের পূর্ববাহিনী পশ্চিমবাহিনী সমস্ত নদী-নির্ঝরিণী অকস্মাৎ পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত হইয়া যৌবনের আনন্দবেগে ধাবিত হইতে লাগিল। কত কাব্য নাটক উপন্যাস কত প্রবন্ধ কত সমালোচনা কত মাসিকপত্র কত সংবাদপত্র বঙ্গভূমিকে জাগ্রত প্রভাতকলরবে মুখরিত করিয়া তুলিল। বঙ্গভাষা সহসা বাল্যকাল হইতে যৌবনে উপনীত হইল।

আমরা কিশোরকালের বঙ্গসাহিত্যের মধ্যে ভাবের সেই নবসমাগমের মহোৎসব দেখিয়াছিলাম; সমস্ত দেশ ব্যাপ্ত করিয়া যে-একটি আশার আনন্দ নূতন হিল্লোলিত হইয়াছিল তাহা অনুভব করিয়াছিলাম– সেইজন্য আজ মধ্যে মধ্যে নৈরাশ্য উপস্থিত হয়। মনে হয় সেদিন হৃদয়ে যে অপরিমেয় আশার সঞ্চার হইয়াছিল তদনুরূপ ফল লাভ করিতে পারি নাই। সে জীবনের বেগ আর নাই। কিন্তু এ নৈরাশ্য অনেকটা অমূলক। প্রথম-সমাগমের প্রবল উচ্ছ্বাস কখনো স্থায়ী হইতে পারে না। সেই নব আনন্দ নবীন আশার স্মৃতির সহিত বর্তমানের তুলনা করাই অন্যায়। বিবাহের প্রথম দিনে যে রাগিণীতে বংশীধ্বনি হয় সে রাগিণী চিরদিনের নহে। সেদিন কেবল অবিমিশ্র আনন্দ এবং আশা, তাহার পর হইতে বিচিত্র কর্তব্য, মিশ্রিত দুঃখসুখ, ক্ষুদ্র বাধাবিঘ্ন, আবর্তিত বিরহমিলন– তাহার পর হইতে গভীর গম্ভীর ভাবে নানা পথ বাহিয়া নানা শোকতাপ অতিক্রম করিয়া সংসারপথে অগ্রসর হইতে হইবে, প্রতিদিন আর সে নহবত বাজিবে না। তথাপি সেই একদিনের উৎসবের স্মৃতি কঠোর কর্তব্যপথে চিরদিন আনন্দ সঞ্চার করে।

বঙ্কিমচন্দ্র স্বহস্তে বঙ্গভাষার সহিত যেদিন নবযৌবনপ্রাপ্ত ভাবের পরিণয় সাধন করাইয়াছিলেন সেইদিনের সর্বব্যাপী প্রফুল্লতা এবং আনন্দ-উৎসব আমাদের মনে আছে। সেদিন আর নাই। আজ নানা লেখা নানা মত নানা আলোচনা আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে– আজ কোনোদিন-বা ভাবের স্রোত মন্দ হইয়া আসে কোনোদিন- বা অপেক্ষাকৃত পরিপুষ্ট হইয়া উঠে।

এইরূপই হইয়া থাকে এবং এইরূপই হওয়া আবশ্যক। কিন্তু কাহার প্রসাদে এরূপ হওয়া সম্ভব হইল সে কথা স্মরণ করিতে হইবে। আমরা আত্মাভিমানে সর্বদাই তাহা ভুলিয়া যাই।

ভুলিয়া যে যাই তাহার প্রথম প্রমাণ, রামমোহন রায়কে আমাদের বর্তমান বঙ্গদেশের নির্মাণকর্তা বলিয়া আমরা জানি না। কী রাজনীতি, কী বিদ্যাশিক্ষা, কী সমাজ, কী ভাষা– আধুনিক বঙ্গদেশে এমন কিছুই নাই রামমোহন রায় স্বহস্তে যাহার সূত্রপাত করিয়া যান নাই। এমন-কি, আজ প্রাচীন শাস্ত্রালোচনার প্রতি, দেশের যে এক নূতন উৎসাহ দেখা যাইতেছে রামমোহন রায় তাহারও পথপ্রদর্শক। যখন নব শিক্ষাভিমানে স্বভাবতই পুরাতন শাস্ত্রের প্রতি অবজ্ঞা জন্মিবার সম্ভাবনা, তখন রামমোহন রায় সাধারণের অনধিগম্য বিস্মৃতপ্রায় বেদ-পুরাণ-তন্ত্র হইতে সারোদ্ধার করিয়া প্রাচীন শাস্ত্রের গৌরব উজ্জ্বল রাখিয়াছিলেন।

বঙ্গদেশ অদ্য সেই রামমোহন রায়ের নিকট কিছুতেই হৃদয়ের সহিত কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতে চাহে না।

রামমোহন বঙ্গসাহিত্যকে গ্রানিট-স্তরের উপর স্থাপন করিয়া নিমজ্জনদশা হইতে উন্নত করিয়া তুলিয়াছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র তাহারই উপর প্রতিভার প্রবাহ ঢালিয়া স্তরবদ্ধ পলিমৃত্তিকা ক্ষেপণ করিয়া গিয়াছেন। আজ বাংলা ভাষা কেবল দৃঢ় বাসযোগ্য নহে, উর্বরা শস্যশ্যামলা হইয়া উঠিয়াছে। বাসভূমি যথার্থ মাতৃভূমি হইয়াছে। এখন আমাদের মনের খাদ্য প্রায় ঘরের দ্বারেই ফলিয়া উঠিতেছে।

মাতৃভাষার বন্ধ্যদশা ঘুচাইয়া যিনি তাহাকে এমন গৌরবশালিনী করিয়া তুলিয়াছেন তিনি বাঙালির যে কী মহৎ কী চিরস্থায়ী উপকার করিয়াছেন সে কথা যদি কাহাকেও বুঝাইবার আবশ্যক হয় তবে তদপেক্ষা দুর্ভাগ্য আর কিছুই নাই। তৎপূর্বে বাংলাকে কেহ শ্রদ্ধাসহকারে দেখিত না। সংস্কৃত পণ্ডিতেরা তাহাকে গ্রাম্য এবং ইংরেজি পণ্ডিতেরা বর্বর জ্ঞান করিতেন। বাংলা ভাষায় যে কীর্তি উপার্জন করা যাইতে পারে সে কথা তাঁহাদের স্বপ্নের অগোচর ছিল। এইজন্য কেবল স্ত্রীলোক ও বালকদের জন্য অনুগ্রহপূর্বক দেশীয় ভাষায় তাঁহারা সরল পাঠ্য-পুস্তক রচনা করিতেন। সেই-সকল পুস্তকের সরলতা ও পাঠযোগ্যতা সম্বন্ধে যাঁহাদের জানিবার ইচ্ছা আছে তাঁহারা রেভারেণ্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়-রচিত পূর্বতন এন্ট্রেন্স-পাঠ্য বাংলা গ্রন্থে দন্তস্ফুট করিবার চেষ্টা করিয়া দেখিবেন। অসম্মানিত বঙ্গভাষাও তখন অত্যন্ত দীন মলিন ভাবে কালযাপন করিত। তাহার মধ্যে যে কতটা সৌন্দর্য কতটা মহিমা প্রচ্ছন্ন ছিল তাহা তাহার দারিদ্র্য ভেদ করিয়া স্ফূর্তি পাইত না। যেখানে মাতৃভাষার এত অবহেলা সেখানে মানবজীবনের শুষ্কতা শূন্যতা দৈন্য কেহই দূর করিতে পারে না।

এমন সময়ে তখনকার শিক্ষিতশ্রেষ্ঠ বঙ্কিমচন্দ্র আপনার সমস্ত শিক্ষা সমস্ত অনুরাগ সমস্ত প্রতিভা উপহার লইয়া সেই সংকুচিতা বঙ্গভাষার চরণে সমর্পণ করিলেন; তখনকার কালে কী যে অসামান্য কাজ করিলেন তাহা তাঁহারই প্রসাদে আজিকার দিনে আমরা সম্পূর্ণ অনুমান করিতে পারি না।

তখন তাঁহার অপেক্ষা অনেক অল্পশিক্ষিত প্রতিভাহীন ব্যক্তি ইংরাজিতে দুই ছত্র লিখিয়া অভিমানে স্ফীত হইয়া উঠিতেন। ইংরাজি সমুদ্রে তাঁহারা যে কাঠবিড়ালির মতো বালির বাঁধ নির্মাণ করিতেছেন সেটুকু বুঝিবার শক্তিও তাঁহাদের ছিল না।

বঙ্কিমচন্দ্র যে সেই অভিমান সেই খ্যাতির সম্ভাবনা অকাতরে পরিত্যাগ করিয়া তখনকার বিদ্বজ্জনের অবজ্ঞাত বিষয়ে আপনার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করিলেন ইহা অপেক্ষা বীরত্বের পরিচয় আর কী হইতে পারে! সম্পূর্ণ ক্ষমতাসত্ত্বেও আপন সমযোগ্য লোকের উৎসাহ এবং তাঁহাদের নিকট প্রতিপত্তির প্রলোভন পরিত্যাগ করিয়া একটি অপরীক্ষিত অনাদৃত অন্ধকার পথে আপন নবীন জীবনের সমস্ত আশা-উদ্যম-ক্ষমতাকে প্রেরণ করা কত বিশ্বাস এবং কত সাহসের বলে হয় তাহার পরিমাণ করা সহজ নহে।

কেবল তাহাই নহে। তিনি আপনার শিক্ষাগর্বে বঙ্গভাষার প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ করিলেন না, একেবারেই শ্রদ্ধা প্রকাশ করিলেন। যত-কিছু আশা আকাঙক্ষা সৌন্দর্য-প্রেম মহত্ত্বভক্তি স্বদেশানুরাগ, শিক্ষিত পরিণত বুদ্ধির যত-কিছু শিক্ষালব্ধ চিন্তাজাত ধনরত্ন সমস্তই অকুণ্ঠিতভাবে বঙ্গভাষার হস্তে অর্পণ করিলেন। পরম সৌভাগ্য-গর্বে সেই অনাদর-মলিন ভাষার মুখে সহসা অপূর্ব লক্ষ্মীশ্রী প্রস্ফুটিত হইয়া উঠিল।

তখন, পূর্বে যাঁহারা অবহেলা করিয়াছিলেন তাঁহারা বঙ্গভাষার যৌবনসৌন্দর্যে আকৃষ্ট হইয়া একে একে নিকটবর্তী হইতে লাগিলেন। বঙ্গসাহিত্য প্রতিদিন গৌরবে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিতে লাগিল।

বঙ্কিম যে গুরুতর ভার লইয়াছিলেন তাহা অন্য কাহারো পক্ষে দুঃসাধ্য হইত। প্রথমত, তখন বঙ্গভাষা যে অবস্থায় ছিল তাহাকে যে শিক্ষিত ব্যক্তির সকলপ্রকার ভাবপ্রকাশে নিযুক্ত করা যাইতে পারে ইহা বিশ্বাস ও আবিষ্কার করা বিশেষ ক্ষমতার কার্য। দ্বিতীয়ত, যেখানে সাহিত্যের মধ্যে কোনো আদর্শ নাই, যেখানে পাঠক অসামান্য উৎকর্ষের প্রত্যাশাই করে না, যেখানে লেখক অবহেলাভরে লেখে এবং পাঠক অনুগ্রহের সহিত পাঠ করে, যেখানে অল্প ভালো লিখিলেই বাহবা পাওয়া যায় এবং মন্দ লিখিলেও কেহ নিন্দা করা বাহুল্য বিবেচনা করে, সেখানে কেবল আপনার অন্তরস্থিত উন্নত আদর্শকে সর্বদা সম্মুখে বর্তমান রাখিয়া সামান্য পরিশ্রমে সুলভখ্যাতিলাভের প্রলোভন সম্বরণ করিয়া অশ্রান্ত যত্নে অপ্রতিহত উদ্যমে দুর্গম পরিপূর্ণতার পথে অগ্রসর হওয়া অসাধারণ মাহাত্ম্যের কর্ম। চতুর্দিকব্যাপী উৎসাহহীন জীবনহীন জড়ত্বের মতো এমন গুরুভার আর কিছুই নেই; তাহার নিয়তপ্রবল ভারাকর্ষণ-শক্তি অতিক্রম করিয়া উঠা যে কত নিরলস চেষ্টা ও বলের কর্ম তাহা এখনকার সাহিত্যব্যবসায়ীরাও কতকটা বুঝিতে পারেন, তখন যে আরো কত কঠিন ছিল তাহা কষ্টে অনুমান করিতে হয়। সর্বত্রই যখন শৈথিল্য এবং সে-শৈথিল্য যখন নিন্দিত হয় না তখন আপনাকে নিয়মব্রতে বন্ধ করা মহাসত্ত্বলোকের দ্বারাই সম্ভব।

বঙ্কিম আপনার অন্তরের সেই আদর্শ অবলম্বন করিয়া প্রতিভাবলে যে কার্য করিলেন তাহা অত্যাশ্চর্য। বঙ্গদর্শনের পূর্ববর্তী এবং তাহার পরবর্তী বঙ্গসাহিত্যের মধ্যে যে উচ্চনীচতা তাহা অপরিমিত। দার্জিলিং হইতে যাঁহারা, কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরমালা দেখিয়াছেন তাঁহারা জানেন সেই অভ্রভেদী শৈলসম্রাটের উদয়রবিরশ্মি-সমুজ্জ্বল তুষারকিরীট চতুর্দিকের নিস্তব্ধ গিরি পারিষদবর্গের কত ঊর্ধ্বে সমুত্থিত হইয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্রের পরবর্তী বঙ্গসাহিত্য সেইরূপ আকস্মিক অত্যুন্নতি লাভ করিয়াছে; একবার সেইটি নিরীক্ষণ এবং পরিমাণ করিয়া দেখিলেই বঙ্কিমের প্রতিভার প্রভূত বল সহজে অনুমান করা যাইবে।

বঙ্কিম নিজে বঙ্গভাষাকে যে শ্রদ্ধা অর্পণ করিয়াছেন অন্যেও তাহাকে সেইরূপ শ্রদ্ধা করিবে ইহাই তিনি প্রত্যাশা করিতেন। পূর্ব-অভ্যাসবশত সাহিত্যের সহিত যদি কেহ ছেলেখেলা করিতে আসিত তবে বঙ্কিম তাহার প্রতি এমন দণ্ড বিধান করিতেন যে দ্বিতীয়বার সেরূপ স্পর্ধা দেখাইতে সে আর সাহস করিত না।

তখন সময় আরো কঠিন ছিল। বঙ্কিম নিজে দেশব্যাপী একটি ভাবের আন্দোলন উপস্থিত করিয়াছিলেন। সেই আন্দোলনের প্রভাবে কত চিত্ত চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল, এবং আপন ক্ষমতার সীমা উপলব্ধি করিতে না পারিয়া কত লোক যে এক লম্ফে লেখক হইবার চেষ্টা করিয়াছিল তাহার সংখ্যা নাই। লেখার প্রয়াস জাগিয়া উঠিয়াছে অথচ লেখার উচ্চ আদর্শ তখনো দাঁড়াইয়া যায় নাই। সেই সময় সব্যসাচী বঙ্কিম এক হস্ত গঠনকার্যে এক হস্ত নিবারণকার্যে নিযুক্ত রাখিয়াছিএলন। এক দিকে অগ্নি জ্বালাইয়া রাখিতেছিলেন আর-এক দিকে ধূম এবং ভস্মরাশি দূর করিবার ভার নিজেই লইয়াছিলেন।

রচনা এবং সমালোচনা এই উভয়কার্যের ভার বঙ্কিম একাকী গ্রহণ করাতেই বঙ্গসাহিত্য এত সত্বর এমন দ্রুত পরিণতি লাভ করিতে সক্ষম হইয়াছিল।

এই দুষ্কর ব্রতানুষ্ঠানের যে ফল তাহাও তাঁহাকে ভোগ করিতে হইয়াছিল। মনে আছে, বঙ্গদর্শনে যখন তিনি সমালোচক-পদে আসীন ছিলেন তখন তাঁহার ক্ষুদ্র শত্রুর সংখ্যা অল্প ছিল না। শত শত অযোগ্য লোক তাঁহাকে ঈর্ষা করিত এবং তাঁহার শ্রেষ্ঠত্ব অপ্রমাণ করিবার চেষ্টা করিতে ছাড়িত না।

কণ্টক যতই ক্ষুদ্র হউক তাহার বিদ্ধ করিবার ক্ষমতা আছে এবং কল্পনাপ্রবণ লেখকদিগের বেদনাবোধও সাধারণের অপেক্ষা কিছু অধিক। ছোটো ছোটো দংশনগুলি যে বঙ্কিমকে লাগিত না, তাহা নহে, কিন্তু কিছুতেই তিনি কর্তব্যে পরাঙ্‌মুখ হন নাই। তাঁহার অজেয় বল, কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠা এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস ছিল। তখন জানিতেন, বর্তমানের কোনো উপদ্রব তাঁহার মহিমাকে আচ্ছন্ন করিতে পারিবে না, সমস্ত ক্ষুদ্র শত্রুর ব্যূহ হইতে তিনি অনায়াসে নিষ্ক্রমণ করিতে পারিবেন। এইজন্য চিরকাল তিনি অম্লানমুখে বীরদর্পে অগ্রসর হইয়াছেন, কোনোদিন তাঁহাকে রথবেগ খর্ব করিতে হয় নাই।

সাহিত্যের মধ্যেও দুই শ্রেণীর যোগী দেখা যায়, ধ্যানযোগী এবং কর্মযোগী। ধ্যানযোগী একান্তমনে বিরলে ভাবের চর্চা করেন,তাঁহার রচনাগুলি সংসারী লোকের পক্ষে যেন উপরি-পাওনা, যেন যথালাভের মতো।

কিন্তু বঙ্কিম সাহিত্যে কর্মযোগী ছিলেন। তাঁহার প্রতিভা আপনাতে আপনি স্থিরভাবে পর্যাপ্ত ছিল না। সাহিত্যের যেখানে যাহা-কিছু অভাব ছিল সর্বত্রই তিনি আপনার বিপুল বল এবং আনন্দ লইয়া ধাবমান হইতেন। কী কাব্য, কী বিজ্ঞান, কী ইতিহাস, কী ধর্মতত্ত্ব যেখানে যখনই তাঁহাকে আবশ্যক হইত সেখানে তখনই তিনি সম্পূর্ণ প্রস্তুত হইয়া দেখা দিতেন। নবীন বঙ্গসাহিত্যের মধ্যে সকল বিষয়েই আদর্শ স্থাপন করিয়া যাওয়া তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল। বিপন্ন বঙ্গভাষা আর্তস্বরে যেখানেই তাঁহাকে আহ্বান করিয়াছে সেখানেই তিনি প্রসন্ন চতুর্ভূজ মূর্তিতে দর্শন দিয়াছেন।

কিন্তু তিনি যে কেবল অভয় দিতেন, সান্ত্বনা দিতেন, অভাব পূর্ণ করিতেন তাহা নহে, তিনি দর্পহারীও ছিলেন। এখন যাঁহারা বঙ্গসাহিত্যের সারথ্য স্বীকার করিতে চান তাঁহারা দিনে নিশীথে বঙ্গদেশকে অত্যুক্তিপূর্ণ স্তুতিবাক্যে নিয়ত প্রসন্ন রাখিতে চেষ্টা করেন, কিন্তু বঙ্কিমের বাণী কেবল স্তুতিবাদিনী ছিল না, খড়গধারিণীও ছিল। বঙ্গদেশ যদি অসাড় প্রাণহীন না হইত তবে “কৃষ্ণচরিত্রে’ বর্তমান পতিত হিন্দুসমাজ ও বিকৃত হিন্দুধর্মের উপর যে অস্ত্রাঘাত আছে সে আঘাতে বেদনাবোধ এবং কথঞ্চিৎ চেতনা লাভ করিত। বঙ্কিমের ন্যায় তেজস্বী প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি ব্যতীত আর কেহই লোকাচার-দেশাচারের বিরুদ্ধে এরূপ নির্ভীক স্পষ্ট উচ্চারণে আপন মত প্রকাশ করিতে সাহস করিত না। এমন-কি, বঙ্কিম প্রাচীন হিন্দু-শাস্ত্রের প্রতি ঐতিহাসিক বিচার প্রয়োগ করিয়া তাহার সার এবং অসার ভাগ পৃথক্‌করণ, তাহার প্রামাণ্য এবং অপ্রামাণ্য অংশের বিশ্লেষণ এবং নিঃসংকোচে করিয়াছেন যে এখনকার দিনে তাহার তুলনা পাওয়া কঠিন।

বিশেষত দুই শত্রুর মাঝখান দিয়া তাঁহাকে পথ কাটিয়া চলিতে হইয়াছে। এক দিকে যাঁহারা অবতার মানেন না তাঁহারা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি দেবত্বারোপে বিপক্ষ হইয়া দাঁড়ান। অন্য দিকে যাঁহারা শাস্ত্রের প্রত্যেক অক্ষর এবং লোকাচারের প্রত্যেক প্রথাকে অভ্রান্ত বলিয়া জ্ঞান করেন তাঁহারাও, বিচারের লৌহাস্ত্র দ্বারা শাস্ত্রের মধ্য হইতে কাটিয়া কাটিয়া কুঁদিয়া কুঁদিয়া মহত্তম মনুষ্যের আদর্শ অনুসারে দেবতা-গঠনকার্যে বড়ো প্রসন্ন হন নাই। এরূপ অবস্থায় অন্য কেহ হইলে কোনো এক পক্ষকে সর্বতোভাবে আপন দলে পাইতে ইচ্ছা করিতেন। কিন্তু সাহিত্যমহারথী বঙ্কিম দক্ষিণে বামে উভয় পক্ষের প্রতিই তীক্ষ্ণ শরচালন করিয়া অকুণ্ঠিতভাবে অগ্রসর হইয়াছেন– তাঁহার নিজের প্রতিভা কেবল তাঁহার একমাত্র সহায় ছিল। তিনি যাহা বিশ্বাস করিয়াছেন তাহা স্পষ্ট ব্যক্ত করিয়াছেন– বাক্‌চাতুরী দ্বারা আপনাকে বা অন্যকে বঞ্চনা করেন নাই।

কল্পনা এবং কাল্পনিকতা দুইয়ের মধ্যে একটা মস্ত প্রভেদ আছে। যথার্থ কল্পনা, যুক্তি সংযম এবং সত্যের দ্বারা সুনির্দিষ্ট আকারবদ্ধ– কাল্পনিকতার মধ্যে সত্যের ভান আছে মাত্র, কিন্তু তাহা অদ্ভুত আতিশয্যে অসংগতরূপে স্ফীতকায়। তাহার মধ্যে যেটুকু আলোকের লেশ আছে ধূমের অংশ তাহার শতগুণ। যাহাদের ক্ষমতা অল্প তাহারা সাহিত্যে প্রায় এই প্রধূমিত কাল্পনিকতার আশ্রয় লইয়া থাকে– কারণ, ইহা দেখিতে প্রকাণ্ড কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অত্যন্ত লঘু। এক শ্রেণীর পাঠকেরা এইরূপ ভূরিপরিমাণ কৃত্রিম কাল্পনিকতার নৈপুণ্যে মুগ্ধ ও অভিভূত হইয়া পড়েন এবং দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলায় সেই শ্রেণীর পাঠক বিরল নহে।

এইরূপ অপরিমিত অসংযত কল্পনার দেশে বঙ্কিমের ন্যয় আদর্শ আমাদের পক্ষে অত্যন্ত মূল্যবান। “কৃষ্ণচরিত্রে’ উদ্দাম ভাবের আবেগে তাঁহার কল্পনা কোথাও উচ্চৃঙ্খল হইয়া ছুটিয়া যায় নাই। প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত সর্বত্রই তিনি পদে পদে আত্মসম্বরণপূর্বক যুক্তির সুনির্দিষ্ট পথ অবলম্বন করিয়া চলিয়াছেন। যাহা লিখিয়াছেন তাহাতে তাঁহার প্রতিভা প্রকাশ পাইয়াছে, যাহা লিখেন নাই তাহাতেও তাঁহার অল্প ক্ষমতা প্রকাশ পায় নাই।

বিশেষত বিষয়টি এমন যে, ইহা কোনো সাধারণ বাঙালি লেখকের হস্তে পড়িলে তিনি এই সুযোগে বিস্তর হরি হরি, মরি মরি, হায় হায়, অশ্রুপাত ও প্রবল অঙ্গভঙ্গি করিতেন এবং কল্পনার উচ্ছ্বাস, ভাবের আবেগ এবং হৃদয়াতিশয্য প্রকাশ করিবার এমন অনুকূল অবসর কখনোই ছাড়িতেন না; সুবিচারিত তর্ক দ্বারা, সুকঠিন সত্যনির্ণয়ের স্পৃহা দ্বারা পদে পদে আপন লেখনীকে বাধা দিতেন না। সর্বজনগম্য সরল পথ ছাড়িয়া দিয়া সূক্ষ্মবুদ্ধি দ্বারা স্বকপোলকল্পিত একটা নূতন আবিষ্কারকেই সর্বপ্রাধান্য দিয়া তাহাকেই বাক্‌প্রাচুর্যে এবং কল্পনাকুহকে সমাচ্ছন্ন করিয়া তুলিতেন, এবং নিজের বিশ্বাস ও ভাষাকে যথাসাধ্য টানিয়া বুনিয়া আশেপাশে দীর্ঘ করিয়া অধিকপরিমাণে লোককে আপন মতের জালে আকর্ষণ করিতে চেষ্টা করিতেন।

বস্তুত আমাদের শাস্ত্র হইতে ইতিহাস উদ্ধারের দুরূহ ভার কেবল বঙ্কিম লইতে পারিতেন। এক দিকে হিন্দুশাস্ত্রের প্রকৃত মর্ম গ্রহণে ইউরোপীয়গণের অক্ষমতা, অন্য দিকে শাস্ত্রগত প্রমাণের নিরপেক্ষ বিচার সম্বন্ধে হিন্দুদের সংকোচ; এক দিকে রীতিমত পরিচয়ের অভাব, অন্য দিকে অতিপরিচয়জনিত অভ্যাস ও সংস্কারের অন্ধতা; যথার্থ ইতিহাসটিকে এই উভয়সংকটের মাঝখান হইতে উদ্ধার করিতে হইবে। দেশানুরাগের সাহায্যে শাস্ত্রের অন্তরে প্রবেশ করিতে হইবে এবং সত্যানুরাগের সাহায্যে তাহার অমূলক অংশ পরিত্যাগ করিতে হইবে। যে বল্‌গার ইঙ্গিতে লেখনীকে বেগ দিতে হইবে, সেই বল্‌গার আকর্ষণে তাহাকে সর্বদা সংযত করিতে হইবে। এই-সকল ক্ষমতাসামঞ্জস্য বঙ্কিমের ছিল। সেইজন্য মৃত্যুর অনতিপূর্বে তিনি যখন প্রাচীন বেদ পুরাণ সংগ্রহ করিয়া প্রস্তুত হইয়া বসিয়াছিলেন তখন বঙ্গসাহিত্যের বড়ো আশার কারণ ছিল, কিন্তু মৃত্যু সে আশা সফল হইতে দিল না, এবং আমাদের ভাগ্যে যাহা অসম্পন্ন রহিয়া গেল তাহা যে কবে সমাধা হইবে কেহই বলিতে পারে না।

বঙ্কিম এই-যে সর্বপ্রকার আতিশয্য এবং অসংগতি হইতে আপনাকে রক্ষা করিয়া গিয়াছেন ইহা তাঁহার প্রতিভার প্রকৃতিগত। যে-কেহ তাঁহার রচনা পড়িয়াছেন সকলেই জানেন বঙ্কিম হাস্যরসে সুরসিক ছিলেন। যে পরিষ্কার যুক্তির আলোকের দ্বারা সমস্ত আতিশয্য ও অসংগতি প্রকাশ হইয়া পড়ে হাস্যরস সেই কিরণেরই একটি রশ্মি। কতদূর পর্যন্ত গেলে একটি ব্যাপার হাস্যজনক হইয়া উঠে তাহা সকলে অনুভব করিতে পারে না, কিন্তু যাঁহারা হাস্যরসরসিক তাঁহাদের অন্তঃকরণে একটি বোধশক্তি আছে যদ্দারা তাঁহারা সকল সময়ে নিজের না হইলেও অপরের কথাবার্তা আচারব্যবহার এবং চরিত্রের মধ্যে সুসংগতির সূক্ষ্ম সীমাটুকু সহজে নির্ণয় করিতে পারেন।

নির্মল শুভ্র সংযত হাস্য বঙ্কিমই সর্বপ্রথমে বঙ্গসাহিত্যে আনয়ন করেন। তৎপূর্বে বঙ্গসাহিত্যে হাস্যরসকে অন্য রসের সহিত এক পঙ্‌ক্তিতে বসিতে দেওয়া হইত না। সে নিম্নাসনে বসিয়া শ্রাব্য অশ্রাব্য ভাষায় ভাঁড়ামি করিয়া সভাজনের মনোরঞ্জন করিত। আদিরসেরই সহিত যেন তাহার কোনো-একটি সর্ব-উপদ্রবসহ বিশেষ কুটুম্বিতার সম্পর্ক ছিল এবং ঐ রসটাকেই সর্বপ্রকারে পীড়ন ও আন্দোলন করিয়া তাহার অধিকাংশ পরিহাস-বিদ্রূপ প্রকাশ পাইত। এই প্রগল্‌ভ বিদূষকটি যতই প্রিয়পাত্র থাক্‌ কখনো সম্মানের অধিকারী ছিল না। যেখানে গম্ভীরভাবে কোনো বিষয়ের আলোচনা হইত সেখানে হাস্যের চপলতা সর্বপ্রযত্নে পরিহার করা হইত।

বঙ্কিম সর্বপ্রথমে হাস্যরসকে সাহিত্যের উচ্চশ্রেণীতে উন্নীত করেন। তিনিই প্রথম দেখাইয়া দেন যে, কেবল প্রহসনের সীমার মধ্যে হাস্যরস বদ্ধ নহে; উজ্জ্বল শুভ্র হাস্য সকল বিষয়কেই আলোকিত করিয়া তুলিতে পারে। তিনিই প্রথম দৃষ্টান্তের দ্বারা প্রমাণ করাইয়া দেন যে, এই হাস্যজ্যোতির সংস্পর্শে কোনো বিষয়ের গভীরতার গৌরব হ্রাস হয় না, কেবল তাহার সৌন্দর্য এবং রমণীয়তার বৃদ্ধি হয়, তাহার সর্বাংশের প্রাণ এবং গতি যেন সুস্পষ্টরূপে দীপ্যমান হইয়া উঠে। যে বঙ্কিম বঙ্গসাহিত্যের গভীরতা হইতে অশ্রুর উৎস উন্মুক্ত করিয়াছেন সেই বঙ্কিম আনন্দের উদয়শিখর হইতে নবজাগ্রত বঙ্গসাহিত্যের উপর হাস্যের আলোক বিকীর্ণ করিয়া দিয়াছেন।

কেবল সুসংগতি নহে, সুরুচি এবং শিষ্টতার সীমা নির্ণয় করিতেও একটি স্বাভাবিক সূক্ষ্ম বোধশক্তির আবশ্যক। মাঝে মাঝে অনেক বলিষ্ঠ প্রতিভার মধ্যে সেই বোধশক্তির অভাব দেখা যায়। কিন্তু বঙ্কিমের প্রতিভায় বল এবং সৌকুমার্যের একটি সুন্দর সংমিশ্রণ ছিল। নারীজাতির প্রতি যথার্থ বীরপুরুষের মনে যেরূপ একটি সসম্ভ্রম সম্মানের ভাব থাকে তেমনি সুরুচি এবং শীলতার প্রতি বঙ্কিমের বলিষ্ঠবুদ্ধির একটি বীরোচিত প্রীতিপূর্ণ শ্রদ্ধা ছিল। বঙ্কিমের রচনা তাহার সাক্ষ্য। বর্তমান লেখক যেদিন প্রথম বঙ্কিমকে দেখিয়াছিল, সেদিন একটি ঘটনা ঘটে যাহাতে বঙ্কিমের এই স্বাভাবিক সুরুচিপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

সেদিন লেখকের আত্মীয় পূজ্যপাদ শ্রীযুক্ত শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর মহোদয়ের নিমন্ত্রণে তাঁহাদের মরকতকুঞ্জে কলেজ-রিয়্যুনিয়ন নামক মিলনসভা বসিয়াছিল। ঠিক কতদিনের কথা স্মরণ নাই, কিন্তু আমি তখন বালক ছিলাম। সেদিন সেখানে আমার অপরিচিত বহুতর যশস্বী লোকের সমাগম হইয়াছিল। সেই বুধমণ্ডলীর মধ্যে একটি ঋজু দীর্ঘকায় উজ্জ্বলকৌতুকপ্রফুল্লমুখ গুম্ফধারী প্রৌঢ় পুরুষ চাপকানপরিহিত বক্ষের উপর দুই হস্ত আবদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন। দেখিবামাত্রই যেন তাঁহাকে সকলের হইতে স্বতন্ত্র এবং আত্মসমাহিত বলিয়া বোধ হইল। আর সকলে জনতার অংশ, কেবল তিনি যেন একাকী একজন। সেদিন আর-কাহারো পরিচয় জানিবার জন্য আমার কোনোরূপ প্রয়াস জন্মে নাই, কিন্তু তাঁহাকে দেখিয়া তৎক্ষণাৎ আমি এবং আমার একটি আত্মীয় সঙ্গী একসঙ্গেই কৌতূহলী হইয়া উঠিলাম। সন্ধান লইয়া জানিলাম তিনিই আমাদের বহুদিনের অভিলষিতদর্শন লোকবিশ্রুত বঙ্কিমবাবু। মনে আছে, প্রথম দর্শনেই তাঁহার মুখশ্রীতে প্রতিভার প্রখরতা এবং বলিষ্ঠতা এবং সর্বলোক হইতে তাঁহার একটি সুদূর স্বাতন্ত্র্যভাব আমার মনে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল। তাহার পর অনেক বার তাঁহার সাক্ষাৎলাভ করিয়াছি, তাঁহার নিকট অনেক উৎসাহ এবং উপদেশ প্রাপ্ত হইয়াছি, এবং তাঁহার মুখশ্রী স্নেহের কোমলহাস্যে অত্যন্ত কমনীয় হইতে দেখিয়াছি, কিন্তু প্রথম দর্শনে সেই-যে তাঁহার মুখে উদ্যত খড়ে্‌গর ন্যায় একটি উজ্জ্বল সুতীক্ষ্ণ প্রবলতা দেখিতে পাইয়াছিলাম, তাহা আজ পর্যন্ত বিস্মৃত হই নাই।

সেই উৎসব উপলক্ষে একটি ঘরে একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত দেশানুরাগমূলক স্বরচিত সংস্কৃত শ্লোক পাঠ এবং তাহার ব্যাখ্যা করিতেছিলেন। বঙ্কিম এক প্রান্তে দাঁড়াইয়া শুনিতেছিলেন। পণ্ডিতমহাশয় সহসা একটি শ্লোকে পতিত ভারতসন্তানকে লক্ষ্য করিয়া একটা অত্যন্ত সেকেলে পণ্ডিতি রসিকতা প্রয়োগ করিলেন, সে রস কিঞ্চিৎ বীভৎস হইয়া উঠিল। বঙ্কিম তৎক্ষণাৎ একান্ত সংকুচিত হইয়া দক্ষিণ-করতলে মুখের নিম্নার্ধ ঢাকিয়া পার্শ্ববর্তী দ্বার দিয়া দ্রুতবেগে অন্য ঘরে পলায়ন করিলেন।

বঙ্কিমের সেই সসংকোচ পলায়নদৃশ্যটি অদ্যাবধি আমার মনে মুদ্রাঙ্কিত হইয়া আছে।

বিবেচনা করিয়া দেখিতে হইবে, ঈশ্বর গুপ্ত যখন সাহিত্যগুরু ছিলেন বঙ্কিম তখন তাঁহার শিষ্যশ্রেণীর মধ্যে গণ্য ছিলেন। সে সময়কার সাহিত্য অন্য যে-কোনো প্রকার শিক্ষা দিতে সমর্থ হউক ঠিক সুরুচি শিক্ষার উপযোগী ছিল না। সে সময়কার অসংযত বাকযুদ্ধ এবং আন্দোলনের মধ্যে দীক্ষিত ও বর্ধিত হইয়া ইতরতার প্রতি বিদ্বেষ, সুরুচির প্রতি শ্রদ্ধা এবং শ্লীলতা সম্বন্ধে অক্ষুণ্ন বেদনাবোধ রক্ষা করা কী যে আশ্চর্য ব্যাপার তাহা সকলেই বুঝিতে পারিবেন। দীনবন্ধুও বঙ্কিমের সমসাময়িক এবং তাঁহার বান্ধব ছিলেন, কিন্তু তাঁহার লেখায় অন্য ক্ষমতা প্রকাশ হইলেও তাহাতে বঙ্কিমের প্রতিভার এই ব্রাহ্মণোচিত শুচিতা দেখা যায় না। তাঁহার রচনা হইতে ঈশ্বর গুপ্তের সময়ের ছাপ কালক্রমে ধৌত হইতে পারে নাই।

আমাদের মধ্যে যাঁহারা সাহিত্যব্যবসায়ী তাঁহারা বঙ্কিমের কাছে যে কী চিরঋণে আবদ্ধ তাহা যেন কোনো কালে বিস্মৃত না হন। একদিন আমাদের বঙ্গভাষা কেবল একতারা যন্ত্রের মতো এক তারে বাঁধা ছিল, কেবল সহজ সুরে ধর্ম সংকীর্তন করিবার উপযোগী ছিল; বঙ্কিম স্বহস্তে তাহাতে এক-একটি করিয়া তার চড়াইয়া আজ তাহাকে বীণাযন্ত্রে পরিণত করিয়া তুলিয়াছেন। পূর্বে যাহাতে কেবল স্থানীয় গ্রাম্য সুর বাজিত তাহা আজ বিশ্বসভায় শুনাইবার উপযুক্ত ধ্রুবপদ অঙ্গের কলাবতী রাগিণী আলাপ করিবার যোগ্য হইয়া উঠিয়াছে। সেই তাঁহার স্বহস্তসম্পূর্ণ স্নেহপালিত ক্রোড়সঙ্গিনী বঙ্গভাষা আজ বঙ্কিমের জন্য অন্তরের সহিত রোদন করিয়া উঠিয়াছে। কিন্তু তিনি এই শোকোচ্ছ্বাসের অতীত শান্তিধামে দুষ্কর জীবনযজ্ঞের অবসানে নির্বিকার নিরাময় বিশ্রাম লাভ করিয়াছেন। মৃত্যুর পরে তাঁহার মুখে একটি কোমল প্রসন্নতা, একটি সর্বদুঃখতাপহীন গভীর প্রশান্তি উদ্‌ভাসিত হইয়া উঠিয়াছিল– যেন জীবনের মধ্যাহ্নরৌদ্রদগ্ধ কঠিন সংসারতল হইতে মৃত্যু তাঁহাকে স্নেহসুশীতল জননীক্রোড়ে তুলিয়া লইয়াছেন। আজ আমাদের বিলাপ-পরিতাপ তাঁহাকে স্পর্শ করিতেছে না, আমাদের ভক্তি-উপহার গ্রহণ করিবার জন্য সেই প্রতিভাজ্যোতির্ময় সৌম্য প্রসন্নমূর্তি এখানে উপস্থিত নাই। আমাদের এই শোক এই ভক্তি কেবল আমাদেরই কল্যাণের জন্য। বঙ্কিম সাহিত্যক্ষেত্রে যে আদর্শ স্থাপন করিয়া গিয়াছেন এই শোকে এই ভক্তিতে সেই আদর্শপ্রতিমা আমাদের অন্তরে উজ্জ্বল এবং স্থায়ীরূপে প্রতিষ্ঠিত হউক। প্রস্তরের মূর্তি স্থাপনের অর্থ এবং সামর্থ্য আমাদের যদি না থাকে, তবে একবার তাঁহার মহত্ত্ব সর্বতোভাবে মনের মধ্যে উপলব্ধি করিয়া তাঁহাকে আমাদের বঙ্গহৃদয়ের স্মরণস্তম্ভে স্থায়ী করিয়া রাখি। ইংরাজ এবং ইংরাজের আইন চিরস্থায়ী নহে; রাজনৈতিক ধর্মনৈতিক সমাজনৈতিক মতামত সহস্রবার পরিবর্তিত হইতে পারে; যে-সকল ঘটনা যে-সকল অনুষ্ঠান আজ সর্বপ্রধান বলিয়া বোধ হইতেছে এবং যাহার উন্মাদনার কোলাহলে সমাজের খ্যাতিহীন শব্দহীন কর্তব্যগুলিকে নগণ্য বলিয়া ধারণা হইতেছে, কাল তাহার স্মৃতিমাত্র চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট থাকিতে না পারে; কিন্তু যিনি আমাদের মাতৃভাষাকে সর্বপ্রকার ভাবপ্রকাশের অনুকূল করিয়া গিয়াছেন তিনি এই হতভাগ্য-দরিদ্র দেশকে একটি অমূল্য চিরসম্পদ দান করিয়াছেন। তিনি স্থায়ী জাতীয় উন্নতির একমাত্র মূল উপায় স্থাপন করিয়া গিয়াছেন। তিনিই আমাদের নিকট যথার্থ শোকের মধ্যে সান্ত্বনা, অবনতির মধ্যে আশা, শ্রান্তির মধ্যে উৎসাহ এবং দারিদ্র্যের শূন্যতার মধ্যে চির-সৌন্দর্যের অক্ষয় আকর উদ্‌ঘাটিত করিয়া দিয়াছেন। আমাদিগের মধ্যে যাহা-কিছু অমর এবং আমাদিগকে যাহা-কিছু অমর করিবে সেই-সকল মহাশক্তিকে ধারণ করিবার পোষণ করিবার প্রকাশ করিবার এবং সর্বত্র প্রচার করিবার একমাত্র উপায় যে মাতৃভাষা তাহাকেই তিনি বলবতী এবং মহীয়সী করিয়াছেন।

রচনাবিশেষের সমালোচনা ভ্রান্ত হইতে পারে– আমাদিগের নিকট যাহা প্রশংসিত কালক্রমে শিক্ষা রুচি এবং অবস্থার পরিবর্তনে আমাদের উত্তরপুরুষের নিকট তাহা নিন্দিত এবং উপেক্ষিত হইতে পারে; কিন্তু বঙ্কিম বঙ্গভাষার ক্ষমতা এবং বঙ্গসাহিত্যের সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করিয়া দিয়াছেন, তিনি ভগীরথের ন্যায় সাধনা করিয়া বঙ্গসাহিত্যে ভাবমন্দাকিনীর অবতারণ করিয়াছেন এবং সেই পুণ্যস্রোতস্পর্শে জড়ত্বশাপ মোচন করিয়া আমাদের প্রাচীন ভস্মরাশিকে সঞ্জীবিত করিয়া তুলিয়াছেন। ইহা কেবল সাময়িক মত নহে, এ কথা কোনো বিশেষ তর্ক বা রুচির উপর নির্ভর করিতেছে না, ইহা একটি ঐতিহাসিক সত্য।

এই কথা স্মরণে মুদ্রিত করিয়া সেই বাংলা লেখকদিগের গুরু, বাংলা পাঠকদিগের সুহৃদ, এবং সুজলা সুফলা মলয়জশীতলা বঙ্গভূমির মাতৃবৎসল প্রতিভাশালী সন্তানের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করি, যিনি জীবনের সায়াহ্ন আসিবার পূর্বেই, নূতন অবকাশে নূতন উদ্যমে নূতন কার্যে হস্তক্ষেপ করিবার প্রারম্ভেই, আপনার অপরিম্লান প্রতিভারশ্মি সংহরণ করিয়া বঙ্গসাহিত্যাকাশ ক্ষীণতর জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর হস্তে সমর্পণপূর্বক গত শতাব্দীর বর্ষশেষের পশ্চিমদিগন্তসীমায় অকালে অস্তমিত হইলেন।

বৈশাখ, ১৩০১

বিদ্যাপতির রাধিকা

গতি এবং উত্তাপ যেমন একটি শক্তির ভিন্ন অবস্থা, বিদ্যাপতি এবং চণ্ডীদাসের কবিতায় প্রেমশক্তির সেই প্রকার দুই ভিন্ন রূপ দেখা যায়। বিদ্যাপতির কবিতায় প্রেমের ভঙ্গি, প্রেমের নৃত্য, প্রেমের চাঞ্চল্য; চণ্ডীদাসের কবিতায় প্রেমের তীব্রতা, প্রেমের দাহ, প্রেমের আলোক। এইজন্য ছন্দ সংগীত এবং বিচিত্র রঙে বিদ্যাপতির পদ এমন পরিপূর্ণ, এইজন্য তাহাতে সৌন্দর্যসুখসম্ভোগের এমন তরঙ্গলীলা। ইহা কেবল যৌবনের প্রথম-আরম্ভের আনেন্দোচ্ছ্বাস। কেবল অবিমিশ্র সুখ এবং অব্যাহত-সংগীতধ্বনি। দুঃখ নাই যে তাহা নহে কিন্তু সুখদুঃখের মাঝখানে একটা অন্তরাল-ব্যবধান আছে। হয় সুখ নয় দুঃখ, হয় মিলন নয় বিরহ, এইরূপ পরিষ্কার শ্রেণীবিভাগ। চণ্ডীদাসের মতো সুখে দুঃখে বিরহে মিলনে জড়িতে হইয়া যায় নাই।সেইজন্য বিদ্যাপতির প্রেমে যৌবনের নবীনতা এবং চণ্ডীদাসের প্রেমে অধিক বয়সের প্রগাঢ়তা আছে।

অল্প বয়সের ধর্মই এই, সুখ এবং দুঃখ, ভালো এবং মন্দ অত্যন্ত স্বতন্ত্র করিয়া দেখে। যেন জগতে এক দিকে বিশুদ্ধ ভালো আর-এক দিকে বিশুদ্ধ মন্দ, এক দিকে একান্ত সুখ আর-এক দিকে একান্ত দুঃখ প্রতিপক্ষতা অবলম্বন করিয়া পরস্পর বিমুখ হইয়া বসিয়া আছে। সে বয়সে সকল বিষয়ের একটা পরিপূর্ণ আদর্শ হৃদয়ে বিরাজ করিতে থাকে। গুণ দেখিলেই সর্বগুণ কল্পনা করি, দোষ দেখিলেই সর্বদোষ একত্র হইয়া পিশাচমূর্তি ধারণ করে। সুখ দেখা দিলেই ত্রিভুবনে দুঃখের চিহ্ন লুপ্ত হইয়া যায়, এবং দুঃখ উপস্থিত হইলে কোথাও সুখের লেশমাত্র দেখা যায় না। সংগীত সেইজন্য সর্বদাই উচ্ছ্বসিত পঞ্চম স্বরে বাঁধা। বিদ্যাপতিতে সেইজন্য কেবল বসন্ত।

রাধা অল্পে মুকুলিত বিকশিত হইয়া উঠিতেছে। সৌন্দর্য ঢলঢল করিতেছে। শ্যামের সহিত দেখা হয় এবং চারি দিকে একটা যৌবনের কম্পন হিল্লোলিত হইয়া উঠে। খানিকটা হাসি, খানিকটা ছলনা, খানিকটা আড়চক্ষে দৃষ্টি। একটু ব্যাকুলতা, একটু আশানৈরাশ্যের আন্দোলনও আছে। কিন্তু তাহা নিতান্ত মর্মঘাতী নহে। চণ্ডীদাসের যেমন–

নয়ন চকোর মোর পিতে করে উতরোল,
নিমিখে নিমিখ নাহি হয়–

বিদ্যাপতিতে সেরূপ উতরোল ভাব নয়– কতকটা উতলা বটে। কেবল আপনাকে আধখানা প্রকাশ এবং আধখানা গোপন; কেবল হঠাৎ উদ্দাম বাতাসের একটা আন্দোলনে অমনি খানিকটা উন্মেষিত হইয়া পড়ে। বিদ্যাপতির রাধা নবীনা নবস্ফুটা। আপনাকে এবং পরকে ভালো করিয়া জানে না। দূরে সহাস্য সতৃষ্ণ লীলাময়ী; নিকটে কম্পিত শঙ্কিত বিহ্বল। কেবল একবার কৌতূহলে চম্পক-অঙ্গুলির অগ্রভাগ দিয়া অতিসাবধানে অপরিচিত প্রেমকে একটুমাত্র স্পর্শ করিয়া অমনি পলায়নপর হইতেছে। যেমন একটি ভীরু বালিকা স্বাভাবিক পশুস্নেহে আকৃষ্ট হইয়া অজ্ঞাতস্বভাব মৃগকে একবার সচকিতে স্পর্শ করে, একবার পালায়, ক্রমে ক্রমে ভয় ভাঙে, সেইরূপ।

যৌবন, সেও সবে আরম্ভ হইতেছে, তখন সকলই রহস্যপরিপূর্ণ। সদ্য-বিকচ হৃদয় সহসা আপনার সৌরভ আপনি অনুভব করিতেছে; আপনার সম্বন্ধে আপনি সবেমাত্র সচেতন হইয়া উঠিতেছে; তাই লজ্জায় ভয়ে– আনন্দে সংশয়ে আপনাকে গোপন করিবে কি প্রকাশ করিবে ভাবিয়া পাইতেছে না–

কবহুঁ বান্ধয়ে কচ কবহুঁ বিথারি।
কবহু ঝাঁপয়ে অঙ্গ কবহুঁ উঘারি।

হৃদয়ের নবীন বাসনাসকল পাখা মেলিয়া উড়িতে চায়, কিন্তু এখনো পথ জানে নাই। কৌতূহল এবং অনভিজ্ঞতায় সে একবার ঈষৎ অগ্রসর হয় আবার জড়সড় অঞ্চলটির অন্তরালে আপনার নিভৃত কোমল কুলায়ের মধ্যে ফিরিয়া আশ্রয় গ্রহণ করে।

এখন প্রেমে বেদনা অপেক্ষা বিলাস বেশি। ইহাতে গভীরতার অটল স্থৈর্য নাই, কেবল নবানুরাগের উদ্‌ভ্রান্ত লীলাচাঞ্চল্য। বিদ্যাপতির এই পদগুলি পড়িতে পড়িতে একটি সমীরচঞ্চল সমুদ্রের উপরিভাগ চক্ষে পড়ে। ঢেউ খেলিতেছে; ফেন উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতেছে, মেঘের ছায়া পড়িতেছে; সূর্যের আলোক শত শত অংশে প্রতিস্ফুরিত হইয়া চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত হইতেছে; তরঙ্গে তরঙ্গে স্পর্শ এবং পলায়ন, কলরব, কলহাস্য, করতালি; কেবল নৃত্য এবং গীত, আভাস এবং আন্দোলন, আলোক এবং বর্ণবৈচিত্র্য। এই নবীন চঞ্চল প্রেমহিল্লোলের উপর সৌন্দর্য যে কত ছন্দে কত ভঙ্গিতে বিচ্ছুরিত হইয়া উঠে, বিদ্যাপতির গানে তাহাই প্রকাশ পাইয়াছে। কিন্তু সমুদ্রের অন্তর্দেশে যে গভীরতা, নিস্তব্ধতা, যে বিশ্ববিস্মৃত ধ্যানলীনতা আছে তাহা বিদ্যাপতির গীতি-তরঙ্গের মধ্যে পাওয়া যায় না।

কদাচ কখনো দেখা যায়, যমুনার জলে অথবা স্নান করিয়া ফিরিবার সময়। কিন্তু ভালো করিয়া দেখা হয় না। একে অল্পক্ষণের দেখা, তাহাতে অধৈর্যচঞ্চল দোদুল্যমান হৃদয়ে সৌন্দর্যের যে প্রতিবিম্ব পড়ে তাহা ভাঙিয়া ভাঙিয়া যায়– মনকে শান্ত করিয়া ধৈর্য করিয়া দেখিবার অবসর পাওয়া যায় না– যেটুকু দেখা গেল সে কেবল–

“আধ আঁচর খসি আধবদনে হাসি,
আধ হি নয়ান তরঙ্গ।’

কিন্তু

“ভাল করি পেখন না ভেল।’

তাহার পর কত আসা-যাওয়া, কত বলা-কওয়া, কত ছলে কত ভাব প্রকাশ, কত ভয়, কত ভাবনা– অবশেষে একদিন মধুর বসন্তে নবীন মিলন; কিন্তু তাহাও নিবিড় নিগূঢ় নিরতিশয় মিলন নহে। তাহার মধ্যে কত আশঙ্কা, কত আশ্বাস, কত কৌতুক, কত ছদ্মলীলা, কত মান-অভিমান সাধ্যসাধনা! আবার সখীর সহিত পরামর্শ; সখীকে ডাকিয়া গৃহকোণে নিভৃতে বসিয়া নানা ছলে এবং কথার কৌশলে আপনার সুখস্মৃতি লইয়া আলোচনা। নবীনার নবপ্রেম যেমন মুগ্ধ যেমন মিশ্রিত বিচিত্র কৌতুককৌতূহলপরিপূর্ণ হইয়া থাকে, ইহাতে তাহার কিছুই কম নাই।

চণ্ডীদাস গভীর এবং ব্যাকুল, বিদ্যাপতি নবীন এবং মধুর।

“নব বৃন্দাবন, নবীন তরুগণ,
নব নব বিকশিত ফুল।
নবীন বসন্ত নবীন মলয়ানিল
মাতল নব অলিকুল।
বিহরই নওল কিশোর।
কালিন্দী-পুলিন-কুঞ্জ নব শোভন,
নব নব প্রেম বিভোর।
নবীন রসাল-মুকুল মধুমাতিয়া
নব কোকিলকুল গায়।
নব যুবতীগণ চিত উময়তাই
নব রসে কাননে ধায়।
নব যুবরাজ নবীন নব নাগরী
মিলয়ে নব নব ভাতি।
নিতি নিতি ঐছন নব নব খেলন
বিদ্যাপতি মতি মাতি।’

ইহার সহিত আর-একটি গীত যোগ না করিলে ইহা সম্পূর্ণ হয় না।

“মধু ঋতু, মধুকর পাঁতি;
মধুর-কুসুম-মধু-মাতি।
মধুর বৃন্দাবন মাঝ,
মধুর মধুর রসরাজ।
মধুর-যুবতীগণ-সঙ্গ
মধুর মধুর রস রঙ্গ।
মধুর যন্ত্র সুরসাল,
মধুর মধুর করতাল।
মধুর নটন-গতিভঙ্গ,
মধুর নটনী-নট-রঙ্গ।
মধুর মধুর রস গান,
মধুর বিদ্যাপতি ভান।’

এইখানেই শেষ করা যাইত। কিন্তু এখানে শেষ করিলে বড়ো অসমাপ্ত থাকে। ঠিক সমে আসিয়া থামে না। এইজন্য বিদ্যাপতি একটি শেষ কথা বলিয়া রাখিয়াছেন। তাহাকে শেষ কথা বলা যাইতে পারে অশেষ কথাও বলা যাইতে পারে; এত লীলাখেলা নব নব রসোল্লাসের পরিণাম-কথা এই যে–

“জনম অবধি হাম রূপ নেহারিনু
নয়ন না তিরপিত ভেল।
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখনু
তবু হিয়ে জুড়ন না গেল।’

নবীন প্রেম একেবারে লক্ষ লক্ষ যুগের পুরাতন হইয়া গেল। ইহার পরে ছন্দ এবং রাগিণী পরিবর্তন করা আবশ্যক। চিরনবীন প্রেমের ভূমিকা সমাপ্ত হইয়াছে। চণ্ডীদাস আসিয়া চিরপুরাতন প্রেমের গান আরম্ভ করিয়া দিলেন।

চৈত্র ১২৯৮

বিহারীলাল

বর্তমান নববর্ষের প্রারম্ভেই কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর পরলোকপ্রাপ্তি হইয়াছে।

বঙ্গের সারস্বতকুঞ্জে মৃত্যু ব্যাধের ন্যায় প্রবেশ করিয়াছে। তাহার নিষ্ঠুর শর-সন্ধানে অল্পকালের মধ্যে অনেকগুলি কণ্ঠ নীরব হইয়া গেল।

তন্মধ্যে বিহারীলালের কণ্ঠ সাধারণের নিকট তেমন সুপরিচিত ছিল না। তাঁহার শ্রোতৃমণ্ডলীর সংখ্যা অল্প ছিল এবং তাঁহার সুমধুর সংগীত নির্জনে নিভৃতে ধ্বনিত হইতে থাকিত, খ্যাতির প্রার্থনায় পাঠক এবং সমালোচক-সমাজের দ্বারবর্তী হইত না।

কিন্তু যাহারা দৈবক্রমে এই বিজনবাসী ভাবনিমগ্ন কবির সংগীতকাকলিতে আকৃষ্ট হইয়া তাঁহার কাছে আসিয়াছিল তাহাদের নিকটে তাঁহার আদরের অভাব ছিল না। তাহারা তাঁহাকে বঙ্গের শ্রেষ্ঠ কবি বলিয়া জানিত।

বঙ্গদর্শন প্রকাশ হইবার বহুপূর্বে কিছুকাল ধরিয়া অবোধবন্ধু-নামক একটি মাসিক পত্র বাহির হইত। তখন বর্তমান লেখক বালকবয়সপ্রযুক্ত নিতান্ত অবোধ ছিল। কিঞ্চিৎ বয়ঃপ্রাপ্তিসহকারে যখন বোধোদয় হইল তখন উক্ত কাগজ বন্ধ হইয়া গেল।

সৌভাগ্যক্রমে পত্রগুলি কতক বাঁধানো কতক-বা খণ্ড আকারে আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আলমারির মধ্যে রক্ষিত ছিল। অনেক মূল্যবান গ্রন্থাদি থাকাতে সে আলমারিতে চপলপ্রকৃতি বালকদের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ ছিল। এক্ষণে নির্ভয়ে স্বীকার করিতে পারি, অবোধবন্ধুর বন্ধুত্ব-প্রলোভনে মুগ্ধ হইয়া সে নিষেধ লঙ্ঘন করিয়াছিলাম। এই গোপন দুষ্কর্মের জন্য কোনোরূপ শাস্তি পাওয়া দূরে থাক, বহুকাল ধরিয়া যে আনন্দলাভ করিয়াছিলাম তাহা এখনো বিস্মৃত হই নাই।

এখনো মনে আছে ইস্কুল ফাঁকি দিয়া একটি দক্ষিণদ্বারী ঘরে সুদীর্ঘ নির্জন মধ্যাহ্নে অবোধবন্ধু হইতে পৌল-বর্জিনীর বাংলা অনুবাদ পাঠ করিতে করিতে প্রবল বেদনায় হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইত। তখন কলিকাতার বহির্বর্তী প্রকৃতি আমার নিকট অপরিচিত ছিল_ এবং পৌল-বর্জিনীতে সমুদ্রতটের অরণ্যদৃশ্যবর্ণনা আমার নিকট অনির্বচনীয় সুখস্বপ্নের ন্যায় প্রতিভাত হইত, এবং সেই তরঙ্গঘাতধ্বনিত বনচ্ছায়াস্নিগ্ধ সমুদ্রবেলায় পৌল-বর্জিনীর মিলন এবং বিচ্ছেদবেদনা হৃদয়ের মধ্যে যেন মূর্ছনাসহকারে অপূর্ব সংগীতের মতো বাজিয়া উঠিত।

এই ক্ষুদ্র পত্রে যে-সকল গদ্যপ্রবন্ধ বাহির হইত, তাহার মধ্যে কিছু বিশেষত্ব ছিল। তখনকার বাংলা গদ্যে সাধুভাষার অভাব ছিল না, কিন্তু ভাষার চেহারা ফোটে নাই। তখন যাঁহারা মাসিক পত্রে লিখিতেন তাঁহারা গুরু সাজিয়া লিখিতেন– এইজন্য তাঁহারা পাঠকদের নিকট আত্মপ্রকাশ করেন নাই এবং এইজন্যই তাঁহাদের লেখার যেন একটা স্বরূপ ছিল না। যখন অবোধবন্ধু পাঠ করিতাম তখন তাহাকে ইস্কুলের পড়ার অনুবৃত্তি বলিয়া মনে হইত না। বাংলা ভাষায় বোধ করি সেই প্রথম মাসিক পত্র বাহির হইয়াছিল যাহার রচনার মধ্যে একটা স্বাদবৈচিত্র্য পাওয়া যাইত। বর্তমান বঙ্গসাহিত্যের প্রাণসঞ্চারের ইতিহাস যাঁহারা পর্যালোচনা করিবেন তাঁহারা অবোধবন্ধুকে উপেক্ষা করিতে পারিবেন না। বঙ্গদর্শনকে যদি আধুনিক বঙ্গসাহিত্যের প্রভাতসূর্য বলা যায় তবে ক্ষুদ্রায়তন অবোধবন্ধুকে প্রত্যুষের শুকতারা বলা যাইতে পারে।

সে-প্রত্যুষে লোক জাগে নাই এবং সাহিত্যকুঞ্চে বিচিত্র কলগীত কুজিত হইয়া উঠে নাই। সেই উষালোকে কেবল একটি ভোরের পাখি সুমিষ্ট সুন্দর সুরে গান ধরিয়াছিল। সে সুর তাহার নিজের।

ঠিক ইতিহাসের কথা বলিতে পারি না– কিন্তু আমি সেই প্রথম বাংলা কবিতায় কবির নিজের সুর শুনিলাম।

রাত্রির অন্ধকার যখন দূর হইতে থাকে তখন যেমন জগতের মূর্তি রেখায় রেখায় ফুটিয়া ওঠে, সেইরূপ অবোধবন্ধুর গদ্যে পদ্যে যেন প্রতিভার প্রত্যুষকিরণে মূর্তির বিকাশ হইতে লাগিল। পাঠকের কল্পনার নিকটে একটি ভাবের দৃশ্য উদ্‌ঘাটিত হইয়া গেল।

“সর্বদাই হু হু করে মন,
বিশ্ব যেন মরুর মতন।
চারি দিকে ঝালাফালা।
উঃ কী জ্বলন্ত জ্বালা,
অগ্নিকুণ্ডে পতঙ্গপতন।’
আধুনিক বঙ্গসাহিত্যে এই প্রথম বোধ হয় কবির নিজের কথা। তৎসময়ে অথবা তৎপূর্বে মাইকেলের চতুর্দশপদীতে কবির আত্মনিবেদন কখনো কখনো প্রকাশ পাইয়া থাকিবে– কিন্তু তাহা বিরল– এবং চতুর্দশপদীর সংক্ষিপ্ত পরিসরের মধ্যে আত্মকথা এমন কঠিন ও সংহত হইয়া আসে যে, তাহাতে বেদনার গীতোচ্ছ্বাস তেমন স্ফূর্তি পায় না।

বিহারীলাল তখনকার ইংরেজিভাষায়-নব্যশিক্ষিত কবিদিগের ন্যায় যুদ্ধবর্ণনাসংকুল মহাকাব্য, উদ্দীপনাপূর্ণ দেশানুরাগমূলক কবিতা লিখিলেন না, এবং পুরাতন কবি-

দিগের ন্যায় পৌরাণিক উপাখ্যানের দিকেও গেলেন না– তিনি নিভৃতে বসিয়া নিজের ছন্দে নিজের মনের কথা বলিলেন। তাঁহার সেই স্বগত উক্তিতে বিশ্বহিত দেশহিত অথবা সভামনোরঞ্জনের কোনো উদ্দেশ্য দেখা গেল না। এইজন্য তাঁহার সুর অন্তরঙ্গরূপে হৃদয়ে প্রবেশ করিয়া সহজেই পাঠকের বিশ্বাস আকর্ষণ করিয়া আনিল।

পাঠকদিগকে এইরূপে বিশ্রব্ধভাবে আপনার নিকটে টানিয়া আনিবার ভাব প্রথম অবোধবন্ধুর গদ্যে এবং অবোধবন্ধুর কবি বিহারীলালের কাব্যে অনুভব করিয়াছিলাম। পৌল-বর্জিনীতে যেমন মানুষের এবং প্রকৃতির নিকট-পরিচয় লাভ করিয়াছিলাম বিহারীলালের কাব্যেও সেইরূপ একটি ঘনিষ্ঠ সঙ্গ প্রাপ্ত হইয়াছিলাম। মনে আছে নিম্ন-উদ্‌ধৃত শ্লোকগুলির বর্ণনায় এবং সংগীতে মনশ্চক্ষের সমক্ষে সুন্দর চিত্রপট উদ্‌ঘাটিত হইয়া হৃদয়কে চঞ্চল করিয়া তুলিত।

“কভু ভাবি কোনো ঝরনার
উপলে বন্ধুর যার ধার–
প্রচণ্ড প্রপাতধ্বনি
বায়ুবেগে প্রতিধ্বনি
চতুর্দিকে হতেছে বিস্তার–
গিয়ে তার তীরতরুতলে
পুরু পুরু নধর শাদ্বলে
ডুবাইয়ে এ শরীর
শবসম রব স্থির
কান দিয়ে জলকলকলে।
যে-সময় কুরঙ্গিণীগণ
সবিস্ময়ে ফেলিয়ে নয়ন
আমার সে দশা দেখে
কাছে এসে চেয়ে থেকে
অশ্রুজল করিবে মোচন–
সে-সময়ে আমি উঠে গিয়ে,
তাহাদের গলা জড়াইয়ে,
মৃত্যুকালে মিত্র এলে
লোকে যেম্নি চক্ষু মেলে
তেম্নিতর থাকিব চাহিয়ে।’
কবি যে মন “হু হু’ করার কথা লিখিয়াছেন তাহা কী প্রকৃতির বলিতে পারি না। কিন্তু এই বর্ণনা পাঠ করিয়া বহির্জগতের জন্য একটি বালক-পাঠকের মন হু হু করিয়া উঠিত। ঝরনার ধারে জলশীকরসিক্ত স্নিগ্ধশ্যামল দীর্ঘকোমল ঘনঘাসের মধ্যে দেহ নিমগ্ন করিয়া নিস্তব্ধভঅবে জলকলধ্বনি শুনিতে পাওয়া একটি পরম আকাঙক্ষার বিষয় বলিয়া মনে হইত; এবং যদিও জ্ঞানে জানি যে, কুরঙ্গিণীগণ কবির দুঃখে অশ্রুপাত করিতে আসে না এবং সাধ্যমতে কবির আলিঙ্গনে ধরা দিতে চাহে না, তথাপি এই নির্ঝরপার্শ্বে ঘনশষ্পতটে মানবের বাহুপাশবদ্ধ মুগ্ধ কুরঙ্গিণীর দৃশ্য অপরূপ সৌন্দর্যে হৃদয়ে সম্ভববৎ চিত্রিত হইয়া উঠিত।

কভু ভাবি পল্লীগ্রামে যাই,
নামধাম সকল লুকাই।
চাষীদের মাঝে রয়ে
চাষীদের মতো হয়ে
চাষীদের সঙ্গেতে বেড়াই।
প্রাতঃকালে মাঠের উপর,
শুদ্ধ বায়ু বহে ঝর ঝর,
চারি দিক মনোরম,
আমোদে করিব শ্রম;
সুস্থ স্ফূর্ত হবে কলেবর।
বাজাইয়ে বাঁশের বাঁশরি
সাদা সোজা গ্রাম্য গান ধরি
সরল চাষার সনে
প্রমোদ-প্রফুল্ল মনে
কাটাইব আনন্দে শর্বরী।
বরষার যে ঘোরা নিশায়
সৌদামিনী মাতিয়ে বেড়ায়–
ভীষণ বজ্রের নাদ,
ভেঙে যেন পড়ে ছাদ,
বায়ু সব কাঁপেন কোঠায়–
সে নিশায় আমি ক্ষেত্রতীরে
নড়বোড়ে পাতার কুটিরে
স্বচ্ছন্দে রাজার মতো
ভূমে আছি নিদ্রাগত,
প্রাতে উঠে দেখিব মিহিরে।’
কলিকাতার ছেলে পল্লীগ্রামের এই সুখময় চিত্রে যে ব্যাকুল হইয়া উঠিবে ইহাতে বিচিত্র কিছুই নাই। ইহা হইতে বুঝা যায় অসন্তোষ মানবপ্রকৃতির সহজাত। অট্টালিকা অপেক্ষা নড়বোড়ে পাতার কুটিরে যে সুখের অংশ অধিক আছে অট্টালিকা-বাসী বালকের মনে এ মায়া কে জন্মাইয়া দিল? আদিম মানবপ্রকৃতি। কবি নহে। কবিকে যিনি ভুলাইয়াছেন সেই মহামায়া। কবিতায় অসন্তোষ-গানের বাহুল্য দেখা যায় বলিয়া অনেকে আক্ষেপ করিয়া থাকেন। কিন্তু দোষ কাহাকে দিব? অসন্তোষ মানুষকে কাজ করাইতেছে, আকাঙক্ষা কবিকে গান গাওয়াইতেছে। সন্তোষ এবং পরিতৃপ্তি যতই প্রার্থনীয় হউক তাহাতে কার্য এবং কাব্য উভয়েরই ব্যাঘাত করিয়া থাকে। অ যেমন বর্ণমালার আরম্ভ এবং সমস্ত ব্যঞ্জনবর্ণের সহিত যুক্ত, অসন্তোষ ও অতৃপ্তি সেইরূপ সৃজনের আরম্ভে বর্তমান এবং সমস্ত মানবপ্রকৃতির সহিত নিয়ত সংযুক্ত। এইজন্যই তাহা কবিতায় প্রাধান্য লাভ করিয়াছে, কবিদিগের মানসিক ক্ষিপ্ততা বা পরিপাকশক্তির বিকারবশত নহে। কৃষক-কবি যখন কবিতা রচনা করে তখন সে মাঠের শোভা কুটিরের সুখ বর্ণনা করে না– নগরের বিস্ময়জনক বৈচিত্র্য তাহার চিত্ত আকর্ষণ করে– তখন সে গাহিয়া ওঠে–

“কী কল বানিয়েছে সাহেব কোম্পানি!
কলেতে ধোঁয়া ওঠে আপনি, সজনি!’
কলের বাঁশি যাহারা শুনিতেছে মাঠের “বাঁশের বাঁশরি’ শুনিয়া তাহারা ব্যাকুল হয় এবং যাহারা বাঁশের বাঁশরি বাজাইয়া থাকে কলের বাঁশি শুনিলে তাহাদের হৃদয় বিচলিত হইয়া উঠে। এইজন্য শহরের কবিও সুখের কথা বলে না, মাঠের কবিও আকাঙক্ষার চাঞ্চল্য গানে প্রকাশ করিতে চেষ্টা করে।

সুখ চিরকালই দূরবর্তী, এইজন্য কবি যখন গাহিলেন– “সর্বদাই হু হু করে মন’ তখন বালকের অন্তরেও তাহার প্রতিধ্বনি জাগিয়া উঠিল। কবি যখন বলিলেন–

“কভু ভাবি ত্যেজে এই দেশ
যাই কোনো এ হেন প্রদেশ
যথায় নগর গ্রাম
নহে মানুষের ধাম,
পড়ে আছে ভগ্ন-অবশেষ।
গর্বভরা অট্টালিকা যায়
এবে সব গড়াগড়ি যায়_
বৃক্ষলতা অগণন
ঘোর করে আছে বন,
উপরে বিষাদবায়ু বায়।
প্রবেশিতে যাহার ভিতরে
ক্ষীণপ্রার্থী নরে ত্রাসে মরে,
যথায় শ্বাপদদল,
করে ঘোর কোলাহল
ঝিল্লি সব ঝিঁ ঝিঁ রব করে।
তথা তার মাঝে বাস করি
ঘুমাইব দিবা বিভাবরী_
আর কারে করি ভয়,
ব্যাঘ্রে সর্পে তত নয়,
মানুষজন্তুকে যত ডরি।’
তখন এই চিত্রে ভয়ের উদয় না হইয়া বাসনার উদ্রেক হইল। যে ছেলে ঘরের বাহিরে একটি দিন যাপন করিতে কাতর হয় ঝিল্লিরবাকুল বিষাদবায়ুবীজিত ঘন-অরণ্যবেষ্টিত ভীষণ ভগ্নাবশেষ কেন যে তাহার নিকট বিশেষণরূপে প্রার্থনীয় বোধ হইল বলা কঠিন। আমাদের প্রকৃতির মধ্যে একটি বন্ধন-অসহিষ্ণু স্বেচ্ছাবিহারপ্রিয় পুরুষ এবং একটি গৃহবাসিনী অবরুদ্ধ রমণী দৃঢ় অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া আছে। একজন জগতের সমস্ত নূতন নূতন দেশ, ঘটনা এবং অবস্থার মধ্যে নব নব রসাস্বাদ করিয়া আপন অমর শক্তিকে বিচিত্র বিপুলভাবে পরিপুষ্ট করিয়া তুলিবার জন্য সর্বদা ব্যাকুল, আর-একজন শতসহস্র অভ্যাসে বন্ধনে প্রথায় প্রচ্ছন্ন এবং পরিবেষ্টিত। একজন বাহিরের দিকে লইয়া যায়, আর-একজন গৃহের দিকে টানে। একজন বনের পাখি, আর-একজন খাঁচার পাখি। এই বনের পাখিটাই বেশি গান গাহিয়া থাকে। কিন্তু ইহার গানের মধ্যে অসীম স্বাধীনতার জন্য একটি ব্যাকুলতা একটি অভ্রভেদী ক্রন্দন বিবিধভাবে এবং বিচিত্র রাগিণীতে প্রকাশ পাইয়া থাকে।

সিন্ধবাদ নাবিকের অপরূপ ভ্রমণ এবং রবিন্সন্‌ ক্রুসোর নির্জন দ্বীপপ্রবাস মনের মধ্যে যে এক তৃষাতুর ভাবের উদ্রেক করিয়া দিত, অবোধবন্ধুর প্রথম কবিতাটি সেই ভাবকেই সংক্ষেপে সংগীতে ব্যক্ত করিয়াছিল। যে ভাবের উদয়ে পরিচিত গৃহকে প্রবাস বোধ হয় অপরিচিত বিশ্বের জন্য মন কেমন করিতে থাকে বিহারীলালের ছন্দেই সেই ভাবের প্রথম প্রকাশ দেখিতে পাইয়াছিলাম।

“কভু ভাবি সমুদ্রের ধারে।
যথা যেন গর্জে একেবারে
প্রলয়ের মেঘসংঘ,
প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ভঙ্গ
আক্রমিছে গর্জিয়া বেলারে–
সম্মুখেতে অসীম অপার
জলরাশি রয়েছে বিস্তার;
উত্তাল তরঙ্গ সব
ফেনপুঞ্জে ধব্‌ ধব্‌,
গণ্ডগোলে ছোটে অনিবার–
মহাবেগে বহিছে পবন,
যেন সিন্ধুসঙ্গে করে রণ–
উভে উভ প্রতি ধায়,
শব্দে ব্যোম ফেটে যায়,
পরস্পরে তুমুল তাড়ন–
সেই মহা রণরঙ্গস্থলে
স্তব্ধ হয়ে বসিয়ে বিরলে
(বাতাসের হুহু রবে
কান বেশ ঠাণ্ডা রবে)
দেখিগে শুনিগে সে সকলে।
যে সময়ে পূর্ণ সুধাকর
ভূষিবেন নির্মল অম্বর,
চন্দ্রিকা উজলি বেলা
বেড়াবেন করে খেলা
তরঙ্গের দোলার উপর–
নিবেদিব তাঁহাদের কাছে
মনে মোর যত খেদ আছে।
শুনি না কি মিত্রবরে
দুখের যে অংশী করে
হাঁপ ছেড়ে প্রাণ তার বাঁচে।’
এই বর্ণনাগুলি কতবার পাঠ করিয়াছি তাহার সংখ্যা নাই, এবং এই-সকল শ্লোকের মধ্য দিয়া সমুদ্র-পর্বত-অরণ্যের আহ্বান বালক পাঠকের অন্তরে ধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছিল। সাময়িক অন্য কবির রচনাতেও প্রকৃতিবর্ণনা আছে কিন্তু তাহা প্রথাসংগত বর্ণনামাত্র, তাহা কেবল কবির কর্তব্যপালন। তাহার মধ্যে সেই সোনার কাঠি নাই যাহার স্পর্শে নিখিল প্রকৃতির অন্তরাত্মা সজীব ও সজাগ হইয়া আমাদিগকে নিবিড় প্রেমপাশে আবদ্ধ করে।

সাময়িক কবিদিগের সহিত বিহারীলালের আর-একটি প্রধান প্রভেদ তাঁহার ভাষা। ভাষার প্রতি আমাদের অনেক কবির কিয়ৎপরিমাণে অবহেলা আছে। বিশেষত মিত্রাক্ষর ছন্দের মিলটা তাঁহারা নিতান্ত কায়ক্লেশে রক্ষা করেন। অনেকে কেবলমাত্র শেষ অক্ষরের মিলকে যথেষ্ট জ্ঞান করেন এবং অনেক “হয়েছে’ “করেছে’ “ভুলেছে’ প্রভৃতি ক্রিয়াপদের মিলকে মিল বলিয়া গণ্য করিয়া থাকেন। মিলের দুইটি প্রধান গুণ আছে, এক তাহা কর্ণতৃপ্তিকর আর-এক অভাবিতপূর্ব। অসম্পূর্ণ মিলে কর্ণের তৃপ্তি হয় না, সেটুকু মিলে স্বরের অনৈক্যটা আরো যেন বেশি করিয়া ধরা পড়ে এবং তাহাতে কবির ক্ষমতা ও ভাষার দারিদ্র্য প্রকাশ পায়। ক্রিয়াপদের মিল যত ইচ্ছা করা যাইতে পারে– সেরূপ মিলে কর্ণে প্রত্যেকবার নূতন বিস্ময় উৎপাদন করে না, এইজন্য তাহা বিরক্তিজনক ও “একঘেয়ে’ হইয়া ওঠে। বিহারীলালের ছন্দে মিলের এবং ভাষার দৈন্য নাই। তাহা প্রবহমান নির্ঝরের মতো সহজ সংগীতে অবিশ্রাম ধ্বনিত হইয়া চলিয়াছে। ভাষা স্থানে স্থানে সাধুতা পরিত্যাগ করিয়া অকস্মাৎ অশিষ্ট এবং কর্ণপীড়ক হইয়াছে, ছন্দ অকারণে আপন বাঁধ ভাঙিয়া স্বেচ্ছাচারী হইয়া উঠিয়াছে, কিন্তু সে কবির স্বেচ্ছাকৃত; অক্ষমতাজনিত নহে। তাঁহার রচনা পড়িতে পড়িতে কোথাও এ কথা মনে হয় না যে, এইখানে কবিকে দায়ে পড়িয়া মিল নষ্ট বা ছন্দ ভঙ্গ করিতে হইয়াছে।

কিন্তু উপরে যে ছন্দের শ্লোকগুলি উদ্‌ধৃত হইয়াছে “বঙ্গসুন্দরী’তে সেই ছন্দই প্রধান নহে। প্রথম উপহারটি ব্যতীত “বঙ্গসুন্দরী’র অন্য-সকল কবিতার ছন্দই পর্যায়ক্রমে বারো এবং এগারো অক্ষরে ভাগ করা। যথা–

“সুঠাম শরীর পেলব লতিকা
আনত সুষমা কুসুম ভরে,
চাঁচর চিকুর নীরদ মালিকা
লুটায়ে পড়েছে ধরণী-‘পরে।’
এ ছন্দ নারীবর্ণনার উপযুক্ত বটে– ইহাতে তালে তালে নূপুর ঝংকৃত হইয়া উঠে। কিন্তু এ ছন্দের প্রধান অসুবিধা এই যে, ইহাতে যুক্ত অক্ষরের স্থান নাই। পয়ার ত্রিপদী প্রভৃতি ছন্দে লেখকের এবং পাঠকের অনেকটা স্বাধীনতা আছে। অক্ষরের মাত্রাগুলিকে কিয়ৎপরিমাণে ইচ্ছামত বাড়াইবার কমাইবার অবকাশ আছে। প্রত্যেক অক্ষরকে একমাত্রার স্বরূপ গণ্য করিয়া একেবারে এক নিশ্বাসে পড়িয়া যাইবার আবশ্যক হয় না। দৃষ্টান্তের দ্বারা আমার কথা স্পষ্ট হইবে।–

“হে সারদে দাও দেখা।
বাঁচিতে পারি নে একা,
কাতর হয়েছে প্রাণ, কাতর হৃদয়।
কী বলেছি অভিমানে
শুনো না শুনো না কানে,
বেদনা দিয়ো না প্রাণে ব্যথার সময়।’
ইহার মধ্যে প্রায় যুক্ত অক্ষর নাই। নিম্নলিখিত শ্লোকে অনেকগুলি যুক্তাক্ষর আছে, অথচ উভয় শ্লোকই সুখপাঠ্য এবং শ্রুতিমধুর।

“পদে পৃথ্বী, শিরে ব্যোম,
তুচ্ছ তারা সূর্য সোম,
নক্ষত্র নখাগ্রে যেন গনিবারে পারে,
সম্মুখে সাগরাম্বরা
ছড়িয়ে রয়েছে ধরা,
কটাক্ষে কখন যেন দেখিছে তাহারে।’
এই দুটি শ্লোকই কবির রচিত “সারদামঙ্গল’ হইতে উদ্‌ধৃত। এক্ষণে “বঙ্গসুন্দরী’ হইতে দুইটি শ্লোকই উদ্‌ধৃত করিয়া তুলনা করা যাক।

“একদিন দেব তরুণ তপন
হেরিলেন সুরনদীর জলে
অপরূপ এক কুমারী রতন
খেলা করে নীল নলিনীদলে।’
ইহার সহিত নিম্ন-উদ্‌ধৃত শ্লোকটি একসঙ্গে পাঠ করিলে প্রভেদ প্রতীয়মান হইবে।

“অপ্সরী কিন্নরী দাঁড়াইয়ে তীরে
ধীরয়ে ললিত করুণাতান
বাজায়ে বাজায়ে বীণা ধীরে ধীরে
গাহিছে আদরে স্নেহের গান।’
“অপ্সরী কিন্নরী’ যুক্ত অক্ষর লইয়া এখানে ছন্দ ভঙ্গ করিয়াছে। কবিও এই কারণে “বঙ্গসুন্দরী’তে যথাসাধ্য যুক্ত অক্ষর বর্জন করিয়া চলিয়াছেন।

কিন্তু বাংলা যে-ছন্দে যুক্ত অক্ষরের স্থান হয় না সে-ছন্দ আদরণীয় নহে। কারণ, ছন্দের ঝংকার এবং ধ্বনিবৈচিত্র্য, যুক্ত অক্ষরের উপরেই অধিক নির্ভর করে। একে বাংলা ছন্দে স্বরের দীর্ঘহ্রস্বতা নাই, তার উপরে যদি যুক্ত অক্ষর বাদ পড়ে তবে ছন্দ নিতান্তই অস্থিবিহীন সুললিত শব্দপিণ্ড হইয়া পড়ে। তাহা শীঘ্রই শ্রান্তিজনক তন্দ্রাকর্ষক হইয়া উঠে, এবং হৃদয়কে আঘাতপূর্বক ক্ষুব্ধ করিয়া তুলিতে পারে না। সংস্কৃত ছন্দে যে বিচিত্র সংগীত তরঙ্গিত হইতে থাকে তাহার প্রধান কারণ স্বরের দীর্ঘহ্রস্বতা এবং যুক্ত অক্ষরের বাহুল্য। মাইকেল মধুসূদন ছন্দের এই নিগূঢ় তত্ত্বটি অবগত ছিলেন সেইজন্য তাঁহার অমিত্রাক্ষরে এমন পরিপূর্ণ ধ্বনি এবং তরঙ্গিত গতি অনুভব করা যায়।

আর্যদর্শনে বিহারীলালের “সারদামঙ্গল’ সংগীত যখন প্রথম বাহির হইল, তখন ছন্দের প্রভেদ মুহূর্তেই প্রতীয়মান হইল। “সারদামঙ্গলে’র ছন্দ নূতন নহে, তাহা প্রচলিত ত্রিপদী, কিন্তু কবি তাহা সংগীতে সৌন্দর্যে সিঞ্চিত করিয়া তুলিয়াছিলেন। “বঙ্গসুন্দরী’র ছন্দোলালিত্য অনুকরণ করা সহজ, এবং সেই মিষ্টতা একবার অভ্যস্ত হইয়া গেলে তাহার বন্ধন ছেদন করা কঠিন কিন্তু “সারদামঙ্গলে’র গীতসৌন্দর্য অনুকরণসাধ্য নহে।

“সারদামঙ্গল’ এক অপরূপ কাব্য। প্রথম যখন তাহার পরিচয় পাইলাম তখন তাহার ভাষায় ভাবে এবং সংগীতে নিরতিশয় মুগ্ধ হইতাম, অথচ তাহার আদ্যোপান্ত একটা সুসংলগ্ন অর্থ করিতে পারিতাম না। যেই একটু মনে হয় এইবার বুঝি কাব্যের মর্ম পাইলাম অমনি তাহা আকার পরিবর্তন করে। সূর্যাস্তকালের সুবর্ণ-মণ্ডিত মেঘমালার মতো “সারদামঙ্গলে’র সোনার শ্লোকগুলি বিবিধ রূপের আভাস দেয়, কিন্তু কোনো রূপকে স্থায়ীভাবে ধারণ করিয়া রাখে না– অথচ সুদূর সৌন্দর্যস্বর্গ হইতে একটি অপূর্ব পূরবী রাগিণী প্রবাহিত হইয়া অন্তরাত্মাকে ব্যাকুল করিয়া তুলিতে থাকে।

এইজন্য “সারদামঙ্গলে’র শ্রেষ্ঠতা অরসিক লোকের নিকট ভালোরূপে প্রমাণ করাবড়োই কঠিন হইত। যে বলিত “আমি বুঝিলাম না।– আমাকে বুঝাইয়া দাও তাহার নিকট হার মানিতে হইত।

কবি যাহা দিতেছেন তাহাই গ্রহণ করিবার জন্য পাঠককে প্রস্তুত হওয়া উচিত; পাঠক যাহা চান তাহাই কাব্য হইতে আদায় করিবার চেষ্টা করিতে গেলে অধিকাংশ সময়ে নিরাশ হইতে হয়। তাহার ফল, যাহা চাই তাহা পাই না এবং কবি যাহা দিতেছেন তাহা হইতেও বঞ্চিত হইতে হয়। “সারদামঙ্গলে’ কবি যাহা গাহিতেছেন তাহা কান পাতিয়া শুনিলে একটি স্বর্গীয় সংগীতসুধায় হৃদয় অভিষিক্ত হইয়া উঠে, কিন্তু সমালোচন-শাস্ত্রের আইনের মধ্য হইতে তাহাকে ছাঁকিয়া লইবার চেষ্টা করিলে তাহার অনেক রস বৃথা নষ্ট হইয়া যায়।

প্রকৃতপক্ষে “সারদামঙ্গল’ একটি সমগ্র কাব্য নহে, তাহাকে কতকগুলি খণ্ড কবিতার সমষ্টিরূপে দেখিলে তাহার অর্থবোধ হইতে কষ্ট হয় না। দ্বিতীয়, সরস্বতী সম্বন্ধে সাধারণত পাঠকের মনে যেরূপ ধারণা আছে কবির সরস্বতী তাহা হইতে স্বতন্ত্র।

কবি যে-সরস্বতীর বন্দনা করিতেছেন তিনি নানা আকারে নানা লোকের নিকট উদিত হন। তিনি কখনো জননী, কখনো প্রেয়সী, কখনো কন্যা। তিনি সৌন্দর্যরূপে জগতের অভ্যন্তরে বিরাজ করিতেছেন এবং দয়া-স্নেহ-প্রেমে মানবের চিত্তকে অহরহ বিচলিত করিতেছেন। ইংরেজ কবি শেলি যে-বিশ্বব্যাপিনী সৌন্দর্য-লক্ষ্মীকে সম্বোধন করিয়া বলিয়াছেন_

Slirit of Beauty, that dost consecrate
With thine own hues all thou dost shine ulon
Of human thought or form.

যাহাকে বলিয়াছেন–

Thou messenger of symlathies,
That wax and wane in lovers’ eyes.

সেই দেবীই বিহারীলালের সরস্বতী।

“সারদামঙ্গলে’র আরম্ভের চারি শ্লোকে কবি সেই সারদা দেবীকে মূর্তিমতী করিয়া বন্দনা করিয়াছেন। তৎপরে, বাল্মীকির তপোবনে সেই করুণারূপিণী দেবীর কিরূপে আবির্ভাব হইল, কবি তাহা বর্ণনা করিতেছেন। পাঠকের নেত্রসম্মুখে দৃশ্যপট যখন উঠিল তখন তপোবনে অন্ধকার রাত্রি।

“নাহি চন্দ্র সূর্য তারা
অনল-হিল্লোল-ধারা
বিচিত্র-বিদ্যুৎ-দাম-দ্যুতি ঝলমল।
তিমিরে নিমগ্ন ভব,
নীরব নিস্তব্ধ সব,
কেবল মরুতরাশি কবে কোলাহল।’
এমন সময়ে উষার উদয় হইল।–

“হিমাদ্রিশিখর-‘পরে
আচম্বিতে আলো করে
অপরূপ জ্যেতি ওই পুণ্য-তপোবন।
বিকচ নয়নে চেয়ে
হাসিছে দুধের মেয়ে–
তামসী-তরুণ-উষা কুমারীরতন।
কিরণে ভুবন ভরা,
হাসিয়ে জাগিল ধরা,
হাসিয়ে জাগিল শূন্যে দিগঙ্গনাগণ।
হাসিল অম্বরতলে
পারিজাত দলে দলে,
হাসিল মানসসরে কমলকানন।’
তপোবনে এক দিকে যেমন তিমির রাত্রি ভেদ করিয়া তরুণ উষার অভ্যুদয় হইল তেমনি অপর দিকে নিষ্ঠুর হিংসাকে বিদীর্ণ করিয়া কিরূপে করুণাময় কাব্যজ্যোতি প্রকাশ পাইল কবি তাহার বর্ণনা করিতেছেন।–

“অম্বরে অরুণোদয়,
তলে দুলে দুলে বয়
তমসা তটিনী-রানী কুলুকুলুস্বনে;
নিরখি লোচনলোভা
পুলিনবিপিনশোভা
ভ্রমণে বাল্মীকি মুনি ভাব-ভোলা মনে।
শাখিশাখে রসসুখে
ক্রৌঞ্চ ক্রৌঞ্চী মুখে মুখে
কতই সোহাগ করে বসি দুজনায়।
হানিল শবরে বাণ–
নাশিল ক্রৌঞ্চের প্রাণ–
রুধিরে- আপ্লুত পাখা ধরণী লুটায়।
ক্রৌঞ্চি প্রিয় সহচরে
ঘেরে ঘেরে শোক করে–
অরণ্য পূরিল তার কাতর ক্রন্দনে।
চক্ষে করি দরশন
জড়িমা-জড়িত মন,
করুণহৃদয় মুনি বিহ্বলের প্রায়।
সহসা ললাটভাগে
জ্যোতির্ময়ী কন্যা জাগে,
জাগিল বিজলী যেন নীল নবঘনে।
কিরণে কিরণময়
বিচিত্র আলোকোদয়,
ম্রিয়মাণ রবিচ্ছবি, ভুবন উজলে।
চন্দ্র নয়, সূর্য নয়,
সমুজ্জ্বল শান্তিময়
ঋষির ললাটে আজি না জানি কী জ্বলে
কিরণমণ্ডলে বসি
জ্যোতির্ময়ী সুরূপসী
যোগীর ধ্যানের ধন ললাটিকা মেয়ে
নামিলেন ধীর ধীর,
দাঁড়ালেন হয়ে স্থির,
মুগ্ধনেত্রে বাল্মীকির মুখপানে চেয়ে।
করে ইন্দ্রধনু-বালা,
গলায় তারার মালা,
সীমন্তে নক্ষত্র জ্বলে, ঝল্‌মলে কানন–
কর্ণে কিরণের ফুল,
দোদুল চাঁচর চুল
উড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে ঢাকিয়ে আনন। …
করুণ ক্রন্দন রোল
উত উত উতরোল,
চমকি বিহ্বলা বালা চাহিলেন ফিরে–
হেরিলেন রক্তমাখা
মৃত ক্রৌঞ্চ ভগ্নপাখা,
কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে ক্রৌঞ্চী ওড়ে ঘিরে ঘিরে।
একবার সে ক্রৌঞ্চীরে
আরবার বাল্মীকিরে
নেহারেন ফিরে ফিরে, যেন উন্মাদিনী–
কাতরা করুণাভরে
গান সকরুণ স্বরে,
ধীরে ধীরে বাজে করে বীণা বিষাদিনী।
সে শোকসংগীতকথা
শুনে কাঁদে তরুলতা,
তমসা আকুল হয়ে কাঁদে উভরায়।
নিরখি নন্দিনীছবি
গদগদ আদিকবি
অন্তরে করুণাসিন্ধু উথলিয়া ধায়।’
সারদা দেবীর এই এক করুণামূর্তি। তাহার পর ২১ শ্লোক হইতে আবার একটি কবিতার আরম্ভ হইয়াছে। সে কবিতায় সারদা দেবী ব্রহ্মার মানস-সরোবরে সুবর্ণপদ্মের উপর দাঁড়াইয়াছেন এবং তাঁহার অসংখ্য ছায়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রতিবিম্বিত হইয়াছে। ইহা সারদা দেবীর বিশ্বব্যাপিনী সৌন্দর্যমূর্তি।

“ব্রহ্মার মানসসরে
ফুটে ঢল ঢল করে
নীল জলে মনোহর সুবর্ণনলিনী,
পাদপদ্ম রাখি তায়
হাসি হাসি ভাসি যায়
ষোড়শী রূপসী বামা পূর্ণিমাযামিনী।
কোটি শশী উপহাসি
উথলে লাবণ্যরাশি,
তরল দর্পণে যেন দিগন্তে আবরে;
আচম্বিতে অপরূপ
রূপসীর প্রতিরূপ
হাসি হাসি ভাসি ভাসি উদয় অম্বরে।’
এই সারদা দেবীর Spirit of Beauty-র নব-অভ্যুদিত করুণা-বালিকামূর্তি এবং সর্বত্রব্যাপ্ত সুন্দরী ষোড়শীমূর্তির বর্ণনা সমাপ্ত করিয়া কবি গাহিয়া উঠিয়াছেন–

“তোমারে হৃদয়ে রাখি
সদানন্দ মনে থাকি,
শ্মশান অমরাবতী দু’ই ভালো লাগে।–
গিরিমালা, কুঞ্জবন,
গৃহ, নাট-নিকেতন,
যখন যেখানে যাই, যাও আগে আগে। …
যত মনে অভিলাষ
তত তুমি ভালোবাসো,
তত মনপ্রাণ ভরে আমি ভালোবাসি।
ভক্তিভরে একতানে
মজেছি তোমার ধ্যানে,
কমলার ধনে মানে নহি অভিলাষী।’
এই মানসীরূপিণী সাধনার ধনকে পরিপূর্ণরূপে লাভ করিবার জন্য কাতরতা প্রকাশ করিয়া কবি প্রথম সর্গ সমাপ্ত করিয়াছেন।

তাহার পর-সর্গ হইতে প্রেমিকের ব্যাকুলতা। কখনো অভিমান কখনো বিরহ, কখনো আনন্দ কখনো বেদনা, কখনো ভর্ৎসনা কখনো স্তব। দেবী কবির প্রণয়িনী রূপে উদিত হইয়া বিচিত্র সুখদুঃখে শতধারে সংগীত উচ্ছ্বসিত করিয়া তুলিতেছেন। কবি কখনো তাঁহাকে পাইতেছেন কখনো তাঁহাকে হারাইতেছেন– কখনো তাঁহার অভয়রূপ কখনো তাঁহার সংহারমূর্তি দেখিতেছেন। কখনো তাঁহার অভয়রূপ কখনো তাঁহার সংহারমূর্তি দেখিতেছেন। কখনো তিনি অভিমানিনী, কখনো বিষাদিনী, কখনো আনন্দময়ী।

কবি বিষাদিনীকে বলিতেছেন–

“অয়ি, এ কী, কেন কেন,
বিষণ্ণ হইলে হেন–
আনত আনন-শশী, আনত নয়ন,
অধরে মন্থরে আসি
কপোলে মিলায় হাসি
থরথর ওষ্ঠাধর, স্ফোরে না বচন!
তেমন অরুণ-রেখা
কেন কুহেলিকা-ঢাকা,
প্রভাত-প্রতিমা আজি কেন গা মলিন?
বলো বলো চন্দ্রাননে,
কে ব্যথা দিয়েছে মনে,
কে এমন– এক এমন হৃদয়বিহীন!
বুঝিলাম অনুমানে,
করুণা-কটাক্ষ দানে
চাবে না আমার পানে, কবেও না কথা।
কেন যে কবে না হায়
হৃদয় জানিতে চায়,
শরমে কি বাধে বাণী, মরমে বা বাজে ব্যথা।
যদি মর্মব্যথা নয়,
কেন অশ্রুধারা বয়।
দেববালা ছলাকলা জানে না কখন–
সরল মধুর প্রাণ,
সতত মুখেতে গান,
আপন বীণার তানে আপনি মগন।
অয়ি, হা, সরলা সতী
সত্যরূপা সরস্বতী,
চির-অনুরক্ত ভক্ত হয়ে কৃতাঞ্জলি
পদপদ্মাসন-কাছে
নীরবে দাঁড়ায়ে আছে,
কী করিবে, কোথা যাবে, দাও অনুমতি।
স্বরগকুসুম মালা,
নরক-জ্বলন-জ্বালা,
ধরিবে প্রফুল্লমুখে মস্তক সকলি।
তব আজ্ঞা সুমঙ্গল,
যাই যাব রসাতল,
চাই নে এ বরমালা, এ অমরাবতী।’
কবি অভিমানিনী সরস্বতীকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন–

“আজি এ বিষণ্ণ বেশে
কেন দেখা দিলে এসে,
কাঁদিলে কাঁদালে, দেবি, জন্মের মতন!
পূর্ণিমাপ্রমোদ-আলো,
নয়নে লেগেছে ভালো,
মাঝেতে উথলে নদী, দু পারে দুজন–
চক্রবাক্‌ চক্রবাকী দু পারে দুজন।
নয়নে নয়নে মেলা,
মানসে মানসে-খেলা,
অধরে প্রেমের হাসি বিষাদে মলিন।
হৃদয়বীণার মাঝে
ললিত রাগিণী বাজে,
মনের মধুর গান মনেই বিলীন।
সেই আমি সেই তুমি,
সেই এ স্বরগভূমি,
সেই-সব কল্পতরু সেই কুঞ্জবন,
সেই প্রেম সেই স্নেহ,
সেই প্রাণ সেই দেহ–
কেন মন্দাকিনী-তীরে দু পারে দুজন!’
কখনো মুহূর্তের জন্য সংশয় আসিয়া বলে–

“তবে কি সকলি ভুল?
নাই কি প্রেমের মূল–
বিচিত্র গগনফুল কল্পনালতার?
মন কেন রসে ভাসে,
প্রাণ কেন ভালোবাসে
আদরে পরিতে গলে সেই ফুলহার?
শত শত নরনারী
দাঁড়ায়েছে সারি সারি–
নয়ন খুঁজিছে কেন সেই মুখখানি!
হেরে হারানিধি পায়,
না হেরিলে প্রাণ যায়–
এমন সরল সত্য কী আছে না জানি!’
কখনো-বা প্রেমোপভোগের আদর্শ চিত্র মানসপটে উদিত হয়–

নন্দননিকুঞ্জবনে
বসি শ্বেতশিলাসনে
খোলা প্রাণে রতি-কাম বিহরে কেমন!
আননে উদার হাসি,
নয়নে অমৃতরাশি,
অপরূপ আলো এক উজলে ভুবন।…
কী এক ভাবেতে ভোর;
কী যেন নেশার ঘোর,
টলিয়ে ঢলিয়ে পড়ে নয়নে নয়ন–
গলে গলে বাহুলতা,
জড়িমা-জড়িত কথা,
সোহাগে সোহাগে রাগে গলগল মন।
করে কর থরথর,
টলমল কলেবর,
গুরুগুরু দুরুদুরু বুকের ভিতর–
তরুণ অরুণ ঘটা
আননে আরক্ত ছটা,
অধর-কমলদলে কাঁপে থরথর।
প্রণয় পবিত্র কাম
সুখস্বর্গ মোক্ষধাম।
আজি কেন হেরি হেন মাতোয়ারা বেশ!
ফুলধনু ছড়াছড়ি
দূরে যায় গড়াগড়ি,
রতির খুলিয়ে খোঁপা আলুথালু কেশ!
বিহ্বল পাগলপ্রাণে
চেয়ে সতী পতিপানে,
গলিয়ে গড়িয়ে কোথা চলে গেছে মন!
মুগ্ধ মত্ত নেত্র দুটি,
আধ ইন্দিবর ফুটি,
দুলুদুলু ঢুলুঢুলু করিছে কেমন!
আলসে উঠিছে হাই,
ঘুম আছে, ঘুম নাই,
কী যেন স্বপনমত চলিয়াছে মনে!
সুখের সাগরে ভাসি
কিবে প্রাণ-খোলা হাসি
কী এক লহরী খেলে নয়নে নয়নে!
উথুলে উথুলে প্রাণ
উঠিছে ললিত তান,
ঘুমায়ে ঘুমায়ে গান গায় দুই জন।
সুরে সুরে সম্‌ রাখি
ডেকে ডেকে ওঠে পাখি,
তালে তালে ঢ’লে ঢ’লে চলে সমীরণ।
কুঞ্জের আড়ালে থেকে
চন্দ্রমা লুকায়ে দেখে,
প্রণয়ীর সুখে সদা সুখী সুধাকর।
সাজিয়ে মুকুলে ফুলে
আহ্লাদেতে হেলে দুলে
চৌদিকে নিকুঞ্জলতা নাচে মনোহর।
সে আনন্দে আনন্দিনী,
উথলিয়ে মন্দাকিনী,
করি করি কলধ্বনি বহে কুতুহলে।’
এইরূপ বিষাদ-বিরহ-সংশয়ের পর কবি হিমালয়শিখরে প্রণয়িনী দেবীর সহিত আনন্দমিলনের চিত্র আঁকিয়া গ্রন্থ শেষ করিয়াছেন। আরম্ভ-অংশ ব্যতীত হিমালয়েরবর্ণনা প্রশংসার যোগ্য নহে, সেই বর্ণনা বাদ দিয়া অবশিষ্ট অংশ উদ্‌ধৃত করি–

উদার উদারতর
দাঁড়ায়ে শিখর- ‘পর
এই-যে হৃদয়রানী ত্রিদিব-সুষমা।
এ নিসর্গ-রঙ্গভূমি,
মনোরমা নটী তুমি,
শোভার সাগরে এক শোভা নিরুপমা।
আননে বচন নাই,
নয়নে পলক নাই,
কান নাই মন নাই আমার কথায়–
মুখখানি হাস-হাস,
আলুথালু বেশবাস,
আলুথালু কেশপাশ বাতাসে লুটায়।
না জানি কী অভিনব
খুলিয়ে গিয়েছে ভব
আজি ও বিহ্বল মত্ত প্রফুল্ল নয়নে!
আদরিণী, পাগলিনী,
এ নহে শশি-যামিনী–
ঘুমাইয়ে একাকিনী কী দেখ স্বপনে!
আহা কী ফুটিল হাসি!
বড়ো আমি ভালোবাসি
ওই হাসিমুখখানি প্রেয়সী তোমার–
বিষাদের আবরণে
বিমুক্ত ও চন্দ্রাননে
দেখিবার আশা আর ছিল না আমার।
দরিদ্র ইন্দ্রত্বলাভে
কতটুকু সুখ পাবে,
আমার সুখের সিন্ধু অনন্ত উদার। …
এসো বোন, এসো ভাই,
হেসে খেলে চলে যাই,
আনন্দে আনন্দ করি আনন্দকাননে।
এমন আনন্দ আর নাই ত্রিভুবনে।
হে প্রশান্ত গিরিভূমি,
জীবন জুড়ালে তুমি
জীবন্ত করিয়ে মম জীবনের ধনে।
এমন আনন্দ আর নাই ত্রিভুবনে।
প্রিয়ে সঞ্জীবনী লতা,
কত যে পেয়েছি ব্যথা
হেরে সে বিষাদময়ী মুরতি তোমার।
হেরে কত দুঃস্বপন
পাগল হয়েছে মন–
কতই কেঁদেছি আমি ক’রে হাহাকার।
আজি সে সকলি মম
মায়ার লহরী সম
আনন্দসাগর-মাঝে খেলিয়া বেড়ায়।
দাঁড়াও হৃদয়েশ্বরী,
ত্রিভুবন আলো করি,
দু-নয়ন ভরি ভরি দেখিব তোমায়।
দেখিয়ে মেটে না সাধ,
কী জানি কী আছে স্বাদ,
কী জানি কী মাখা আছে ও শুভ-আননে!
কী এক বিমল ভাতি
প্রভাত করেছে রাতি,
হাসিছে অমরাবতী নয়নকিরণে।
এমন সাধের ধনে
প্রতিবাদী জনে জনে–
দয়া মায়া নাই মনে, কেমন কঠোর!
আদরে গেঁথেছে বালা
হৃদয়কুসুমমালা,
কৃপাণে কাটিবে কে রে সেই ফুলডোর!
পুন কেন অশ্রুজল,
বহ তুমি অবিরল,
চরণকমল আহা ধুয়াও দেবীর!
মানসসরসী কোলে
সোনার নলিনী দোলে,
আনিয়ে পরাও গলে সমীর সুধীর।
বিহঙ্গম, খুলে প্রাণ
ধরো রে পঞ্চম তান,
সারদামঙ্গলগান গাও কুতুহলে।’
কবি যে সূত্রে “সারদামঙ্গলে’র এই কবিতাগুলি গাঁথিয়াছেন তাহা ঠিক ধরিতে পারিয়াছি কি না জানি না– মধ্যে মধ্যে সূত্র হারাইয়া যায়, মধ্যে মধ্যে উচ্ছ্বাস উন্মত্ততায় পরিণত হয়– কিন্তু এ কথা বলিতে পারি আধুনিক বঙ্গসাহিত্যে প্রেমের সংগীত এরূপ সহস্রাধার উৎসের মতো কোথাও উৎসারিত হয় নাই। এমন নির্মল সুন্দর ভাষা, এমন ভাবের আবেগ, কথার সহিত এমন সুরের মিশ্রণ আর কোথাও পাওয়া যায় না; বর্তমান সমালোচক এককালে “বঙ্গসুন্দরী’ “সারদামঙ্গলে’র কবির নিকট হইতে কাব্যশিক্ষার চেষ্টা করিয়াছিল, কতদূর কৃতকার্য হইয়াছে বলা যায় না, কিন্তু এই শিক্ষাটি স্থায়ীভাবে হৃদয়ে মুদ্রিত হইয়াছে যে, সুন্দর ভাষা কাব্যসৌন্দর্যের একটি প্রধান অঙ্গ; ছন্দে এবং ভাষার সর্বপ্রকার শৈথিল্য কবিতার পক্ষে সাংঘাতিক। এই প্রসঙ্গে আমার সেই কাব্যগুরুর নিকট আর-একটি ঋণ স্বীকার করিয়া লই। বাল্যকালে “বাল্মীকি-প্রতিভা’ নামক একটি গীতিনাট্য রচনা করিয়া “বিদ্বজনসমাগম”- নামক সম্মিলন উপলক্ষে অভিনয় করিয়াছিলাম। বঙ্কিমচন্দ্র এবং অন্যান্য অনেক রসজ্ঞ লোকের নিকট সেই ক্ষুদ্র নাটকটি প্রীতিপদ হইয়াছিল। সেই নাটকের মূল ভাবটি, এমন-কি, স্থানে স্থানে তাহার ভাষা পর্যন্ত বিহারীলালের “সারদামঙ্গলে’র আরম্ভভাগ হইতে গৃহীত।

আজ কুড়ি বৎসর হইল “সারদামঙ্গল’ আর্যদর্শন পত্রে এবং ষোলো বৎসর হইল পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইয়াছে; ভারতী পত্রিকায় কেবল একটিমাত্র সমালোচক ইহাকে সাদর সম্ভাষণ করেন। তাহার পর হইতে “সারদামঙ্গল’ এই ষোড়শ বৎসর অনাদৃতভাবে প্রথম সংস্করণের মধ্যেই অজ্ঞাতবাস যাপন করিতেছে। কবিও সেই অবধি আর বাহিরে দর্শন দেন নাই। যিনি জীবনরঙ্গভূমির নেপথ্যে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া দর্শকমণ্ডলীর স্তুতিধ্বনির অতীত ছিলেন তিনি আজ মৃত্যুর যবনিকান্তরালে অপসৃত হইয়া সাধারণের বিদায়সম্ভাষণ প্রাপ্ত হইলেন না; কিন্তু এ কথা সাহসপূর্বক বলিতে পারি, সাধারণের পরিচিত কণ্ঠস্থ শতসহস্র রচনা যখন বিনষ্ট এবং বিস্মৃত হইয়া যাইবে “সারদামঙ্গল’ তখন লোকস্মৃতিতে প্রত্যহ উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিবে এবং কবি বিহারীলাল যশঃস্বর্গে অম্লান বরমাল্য ধারণ করিয়া বঙ্গসাহিত্যের অমরগণের সহিত একাসনে বাস করিতে থাকিবেন।

আষাঢ় ১৩০১

 মন্দ্র

“মন্দ্র’ শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নূতন প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। এই গ্রন্থখানিকে আমরা সাহিত্যের আসরে সাদর অভিবাদনের সঙ্গে আহ্বান করিয়া আনিব– ইহাকে আমরা মুহূর্তমাত্র দ্বারের কাছে দাঁড় করাইয়া রাখিতে পারিব না।

গ্রন্থ-সমালোচনা সম্পাদকের কর্তব্য বলিয়াই গণ্য। অনেকেই অতিমাত্র আগ্রহের সঙ্গেই এ কর্তব্য পালন করিতে অগ্রসর হন। কিন্তু আমাদের এ সম্বন্ধে ব্যগ্রতার যথেষ্ট অভাব আছে, সে কথা স্বীকার করি।

“মন্দ্র’ কাব্যখানিকে অবলম্বন করিয়া আমরা অকস্মাৎ কর্তব্য পালন করিতে আসি নাই। গ্রন্থ পাঠ করিয়া যে আনন্দ পাইয়াছি, তাহাই প্রকাশ করিবার জন্য আমাদের এই উদ্যম।

“মন্দ্র’ কাব্যখানি বাংলার কাব্যসাহিত্যকে অপরূপ বৈচিত্র্য দান করিয়াছে। ইহা নূতনতায় ঝল্‌মল্‌ করিতেছে এবং এই কাব্যে যে ক্ষমতা প্রকাশ পাইয়াছে, তাহা অবলীলাকৃত ও তাহার মধ্যে সর্বত্রই প্রবল আত্মবিশ্বাসের একটি অবাধ সাহস বিরাজ করিতেছে।

সে সাহস কী শব্দনির্বাচনে, কী ছন্দোরচনায়, কী ভাববিন্যাসে সর্বত্র অক্ষুণ্ন। সে সাহস আমাদিগকে বারংবার চকিত করিয়া তুলিয়াছে– আমাদের মনকে শেষ পর্যন্ত তরঙ্গিত করিয়া রাখিয়াছে।

কাব্যে যে নয় রস আছে, অনেক কবিই সেই ঈর্ষান্বিত নয় রসকে নয় মহলে পৃথক করিয়া রাখেন — দ্বিজেন্দ্রলালবাবু অকুতোভয়ে এক মহলেই একত্র তাহাদের উৎসব জমাইতে বসিয়াছেন। তাঁহার কাব্যে হাস্য, করুণা, মাধুর্য, বিস্ময়, কখন কে কাহার গায়ে আসিয়া পড়িতেছে, তাহার ঠিকানা নাই।

এইরূপে “মন্দ্র’ কাব্যের প্রায় প্রত্যেক কবিতা নব নব গতিভঙ্গে যেন নৃত্য করিতেছে, কেহ স্থির হইয়া নাই; ভাবের অভাবনীয় আবর্তনে তাহার ছন্দ ঝংকৃত হইয়া উঠিতেছে এবং তাহার অলংকারগুলি হইতে আলোক ঠিকরিয়া পড়িতেছে।

কিন্তু নর্তনশীলা নটীর সঙ্গে তুলনা করিলে “মন্দ্র’ কাব্যের কবিতাগুলির ঠিক বর্ণনা হয় না। কারণ ইহার কবিতাগুলির মধ্যে পৌরুষ আছে। ইহার হাস্য, বিষাদ, বিদ্রুপ, বিস্ময় সমস্তই পুরুষদের– তাহাতে চেষ্টাহীন সৌন্দর্যের সঙ্গে একটা স্বাভাবিক সবলতা আছে। তাহাতে হাবভাব ও সাজসজ্জার প্রতি কোনো নজর নাই।

বরং উপমা দিতে হইলে শ্রাবণের পূর্ণিমারাত্রির কথা পাড়া যাইতে পারে। আলোক এবং অন্ধকার, গতি এবং স্তব্ধতা, মাধুর্য ও বিরাটভাব আকাশ জুড়িয়া অনায়াসে মিলিত হইয়াছে। আবার মাঝে মাঝে এক-এক পসলা বৃষ্টিও বাতাসকে আর্দ্র করিয়া ঝর্‌ঝর্‌ শব্দে ঝরিয়া পড়ে। মেঘেরও বিচিত্র ভঙ্গি– তাহা কখনো চাঁদকে অর্ধেক ঢাকিতেছে, কখনো পুরা ঢাকিতেছে, কখনো-বা হঠাৎ একেবারে মুক্ত করিয়া দিতেছে — কখনো-বা ঘোরঘটায় বিদ্যুতে স্ফুরিত ও গর্জনে স্তনিত হইয়া উঠিতেছে।

দ্বিজেন্দ্রলালবাবু বাংলাভাষায় একটা নূতন শক্তি আবিষ্কার করিয়াছেন। প্রতিভাসম্পন্ন লেখকের সেই কাজ। ভাষাবিশেষের মধ্যে যে কতটা ক্ষমতা আছে, তাহা তাঁহারাই দেখাইয়া দেন– পূর্বে যাহার অস্তিত্ব কেহ সন্দেহ করে নাই, তাহাই তাঁহারা প্রমাণ করিয়া দেন। দ্বিজেন্দ্রলালবাবু বাংলা কাব্যভাষার একটি বিশেষ শক্তি দেখাইয়া দিলেন। তাহা ইহার গতিশক্তি। ইহা যে কেমন দ্রুতবেগে, কেমন অনায়াসে তরল হইতে গভীর ভাষায়, ভাব হইতে ভাবান্তরে চলিতে পারে, ইহার গতি যে কেবলমাত্র মৃদুমন্থর আবেশভারাক্রান্ত নহে, তাহা কবি দেখাইয়াছেন।

ছন্দ সম্বন্ধেও যেন স্পর্ধাভরে কবি যথেচ্ছ ক্ষমতা প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহার “আশীর্বাদ’ ও “উদ্বোধন’ কবিতায় ছন্দকে একেবারে ভাঙিয়া চুড়িয়া উড়াইয়া দিয়া ছন্দোরচনা করা হইয়াছে। তিনি যেন সাংঘাতিক সংকটের পাশ দিয়া গেছেন– কোথাও যে কিছু বিপদ ঘটে নাই, তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু এই দুঃসাহস কোনো ক্ষমতাহীন কবিকে আদৌ শোভা পাইত না।

এইবার নমুনা উদ্‌ধৃত করিবার সময় আসিয়াছে। কিন্তু আমরা ফুল ছিঁড়িয়া বাগানের শোভা দেখাইবার আশা করি না। পাঠকগণ কাব্য পড়িবেন– কেবল সমালোচনা চাখিয়া ভোজের পূর্ণসুখ নষ্ট করিবেন না।

কার্তিক ১৩০৯

মুসলমান রাজত্বের ইতিহাস

ভারতবর্ষে মুসলমান-প্রবেশের অনতিপূর্বে খৃষ্টশতাব্দীর আরম্ভকালে ভারত-ইতিহাসে একটা রোমাঞ্চকর মহাশূন্যতা দেখা যায়। দীর্ঘ দিবসের অবসানের পর একটা যেন চেতনাহীন সুষুপ্তির অন্ধকার সমস্ত দেশকে আচ্ছন্ন করিয়াছিল– সেটুকু সময়ের কোনো জাগ্রত সাক্ষী কোনো প্রামাণিক নিদর্শন পাওয়া যায় না। গ্রীক এবং শকগণের সহিত সংঘাত তাহার পূর্বেই সমাপ্ত হইয়া গিয়াছিল। যে দ্বন্দ্বসংঘাতে চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য শালিবাহন সমস্ত ভারতবর্ষের চূড়ার উপরে জাগিয়া উঠিয়াছিলেন তাহা কেমন করিয়া একেবারে শান্ত নিরস্ত নিস্তরঙ্গ হইয়াছিল। নিকটবর্তী সময়ের মধ্যে কোনো মহৎ ব্যক্তি বা বৃহৎ উদ্‌বোধনের আবির্ভাব হয় নাই। মুসলমানগণ যখন ভারতবর্ষের ইতিহাস-যবনিকা সবলে ছিন্ন করিয়া উদ্‌ঘাটন করিল তখন রাজপুত নামক এক আধুনিক সম্প্রদায় দেশের সমুদয় উচ্চ স্থানগুলি অধিকার করিয়া মানঅভিমানের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিরোধে দেশকে বিচ্ছিন্ন করিয়া তুলিতেছিল। সে জাতি কখন গঠিত হইল, কখন প্রবল হইল, কখন পশ্চিম হইতে পূর্বদেশ পর্যন্ত ব্যাপ্ত হইল, তাহারা কাহাকেও দূরীকৃত করিয়া কাহার স্থান অধিকার করিল, তা সমস্তই ভারতবর্ষে সেই ঐতিহাসিক অন্ধরজনীর কাহিনী; তাহার আনুপূর্বিকতা প্রচ্ছন্ন। মনে হয়, ভারতবর্ষ তদানীং সহসা কোথা হইতে একটা নিষ্ঠুর আঘাত একটা প্রচণ্ড বেদনা পাইয়া নিঃশব্দ মূর্ছিত হইয়াছিল। তাহার পর হইতে আর সে নিজের পূর্বাবস্থা ফিরিয়া পায় নাই; আর তাহার বীণায় সংগীত বাজে নাই, কোদণ্ডে টংকার জাগে নাই, হোমাগ্নিদীপ্ত তপোবনে ঋষিললাট হইতে ব্রহ্মবিদ্যা উদ্‌ভাসিত হয় নাই।

এ দিকে অনতিপূর্বে ভারতবর্ষের প্রতিবেশে বহুতর খণ্ডবিচ্ছিন্ন জাতি মহাপুরুষ মহম্মদের প্রচণ্ড আকর্ষণবলে একীভূত হইয়া মুসলমান নামক এক বিরাট কলেবর ধারণ করিয়া উত্থিত হইয়াছিল। তাহার যেন ভিন্ন ভিন্ন দুর্গম মরুময় গিরিশিখরের উপরে খণ্ড তুষারের ন্যায় নিজের নিকটে অপ্রবুদ্ধ এবং বাহিরের নিকটে অজ্ঞাত হইয়া বিরাজ করিতেছিল। কখন প্রচণ্ড সূর্যের উদয় হইল এবং দেখিতে দেখিতে নানা শিখর হইতে ছুটিয়া আসিয়া তুষারস্রুত বন্যা একবার একত্র স্ফীত হইয়া তাহার পরে উন্মত্ত সহস্র ধারায় জগৎকে চতুর্দিকে আক্রমণ করিতে বাহির হইল।

তখন শ্রান্ত পুরাতন ভারতবর্ষে বৈদিক ধর্ম বৌদ্ধদের দ্বারা পরাস্ত; এবং বৌদ্ধধর্ম বিচিত্র বিকৃত রূপান্তরে ক্রমশ পুরাণ-উপপুরাণের শতধাবিভক্ত ক্ষুদ্র সংকীর্ণ বক্র প্রণালীর মধ্যে স্রোতোহীন মন্দগতিতে প্রবাহিত হইয়া একটি সহস্রলাঙ্গুল শীতরক্ত সরীসৃপের ন্যায় ভারতবর্ষকে শতপাকে জড়িত করিতেছিল। তখন ধর্মে সমাজে শাস্ত্রে কোনো বিষয়ে নবীনতা ছিল না, গতি ছিল না, বৃদ্ধি ছিল না, সকল বিষয়েই যেন পরীক্ষা শেষ হইয়া গেছে, নূতন আশা করিবার বিষয় নাই। সে সময়ে নূতনসৃষ্ট মুসলমানজাতির বিশ্ববিজয়োদীপ্ত নবীন বল সম্বরণ করিবার উপযোগী কোনো একটা উদ্দীপনা ভারতবর্ষের মধ্যে ছিল না।

নবভাবোৎসাহে এবং ঐক্যপ্রবণ ধর্মবলে একটা জাতি যে কিরূপ মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি লাভ করে পরবর্তীকালে শিখগণ তাহার দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছিল।

কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায় নিরুৎসুক হিন্দুগণ মরিতে কুন্ঠিত হয় নাই। মুসলমানেরা যুদ্ধ করিয়াছে, আর হিন্দুরা দলে দলে আত্মহত্যা করিয়াছে। মুসলমানদের যুদ্ধের মধ্যে এক দিকে ধর্মোৎসাহ, অপর দিকে রাজ্য অথবা অর্থ-লোভ ছিল; কিন্তু হিন্দুরা চিতা জ্বালাইয়া স্ত্রীকন্যা ধ্বংস করিয়া আবালবৃদ্ধ মরিয়াছে– মরা উচিত বিবেচনা করিয়া; বাঁচা তাহাদের শিক্ষাবিরুদ্ধ সংস্কারবিরুদ্ধ বলিয়া। তাহাকে বীরত্ব বলিতে পার কিন্তু তাহাকে যুদ্ধ বলে না। তাহার মধ্যে উদ্দেশ্য অথবা রাষ্ট্রনীতি কিছুই ছিল না।

শাস্ত্রের উপদেশই হউক বা অন্য কোনো ঐতিহাসিক কারণ অথবা জলবায়ুঘটিত নিরুদ্যমবশতই হউক পৃথিবীর উপর হিন্দুদের লুব্ধমুষ্টি অনেকটা শিথিল হইয়া আসিয়াছিল। জগতের কিছুর উপরে তেমন প্রাণপণ দাবি ছিল না। প্রবৃত্তির সেই উগ্রতা না থাকিলে মাংসপেশীতেও যথোচিত শক্তি জোগায় না। গাছ যেমন সহস্র শিকড় দিয়া মাটি কামড়াইয়া থাকে এবং চারি দিক হইতে রস শুষিয়া টানে, যাহারা তেমনি আগ্রহে জগৎকে খুব শক্ত করিয়া না ধরিতে পারে জগৎও তাহাদিগকে ধরিয়া রাখে না। তাহাদের গোড়া আলগা হয়, তাহারা ঝড়ে উলটাইয়া পড়ে। আমরা হিন্দুরা, বিশেষ করিয়া কিছু চাহি না, অন্য প্রাচীরের সন্ধি বিদীর্ণ করিয়া দূরের দিকে শিকড় প্রসারণ করি না — সেইজন্য, যাহারা চায় তাহাদের সহিত পারিয়া উঠা আমাদের কর্ম নহে।

যাহারা চায় তাহারা যে কেমন করিয়া চায় এই সমালোচ্য গ্রন্থে তাহার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত আছে। পৃথিবীর জন্য এমন ভয়ংকর কাড়াকাড়ি রক্তপাত, এত মহাপাতক একত্র আর কোথাও দেখা যায় না। অথচ এই রক্তস্রোতের ভীষণ আবর্তের মধ্য হইতে মাঝে মাঝে দয়াদাক্ষিণ্য ধর্মপরতা রত্নরাজির ন্যায় উৎক্ষিপ্ত হইয়া উঠে।

য়ুরোপীয় খৃস্টানজাতির মধ্যেও এই বিশ্বব্যাপী প্রবৃত্তিক্ষুধা কিরূপ সাংঘাতিক তাহা সমুদ্রতীরের বিলুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় কৃষ্ণ ও রক্তকায় জাতিরা জানে। রূপকথার রাক্ষস যেমন নাসিকা উদ্যত করিয়া আছে, আমিষের ঘ্রাণ পাইলেই গর্জন করিয়া উঠে, “হাঁউ মাঁউ খাঁউ মানুষের গন্ধ পাঁউ–” ইহারা তেমনি কোথাও একটুকরা নূতন জমির সন্ধান পাইলেই দলে দলে চীৎকার করিয়া উঠে, “হাঁউ মাঁউ খাঁউ মাটির গন্ধ পাঁউ। উত্তর আমেরিকার দুর্গম তুষারমরুর মধ্যে স্বর্ণখনির সংবাদ পাইয়া লোভোন্মত্ত নরনারীগণ দীপশিখালুব্ধ পতঙ্গের মতো কেমন উর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়াছে, পথের বাধা, প্রাণের ভয়, অন্নকষ্ট কিছুতেই তাহাদিগকে রোধ করিতে পারে নাই, সে বৃত্তান্ত সংবাদপত্রে সকলেই পাঠ করিয়াছেন। এই যে অচিন্তনীয় কষ্টসাধন– ইহাতে দেশের উন্নতি করিতে পারে কিন্তু ইহার লক্ষ্য দেশের উন্নতি, জ্ঞানের অর্জন অথবা আর-কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নহে– ইহার উদ্দীপক দুর্দান্ত লোভ। দুর্যোধনপ্রমুখ কৌরবগণ যেমন লোভের প্ররোচনায় উত্তরের গোগৃহে ছুটিয়াছিল ইহারাও তেমনি ধরণীর স্বর্ণরস দোহন করিয়া লইবার জন্য মৃত্যুসংকুল উত্তরমেরুর দিকে ধাবিত হইয়াছে।

অধিক দিনের কথা নহে, ১৮৭১ খৃস্টাব্দে একটি ইংরাজ দাসদস্যুব্যবসায়ী জাহাজে কিরূপ ব্যাপার ঘটিয়াছিল তাহার বর্ণনাThe Wide World Magazineনামক একটি নূতন সাময়িক পত্রে প্রকাশিত হইয়াছে। ফিজিদ্বীপে য়ুরোপীয় শস্যক্ষেত্রে মনুষ্য-পিছু তিন পাউন্ড করিয়া মূল্য দেওয়া হইত। সেই লোভে এক দল দাস-চৌর যে কিরূপ অমানুষিক নিষ্ঠুরতার সহিত দক্ষিণসামুদ্রিক দ্বীপপুঞ্জে মনুষ্য শিকার করিত এবং একদা ষাট-সত্তর জন বন্দীকে কিরূপ পিশাচের মতো হত্যা করিয়া সমুদ্রের হাঙর দিয়া খাওয়াইয়াছিল তাহার নিদারুণ বিবরণ পাঠ করিলে খৃস্টানমতের অনন্ত নরকদণ্ডে বিশ্বাস জন্মে।

যে-সকল জাতি বিশ্ববিজয়ী, যাহাদের অসন্তোষ এবং আকাঙক্ষার সীমা নাই, তাহাদের সভ্যতার নিম্নকক্ষে শৃঙ্খলবদ্ধ হিংস্রতা ও উচ্ছৃঙ্খল লোভের যে-একটা পশুশালা গুপ্ত রহিয়াছে, মাঝে মাঝে তাহার আভাস পাইলে কন্টকিত হইতে হয়।

তখন আমাদের মনের মধ্যে এই দ্বন্দ্বের উদয় হয় যে, যে-বৈরাগ্য ভারতবর্ষীয় প্রকৃতিকে পরের অন্নে হস্তপ্রসারণ হইতে নিবৃত্ত করিয়া রাখিয়াছে, দুর্ভিক্ষের উপবাসের দিনেও যাহা তাহাতে শান্তভাবে মরিতে দেয়, তাহা স্বার্থরক্ষার পক্ষে উপযোগী নহে বটে, তথাপি যখন মুসলমানদের ইতিহাসে দেখি উদ্দাম প্রবৃত্তির উত্তেজনার সম্মুখে, ক্ষমতালাভ স্বার্থসাধন সিংহাসনপ্রাপ্তির নিকটে স্বাভাবিক স্নেহ দয়া ধর্ম সমস্তই তুচ্ছ হইয়া যায়; ভাই-ভাই, পিতাপুত্র, স্বামীস্ত্রী, প্রভুভৃত্যের মধ্যে বিদ্রোহ বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা, রক্তপাত এবং অকথ্য অনৈসর্গিক নির্মমতার প্রাদুর্ভাব হয়, যখন খৃস্টান ইতিহাসে দেখা যায় আমেরিকায় অস্ট্রেলিয়ায় মাটির লোভে অসহায় দেশবাসীদিগকে পশুদলের মতো উৎসাদিত করিয়া দেওয়া হইয়াছে, লোভান্ধ দাসব্যবসায়িগণ মানুষকে মানুষ জ্ঞান করে নাই, যখন দেখিতে পাই পৃথিবীটাকে ভাঙিয়া চুরিয়া নিজের কবলে পুরিবার জন্য সর্বপ্রকার বাধা অমান্য করিতে মানুষ প্রস্তুত– ক্লাইভ, হেস্টিংস তাহাদের নিকট মহাপুরুষ এবং সফলতালাভ রাজনীতির শেষ নীতি — তখন ভাবি শ্রেয়ের পথ কোন্‌ দিকে! যদিও জানি যে-বল পশুত্বকে উত্তেজিত করে, সেই বল সময়ক্রমে দেবত্বকে উদ্‌বোধিত করে, জানি যেখানে আসক্তি প্রবল সেইখানেই আসক্তিত্যাগ সুমহৎ, জানি বৈরাগ্যধর্মের ঔদাসীন্য যেমন প্রকৃতিকে দমন করে তেমনি মনুষ্যত্বে অসাড়তা আনে এবং ইহাও জানি অনুরাগধর্মের নিম্নস্তরে যেমন মোহান্ধকার তেমনি তাহার উচ্চশিখরে ধর্মের নির্মলতম জ্যোতি– জানি যে, যেখানে মনুষ্যপ্রকৃতির বলশালিতাবশত প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির সংঘর্ষ প্রচণ্ড সেইখানেই দেবগণের ভোগে বিশুদ্ধতম আধ্যাত্মিক অমৃত উন্মথিত হইয়া উঠে, তথাপি লোভ-হিংসার ভীষণ আন্দোলন এবং বিলাসলালসার নিয়ত চাঞ্চল্যের দৃষ্টান্ত দেখিলে ক্ষণকালের জন্য দ্বিধা উপস্থিত হয়, মনে সন্দেহ জাগে যে, পাপ-পুণ্যের ভালো-মন্দের এইরূপ উত্তঙ্গ তরঙ্গিত অসাম্য শ্রেয়, না অপাপের অমন্দের একটি নির্জীব সুবৃহৎ সমতল নিশ্চলতা শ্রেয়! শেষের দিকেই আমাদের অন্তরের আকর্ষণ– কারণ, বিরাট সংগ্রামের উপযোগী বল আমরা অন্তঃকরণের মধ্যে অনুভব করি না, ধর্ম এবং অর্থ, কাম এবং মোক্ষ এই সব-কটাকে একত্র চালনা করিবার মতো উদ্যম আমাদের নাই– আমরা সর্বপ্রকার দুরন্ত চেষ্টাকে নিবৃত্ত করিয়া সম্পূর্ণ শান্তিলাভ করিবার প্রয়াসী। কিন্তু শাস্ত্রে যখন ভারতবর্ষকে দুর্গপ্রাচীরের মতো রক্ষা করিতে পারে না, পরজাতির সংঘাত যখন অনিবার্য, যখন লোভের নিকট হইতে স্বার্থরক্ষা এবং হিংসার নিকট হইতে আত্মরক্ষা করিতে আমরা বাধ্য, তখন মানবের মধ্যে যে-দানবটা আছে, সেটাকে সকালে সন্ধ্যায় আমিষ খাওয়াইয়া কিছু না হউক দ্বারের বাহিরেও প্রহরীর মতো বসাইয়া রাখা সংগত। তাহাতে কিছু না হউক, বলশালী লোকের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে।

কিন্তু হায়, ভারতবর্ষে দেব-দানবের যুদ্ধে দানবগুলো একেবারেই গেছে– দেবতারাও যে খুব সজীব আছেন, তাহা বোধ হয় না। অন্তত সর্বপ্রকার শঙ্কা ও দ্বন্দ্ব-শূন্য হইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন।

শ্রাবণ ১৩০৫

যুগান্তর

যুগান্তর। সামাজিক উপন্যাস। শ্রীশিবনাথ শাস্ত্রী বিরচিত

শিবনাথবাবুর “যুগান্তর’ উপন্যাসখানি পাঠ করিতে করিতে কর্তব্যক্লান্ত সমালোচকের চিত্ত বহুকাল পরে আনন্দ এবং কৃতজ্ঞতায় উচ্ছ্বসিত হইতেছিল। এমন পর্যবেক্ষণ, এমন চরিত্রসৃজন, এমন সরস হাস্য, এমন সরল সহৃদয়তা বঙ্গসাহিত্যে দুর্লভ। লেখক বিশ্বনাথ তর্কভূষণকে আমাদের নিকট পরমাত্মীয়ের ন্যায় পরিচিত করিয়া দিয়াছেন। এমন সত্য চরিত্র বাংলা উপন্যাসে ইতিপূর্বে কোথাও দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না। লেখক তাঁহাকে সমস্ত তুচ্ছ ঘটনার মধ্যে প্রত্যক্ষবৎ জাজ্বল্যমান দেখিয়াছেন– তাঁহার চরিত্রটিকে প্রতিদিনের হাস্যে এবং অশ্রুজলে, দোষে এবং গুণে অতি সহজেই সজীব করিয়া তুলিয়াছেন। বিরলবসতি বঙ্গসাহিত্যরাজ্যে তর্কভূষণ মহাশয় যে একটি জনসংখ্যা বৃদ্ধি করিলেন এবং আমরা যে একটি স্থায়ী বন্ধু লাভ করিলাম সে বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহমাত্র নাই।

কেবল তর্কভূষণকে কেন, লেখক বঙ্গসাহিত্যে নশিপুর নামক আস্ত-একটি গ্রাম বসাইয়া দিয়াছেন। এই গ্রামের ক্রিয়াকর্ম, আমোদপ্রমোদ, কৌতুক-উপদ্রব, সুজন-দুর্জন সমস্তই পাঠকদের চিরসম্পত্তি হইয়া গিয়াছে। তর্কভূষণের টোল, “হাঁসের দল’ চিমু ঘোষ, জহরলালের ইতিহাস নূতনগঠিত সদ্য-পঠিত হইলেও তাহা আমাদের নিকট যেন অনেক কালের পুরাতন পরিচিত হইয়া উঠিয়াছে। এ দিকে উলোর রামরতন মুখুজ্যের ঘরে তর্কভূষণের কন্যা ভুবনেশ্বরীর ঘরকন্নাও আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ সত্য এবং অত্যন্ত বেদনাজনক হইয়াছে। সংক্ষেপে তর্কভূষণ, তাঁহার গ্রাম, তাঁহার পরিবার, তাঁহার ছাত্রবর্গ, তাঁহার শত্রুমিত্র সকলকে লইয়া একটি গ্রাম্যমণ্ডলীর কেন্দ্রবর্তী সূর্যের ন্যায় আমাদের নিকট প্রবল উজ্জ্বলভাবে প্রকাশিত হইয়াছেন।

এমন সময় আমাদের পরম দুর্ভাগ্যবশত উপন্যাসটি অকস্মাৎ যুগান্তরে লোকান্তরে আসিয়া উপস্থিত হইল। কোথায় গেল তর্কভূষণ, নশিপুর, হাঁসের দল– কোথা হইতে উপস্থিত নবীনচন্দ্র, হাতিবাগান, নবরত্নসভা। গ্রন্থকারও নূতন বেশ ধারণ করিলেন। তিনি ছিলেন ঔপন্যাসিক, হইলেন ঐতিহাসিক; ছিলেন ভাবুক, হইলেন নীতিপ্রচারক। আমরা রসসম্ভোগের সত্যযুগ হইতে তর্কবিতর্কের যুগান্তরে আসিয়া অবতীর্ণ হইলাম। গ্রন্থকার পূর্বে যেখানে মানুষ গড়িতেছিলেন এখন সেখানে মত গড়িতে লাগিলেন, পূর্বে যেখানে আনন্দনিকেতন ছিল এখন সেখানে পাঠশালা বসিয়া গেল। এরূপ অঘটন সংঘটন হইল কেন তাহা বলিতে পারি না। তর্কভূষণের বিধবা ভগিনী বিজয়া এবং তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্র হরচন্দ্রের কলিকাতায় আগমনকালটি তাঁহাদের নিজের পক্ষে সুক্ষণ, কিন্তু উপন্যাসের পক্ষে কুক্ষণ– কারণ সেই উপলক্ষটুকু অবলম্বন করিয়া গ্রন্থের শেষার্ধটি প্রথমার্ধের সহিত জুড়িয়া দেওয়া হইয়াছে। পরস্পরের মধ্যে কোনো অবশ্যযোগ নাই।

দুইটা মানুষকে এক দড়ি দিয়া বাঁধিলে ঐক্য হিসাবেও তাহাদের বলবৃদ্ধি হয় না এবং দ্বৈত হিসাবেও তাহা সুবিধা হয় না। তেমনি দুই স্বতন্ত্র গল্পকে জবরদস্তি করিয়া একত্র বাঁধিয়া দিলে একটা গল্পের হিসাবেও তাহাদের স্বচ্ছন্দ স্বাধীন পরিণতিতে বাধা দেওয়া হয়, দুইটা গল্পের হিসাবেও তাহাদিগকে আড়ষ্ট করিয়া বধ করা হয়। বর্তমান গ্রন্থেও তাহাই হইয়াছে। গ্রন্থকার যদি দুটি গল্পকে বিচ্ছিন্ন আকারে রচনা করিতেন তাহা হইলে সম্ভবত দুটিকেই উৎকৃষ্ট গল্পে পরিণত করিতে পারিতেন।

দ্বিতীয় গল্পটির কথা বলিতে পারি না– কিন্তু প্রথম গল্পটি যে সাহিত্যের অত্যুচ্চ স্থান অধিকার করিত সে বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নাই।

আসল কথা, লেখক নিজেই নূতন যুগের মধ্যে বাস করিতেছেন; এমন-কি, নবযুগরথে চালকবর্গ-মধ্যে তিনিও একজন যোগ্য ব্যক্তি। তিনি ইহার ঘর্গর শব্দ এবং জনতা-কোলাহল হইতে কল্পনাযোগে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করিয়া এতদূরে লইয়া যাইতে পারেন নাই যেখানে শান্তিতে বসিয়া নিপুণ চিত্রকরের ন্যায় ইহাকে চিত্রিত করিতে পারেন। বিচিত্র মতামত এবং তর্কবিতর্কগুলা একেবারে গোটা আসিয়া পড়ে, তাহা রক্তমাংসের মানবাকারে পরিণত হইয়া উঠে না। তাঁহার পঞ্চু, ব্রজরাজ, সুরেন্দ্র গুপ্ত, মথুরেশ, এমন-কি, নবীনও খুব ভালো ছেলে বটে কিন্তু সজীব নহে– তাহারা বীজগণিতের ক খ গ অক্ষরের ন্যায় কেবল কতগুলি চিহ্নমাত্র।

সাহিত্যের চিত্রপটে স্থিতি অপেক্ষা গতি আঁকা শক্ত। যাহা পুরাতন, যাহা স্থির, যাহা নানা দিকে নানা ভাবে সমাজের হৃদয় হইতে রসাকর্ষণ করিয়া শ্যামল সতেজ এবং পরিপূর্ণ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে– তাহাকে সত্য এবং সরসভাবে পাঠকের মনে জাজ্বল্যমান করিয়া তোলা অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু যাহা নূতন উঠিতেছে, যাহা চেষ্টা করিতেছে, যুদ্ধ করিতেছে, পরিবর্তনের মুখে আবর্তিত হইতেছে, যাহা এখনো সর্বাঙ্গীণ পরিণতিলাভ করে নাই তাহাকে যথাযথভাবে প্রতিফলিত করিতে হইলে বিস্তর সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ অথবা ঘাতপ্রতিঘাত-ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়া বিচিত্র নাট্যকলা প্রয়োগ আবশ্যক হয়। কিন্তু সেরূপ করিতে হইলে রচনার বিষয় হইতে রচয়িতার নিজেকে বিশ্লিষ্ট করিয়া লইতে হয় — অত্যন্ত কাছে থাকিলে, মণ্ডলীর কেন্দ্রের মধ্যে বাস করিলে সমগ্রের তুলনায় তাহার অংশগুলি, ব্যক্তির তুলনায় তাহার মতগুলি, কার্যপ্রবাহের তুলনায় তাহার উদ্দেশ্যগুলি যেরূপ বেশি করিয়া চোখে পড়ে, তাহাতে রচনা সত্যবৎ হয় না, তাহার পরিমাণ সামঞ্জস্য নষ্ট হইয়া এবং বাহিরের নির্লিপ্ত পাঠকদের নিকটে কিরূপে বিষয়টিকে সমগ্র এবং সপ্রমাণ করিতে হইবে তাহার ঠাহর থাকে না।

কিন্তু এই দ্বিতীয় নম্বর গল্পটিতেও লেখক যেখানেই নবযুগের আবর্ত ছাড়িয়া খাঁটি মানুষগুলির কথা বলিয়াছেন সেইখানেই দুই-চারিটি সরল বর্ণনায় স্বল্প রেখাপাতে অতি সহজেই চিত্র আঁকিয়াছেন চিত্র এবং পাঠকের হৃদয়কে রসে অভিষিক্ত করিয়াছেন। এক স্থলে গ্রন্থকার প্রসঙ্গক্রমে শ্রীধর ঘোষের সহিত কেবল চকিতের মতো আমাদের পরিচয় করাইয়া তাহাকে অপসৃত করিয়া দিয়াছেন– কিন্তু সেই স্বল্পকালের পরিচয়েই আমাদের মনে একটা আক্ষেপ রাখিয়া গিয়াছেন; আমাদের বিশ্বাস, লেখক মনোযোগ করিলে এই শ্রীধর ঘোষটিকে একটি গ্রন্থের কেন্দ্রস্থলে স্থাপন করিয়া আর-একটি উপন্যাসকে প্রাণদান করিতে পারিতেন। আমরা শ্রীধরের সংক্ষেপ পরিচয়টি এ স্থলে উদ্‌ধৃত করি।

“এই ঘোষ-পরিবার বৈষ্ণব পরিবার– গোঁসায়ের শিষ্য। শ্রীধর মহাশয় অতি সাত্ত্বিক প্রকৃতির লোক ছিলেন। উদরান্নের জন্য ম্লেচ্ছের অধীনে কাজ করিতেন বটে, কিন্তু নিষ্ঠার কিছুমাত্র ব্যাঘাত হইত না। আপিসে যখন কর্ম করিতেন, তখন তাঁহার নাসাতে তিলক ও সর্বাঙ্গে হরিনামের ছাপ দৃষ্ট হইত। || মানুষটি শ্যামবর্ণ সুস্থ ও সবলদেহ ছিলেন, মুখটি সদ্‌ভাবে ও ভক্তিতে যেন গদ্‌গদ, সে মুখ দেখিলেই কেমন হৃদয় স্বভাবত তাঁহার দিকে আকৃষ্ট হইত। ঘোষজা মহাশয় আপিসে প্রবেশের দ্বারের পার্শ্বের ঘরেই বসিতেন; এবং যত গাড়ি মাল আমদানি ও রপ্তানি হইত তাহার হিসাব রাখিতেন। সুতরাং তাঁহাকে প্রতিদিন প্রাতঃকালে আপিসে প্রবেশের সময়ে অনেকবার এই প্রশ্ন শুনিতে হইত||| কী ঘোষজা মশাই, খবর কীও? সব কুশল তো? অমনি ঘোষজার উত্তর, “আজ্ঞে গোবিন্দের কৃপাতে সবই কৃশল।” ঘোষজা দোলের সময় কিছু ব্যয় করিতেন; লোকজনকে শ্রদ্ধাসহকারে আহ্বান করিয়া উত্তমরূপ খাওয়াইতেন। এইজন্য আপিসের লোক মাঘ মাস পড়িলেই জিজ্ঞাসা করিত– “কী ঘোষজা মশাই, এবার দোল করবেন তো?” অমনি উত্তর– “আজ্ঞে কী জানি, যা গোবিন্দের ইচ্ছা।” গোবিন্দের প্রতি নির্ভরের ভাব তাঁহার এমন স্বাভাবিক ছিল যে, আট বৎসর বয়সে ওলাউঠা রোগে তাঁহার দ্বিতীয় পুত্রটির কাল হইলে, তাহারই তিন-চারি দিন পরে আপিসের একজন লোক জিজ্ঞাসা করিলেন– “কী ঘোষমশাই, ছেলে দুটো মানুষ হচ্ছে তো?” ঘোষজা উত্তর করিলেন– “আজ্ঞে দুটো আর কই? এখন তো একটি, কেবল বড়োটিই আছে।” প্রশ্নকর্তা বিস্মিত হইয়া কহিলেন– “সে ছেলেটির কী হল? ঘোষজা উত্তর করিলেন– “আজ্ঞে গোবিন্দ সেটিকে নিয়েছেন।”||| তিনি সাধ করিয়া নাতি নাতনীদের নাম রাখিয়াছিলেন। পুত্রের সর্বজ্যেষ্ঠা কন্যা হইলে তাহার নাম রাধারানী রাখিলেন ||| সবজ্যেষ্ঠা রাধারানী তাঁহার প্রথম আদরের ধন ছিল। “রাধে। রাজনন্দিনী। গরবিনী। শ্যামসোহাগিনী।” বলিয়া যখন ডাকিতেন, তখন এক বৎসরের বালিকা রাধারানী অচিরোদ্‌গত-দন্তাবলীশোভিত মুখচন্দ্রে একটু হাসিয়া, ঝাঁপাইয়া তাঁহার ক্রোড়ে গিয়া পড়িত। তাহাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া বলিতেন — “রাখালের সনে প্রেম করিস নে রাই!” অমনি চক্ষে জলধারা বহিত।’

এ দিকে শিশুকন্যা টিমিমণি, নবীনের সহিত তাঁহার ভ্রাতৃবধূর সম্বন্ধ, নবীনের রাঙা মা — এগুলিও লেখক বড়ো সরল এবং সরস সুমিষ্টভাবে ফুটাইয়া তুলিয়াছেন।

লেখক ধারাবাহিক গল্পের প্রতি বড়ো-একটা দৃষ্টিপাত করেন নাই– আমরাও গল্পের জন্য বিশেষ লালায়িত নহি। আমরা একজন রীতিমত মনুষ্যের আনন্দজনক বিশ্বাসজনক জীবনবৃত্তান্ত চাহি– নশিপুর গ্রামে তর্কভূষণ-পরিবারের আদ্যোপান্ত বিবরণ শুনিয়া যাইতে আমাদের কিছুমাত্র শ্রান্তিবোধ হইত না; কারণ, তর্কভূষণ আমাদের হৃদয় আকর্ষণ করিয়াছেন এবং লেখকও তাঁহার সূক্ষ্মদর্শিনী হাস্যবর্ষিণী কল্পনাশক্তি দ্বারা আমাদের সম্পূর্ণ বিশ্বাস আকর্ষণ করিতে পারিয়াছেন। কিন্তু লেখক দুইখানি বহির পাতা পরস্পর উল্‌টাপাল্‌টা করিয়া দিয়া একসঙ্গে বাঁধাইয়া দপ্তরির অন্ন মারিয়াছেন এবং পাঠকদিগের রসভঙ্গ করিয়াছেন, এ আক্ষেপ আমরা কিছুতেই ভুলিতে পারিব না ।

চৈত্র ১৩০১

রাজসিংহ

নূতন পরিবর্ধিত সংস্করণ

“রাজসিংহ’ প্রথম হইতে উলটাইয়া গেলে এই কথাটি বারম্বার মনে হয় যে, কোনো ঘটনা কোনো পরিচ্ছেদ কোথাও বসিয়া কালক্ষেপ করিতেছে না। সকলেই অবিশ্রাম চলিয়াছে, এবং সেই অগ্রসরগতিতে পাঠকের মন সবলে আকৃষ্ট হইয়া গ্রন্থের পরিণামের দিকে বিনা আয়াসে ছুটিয়া চলিতেছে।

এই অনিবার্য অগ্রসরগতি সঞ্চার করিবার জন্য বঙ্কিমবাবু তাঁহার প্রত্যেক পরিচ্ছেদ হইতে সমস্ত অনাবশ্যক ভার দূরে ফেলিয়া দিয়াছেন। অনাবশ্যক কেন, অনেক আবশ্যক ভারও বর্জন করিয়াছেন, কেবল অত্যাবশ্যকটুকু রাখিয়াছেন মাত্র।

কোনো ভীরু লেখকের হাতে পড়িলে ইহার মধ্যে অনেকগুলি পরিচ্ছেদে বড়ো বড়ো কৈফিয়ত বসিত। জবাবদিহির ভয়ে তাহাকে অনেক কথা বাড়াইয়া লিখিতে হইত। সম্রাটের অন্তঃপুরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া বাদশাহজাদীর সহিত মোবারকের প্রণয়ব্যাপার, তাহা লইয়া দুঃসাহসিকা আতরওয়ালী দরিয়ার প্রগল্‌ভতা, চঞ্চলকুমারীর নিকট আপন পরামর্শ ও পাঞ্জা-সমেত যোধপুরী বেগমের দূতীপ্রেরণ, সেনাপতির নিকট নৃত্যকৌশল দেখাইয়া দরিয়ার পুরুষবেশী অশ্বারোহী সৈনিক সাজিবার সম্মতি গ্রহণ– এ-সমস্ত যে একেবারেই সম্ভবাতীত তাহা না হইতে পারে– কিন্তু ইহাদের সত্যতার বিশিষ্ট প্রমাণ আবশ্যক। বঙ্কিমবাবু এক-একটি ছোটো ছোটো পরিচ্ছেদে ইহাদিগকে এমন অবলীলাক্রমে অসংকোচে ব্যক্ত করিয়া গেছেন যে, কেহ তাঁহাকে সন্দেহ করিতে সাহস করে না। ভীতু লেখকের কলম এই-সকল জায়গায় ইতস্তত করিত, অনেক কথা বলিত এবং অনেক কথা বলিতে গিয়াই পাঠকের সন্দেহ আরো বেশি করিয়া আকর্ষণ করিত।

বঙ্কিমবাবু একে তো কোথাও কোনোরূপ জবাবদিহি করেন নাই, তাহার উপরে আবার মাঝে মাঝে নির্দোষ পাঠকদিগকেও ধমক দিতে ছাড়েন নাই। মানিকলাল যখন পথের মধ্যে হঠাৎ অপরিচিতা নির্মলকুমারীকে তাহার সহিত এক ঘোড়ায় উঠিয়া বসিতে বলিল এবং নির্মল যখন তাহার নিকট বিবাহের প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করিয়া অবিলম্বে মানিকলালের অনুরোধ রক্ষা করিল, তখন লেখক কোথায় তাঁহার স্বরচিত পাত্রগুলির এইরূপ অপূর্ব ব্যবহারে কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হইবেন, তাহা না হইলে উলটিয়া তিনি বিস্মিত পাঠকবর্গের প্রতি কটাক্ষপাত করিয়া বলিয়াছেন — “বোধ হয় কোর্টশিপটা পাঠকের বড়ো ভালো লাগিল না। আমি কী করিব। ভালোবাসাবাসির কথা একটাও নাই– বহকালসঞ্চিতপ্রণয়ের কথা কিছু নাই — “হে প্রাণ! “হে প্রাণাধিকা!’ সে-সব কিছুই নাই– ধিক!’

এই গ্রন্থবর্ণিত পাত্রগণের চরিত্রের, বিশেষত স্ত্রীচরিত্রের মধ্যে বড়ো একটা দ্রুততা আছে। তাহারা বড়ো বড়ো সাহসের এবং নৈপুণ্যের কাজ করে অথচ তৎপূর্বে যথেষ্ট ইতস্তত অথবা চিন্তা করে না। সুন্দরী বিদ্যুৎরেখার মতো এক নিমেষে মেঘাবরোধ ছিন্ন করিয়া লক্ষ্যের উপর গিয়া পড়ে, কোনো প্রস্তরভিত্তি সেই প্রলয়গতিকে বাধা দিতে পারে না। স্ত্রীলোক যখন কাজ করে তখন এমনি করিয়াই কাজ করে; তাহার সমগ্র মনপ্রাণ লইয়া বিবেচনা চিন্তা বিসর্জন দিয়া একেবারে অব্যবহিতভাবে উদ্দেশ্যসাধনে প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু যে হৃদয়বৃত্তি প্রবল হইয়া তাহার প্রাত্যহিক গৃহকর্মসীমার বাহিরে তাহাকে অনিবার্যবেগে আকর্ষণ করিয়া আনে, পাঠককে পূর্ব হইতে তাহার একটা পরিচয় একটু সংবাদ দেওয়া আবশ্যক। বঙ্কিমবাবু তাহা পুরাপুরি দেন নাই।

সেইজন্য “রাজসিংহ’ প্রথম পড়িতে পড়িতে মনে হয় সহসা এই উপন্যাস-জগৎ হইতে মাধ্যাকর্ষণশক্তির প্রভাব যেন অনেকটা হ্রাস হইয়া গিয়াছে। আমাদিগকে যেখানে কষ্টে চলিতে হয় এই উপন্যাসের লোকেরা সেখানে লাফাইয়া চলিতে পারে। সংসারে আমরা চিন্তা শঙ্কা সংশয়-ভারে ভারাক্রান্ত, কার্যক্ষেত্রে সর্বদাই দ্বিধাপরায়ণ মনের বোঝাটা বহিয়া বেড়াইতে হয়– কিন্তু “রাজসিংহ’-জগতে অধিকাংশ লোকের যেন আপনার ভার নাই।

যাহারা আজকালকার ইংরাজি নভেল বেশি পড়ে তাহাদের কাছে এই লঘুতা বড়ো বিস্ময়জনক। আধুনিক ইংরাজি নভেলে পদে পদে বিশ্লেষণ– একটা সামান্যতম কার্যের সহিত তাহার দূরতম কারণপরম্পরা গাঁথিয়া দিয়া সেটাকে বৃহদাকার করিয়া তোলা হয়– ব্যাপারটা হয়তো ছোটো কিন্তু তাহার নথিটা বড়ো বিপর্যয়। আজকালকার নভেলিস্টরা কিছুই বাদ দিতে চান না, তাঁহাদের কাছে সকলই গুরুতর। এইজন্য উপন্যাসে সংসারের ওজন ভয়ংকর বাড়িয়া উঠিয়াছে। ইংরাজের কথা জানি না, কিন্তু আমাদের মতো পাঠককে তাহাতে অত্যন্ত ক্লিষ্ট করে।

এইজন্য আধুনিক উপন্যাস আরম্ভ করিতে ভয় হয়। মনে হয়, কর্মক্লান্ত মানবহৃদয়ের পক্ষে বাস্তবজগতের চিন্তাভার অনেক সময় যথেষ্টের বেশি হইয়া পড়ে, আবার যদি সাহিত্যও নির্দয় হয় তবে আর পলায়নের পথ থাকে না। সাহিত্যে আমরা জগতের সত্য চাই, কিন্তু জগতের ভার চাহি না।

কিন্তু সত্যকে সম্যক প্রতীয়মান করিয়া তুলিবার জন্য কিয়ৎপরিমাণে ভারের আবশ্যক, সেটুকু ভারে কেবল সত্য ভালোরূপ অনুভবগম্য হইয়া হৃদয়ের আনন্দ উৎপাদন করে; কল্পনাজগৎ প্রত্যক্ষবৎ দৃঢ় স্পর্শযোগ্য ও চিরস্থায়ীরূপে প্রতিষ্ঠিত বোধ হয়।

বঙ্কিমবাবু রাজসিংহে সেই আবশ্যক ভারেরও কিয়দংশ যেন বাদ দিয়াছেন বোধ হয়। ভারে যেটুকু কম পড়িয়াছে গতির দ্বারায় তাহা পূরণ করিয়াছেন। উপন্যাসের প্রত্যেক অংশ অসন্দিগ্ধরূপে সম্ভবপর ও প্রশ্নসহ করিয়া তুলেন নাই, কিন্তু সমস্তটার উপর দিয়া এমন দ্রুত অবলীলাভঙ্গিতে চলিয়া গিয়াছেন যে প্রশ্ন করিবার আবশ্যক হয় নাই। যেন রেলপথের মাঝে মাঝে এমন এক-আধটা ব্রিজ আছে যাহা পুরা মজবুত বলিয়া বোধ হয় না– কিন্তু চালক তাহার উপর দিয়া এমন দ্রুত গাড়ি লইয়া চলে যে, ব্রিজ ভাঙিয়া পড়িবার অবসর পায় না।

এমন হইবার কারণও স্পষ্ট পড়িয়া রহিয়াছে। যখন বৃহৎ সৈন্যদল যুদ্ধ করিতে চলে তখন তাহারা সমস্ত ঘরকর্‌না কাঁধে করিয়া লইয়া চলিতে পারে না। বিস্তর আবশ্যক দ্রব্যের মায়াও তাহাদিগতে ত্যাগ করিতে হয়। চলৎশক্তির বাধা তাহাদের পক্ষে মারাত্মক। গৃহস্থ-মানুষের পক্ষে উপকরণের প্রাচুর্য এবং ভারবাহুল্য শোভা পায়।

রাজসিংহের গল্পটা সৈন্যদলের চলার মতো– ঘটনাগুলা বিচিত্র ব্যূহ রচনা করিয়া বৃহৎ আকারে চলিয়াছে। এই সৈন্যদলের নায়ক যাঁহারা তাঁহারাও সমান বেগে চলিয়াছেন, নিজের সুখদুঃখের খাতিরে কোথাও বেশিক্ষণ থামিতে পারিতেছেন না।

একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। রাজসিংহের সহিত চঞ্চলকুমারীর প্রণয়ব্যাপরটা তেমন ঘনাইয়া উঠে নাই বলিয়া কোনো কোনো পাঠক এবং সম্ভবত বহুসংখ্যক পাঠিকা আক্ষেপ করিয়া থাকেন। বঙ্কিমবাবু বড়ো-একটি দুর্লভ অবসর পাইয়াছিলেন — এই সুযোগে কন্দর্পের পঞ্চশরে এবং করণরসের বরুণবাণে দিগ্‌বিদিক সমাকুল করিয়া তুলিতে পারিতেন।

কিন্তু তাহার সময় ছিল না। ইতিহাসের সমস্ত প্রবাহ তখন একটি সংকীর্ণ সন্ধিপথে বজ্রস্তনিতরবে ফেনাইয়া চলিতেছে– তাহারই উপর দিয়া সামাল্‌ সামাল্‌ তরী। তখন রহিয়া-বসিয়া ইনিয়া-বিনিয়া প্রেমাভিনয় করিবার সময় নহে।

তখনকার যে প্রেম, সে অত্যন্ত বাহুল্যবর্জিত সংক্ষিপ্ত সংহত। সে তো বাসররাত্রের সুখশয্যার বাসন্তী প্রেম নহে– ঘনবর্ষার কালরাত্রে মৃত্যু হঠাৎ পশ্চাৎ হইতে আসিয়া দোলা দিয়াছে– মান-অভিমান লাজ-লজ্জা বিসর্জন দিয়া ত্রস্ত নায়িকা চকিত বাহুপাশে নায়ককে বাঁধিয়া ফেলিয়াছে। এখন সুদীর্ঘ সুমধুর ভূমিকার সময় নাই।

এই অকস্মাৎ মৃত্যুর দোলায় সকলেই সজাগ হইয়া উঠিয়াছে এবং আপনার অন্তরবাসী মহাপ্রাণীর আলিঙ্গন অনুভব করিতেছে। কোথায় ছিল ক্ষুদ্র রূপনগরের অন্তঃপুরপ্রান্তে একটি বালিকা, কালক্রমে সে কোন্‌ ক্ষুদ্র রাজপুত নৃপতির শত রাজ্ঞীর মধ্যে অন্যতম হইয়া অসম্ভব-চিত্রিত লতার উপরে অসম্ভব-চিত্রিত পক্ষী-খচিত শ্রেতপ্রস্তররচিত কক্ষপ্রাচীরমধ্যে পুরু গালিচায় বসিয়া রঙ্গসঙ্গিনীগণের হাসিটিটকারি-পরিবৃত হইয়া আলবোলায় তামাকু টানিত, সেই পুষ্পপ্রতিমা সুকুমার সুন্দর বালিকাটুকুর মধ্যে কী এক দুর্বার দুর্ধর্ষ প্রাণশক্তি জাগিয়া উঠিল — সে আজ বাঁধমুক্ত বন্যার একটি গর্বোদ্ধত প্রবল তরঙ্গের ন্যায় দিল্লির সিংহাসনে গিয়া আঘাত করিল। কোথায় ছিল মোগল-রাজপ্রাসাদের রত্নখচিত রঙমহলে সুন্দরী জেবউন্নিসা–সে সুখের উপর সুখ, বিলাসের উপর বিলাস বিকীর্ণ করিয়া আপনার অত্মরাত্মাকে আরামের পুষ্পরাশির মধ্যে আচ্ছন্ন অচেতন্‌ করিয়া রাখিয়াছিল–সেদিনের সেই মৃত্যুদোলায় হঠাৎ তাহার অন্তরশয্যা হইতে জাগ্রত হইয়া তাহাকে কোন্‌ মহাপ্রাণী এমন নিষ্ঠুর কঠিন বাহুবেষ্টনে পীড়ন করিয়া ধরিল, সম্রাটদুহিতাকে কে সেই সর্বত্রগামী দুঃখের হস্তে সমর্পণ করিল যে দুঃখ প্রাসাদের রাজরাজেশ্বরীকেও কুটিরবাসিনী কৃষককন্যার সহিত এক বেদনাশয্যায় শয়ন করাইয়া দেয়! দস্যু মানিকলাল হইল বীর, রূপমুগ্ধ মোবারক মৃত্যুসাগরে আত্মবিসর্জন করিল, গৃহপিঞ্জরের নির্মলকুমারী বিপ্লবের বহিরাকাশে উড়িয়া আসিল এবং নৃত্যকুশলা পতঙ্গচপলা দরিয়া সহস্য অট্টহাস্যে মুক্তকেশে কালনৃত্যে আসিয়া যোগ দিল।

অর্ধরাত্রির এই বিশ্বব্যাপী ভয়ংকর জাগরণের মধ্যে কি মধ্যাহ্নকুলায়বাসী প্রণয়ের করুণ কপোতকূজন প্রত্যাশা করা যায়?

“রাজসিংহ’ দ্বিতীয় “বিষবৃক্ষ’ হয় নাই বলিয়া আক্ষেপ করা সাজে না। “বিষবৃক্ষে’র সুতীব্র সুখদুঃখের পাকগুলা প্রথম হইতেই পাঠকের মনে কাটিয়া কাটিয়া বসিতেছিল; অবশেষে শেষ কয়টা পাকে হতভাগ্য পাঠকের একেবারে কণ্ঠরূদ্ধ হইয়া আসে। “রাজসিংহে’র প্রথম দিকের পরিচ্ছেদগুলি মনের উপর সেরূপ রক্তবর্ণ সুগভীর চিহ্ন দিয়া যায় না। তাহার কারণ “রাজসিংহ’ স্বতন্ত্রজাতীয় উপন্যাস।

প্রবন্ধ লিখিতে বসিয়াছি বলিয়াই মিথ্যা কথা বলিবার আবশ্যক দেখি না। কাল্পনিক পাঠক খাড়া করিয়া তাহাদের প্রতি দোষারোপ করা আমার উচিত হয় না। আসল কথা এই যে, “রাজসিংহ’ পড়া আরম্ভ করিয়া আমারই মনে প্রথম-প্রথম খটকা লাগিতেছিল। আমি ভাবিতেছিলাম, বড়োই বেশি বাড়াবাড়ি দেখিতেছি — কাহারো যেন মিষ্টমুখে দুটো ভদ্রতার কথা বলিয়া যাইবারও অবসর নাই। মনের ভিতর এমন আঁচড় দিয়া না গিয়া আর-একটু গভীরতররূপে কর্ষণ করিয়া গেলে ভালো হইত। যখন এই-সকল কথা ভাবিতেছিলাম তখন “রাজসিংহে’র ভিতরে গিয়া প্রবেশ করি নাই।

পর্বত হইতে প্রথম বাহির হইয়া যখন নির্ঝরগুলা পাগলের মতো ছুটিতে আরম্ভ করে তখন মনে হয় তাহারা খেলা করিতে বাহির হইয়াছে, মনে হয় না তাহারা কোনো কাজের। পৃথিবীতেও তাহারা গভীর চিহ্ন অঙ্কিত করিতে পারে না। কিছুদূর তাহাদের পশ্চাতে অনুসরণ করিলে দেখা যায় নির্ঝরগুলা নদী হইতেছে– ক্রমেই গভীরতর হইয়া ক্রমেই প্রশস্ততর হইয়া পর্বত ভাঙিয়া পথ কাটিয়া জয়ধ্বনি করিয়া মহাবলে অগ্রসর হইতেছে– সমুদ্রের মধ্যে মহাপরিণাম প্রাপ্ত হইবার পূর্বে তাহার আর বিশ্রাম নাই।

“রাজসিংহে’ও তাই। তাহার এক-একটি খণ্ড এক-একটি নির্ঝরের মতো দ্রুত ছুটিয়া চলিয়াছে। প্রথম-প্রথম তাহাতে কেবল আলোকের ঝিকিঝিকি এবং চঞ্চল লহরীর তরল কলধ্বনি — তাহার পর ষষ্ঠ খণ্ডে দেখি ধ্বনি গভীর স্রোতের পথ গভীর এবং জলের বর্ণ ঘনকৃষ্ণ হইয়া আসিতেছে, তাহার পর সপ্তম খণ্ডে দেখি কতক-বা নদীর স্রোত, কতক-বা সমুদ্রের তরঙ্গ, কতক-বা অমোঘ পরিণামের মেঘগম্ভীর গর্জন, কতক-বা তীব্র লবণাশ্রুনিমগ্ন হৃদয়ের সুগভীর ক্রন্দনোচ্ছ্বাস, কতক-বা কালপুরুষলিখিত ইতিহাসের অব্যাকুল বিরাট বিস্তার, কতক-বা ব্যক্তিবিশেষের মজ্জমান তরণীর প্রাণপণ হাহাধ্বনি। সেখানে নৃত্য অতিশয় রুদ্র, ক্রন্দন অতিশয় তীব্র এবং ঘটনাবলী ভারত-ইতিহাসের একটি যুগাবসান হইতে যুগান্তরের দিকে ব্যাপ্ত হইয়া গিয়াছে।

“রাজসিংহ’ ঐতিহাসিক উপন্যাস। ইহার নায়ক কে কে? ঐতিহাসিক অংশের নায়ক ঔরংজেব, রাজসিংহ এবং বিধাতাপুরুষ– উপন্যাস অংশের নায়ক আছে কি না জানি না, নায়িক জেবউন্নিসা।

রাজসিংহ, চঞ্চলকুমারী, নির্মলকুমারী, মানিকলাল প্রভৃতি ছোটোবড়ো অনেকে মিলিয়া সেই মেঘদুর্দিন রথযাত্রার দিনে ভারত-ইতিহাসের রথরজ্জু আকর্ষণ করিয়া দুর্গম বন্ধুর পথে চলিয়াছিল। তাহাদের মধ্যে অনেকে লেখকের কল্পনাপ্রসূত হইতে পারে তথাপি তাহারা এই ঐতিহাসিক উপন্যাসের ঐতিহাসিক অংশেরই অন্তর্গত। তাহাদের জীবন-ইতিহাসের, তাহাদের সুখদুঃখের স্বতন্ত্র মূল্য নাই– অর্থাৎ এ গ্রন্থে প্রকাশ পায় নাই।

জেবউন্নিসার সহিত ইতিহাসের যোগ আছে বটে, কিন্তু সে যোগ গৌণভাবে। সে যোগটুকু না থাকিলে এ গ্রন্থের মধ্যে তাহার কোনো অধিকার থাকিত না। যোগ আছে কিন্তু বিপুল ইতিহাস তাহাকে গ্রাস করিয়া আপনার অংশীভূত করিয়া লয় নাই, সে আপনার জীবন-কাহিনী লইয়া স্বতন্ত্রভাবে দীপ্যমান হইয়া উঠিয়াছে।

সাধারণ ইতিহাসের একটা গৌরব আছে। কিন্তু স্বতন্ত্র মানবজীবনের মহিমাও তদপেক্ষা ন্যূন নহে। ইতিহাসের উচ্চচূড় রথ চলিয়াছে, বিস্মিত হইয়া দেখো, সমবেত হইয়া মাতিয়া উঠ, কিন্তু সেই রথচক্রতলে যদি একটি মানবহৃদয় পিষ্ট হ|ইয়া ক্রন্দন করিয়া মরিয়া যায় তবে তাহার সেই মর্মান্তিক আর্তধ্বনিও, রথের চূড়া যে গগনতল স্পর্শ করিতে স্পর্ধা করিতেছে সেই গগনপথে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে, হয়তো সেই রথচূড়া ছাড়াইয়া চলিয়া যায়।

বঙ্কিমবাবু সেই ইতিহাস এবং মানব উভয়কেই একত্র করিয়া এই ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করিয়াছেন।

তিনি এই বৃহৎ জাতীয়-ইতিহাসের এবং তীব্র মানব-ইতিহাসের পরস্পরের মধ্যে কিয়ৎপরিমাণে ভাবেরও যোগ রাখিয়াছেন।

মোগল-সাম্রাজ্য যখন সম্পদে এবং ক্ষমতায় স্ফীত হইয়া একান্ত স্বার্থপর হইয়া উঠিল, যখন সে সম্রাটের পক্ষে ন্যায়পরতা অনাবশ্যক বোধ করিয়া, প্রজার সুখদুঃখে একেবারে অন্ধ হইয়া পড়িল, তখন তাহার জাগরণের দিন উপস্থিত হইল।

বিলাসিনী জেবউন্নিসাও মনে করিয়াছিল সম্রাটদুহিতার পক্ষে প্রেমের আবশ্যক নাই, সুখই একমাত্র শরণ্য। সেই সুখে অন্ধ হইয়া যখন সে দয়াধর্মের মস্তকে আপন জরিজহরতজড়িত পাদুকাখচিত সুন্দর বামচরণখানি দিয়া পদাঘাত করিল তখন কোন্‌ অজ্ঞাত গুহাতল হইতে কুপিত প্রেম জাগ্রত হইয়া তাহার মর্মস্থলে দংশন করিল, শিরায় শিরায় সুখমন্থরগামী রক্তস্রোতের মধ্যে একেবারে আগুন বহিতে লাগিল, আরামের পুষ্পশয্যা চিতাশয্যার মতো তাহাকে দগ্ধ করিল– তখন সে ছুটিয়া বাহির হইয়া উপেক্ষিত প্রেমের কন্ঠে বিনীত দীনভাবে সমস্ত সুখসম্পদের বরমাল্য সমর্পণ করিল– দুঃখকে স্বেচ্ছায় বরণ করিয়া হৃদয়াসনে অভিষেক করিল। তাহার পরে আর সুখ পাইল না, কিন্তু আপন সচেতন অন্তরাত্মাকে ফিরিয়া পাইল। জেবউন্নিসা সম্রাটপ্রাসাদের অবরুদ্ধ অচেতন আরামগর্ভ হইতে তীব্র যন্ত্রণার পর ধুলায় ভূমিষ্ঠ হইয়া উদার জগতীতলে জন্মগ্রহণ করিল। এখন হইতে সে অনন্ত জগৎবাসিনী রমণী।

ইতিহাসের মহাকোলাহলের মধ্যে এই নবজাগ্রত হতভাগিনী নারীর বিদীর্ণপ্রায় হৃদয় মাঝে মাঝে ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া উঠিয়া রাজসিংহের পরিণাম অংশে বড়ো-একটা রোমাঞ্চকর সুবিশাল করুণা ও ব্যাকুলতা বিস্তার করিয়া দিয়াছে। দুর্যোগের রাত্রে এক দিকে মোগলের অভ্রভেদী পাষাণপ্রাসাদ ভাঙিয়া ভাঙিয়া পড়িতেছে, আর-এক দিকে সর্বত্যাগিনী রমণীর অব্যক্ত ক্রন্দন ফাটিয়া ফাটিয়া উঠিতেছে; সেই বৃহৎ ব্যাপারের মধ্যে কে তাহার প্রতি দৃক্‌পাত করিবে — কেবল যিনি অন্ধকার রাত্রে অতন্দ্র থাকিয়া সমস্ত ইতিহাসপর্যায়কে নীরবে নিয়মিত করিতেছেন তিনি এই ধূলিলুন্ঠ্যমান ক্ষুদ্র মানবীকেও অনিমেষ লোচনে নিরীক্ষণ করিতেছিলেন।

এই ইতিহাস এবং উপন্যাসকে একসঙ্গে চালাইতে গিয়া উভয়কেই এক রাশের দ্বারা বাঁধিয়া সংযত করিতে হইয়াছে। ইতিহাসের ঘটনাবহুলতা এবং উপন্যাসের হৃদয়বিশ্লেষণ উভয়কেই কিছু খর্ব করিতে হইয়াছে– কেহ কাহারো অগ্রবর্তী না হয়, এ বিষয়ে গ্রন্থকারের বিশেষ লক্ষ্য ছিল দেখা যায়। লেখক যদি উপন্যাসের পাত্রগণের সুখদুঃখ এবং হৃদয়ের লীলা বিস্তার করিয়া দেখাইতে বসিতেন তবে ইতিহাসের গতি অচল হইয়া পড়িত। তিনি একটি প্রবল স্রোতস্বিনীর মধ্যে দুটি-একটি নৌকা ভাসাইয়া দিয়া নদীর স্রোত এবং নৌকা উভয়কেই একসঙ্গে দেখাইতে চাহিয়াছেন। এইজন্য চিত্রে নৌকার আয়তন অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র হইয়াছে, তাহার প্রত্যেক সূক্ষ্মানুসূক্ষ অংশ দৃষ্টিগোচর হইতেছে না। চিত্রকর যদি নৌকার ভিতরের ব্যাপারটাই বেশি করিয়া দেখাইতে চাহিতেন তবে নদীর অধিকাংশই তাঁহার চিত্রপট হইতে বাদ পড়িত। হইতে পারে কোনো কোনো অতিকৌতূহলী পাঠক ঐ নৌকার অভ্যন্তরভাগ দেখিবার জন্য অতিমাত্র ব্যগ্র, এবং সেইজন্য মনঃক্ষোভে লেখককে তাঁহারা নিন্দা করিবেন। কিন্তু সেরূপ বৃথা চপলতা পরিহার করিয়া দেখা কর্তব্য, লেখক গ্রন্থবিশেষে কী করিতে চাহিয়াছেন এবং তাহাতে কতদূর কৃতকার্য হইয়াছেন। পূর্ব হইতে একটা অমূলক প্রত্যাশা ফাঁদিয়া বসিয়া তাহা পূর্ণ হইল না বলিয়া লেখকের প্রতি দোষারোপ করা বিবেচনাসংগত নহে। গ্রন্থপাঠারম্ভে আমি নিজে এই অপরাধ করিবার উপক্রম করিয়াছিলাম বলিয়াই এ কথাটা বলিতে হইল।

চৈত্র ১৩০০

শুভবিবাহ

রাস্কিন এক জায়গায় বলিয়াছেন, মহৎ আর্ট মাত্রই স্তব। সেইসঙ্গেই তাঁহাকে বলিতে হইয়াছে, কোনো বড়ো জিনিসকে সংজ্ঞার দ্বারা বাঁধা সহজ নহে– অতএব, আর্ট ব্যাপারটা যে স্তব, সেটা খোলসা করিয়া বোঝানো আবশ্যক।

মানুষ বিশ্বসংসারে যাহা ভালোবাসে, আর্টের দ্বারা তাহার স্তব করে। সুন্দর গড়ন দিয়া মানুষ যখন একটা সামান্য ঘট প্রস্তুত করে, তখন সে কী করে? না, রেখার যে মনোহর রহস্য আমরা ফুলের পাপড়ির মধ্যে, ফলের পূর্ণতার মধ্যে, পাতার ভঙ্গিমায়, জীবশরীরের লাবণ্যে দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছি, মানুষ ঘটের গঠনে বিশ্বের সেই রেখাবিন্যাস-চাতুরীর প্রশংসা করে। বলে যে, জগতে চোখ মেলিয়া এই-সকল বিচিত্র সুষমা আমার ভালো লাগিয়াছে।

এইখানে একটা কথা ভাবিবার আছে। বিশ্বপ্রকৃতির বা মানবপ্রকৃতির মধ্যে যাহা-কিছু মহৎ বা সুন্দর, তাহাই আমাদের স্তবের যোগ্য, সুতরাং তাহাই আর্টের বিষয়, এ কথা বলিলে সমস্ত কথা বলা হয় না।

প্রাণের প্রতি প্রাণের, মনের প্রতি মনের, হৃদয়ের প্রতি হৃদয়ের একটা স্বাভাবিক টান আছে ইহাকে বিশেষভাবে সৌন্দর্য বা ঔদার্যের আকর্ষণ বলিতে পারি না। ইহাকে ঐক্যের আকর্ষণ বলা যাইতে পারে। আমি মানুষ কেবল এইজন্যেই মানুষের সকল বিষয়েই আমার মনের একটা ঔৎসুক্য আছে। আমি বাঙালি, এইজন্য বাঙালির তুচ্ছ বিষয়টিত্যে আমার মনের মধ্যে একটা সাড়া পাওয়া যায়। গ্রামের দিঘির ভাঙা ঘাটটি আমার ভালো লাগে– সুন্দর বলিয়া নয়, গ্রামকে ভালোবাসি বলিয়া। গ্রামকে কেন ভালোবাসি? না, গ্রামের লোকজনদের প্রতি আমার মনের একটা টান আছে। কিন্তু গ্রামের লোকেরা যে রামচন্দ্র-যুধিষ্ঠির, সীতা-সাবিত্রীর দল, তাহা নহে– তাহারা নিতান্তই সাধারণ লোক– তাহাদের মধ্যে স্তব করিবার যোগ্য কোনো বিশেষত্বই দেখা যায় না।

যদি কোনো কবি এই ঘাটটির প্রতি তাঁহার অনুরাগ ঠিকমত ব্যক্ত করিয়া কবিতা লিখিতে পারেন, তবে সে কবিতা কেবল যে এই গ্রামের লোকেরই মনে লাগিবে, তাহা নহে — সকল দেশেরই সহৃদয় পাঠক এই কবিতার রস উপভোগ করিতে পারিবে। কারণ, যে-ভাবটি লইয়া এই কবিতা রচিত, তাহা সকল দেশের মানুষের পক্ষেই সমান।

এ কথা সত্য যে, অনেক আর্টই, যাহা উদার, যাহা সুন্দর, তাহার প্রতি আমাদের ভক্তি বা প্রীতির প্রকাশ। কিন্তু যাহা সুন্দর নহে, যাহা সাধারণ, তাহার প্রতি আমাদের মনের সহজ আনন্দ, ইহাও আর্টের বিষয়। যদি তাহা না হইত, তবে আর্ট আমাদের ক্ষতিই করিত।

কারণ, কেবলমাত্র বাছাই করিয়া জগতের যাহা-কিছু বিশেষভাবে সুন্দর বিশেষভাবে মহৎ, তাহারই প্রতি আমাদের রুচিকে বারংবার প্রবর্তিত করিতে থাকিলে আমাদের একটা রসের বিলাসিতা জন্মায়। যাহা প্রতিদিনের, যাহা চারিদিকের, যাহা হাতের কাছে আছে, তাহা আমাদের কাছে বিস্বাদ হইয়া আসে; ইহাতে সংকীর্ণ সীমার মধ্যে আমাদের অনুভবশক্তির আতিশয্য ঘটাইয়া আর সর্বত্র তাহার জড়ত্ব উৎপাদন করা হয়। এইরূপ আর্ট-সম্বন্ধীয় বাবুয়ানার দুর্গতির কথা টেনিসন তাঁহার কোনো কাব্যে বর্ণনা করিয়াছেন, সকলেই তাহা জানেন।

আমরা যে-গ্রন্থখানির সমালোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছি, পাঠকের সহিত তাহার পরিচয়সাধন করাইবার আরম্ভে ভূমিকাস্বরূপ উপরের কয়েকটি কথা বলা গেল।

রাস্কিনের সংজ্ঞা অনুসারে “শুভবিবাহ’ বইখানি কিসের স্তব? ইহার মধ্যে সৌন্দর্যের ছবি, মহত্ত্বের আদর্শ, কী প্রকাশ পাইয়াছে? ইহার উত্তরে বলিব, এমন করিয়া হিসাব খতাইয়া দেখা চলে না। আপিস হইতে ফিরিয়া আসিলে ঘরের লোক জিজ্ঞাসা করিতে পারে, আজ তুমি কী রোজগার করিয়া আনিলে? লাভের পরিমাণ তখনই তাহাকে গুনিয়া দেখানো যাইতে পারে। কিন্তু বন্ধুবান্ধবের বাড়ি ঘুরিয়া আসিলে যদি প্রশ্ন ওঠে, আজ তুমি কী লাভ করিলে, তবে থলি ঝাড়িয়া তাহা হাতে হাতে দেখানো সম্ভবপর হইতে পারে না।

সাহিত্যেও কোনো কোনো বিশেষ গ্রন্থে কী পাওয়া গেল, তাহা বেশ স্পষ্ট করিয়া দেখানো যাইতে পারে। কিন্তু এমন গ্রন্থও আছে, যাহার লাভ অমন করিয়া হিসাবের মধ্যে আনা যায় না– যাহা নূতন শিক্ষা নহে, যাহা মহান উপদেশ নহে, যাহা অপরূপ সৃষ্টি নহে। যাহা কেবল পরিচিতের সঙ্গে পরিচয়, আলাপীর সঙ্গে আলাপ, বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুত্বমাত্র।

কিন্তু জীবনের আনন্দের অধিকাংশই এইরূপ অত্যন্ত সহজ এবং সামান্য জিনিস লইয়াই তৈরি। আকস্মিক, অদ্ভুত, অপূর্ব আমাদের জীবনের পথে দৈবাৎ আসিয়া জোটে; তাহার জন্য যে বসিয়া থাকে বা খুঁজিয়া বেড়ায় তাহাকে প্রায়ই বঞ্চিত হইতে হয়।

“শুভবিবাহ’ একটি গল্পের বই, স্ত্রীলোকের লেখা, ইহার গল্পের ক্ষেত্রটি কলিকাতাকায়স্থসমাজের অন্তঃপুর। এটুকু বলিতে পারি, মেয়ের কথা মেয়েতে যেমন করিয়া লিখিয়াছে, এমন কোনো পুরুষ-গ্রন্থকার লিখিতে পারিত না।

পরিচয় থাকিলেই তাহার বিষয়ে যে সহজে লেখা যায়, এ কথা ঠিক নহে। নিত্যপরিচয়ে আমাদের দৃষ্টিশক্তির জড়তা আনে– মনকে যাহা নূতন করিয়া, বিশেষ করিয়া আঘাত না করে, মন তাহাকে জানিয়াও জানে না। যাহা সুপরিচিত, তাহার প্রতিও মনের নবীন ঔৎসুক্য থাকা একটি দুর্লভ ক্ষমতা।

“শুভবিবাহে’ লেখিকা সেই ক্ষমতা প্রচুর পরিমাণের প্রকাশ করিয়াছেন। এমন সজীব সত্য চিত্র বাংলা কোনো গল্পের বইয়ে আমরা দেখি নাই। গ্রন্থে বর্ণিত অন্তঃপুর ও অন্তঃপুরিকাগণ যে লেখিকার বানানো, এ কথা আমরা কোনো জায়গাতেই মনে করিতে পারি নাই। তাহারাই দেদীপ্যমান সত্য এবং লেখিকা উপলক্ষমাত্র।

এই বইখানির মধ্যে সামান্য একটুখানিমাত্র গল্প আছে এবং নায়কনায়িকার উপসর্গএকেবারেই নাই। তবু প্রথম খানত্রিশেক পাতা পড়া হইয়া গেলেই মনের ঔৎসুক্য শেষ ছত্র পর্যন্ত সমান সজাগ হইয়া থাকে। অথচ সমস্ত গ্রন্থে কলাকৌশল বা ভাষার ছটা একেবারেই নাই, কেবল জীবন এবং সত্য আছে। যাহা-কিছু আছে, সমস্তই সহজেই প্রত্যক্ষ এবং অনায়াসে প্রত্যয়যোগ্য।

গ্রন্থে বর্ণিত নারীগুলিকে অসামান্যভাবে চিত্র করিবার চেষ্টামাত্র করা হয় নাই — অথচ তাহাদের চরিত্রে আমাদের মনকে পাইয়া বসিয়াছে, তাহাদের সুখদুঃখে আমরা কিছুমাত্র উদাসীন নই। যিনি ঘরের গৃহিণী, এই গ্রন্থের যিনি “দিদি’, তিনি মোটাসোটা, সাদাসিধা প্রৌঢ় স্ত্রীলোক, ছেলের উপার্জিত নূতনলব্ধ ঐশ্বর্যে অহংকৃত; অথচ তাঁহার অন্তঃকরণে যে স্বাভাবিক স্নেহরস সঞ্চিত আছে, তাহা বিকৃত হইতে পায় নাই; তিনি উপরে ধনী-ঘরের কর্ত্রী, কিন্তু ভিতরে সরলহৃদয় সহজ স্ত্রীলোক। তাঁহার বিধবাকন্যা “রানী’ কল্যাণের প্রতিমা। অথচ ইঁহার চিত্রে সচেষ্টভাবে বেশি করিয়া রঙ ফলাইবার প্রয়াস কোনো জায়গাতেই দেখা যায় না। অতি সহজেই ইনি ইঁহার স্থান লইয়া আছেন। নিতান্ত সামান্য ব্যাপারের মধ্যেই ইনি আপনার অসামান্যতাকে পরিস্ফুট করিয়া তুলিয়াছেন। লেখিকা ইঁহাকে আমাদের সম্মুখে খাড়া করিয়া দিয়া বাহবা লইবার জন্য কোথাও আমাদের মুখের দিকে তাকান নাই। আর সেই “পিসিমা’– অনাথা সন্তানহীনা– জনশূন্য বৃহৎ ঘরে অনাবশ্যক ঐশ্বর্যের মধ্যে শ্যামসুন্দরের বিগ্রহটিকে লইয়া যিনি নারীহৃদয়ের সমস্ত অতৃপ্ত আকাঙক্ষা প্রশান্ত ধৈর্যের সহিত মিটাইতেছেন, তাঁহার চরিত্রে শুভ পবিত্রতার সহিত স্নিগ্ধ করুণার, বঞ্চিত স্নেহবৃত্তির সহিত সংযত নিষ্ঠার সুন্দর সমবায় যেন অনায়াসে ফুটিয়া উঠিয়াছে। হঠাৎ পিতৃহীন ভ্রাতুষ্পুত্রটিকে কাছে পাইয়া যখন এই তপস্বিনী স্ত্রীপ্রকৃতি সুধারসে উচ্ছ্বসিত হইয়া তাহার দেবসেবার নিত্যকর্মকেও যেন ক্ষণকালের জন্য ভুলিয়া গেল, তখন আন্তরিক অশ্রুজলে পাঠকের হৃদয় যেন সুস্নিগ্ধ হইয়া যায়।

রোমান্টিক উপন্যাস বাংলাসাহিত্যে আছে, কিন্তু বাস্তবচিত্রের অত্যন্ত অভাব। এজন্যও এই গ্রন্থকে আমরা সাহিত্যের একটি বিশেষ লাভ বলিয়া গণ্য করিলাম। য়ুরোপীয় সাহিত্যে কোথাও কোথাও দেখিতে পাই,মানবচরিত্রের দীনতা ও জঘন্যতাকেই বাস্তবিকতা বলিয়া স্থির করা হইয়াছে। আমাদের আলোচ্য বাংলা গ্রন্থটিতে পঙ্কিলতার নামগন্ধমাত্র নাই, অথচ বইটির আগাগোড়ায় এমন কিছু নাই, যাহা সাধারণ নহে,স্বাভাবিক নহে, বাস্তব নহে।

আষাঢ় ১৩১৩

সঞ্জীবচন্দ্র

পালামৌ

কোনো কোনো ক্ষমতাশালী লেখকের প্রতিভায় কী একটি গ্রহদোষে অসম্পূর্ণতার অভিশাপ থাকিয়া যায়; তাঁহারা অনেক লিখিলেও মনে হয় তাঁহাদের সব লেখা শেষ হয় নাই। তাঁহাদের প্রতিভাকে আমরা সুসংলগ্ন আকারবদ্ধভাবে পাই না; বুঝিতে পারি তাহার মধ্যে বৃহত্ত্বের মহত্ত্বের অনেক উপাদান ছিল, কেবল সেই সংযোজনা ছিল না যাহার প্রভাবে সে আপনাকে সর্বসাধারণের নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়ে প্রকাশ ও প্রমাণ করিতে পারে।

সঞ্জীবচন্দ্রের প্রতিভা পূর্বোক্ত শ্রেণীর। তাঁহার রচনা হইতে অনুভব করা যায় তাঁহার প্রতিভার অভাব ছিল না, কিন্তু সেই প্রতিভাকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করিয়া যাইতে পারেন নাই। তাঁহার হাতের কাজ দেখিলে মনে হয়, তিনি যতটা কাজে দেখাইয়াছেন তাঁহার সাধ্য তদপেক্ষা অনেক অধিক ছিল। তাঁহার মধ্যে যে পরিমাণে ক্ষমতা ছিল সে পরিমাণে উদ্যম ছিল না।

তাঁহার প্রতিভার ঐশ্বর্য ছিল কিন্তু গৃহিণীপনা ছিল না। ভালো গৃহিণীপনায় স্বল্পকেও যথেষ্ট করিয়া তুলিতে পারে; যতটুকু আছে তাহার যথাযোগ্য বিধান করিতে পারিলে তাহার দ্বারা প্রচুর ফল পাওয়া গিয়া থাকে। কিন্তু অনেক থাকিলেও উপযুক্ত গৃহিণীপনার অভাবে সে ঐশ্বর্য ব্যর্থ হইয়া যায়; সে-স্থলে অনেক জিনিস ফেলাছড়া যায় অথচ অল্প জিনিসই কাজে আসে। তাঁহার অপেক্ষা অল্প ক্ষমতা লইয়া অনেকে যে পরিমাণে সাহিত্যের অভাব মোচন করিয়াছেন তিনি প্রচুর ক্ষমতা সত্ত্বেও তাহা পারেন নাই; তাহার কারণ সঞ্জীবের প্রতিভা ধনী, কিন্তু গৃহিনী নহে।

একটা উদাহরণ দিলেই পাঠকগণ আমার কথাটা বুঝিতে পারিবেন। “জাল প্রতাপচাঁদ’ নামক গ্রন্থে সঞ্জীবচন্দ্র যে ঘটনাসংস্থান, প্রমাণবিচার এবং লিপিনৈপুণ্যের পরিচয় দিয়াছেন, বিচিত্র জটিলতা ভেদ করিয়া যে-একটি কৌতূহলজনক আনুপূর্বিক গল্পের ধারা কাটিয়া আনিয়াছেন তাহাতে তাঁহার অসামান্য ক্ষমতার প্রতি কাহারো সন্দেহ থাকে না– কিন্তু সেইসঙ্গে এ কথাও মনে হয় ইহা ক্ষমতার অপব্যয় মাত্র। এই ক্ষমতা যদি তিনি কোনো প্রকৃত ঐতিহাসিক ব্যাপারে প্রয়োগ করিতেন তবে তাহা আমাদের ক্ষণিক কৌতূহল চরিতার্থ না করিয়া স্থায়ী আনন্দের বিষয় হইত। যে কারুকার্য প্রস্তরের উপর খোদিত করা উচিত তাহা বালুকার উপরে অঙ্কিত করিলে কেবল আক্ষেপের উদয় হয়।

“পালামৌ’ সঞ্জীবের রচিত একটি রমণীয় ভ্রমণবৃত্তান্ত। ইহাতে সৌন্দর্য যথেষ্ট আছে, কিন্তু পড়িতে পড়িতে প্রতিপদে মনে হয় লেখক যথোচিত যত্নসহকারে লেখেন নাই। ইহার রচনার মধ্যে অনেকটা পরিমাণে আলস্য ও অবহেলা জড়িত আছে, এবং তাহা রচয়িতারও অগোচর ছিল না। বঙ্কিমবাবুর রচনায় যেখানেই দুর্বলতার লক্ষণ আছে সেইখানেই তিনি পাঠকগণকে চোখ রাঙাইয়া দাবাইয়া রাখিবার চেষ্টা করিয়াছেন–সঞ্জীববাবু অনুরূপ স্থলে অপরাধ স্বীকার করিয়াছেন, কিন্তু সেটা কেবল পাঠকদের মুখ বন্ধ করিবার জন্য– তাহার মধ্যে অনুতাপ নাই এবং ভবিষ্যতে যে সতর্ক হইবেন কথার ভাবে তাহাও মনে হয় না। তিনি যেন পাঠকদিগকে বলিয়া রাখিয়াছেন, “দেখো বাপু, আমি আপন ইচ্ছায় যাহা দিতেছি তাহাই গ্রহণ করো, বেশি মাত্রায় কিছু প্রত্যাশা করিয়ো না।’

“পালামৌ’-ভ্রমণবৃত্তান্ত তিনি যে ছাঁদে লিখিয়াছেন, তাহাতে প্রসঙ্গক্রমে আশপাশের নানা কথা আসিতে পারে– কিন্তু তবু তাহার মধ্যেও নির্বাচন এবং পরিমাণসামঞ্জস্যের আবশ্যকতা আছে। যে-সকল কথা আসিবে তাহারা আপনি আসিয়া পড়িবে, অথচ কথার স্রোতকে বাধা দিবে না। ঝর্ণা যখন চলে তখন যে পাথরগুলোকে স্রোতের মুখে ঠেলিয়া লইতে পারে তাহাকেই বহন করিয়া লয়, যাহাকে অবাধে লঙ্ঘন করিতে পারে তাহাকে নিমগ্ন করিয়া চলে, আর যে পাথরটা বহন বা লঙ্ঘন -যোগ্য নহে’ তাহাকে অনায়াসে পাশ কাটাইয়া যায়। সঞ্জীববাবুর এই ভ্রমণকাহিনীর মধ্যে এমন অনেক বক্তৃতা আসিয়া পড়িয়াছে যাহা পাশ কাটাইবার যোগ্য, যাহাতে রসের ব্যাঘাত করিয়াছে এবং লেখকও অবশেষে বলিয়াছেন, “এখন এ-সকল কচ্‌কচি যাক।’ কিন্তু এই-সকল কচ্‌কচিগুলিকে সযত্নে বর্জন করিবার উপযোগী সতর্ক উদ্যম তাঁহার স্বভাবতই ছিল না। যে কথা যেখানে আসিয়া পড়িয়াছে অনাবশ্যক হইলেও সে কথা সেইখানেই রহিয়া গিয়াছে। যেজন্য সঞ্জীবের প্রতিভা সাধারণের নিকট প্রতিপত্তি লাভ করিতে পারে নাই আমরা উপরে তাহার কারণ ও উদাহরণ দেখাইতেছিলাম, আবার যেজন্য সঞ্জীবের প্রতিভা ভাবুকের নিকট সমাদরের যোগ্য তাহার কারণও যথেষ্ট আছে।

“পালামৌ’-ভ্রমণবৃত্তান্তের মধ্যে সৌন্দর্যের প্রতি সঞ্জীবচন্দ্রের যে-একটি অকৃত্রিম সজাগ অনুরাগ প্রকাশ পাইয়াছে এমন সচরাচর বাংলা লেখকদের মধ্যে দেখা যায় না। সাধারণত আমাদের জাতির মধ্যে একটি বিজ্ঞবার্ধক্যের লক্ষণ আছে– আমাদের চক্ষে সমস্ত জগৎ যেন জরাজীর্ণ হইয়া গিয়াছে। সৌন্দর্যের মায়া-আবরণ যেন বিস্রস্ত হইয়াছে, এবং বিশ্বসংসারের অনাদি প্রাচীনতা পৃথিবীর মধ্যে কেবল আমাদের নিকটই ধরা পড়িয়াছে। সেইজন্য অশনবসন ছন্দভাষা আচারব্যবহার বাসস্থান সর্বত্রই সৌন্দর্যের প্রতি আমাদের এমন সুগভীর অবহেলা। কিন্তু সঞ্জীবের অন্তরে সেই জরার রাজত্ব ছিল না। তিনি যেন একটি নূতনসৃষ্ট জগতের মধ্যে একজোড়া নূতন চক্ষু লইয়া ভ্রমণ করিতেছেন। “পালামৌ’তে সঞ্জীবচন্দ্র যে বিশেষ কোনো কৌতূহলজনক নতূন কিছু দেখিয়াছেন, অথবা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে কিছু বর্ণনা করিয়াছেন তাহা নহে, কিন্তু সর্বত্রই ভালোবাসিবার ও ভালো লাগিবার একটা ক্ষমতা দেখাইয়াছেন। পালামৌ দেশটা সুসংলগ্ন সুস্পষ্ট জাজ্বল্যমান চিত্রের মতো প্রকাশ পায় নাই, কিন্তু যে সহৃদয়তা ও রসবোধ থাকিলে জগতের সর্বত্রই অক্ষয় সৌন্দর্যের সুধাভাণ্ডার উদ্‌ঘাটিত হইয়া যায় সেই দুর্লভ জিনিসটি তিনি রাখিয়া গিয়াছেন, এবং তাঁহার হৃদয়ের সেই অনুরাগপূর্ণ মমত্ববৃত্তির কল্যাণকিরণ যাহাকেই স্পর্শ করিয়াছে– কৃষ্ণবর্ণ কোলরমণীই হউক, বনসমাকীর্ণ পর্বতভূমিই হউক, জড় হউক চেতন হউক ছোটো হউক বড়ো হউক, সকলকেই একটি সুকোমল সৌন্দর্য এবং গৌরব অর্পণ করিয়াছে। লেখক যখন যাত্রা-আরম্ভকালে গাড়ি করিয়া বরাকর নদী পার হইতেছেন এমন সময় কুলিদের বালকবালিকারা তাঁহার গাড়ি ঘিরিয়া “সাহেব একটি পয়সা’ “সাহেব একটি পয়সা’ করিয়া চীৎকার করিতে লাগিল; লেখক বলিতেছেন–

“এই সময় একটি দুই-বৎসর-বয়স্ক শিশু আসিয়া আকাশের দিকে মুখ তুলিয়া হাত পাতিয়া দাঁড়াইল। কেন হাত পাতিল তাহা সে জানে না, সকলে হাত পাতিয়াছে দেখিয়া সেও হাত পাতিল। আমি তাহার হস্তে একটি পয়সা দিলাম, শিশু তাহা ফেলিয়া দিয়া আবার হাত পাতিল; অন্য বালক সে পয়সা কুড়াইয়া লইলে শিশুর ভগিনীর সহিত তুমুল কলহ বাধিল।’

সামান্য শিশুর এই শিশুত্বটুকু তাহার উদ্দেশ্যবোধহীন অনুকরণবৃত্তির এই ক্ষুদ্র উদাহরণটুকুর উপর সঞ্জীবের যে-একটি সকৌতুক স্নেহহাস্য নিপতিত রহিয়াছে সেইটি পাঠকের নিকট রমণীয়; সেই একটি উলটা-হাতপাতা ঊর্ধ্বমুখ অজ্ঞান লোভহীন শিশু-ভিক্ষুকের চিত্রটি সমস্ত শিশুজাতির প্রতি আমাদের মনের একটি মধুর রস আকর্ষণ করিয়া আনে।

দৃশ্যটি নূতন অসামান্য বলিয়া নহে, পরন্তু পুরাতন এবং সামান্য বলিয়াই আমাদের হৃদয়কে এরূপ বিচলিত করে। শিশুদের মধ্যে আমরা মাঝে মাঝে ইহারই অনুরূপ অনেক ঘটনা দেখিয়া আসিয়াছি, সেইগুলি বিস্মৃতভাবে আমাদের মনের মধ্যে সঞ্চিত ছিল। সঞ্জীবের রচিত চিত্রটি আমাদের সম্মুখে খাড়া হইবামাত্র সেই-সকল অপরিস্ফুট স্মৃতি পরিস্ফুট হইয়া উঠিল এবং তৎসহকারে শিশুদের প্রতি আমাদের স্নেহরাশি ঘনীভূত হইয়া আনন্দরসে পরিণত হইল।

চন্দ্রনাথবাবু বলেন, সচরাচর লোকে যাহা দেখে না সঞ্জীববাবু তাহাই দেখিতেন– ইহা তাঁহার একটি বিশেষত্ব। আমরা বলি, সঞ্জীববাবুর সেই বিশেষত্ব থাকিতে পারে, কিন্তু সাহিত্যে সে বিশেষত্বের কোনো আবশ্যকতা নাই। আমরা পূর্বে যে ঘটনাটি উদ্‌ধৃত করিয়াছি তাহা নূতন লক্ষ্যগোচর বিষয় নহে, তাহার মধ্যে কোনো নূতন চিন্তা বা পর্যবেক্ষণ করিবার কোনো নূতন প্রণালী নাই, কিন্তু তথাপি উহা প্রকৃত সাহিত্যের অঙ্গ। গ্রন্থ হইতে আর-এক অংশ উদ্‌ধৃত করিয়া দিতেছি। লেখক বলিতেছেন, একদিন পাহাড়ের মূলদেশে দাঁড়াইয়া চিৎকার-শব্দে একটা পোষা কুকুরকে ডাকিবামাত্র “পশ্চাতে সেই চীৎকার আশ্চর্যরূপে প্রতিধ্বনিত হইল। পশ্চাৎ ফিরিয়া পাহাড়ের প্রতি চাহিয়া আবার চীৎকার করিলাম, প্রতিধ্বনি আবার পূর্বমত হ্রস্বদীর্ঘ হইতে হইতে পাহাড়ের অপর প্রান্তে চলিয়া গেল। আবার চীৎকার করিলাম, শব্দ পূর্ববৎ পাহাড়ের গায়ে লাগিয়া উচ্চনীচ হইতে লাগিল। এইবার বুঝিলাম, শব্দ কোনো-একটি বিশেষ স্তর অবলম্বন করিয়া যায়; সেই স্তর যেখানে উঠিয়াছে বা নামিয়াছে শব্দও সেইখানে উঠিতে নামিতে থাকে। ||| ঠিক যেন সেই স্তরটি শব্দ-কন্‌ডক্‌টার।’

ইহা বিজ্ঞান, সম্ভবত ভ্রান্ত বিজ্ঞান। ইহা নূতন হইতে পারে, কিন্তু ইহাতে কোনো রসের অবতারণা করে না– আমাদের হৃদয়ে মধ্যে যে-একটি সাহিত্য-কন্‌ডক্‌টর আছে সে স্তরে ইহা প্রতিধ্বনিত হয় না। ইহার পূর্বোদ্‌ধৃত ঘটনাটি অবিসংবাদিত ও পুরাতন, কিন্তু তাহার বর্ণনা আমাদের হৃদয়ের সাহিত্যস্তরে কম্পিত হইতে থাকে।

চন্দ্রনাথবাবু তাঁহার মতের সপক্ষে একটি উদাহরণ প্রয়োগ করিয়াছেন। সেটি আমরা মূল গ্রন্থ হইতে আদ্যোপান্ত উদ্‌ধৃত করিতে ইচ্ছা করি।

“নিত্য অপরাহ্নে আমি লাতেহার পাহাড়ের ক্রোড়ে গিয়া বসিতাম, তাঁবুতে শত কার্য থাকিলেও আমি তাহা ফেলিয়া যাইতাম। চারিটা বাজিলে আমি অস্থির হইতাম; কেন তাহা কখনো ভাবিতাম না; পাহাড়ে কিছুই নূতন নাই; কাহারো সহিত সাক্ষাৎ হইবে না, কোনো গল্প হইবে না, তথাপি কেন আমায় সেখানে যাইতে হইত জানি না। এখন দেখি এ বেগ আমার একার নহে। যে সময় উঠানে ছায়া পড়ে, নিত্য সে সময় কুলবধুর মন মাতিয়া উঠে জল আনিতে যাইবে। জল আছে বলিলেও তাহারা জল ফেলিয়া জল আনিতে হইবে।’ জলে যে যাইতে পাইল না সে অভাগিণী, সে গৃহে বসিয়া দেখে উঠানে ছায়া পড়িতেছে, আকাশে ছায়া পড়িতেছে, পৃথিবীর রঙ ফিরিতেছে, বাহির হইয়া সে তাহা দেখিতে পাইল না, তাহার কত দুঃখ। বোধ হয় আমিও পৃথিবীর রঙ-ফেরা দেখিতে যাইতাম।’

চন্দ্রনাথবাবু বলেন–

“জল আছে বলিলেও তাহারা জল ফেলিয়া জল আনিতে যায়, আমাদের মেয়েদের জল আনা এমন করিয়া কয়জন লক্ষ্য করে?’

আমাদের বিবেচনায় সমালোচকের এ প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। হয়তো অনেকেই লক্ষ্য করিয়া দেখিয়া থাকিবে, হয়তো নাও দেখিতে পারে। কূলবধূরা জল ফেলিয়াও জল আনিতে যায়, সাধারণের স্থূলদৃষ্টির অগোচর এই নবাবিষ্কৃত তথ্যটির জন্য আমরা উপরি-উদ্‌ধৃত বর্ণনাটির প্রশংসা করি না। বাংলাদেশে অপরাহ্নে মেয়েদের জল আনিতে যাওয়া-নামক সর্বসাধারণের সুগোচর একটি অত্যন্ত পুরাতন ব্যাপারকে সঞ্জীব নিজের কল্পনার সৌন্দর্যকিরণ দ্বারা মণ্ডিত করিয়া তুলিয়াছেন বলিয়া উক্ত বর্ণনা আমাদের নিকট আদরের সামগ্রী। যাহা সুগোচর তাহা সুন্দর হইয়া উঠিয়াছে ইহা আমাদের পরম লাভ। সম্ভবত, সত্যের হিসাব হইতে দেখিতে গেলে অনেক মেয়ে ঘাটে সখীমণ্ডলীর নিকট গল্প শুনিতে বা কুৎসা রটনা করিতে যায়, হয়তো সমস্ত দিন গৃহকার্যের পর ঘরের বাহিরে জল আনিতে যাওয়াতে তাহারা একটা পরিবর্তন অনুভব করিয়া সুখ পায়, অনেকেই হয়তো নিতান্তই কেবল একটা অভ্যাসপালন করিবার জন্য ব্যগ্র হয় মাত্র, কিন্তু সেই-সকল মনস্তত্ত্বের মীমাংসাকে আমরা এ স্থলে অকিঞ্চিৎকর জ্ঞান করি। অপরাহ্নে জল আনিতে যাইবার যতগুলি কারণ সম্ভব হইতে পারে তন্মধ্যে সব চেয়ে যেটি সুন্দর সঞ্জীব সেইটি আরোপ করিবামাত্র অপরাহ্নের ছায়ালোকের সহিত মিশ্রিত হইয়া কুলবধুর জল আনার দৃশ্যটি বড়োই মনোহর হইয়া উঠে; এবং যে মেয়েটি জল আনিতে যাইতে পারিল না বলিয়া একা বসিয়া শূন্যমনে দেখিতে থাকে উঠানের ছায়া দীর্ঘতর এবং আকাশের ছায়া নিবিড়তর হইয়া আসিতেছে, তাহার বিষণ্ন মুখের উপর সায়াহ্নের ম্লান স্বর্ণচ্ছায়া পতিত হইয়া গৃহপ্রাঙ্গণতলে একটি অপরূপ সুন্দর মূর্তির সৃষ্টি করিয়া তোলে। এই মেয়েটিকে যে সঞ্জীব লক্ষ্য করিয়াছেন এবং আমরা লক্ষ্য করি নাই তাহা নহে, তিনি ইহাকে সৃষ্টি করিয়াছেন, তিনি ইহাকে সম্ভবপররূপে স্থায়ী করিয়া তুলিয়াছেন। আমরা জিজ্ঞাসা করিতেও চাহি না, এইরূপ মেয়ের অস্তিত্ব বাংলাদেশে সাধারণত সত্য কি না এবং সেই সত্যটি সঞ্জীবের দ্বারা আবিষ্কৃত হইয়াছে কি না। আমরা কেবল অনুভব করি ছবিটি সুন্দর বটে এবং অসম্ভবও নহে।

সঞ্জীববাবু এক স্থলে লিখিয়াছেন–

“বাল্যকালে আমার মনে হইত যে, ভূত প্রেত যেপ্রকার নিজে দেহহীন, অন্যের দেহ-আবির্ভাবে বিকাশ পায়, রূপও সেইপ্রকার অন্য দেহ অবলম্বন করিয়া প্রকাশ পায়; কিন্তু প্রভেদ এই যে, ভূতের আশ্রয় কেবল মনুষ্য, বিশেষতঃ মানবী, কিন্তু বৃক্ষপল্লব নদ ও নদী প্রভৃতি সকলেই রূপ আশ্রয় করে। সুতরাং রূপ-এক, তবে পাত্রভেদ।’

সঞ্জীববাবুর এই মতটি অবলম্বন করিয়া চন্দ্রনাথবাবু বলিয়াছেন–

“সঞ্জীববাবুর সৌন্দর্যতত্ত্ব ভালো করিয়া না বুঝিলে তাঁহার লেখাও ভালো করিয়া বুঝা যায় না, ভালো করিয়া সম্ভোগ করা যায় না।’

সমালোচকের এ কথায় আমরা কিছুতেই সায় দিতে পারি না। কোনো-একটি বিশেষ সৌন্দর্যতত্ত্ব অবলম্বন না করিলে সঞ্জীবের রচনার সৌন্দর্য বুঝা যায় না এ কথা যদি সত্য হইত তবে তাঁহার রচনা সাহিত্যে স্থান পাইবার যোগ্য হইতে না। নদ-নদীতেও সৌন্দর্য আছে, পুষ্পে নক্ষত্রেও সৌন্দর্য আছে, মনুষ্যে পশুপক্ষীতেও সৌন্দর্য আছে, এ কথা প্লেটো না পড়িয়াও আমরা জানিতাম– সেই সৌন্দর্য ভূতের মতো বাহির হইতে আসিয়া বস্তুবিশেষে আবির্ভূত হয় অথবা তাহা বস্তুর এবং আমাদের প্রকৃতির বিশেষ ধর্মবশত আমাদের মনের মধ্যে উদিত হয় সে-সমস্ত তত্ত্বের সহিত সৌন্দর্যসম্ভোগের কিছুমাত্র যোগ নাই। একজন নিরক্ষর ব্যক্তিও যখন তাহার প্রিয়মুখকে চাঁদমুখ বলে তখন সে কোনো বিশেষ তত্ত্ব না পড়িয়াও স্বীকার করে যে যদি চাঁদ এবং তাহার প্রিয়জন বস্তুত সম্পূর্ণ ভিন্ন পদার্থ তথাপি চাঁদের দর্শন হইতে সে যে-জাতীয় সুখ অনুভব করে তাহার প্রিয়মুখ হইতেও ঠিক সেই-জাতীয় সুখের আস্বাদ প্রাপ্ত হয়।

চন্দ্রনাথবাবুর সহিত আমাদের মতভেদ কিছু বিস্তারিত করিয়া বলিলাম; তাহার কারণ এই যে, এই উপায়ে পাঠকগণ অতি সহজে বুঝিতে পারিবেন আমরা সাহিত্যকে কী নজরে দেখিয়া থাকি। এবং ইহাও বুঝিবেন, যাহা প্রকৃতপক্ষে সহজ এবং সর্বজনগম্য আজকালকার সমালোচন-প্রণালীতে তাহাকে জটিল করিয়া তুলিয়া পুরাতনকে একটা নূতন ঘরগড়া আকার দিয়া পাঠকের নিকট ধরিবার চেষ্টা করা হয়। ভালো কাব্যের সমালোচনায় পাঠকের হৃদয়ে সৌন্দর্য সঞ্চার করিবার দিকে লক্ষ না রাখিয়া নূতন এবং কঠিন কথায় পাঠককে চমৎকৃত করিয়া দিবার প্রয়াস আজকাল দেখা যায়; তাহাতে সমালোচনা সত্য হয় না, সহজ হয় না, সুন্দর হয় না, অত্যন্ত আশ্চর্যজনক হইয়া উঠে।

গ্রন্থকার কোল-যুবতীদের নৃত্যের যে বর্ণনা করিয়াছেন তাহা উদ্‌ধৃত করি।–

“এই সময় দলে দলে গ্রামস্থ যুবতীরা আসিয়া জমিতে লাগিল; তাহারা আসিয়াই যুবাদিগের প্রতি উপহাস আরম্ভ করিল, সঙ্গে সঙ্গে বড়ো হাসির ঘটা পড়িয়া গেল। উপহাস আমি কিছুই বুঝিতে পারিলাম না; কেবল অনুভবে স্থির করিলাম যে, যুবারা ঠকিয়া গেল। ঠকিবার কথা, যুবা দশ-বারোটি, কিন্তু যুবতীরা প্রায় চল্লিশ জন, সেই চল্লিশ জনে হাসিলে হাইলণ্ডের পল্টন ঠকে। হাস্য-উপহাস্য শেষ হইলে নৃত্যের উদ্‌যোগ আরম্ভ হইল। যুবতী সকলে হাত-ধরাধরি করিয়া অর্ধচন্দ্রাকৃতি রেখা বিন্যাস করিয়া দাঁড়াইল। দেখিতে বড়ো চমৎকার হইল। সকলগুলিই সম-উচ্চ, সকলগুলিই পাথুরে কালো; সকলেরই অনাবৃত দেহ; সকলেরই সেই অনাবৃত বক্ষে আরসির ধুকধুকি চন্দ্রকিরণে এক-একবার জ্বলিয়া উঠিতেছে। আবার সকলের মাথায় বনপুষ্প, কর্ণে বনপুষ্প, ওঠে হাসি। সকলেরই আহ্লাদে পরিপূর্ণ, আহ্লাদে চঞ্চল, যেন তেজঃপুঞ্জ অশ্বের ন্যায় সকলেই দেহবেগ সংযম করিতেছে।

“সম্মুখে যুবারা দাঁড়াইয়া, যুবাদের পশ্চাতে মৃন্ময়মঞ্চোপরি বৃদ্ধেরা এবং তৎসঙ্গে এই নরাধম। বৃদ্ধেরা ইঙ্গিত করিলে যুবাদের দলে মাদল বাজিল, অমনি যুবতীদের দেহ যেন শিহরিয়া উঠিল। যদি দেহের কোলাহল থাকে, তবে যুবতীদের দেহে কোলাহল পড়িয়া গেল, পরেই তাহারা নৃত্য আরম্ভ করিল।”

এই বর্ণনাটি সুন্দর, ইহা ছাড়া আর কী বলিবার আছে? এবং ইহা অপেক্ষা প্রশংসার বিষয়ই বা কী হইতে পারে? নৃত্যের পূর্বে আহ্লাদে চঞ্চল যুবতীগণ তেজঃপুঞ্জ অশ্বের ন্যায় দেহবেগ সংযত করিয়া আছে, এ কথায় যে চিত্র আমাদের মনে উদয় হয় সে আমাদের কল্পনাশক্তিরপ্রভাবে হয়, কোনো বিশেষ তত্ত্বজ্ঞান-দ্বারা হয় না। “যুবতীদের দেহে কোলাহল পড়িয়া গেল’ এ কথা বলিলে ত্বরিত আমাদের মনে একটা ভাবের উদয় হয়; যে কথাটা সহজে বর্ণনা করা দুরূহ তাহা ঐ উপমা-দ্বারা এক পলকে আমাদের হৃদয়ে মুদ্রিত হইয়া যায়। নৃত্যের বাদ্য বাজিবামাত্র চিরাভ্যাসক্রমে কোল-রমণীদের সর্বাঙ্গে একটা উদ্দাম উৎসাহচাঞ্চল্য তরঙ্গিত হইয়া উঠিল, তৎক্ষণাৎ তাহাদের প্রত্যেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে যেন একটা জানাজানি কানাকানি, একটা সচকিত উদ্যম, একটা উৎসবের আয়োজন পড়িয়া গেল– যদি আমাদের দিব্যকর্ণ থাকিত তবে যেন আমরা তাহাদের নৃত্যবেগে উল্লসিত দেহের কলকোলাহল শুনিতে পাইতাম। নৃত্যবাদ্যের প্রথম আঘাতমাত্রেই যৌবনসন্নদ্ধ কোলাঙ্গনাগণের অঙ্গে প্রত্যঙ্গে বিভঙ্গিত এই-যে একটা হিল্লোল ইহা এমন সূক্ষ্ম, ইহার এতটা কেবল আমাদের অনুমানবোধ্য এবং ভাবগম্য যে, তাহা বর্ণনায় পরিস্ফুট করিতে হইলে “কোলাহলে’র উপমা অবলম্বন করিতে হয়, এতদ্‌ব্যতীত ইহার মধ্যে আর-কোনো গূঢ়তত্ত্ব নাই। যদি এই উপমা-দ্বারা লেখকের মনোগত ভাব পরিস্ফুট না হইয়া থাকে, তবে ইহার অন্য কোনো সার্থকতা নাই, তবে ইহা প্রলাপোক্তি মাত্র।

বসন্তপুষ্পাভরণা গৌরী যখন পদ্মবীজমালা হস্তে মহাদেবের তপোবনে প্রবেশ করিতেছেন তখন কালিদাস তাঁহাকে “সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতেব’ বলিয়াছেন; সঙ্গিনীপরিবৃতা সুন্দরী রাধিকা যখন দৃষ্টিপথে প্রবেশ করিলেন তখন গোবিন্দদাস তাঁহাকে মোহিনী পঞ্চম রাগিণীর সহিত তুলনা করিয়াছেন; তাঁহাদের কোনো বিশেষ সৌন্দর্যতত্ত্ব ছিল কি না জানি না, কিন্তু এরূপ বিসদৃশ উপমাপ্রয়োগের তাৎপর্য এই যে, দক্ষিণ-বায়ুতে বসন্তকালের পল্লবে-ভরা লতার আন্দোলন আমরা অনেকবার দেখিয়াছি; তাহার সেই সৌন্দর্যভঙ্গি আমাদের নিকট সুপরিচিত; সেই উপমাটি প্রয়োগ করিবামাত্র আমাদের বহুকালের সঞ্চিত পরিচিত একটি সৌন্দর্যভাবে ভূষিত হইয়া এক কথায় গৌরী আমাদের হৃদয়ে জাজ্বল্যমান হইয়া উঠেন; আমরা জানি রাগিণী আমাদের মনে কী-একট বর্ণনাতীত সৌন্দর্যের ব্যাকুলতা সঞ্চার করে, এইজন্য পঞ্চম রাগিণীর সহিত রাধিকার তুলনা করিবামাত্র আমাদের মনে যে-একটি অনির্দেশ্য অথচ চিরপরিচিত মধুর ভাবের উদ্রেক হয় তাহা কোনো বর্ণনাবাহুল্যের দ্বারা হইত না; অতএব দেখা যাইতেছে, অদ্য সৌন্দর্যরাজ্য সঞ্জীববাবু তাঁহার নিজের রচিত একটা নূতন গলি কাটেন নাই, সমুদয় ভাবুক ও কবিবর্গের পুরাতন রাজপথ অবলম্বন করিয়া চলিয়াছেন এবং সেই তাঁহার গৌরব।

সঞ্জীব একটি যুবতীর বর্ণনার মধ্যে বলিয়াছেন–

“তাঁহার যুগ্ম ভ্রু দেখিয়া আমার মনে হইল যেন অতি ঊর্ধ্বে নীল আকাশে কোনো বৃহৎ পক্ষী পক্ষ বিস্তার করিয়া ভাসিতেছে।’

এই উপমাটি পড়িবামাত্র মনে বড়ো একটি আনন্দের উদয় হয়; কেবলমাত্র উপমাসাদৃশ্য তাহার কারণ নহে, কিন্তু সেই সাদৃশ্যটুকুকে উপলক্ষমাত্র করিয়া একটা সৌন্দর্যের সহিত আর-কতকগুলি সৌন্দর্য জড়িত হইয়া যায়– সে একটা ইন্দ্রজালের মতো; ঠিক করিয়া বলা শক্ত যে, অপরাহ্নের অতিদূর নির্মল নীলাকাশে ভাসমান স্থিরপক্ষ স্থগিতগতি পাখিটাকে দেখিতেছি না, যুবতীর শুভ্রসুন্দর ললাটতলে অঙ্কিত একটি জোড়া ভুরু আমাদের চক্ষে পড়িতেছে। জানি না, কেমন করিয়া কী মন্ত্রবলে একটি ক্ষুদ্র ললাটের উপর সহসা আলোকধৌত নীলাম্বরের অনন্ত বিস্তার আসিয়া পড়ে এবং মনে হয় যেন রমণীমুখের সেই ভ্রূযুগল দেখিতে স্থিরদৃষ্টিকে বহু উচ্চে বহু দূরে প্রসারিত করিয়া দিতে হয়। এই উপমার হঠাৎ এইরূপ একটা বিভ্রম উৎপন্ন করে– কিন্তু সেই ভ্রমের কুহকেই সৌন্দর্য ঘনীভূত হইয়া উঠে।

অবশেষে গ্রন্থ হইতে একটি সরল বর্ণনার উদাহরণ দিয়া প্রবন্ধের উপসংহার করি। গ্রন্থকার একটি নিদ্রিত বাঘের বর্ণনা করিতেছেন–

“প্রাঙ্গণের এক পার্শ্বে ব্যাঘ্র নিরীহ ভালোমানুষের ন্যায় চোখ বুজিয়া আছে; মুখের নিকট সুন্দর নখরসংযুক্ত একটি থাবা দর্পণের ন্যায় ধরিয়া নিদ্রা যাইতেছে। বোধ হয় নিদ্রার পূর্বে থাবাটি একবার চাটিয়াছিল।’

আহারপরিতৃপ্ত সুপ্তশান্ত ব্যাঘ্রটি ঐ-যে মুখের সামনে একটি থাবা উলটাইয়া ধরিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, এই এক কথায় ঘুমন্ত বাঘের ছবিটি যেমন সুস্পষ্ট সত্য হইয়া উঠিয়াছে এমন আর-কিছুতে হইতে পারিত না। সঞ্জীব বালকের ন্যায় সকল জিনিস সজীব কৌতুহলের সহিত দেখিতেন এবং প্রবীণ চিত্রকরের ন্যায় তাহার প্রধান অংশগুলি নির্বাচন করিয়া লইয়া তাঁহার চিত্রকে পরিস্ফুট করিয়া তুলিতেন এবং ভাবুকের ন্যায় সকলের মধ্যেই তাঁহার নিজের একটি হৃদয়াংশ যোগ করিয়া দিতেন।

পৌষ ১৩০১

সাকার ও নিরাকার

সাকার ও নিরাকার-তত্ত্ব। শ্রীযতীন্দ্রমোহন সিংহ বি.এ. প্রণীত

ঈশ্বর সাকার কি নিরাকার এরূপ তর্ক মধ্যে মধ্যে আমাদের দেশে শুনা যায়। কিন্তু বর্তমান সমালোচ্য গ্রন্থে তর্কটা ততদূর স্থূল নহে। গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এই যে, ঈশ্বরকে সাকার ভাবে উপাসনা করিতে হইবে কি নিরাকার ভাবে।

কেহ কেহ এ প্রশ্নের উত্তর দিয়া থাকেন যে, যে লোক নিরাকারে মন দিতে পারে না তাহার পক্ষে সাকার উপাসনা শ্রেয়।

কিন্তু গ্রন্থকার সেরূপ মাঝামাঝি কিছু বলিতে চাহেন না; তিনি বলেন, নিরাকার উপাসনা হইতেই পারে না। হয় সোইহং ব্রহ্ম হইয়া যাও, নয় মূর্তিপূজা করো। তিনি কালাপাহাড়ের ঠিক বিপরীতমুখে সংহারকার্য শুরু করিয়াছেন। মূর্তিপূজাকে কেবল যে তিনি রক্ষা করিতে চান তাহা নহে, অমূর্ত পূজাকে তর্কের দ্বারা ধ্বংস করিতে ইচ্ছা করেন।

কী হইতে পারে এবং কী হইতে পারে না, তর্ক অপেক্ষা ইতিহাসে তাহার প্রমাণ সহজে পাওয়া যায়। জল যে শীতে জমিয়া বরফ হইতে পারে উষ্ণপ্রধান দেশের রাজাকে তাহা তর্কে বুঝানো অসাধ্য কিন্তু যদি একবার নড়িয়া হিমালয়প্রদেশে ভ্রমণ করিয়া আসেন তবে এ সম্বন্ধে আর কথা থাকে না। লেখকমহাশয় সে রাস্তায় যান নাই। তিনি তর্কদ্বারা বলিয়াছেন, নিরাকার উপাসনা হইতেই পারে না।

মুসলমানেরা মূর্তিপূজা করে না। অথচ মুসলমান-সম্প্রদায়ের মধ্যে ভক্ত কেহ নাই বা কখনো জন্মেন নাই, এ কথা বিশ্বাস্য নহে। কী করিয়া যে তাঁহাদের ভক্তিবৃত্তির পরিতৃপ্তি হয় তাহা যতীন্দ্রমোহনবাবু না বুঝিতে পারেন কিন্তু মূর্তিপূজা করিয়া নহে এ কথা নিশ্চয়।

নানক যে জগতের ভক্তশ্রেষ্ঠদের মধ্যে একজন নহেন তাহা কেহ সাহস করিয়া বলিবেন না। তিনি যে সোহহংসব্রহ্মবাদী ছিলেন না ইহাও নিঃসন্দেহ। তিনি যে প্রচলিত মূর্তি-উপাসনা বিশেষরূপে পরিত্যাগ করিয়া অমূর্ত উপাসনা প্রচার করিয়াছিলেন ইহার একটি বৈ কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। নিশ্চয় তিনি নিরাকার উপাসনায় চরিতার্থতা লাভ করিতেন এবং মূর্তি-উপাসনায় তাহার ব্যাঘাত করিয়াছিল।

ব্রাহ্মদের মধ্যেও নিঃসন্দেহ কেহ-না-কেহ আছেন যিনি প্রবল ভক্তির আবেগ-বশতই মূর্তিপূজা পরিহারপূর্বক সমস্ত জীবন নিরাকার উপাসনায় যাপন করিয়াছেন। গ্রন্থকারের মতে তিনি ভ্রান্ত হইতে পারেন কিন্তু তিনি যে ভক্ত তাহা কেবল তর্কে নহে আচরণে এবং বহু পীড়ন ও ত্যাগ স্বীকারে প্রমাণ করিয়াছেন।

এককালে ভারতবর্ষে মূর্তিপূজা ছিল না, কিন্তু সেই দূরকাল সম্বন্ধে ঐতিহাসিক প্রমাণ উত্থাপন করা নিষ্ফল। আধুনিক কালের যে কয়টি উদাহরণ দেওয়া গেল তাহা হইতে অন্তত এটুকু প্রমাণ হয় যে, কোনো কোনো ভক্ত মূর্তিপূজায় বিরক্ত হইয়া তাহা ত্যাগ করিয়াছেন এবং অনেক ভক্ত পৃথিবীর অনেক দেশে অমূর্ত উপাসনায় ভক্তিবৃত্তির পরিতৃপ্তি লাভ করিয়াছেন।

গ্রন্থকার বলেন, মানিলাম তাঁহারা মূর্তিপূজা করেন না কিন্তু তাঁহারা নিরাকার উপাসনা করেন ইহা হইতেই পারে না। কারণ, “জাতিবাচক ও গুণবাচক পদার্থ অবলম্বনে ঈশ্বরের জ্ঞান সাকার।’

এ কেমন তর্ক, যেমন– যদি আমি বলি ক বাঁকা পথে চলে এবং খ সোজা পথে চলে তুমি বলিতে পারো খও সোজা পথে চলে না– কারণ সরল রেখা কাল্পনিক; পৃথিবীতে কোথাও সরল রেখা নাই।

কথাটা সত্য বটে কিন্তু তথাপি ইহা তর্কমাত্র। আমাদের ভাষা আমাদের মনকে একদম ছাড়াইয়া যাইতে পারে না; এবং আমাদের মন সীমাবদ্ধ। সুতরাং আমাদের ভাষা আপেক্ষিক। আমরা যাহাকে তীক্ষ্ণ বলি অণুবীক্ষণ দিয়া দেখিতে গেলে তাহা ভোঁতা হইয়া পড়ে, আমরা যাহাকে নিটোল গোল বলি তাহাকে সহস্রগুণ বাড়াইয়া দেখিলে তাহার অসমানতা ধরা পড়িয়া যায়। অণুবীক্ষণ দিয়া দেখিতে গেলে নিরাকার উপাসনার মধ্যে যে আকারের আভাস পাওয়া যায় না তাহা বলিতে সাহস করি না।

তাই যদি হইল, তবে আমরা যাহাকে সাকার উপাসনা বলি তাহাতেই বা দোষ কী? নিরাকার যখন পূর্ণভাবে মনের অগম্য তখন তাঁহাকে সুগম আকারে পূজা করাই ভালো।

আকার আমাদের মনের পক্ষে সুগম হইতে পারে কিন্তু তাই বলিয়া নিরাকার যে আকারের দ্বারা সুগম হইতে পারেন তাহা নহে– ঠিক তাহার উলটা।

মনে করো, আমি সমুদ্রের ধারণা করিতে ইচ্ছা করি। সমুদ্র ক্রোশ-দুই তফাতে আছে। আমি তাহা দেখিতে যাত্রা করিবার সময় পণ্ডিত আসিয়া বলিলেন, সমুদ্র এতই বড়ো যে সচক্ষে দেখিয়াও তাহার ধারণা হইতে পারে না; কারণ আমাদের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ; আমরা সমুদ্রের মধ্যে যতই দূরে যাই, যতই প্রয়াস পাই, সমুদ্রকে ছোটো করিয়া দেখা ছাড়া উপায়ই নাই। অতএব তোমার অন্দরের মধ্যে একটি ছোটো ডোবা খুঁড়িয়া তাহাকে সমুদ্র বলিয়া কল্পনা করো।

কিন্তু দর্শনশক্তির সাধ্য সীমা দ্বারা সমুদ্র দেখিয়াও যদি সমুদ্রের ধারণা সম্পূর্ণ না হয় তবে ডোবা হইতে সমুদ্রের ধারণা অসম্ভব বলিলেও হয়।

অনন্ত আকাশ আমাদের কাছে মণ্ডলবদ্ধ, কিন্তু তাই বলিয়া ঘরে দ্বার বন্ধ করিয়া আকাশ দেখার সাধ মিটাইতে পারি না। আমি যতদূর পর্যন্ত দেখিতে পাই তাহা না দেখিয়া আমার তৃপ্তি হয় না।

এই যে প্রয়াস, বস্তুত ইহাই উপাসনা। আমার শেষ পর্যন্ত গিয়াও যখন তাঁহার শেষ পাই না, আমার মন যখন একাকী বিশ্বব্রহ্মান্ডের মধ্যে যাত্রা করিয়া বাহির হয়, যখন অগণ্য গ্রহচন্দ্রতারকার অনন্ত জটিল জ্যোতিররণ্যমধ্যে সে হারাইয়া যায়, এবং প্রভাতকরপ্লাবিত নীলাকাশের মহোচ্চদেশে বিলীনপ্রায় বিহঙ্গমের মতো উচ্ছ্বসিতকণ্ঠে গাহিয়া উঠে, আমি ভূমা, আমি তোমার শেষ পাইলাম না– তখন তাহাতেই সে কৃতার্থ হয়। সেই অন্ত না পাইয়াই তাহার সুখ, “ভূমৈব সুখং, নাল্পে সুখমস্তি।”

টলেমির জগৎতন্ত্র আমাদের ধারণাযোগ্য। পৃথিবীকে মধ্যে রাখিয়া বদ্ধ কঠিন আকাশে জ্যোতিষ্কগণ সংকীর্ণ নিয়মে ঘুরিতেছে ইহা ঠিক মনুষ্যজনের আয়ত্তগম্য; কিন্তু অধুনা জ্যোতির্বিদ্যার বন্ধনমুক্তি হইয়াছে, সে সীমাবদ্ধ ধারণার বাহিরে অনন্ত রহস্যের মধ্যে গিয়া পড়িয়াছে বলিয়া তাহার গৌরব বাড়িয়াছে। জগৎটা যে পৃথিবীর প্রাঙ্গণমাত্র নহে,পৃথিবী যে বিশ্বজগতে ধূলিকণার অধম এই সংবাদেই আমাদের কল্পনা প্রসারিত হইয়া যায়।

আমাদের উপাস্য দেবতাকেও যখন কেবলমাত্র মনুষ্যের গৃহপ্রাঙ্গণের মধ্যে বদ্ধ করিয়া না দেখি, তাঁহাকে আমাদের ধারণার অতীত বলিয়া জানি, যখন ঋষিদের মুখে শুনি–

যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ

আনন্দ ব্রহ্মণো বিদ্বান্‌ ন বিভেতি কুতশ্চন

অর্থাৎ মনের সহিত বাক্য যাঁহাকে না পাইয়া ফিরিয়া আসে সেই আনন্দকে সেই ব্রহ্মকে যিনি জানেন তিনি কাহা হইতেও ভয় পান না– তখনই আমাদের বদ্ধ হৃদয় মুক্তির আশ্বাস লাভ করিতে থাকে। বাক্য-মন যাঁহাকে না পাইয়া ফিরিয়া আসে তিনি যে আমাদের পক্ষে শূন্যস্বরূপ তাহা নহে, তিনিই আনন্দ।

যাঁহাকে আমাদের অপেক্ষা বড়ো বলিয়া জানি তাঁহাকেই উপাসনা করি।

আমাদের সর্বোচ্চ উপাসনা তিনিই আকর্ষণ করেন যিনি এতবড়ো যে কোথাও তাঁহার শেষ নাই।

তর্কের মুখে বলা যাইতে পারে, তাঁহাকে জানিব বড়ো করিয়া, কিন্তু দেখিব ছোটো করিয়া। আপনাকে আপনি খণ্ডন করিয়া চলা কি সহজ কাজ? বিশেষত ইন্দ্রিয় প্রশ্রয় পাইলে সে মনের অপেক্ষা বড়ো হইয়া উঠে। সেই ইন্দ্রিয়ের সাহায্য যতটুকু না লইলে নয় তদপেক্ষা বেশি কর্তৃত্ব তাহার হাতে স্বেচ্ছাপূর্বক সমর্পণ করিলে মনের জড়ত্ব অবশ্যম্ভাবী হইয়া পড়ে।

তাঁহাকে ছোটো করিয়াই বা দেখিব কেন?

নতুবা তাঁহাকে কিছু-একটা বলিয়া মনে হয় না, তিনি মন হইতে ক্রমশ স্খলিত হইয়া পড়েন।

কিন্তু মহৎ লক্ষ্যের জন্য ফাঁকি দিয়া সারিবার সংক্ষিপ্ত রাস্তা নাই। দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি। সেই দুর্গম পথ এড়াইবার উপায় থাকিলে ভাবনা ছিল না। কষ্ট করিতে হয়, চেষ্টা করিতে হয় বলিয়া বিনা-প্রয়াসের পথ অবলম্বন করিলে লক্ষ্য ভ্রষ্ট হইয়া যায়। যে লোক ধনী হইতে চায় সে সমস্তদিন খাটিয়া রাত্রি একটা পর্যন্ত হিসাব মিলাইয়া তবে শুইতে যায়; পায়ের উপর পা দিয়া তাহার অভীষ্টসিদ্ধি হয় না। আর যে ঈশ্বরকে চায়, পথ দুর্গম বলিয়া সে কি খেলা করিয়া তাঁহাকে পাইবে?

আসল কথা, ঈশ্বরকে সকলে চায় না, পারমার্থিক দিকে স্বভাবতই অনেকের মন নাই। ধন ঐশ্বর্য সুখ সৌভাগ্য পাপক্ষয় এবং পুণ্য-অর্জনের দিকে লক্ষ্য রাখিয়া দেবসেবা ও ধর্মকর্ম করাকে জর্জ এলিয়ট other worldliness নাম দিয়াছেন। অর্থাৎ সেটা পারলৌকিক বৈষয়িকতা। তাহা আধ্যাত্মিকতা নহে। যাহাদের সেই দিকে লক্ষ্য সাকার-নিরাকার তাহাদের পক্ষে উপলক্ষমাত্র। সুতরাং হাতের কাছে যেটা থাকে, যাহাতে সুবিধা পায়, দশ জনে যেটা পরামর্শ দেয় তাহাই অবলম্বন করিয়া ধর্মচতুর লোক পুণ্যের খাতায় লাভের অঙ্ক জমা করিতে থাকেন। নিরাকার-বাদী এবং সাকারবাদী উভয় দলেই তেমন লোক ঢের আছে।

কিন্তু আধ্যাত্মিকতা যাঁহাদের প্রকৃতির সহজ ধর্ম, সংসার যাঁহাদিগকে তৃপ্ত ও বিক্ষিপ্ত করিতে পারে না, যে দিকেই স্থাপন কর কম্পাসের কাঁটার মতো যাঁহাদের মন এক অনির্বচনীয় চুম্বক- আকর্ষণে অনন্তের দিকে আপনি ফিরিয়া দাঁড়ায়, জগদীশ্বরকে বাদ দিলে যাঁহাদের নিকট আমাদের স্থিতিগতি চিন্তাচেষ্টা ক্রিয়াকর্ম একেবারেই নিরর্থক এবং সমস্ত জগদ্‌ব্যাপার নিরবচ্ছিন্ন বিভীষিকা, যাঁহারা অন্তরাত্মার মধ্যে পরমাত্মার প্রত্যক্ষ আনন্দ উপভোগ করিয়াই বুঝিতে পারিয়াছেন যে, আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে, আনন্দেন জাতানি জীবন্তি, আনন্দং প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি, সাধনা তাঁহাদের নিকট দুঃসাধ্য নহে এবং তাঁহারা আপনাকে ভুলাইয়া এবং আপনার ঈশ্বরকে ভুলাইয়া সংক্ষেপে কার্যোদ্ধার করিতে চাহেন না– কারণ, নিত্যসাধনাতেই তাঁহাদের সুখ, নিয়তপ্রয়াসেই তাঁহাদের প্রকৃতির পরিতৃপ্তি।

সেইরূপ কোনো স্বভাবভক্ত যখন মূর্তিপূজার মধ্যে জন্মগ্রহণ করেন তখন তিনি আপন অসামান্য প্রতিভাবলে মূর্তিকে অমূর্ত করিয়া দেখিতে পারেন; তাঁহার প্রত্যক্ষবর্তী কোনো সীমা তাঁহাকে অসীমের নিকট হইতে কাড়িয়া রাখিতে পারে না; তাঁহার চক্ষু যাহা দেখে তাঁহার মন তাহাকে বিদ্যুদ্‌বেগে ছাড়াইয়া চলিয়া যায়; বাহিরের উপলক্ষ তাঁহার নিকট কেবল অভ্যাসক্রমে থাকে মাত্র, তাহাকে দূর করিবার কোনো প্রয়োজন হয় না; বিশ্বসংসারই তাঁহার নিকট রূপক, প্রতিমার তো কথাই নাই; যে লোকের অক্ষরজ্ঞান আছে সে যেমন অক্ষরকে অক্ষররূপে দেখে না, সে যেমন কাগজের উপর যখন “গা’ এবং “ছ’ দেখে তখন ক্ষুদ্র গয়ে আকার ছ দেখে না কিন্তু তৎক্ষণাৎ মনশ্চক্ষে শাখাপল্লবিত বৃক্ষ দেখিতে পায়, তেমনি তিনি সম্মুখে স্থাপিত বস্তুকে দেখিয়াও দেখিতে পান না, মুহূর্তমধ্যে অন্তঃকরণে সেই অমূর্ত আনন্দ উপলব্ধি করেন, যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ। কিন্তু এই ইন্দ্রজাল অসামান্য প্রতিভার দ্বারাই সাধ্য। সে প্রতিভা চৈতন্যের ছিল, রামপ্রসাদ সেনের ছিল।

আবার প্রকৃতিভেদে কোনো কোনো স্বভাবভক্ত লোক প্রচলিত মূর্তি দ্বারা ঈশ্বরের পূজাকে আত্মাবমাননা এবং পরমাত্মাবমাননা বলিয়া অভ্যাসবন্ধন ছেদন করিয়া আত্মার মধ্যে এবং বিশ্বের মধ্যে তাঁহার উপাসনা করেন। মহম্মদ এবং নানক তাহার দৃষ্টান্ত।

কিন্তু আমাদের মধ্যে ভক্তির প্রতিভা খুব অল্প লোকেরই আছে। প্রত্যক্ষ সংসার অরণ্য আমাদিগকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে; মাঝে মাঝে তাহারই ডালপালার অবকাশপথে অধ্যাত্মরশ্মি দেবদূতের তর্জনীর মতো আমাদের অন্ধকারের একাংশ স্পর্শ করিয়া যায়। এখন, আমরা যদি মাঝে মাঝে সংসারের বনচ্ছায়াতলে কীটানুসন্ধান ছাড়িয়া দিয়া অনন্ত আকাশের মধ্যে মুক্তির আনন্দ ভোগ করিতে চাই তো কী করিব?

“যদি চাই’ এ কথা বলিতে হইল। কারণ, পূর্বেই বলিয়াছি আমরা সকলে চাই না, ঈশ্বরকে উপলক্ষ করিয়া আর-কিছু চাই। কিন্তু যদি চাই তো কী করিব?

তবে, যাহাতে বাধা যাহাতে অন্ধকার তাহা সাবধানে এড়াইয়া যে দিকে আলোক আপনাকে প্রকাশ করে সেই পথ দিয়া পাখা মেলিয়া আকাশের দিকে উড়িতে হইবে।

সে পথ কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়ের পথ ধূলির পথ পৃথিবীর পথ নহে, তাহা পদচিহ্নহীন বায়ুর পথ আলোকের পথ আকাশের পথ। আমাদের পক্ষে সেই এক পথ।

যাঁহারা মুক্তক্ষেত্রে বাস করেন তাঁহারা মাটিতে বসিয়াও আকাশের আলো পান, কিন্তু যাহারা জটিল প্রবৃত্তিজালে পরিবৃত হইয়া আছে তাহাদিগকে একেবারে পৃথিবীর দিক হইতে উড়িয়া বাহির হইয়া যাইতে হয়।

তাহা না করিয়া আমরা যদি আমাদেরই প্রবৃত্তি আমাদেরই আকৃতি দিয়া দেবতা গড়ি তবে তাহার মধ্যে মুক্তি কোন্‌খানে? যদি তাহাকে স্নান করাই, খাওয়াই, মশারিতে শোয়াই, এমন-কি, তাহার জন্য নটী নিযুক্ত করিয়া রাখি তবে তাহার ফল কী হয়? তবে নিজের প্রবৃত্তিকেই দেবতা করিয়া পূজা করা হয়। আমাদের লোভ আমাদের হিংসা আমাদের ক্ষুদ্রতাকে দেবতারূপে অমর করিয়া রাখি। এই কারণেই কালীকে দস্যু আপন দস্যুবৃত্তির সহায় বলিয়া জ্ঞান করে, মিথ্যাশপথকারী আদালতে জয়লাভের জন্য পশু মানত করে, এমন-কি, যে সকল অন্যায়-অবিচার-দুষ্কর্ম মনুষ্যলোকে গর্হিত বলিয়া খ্যাত, দেবচরিত্রে তাহাও অনিন্দনীয় বলিয়া স্থান পায়।

আমাদের দেশের দেবতা কি কেবল মূর্তিতেই বদ্ধ যে রূপক ভাঙিয়া তাহার মধ্যে আমরা ভাবের স্বাধীনতা লাভ করিব? চার হাতকে যেন আমরা চারিদিক্‌বর্তী কর্মশীলতা বলিয়া মনে করিলাম কিন্তু পুরাণে উপপুরাণে যাত্রায় কথকতায় তাঁহার জন্মমৃত্যুবিবাহ-রাগদ্বেষ-সুখদুঃখ-দৈন্যদুর্বলতার বিচিত্র পাঠ ও পাঠান্তর হইতে মনকে মুক্ত করিব কেমন করিয়া? যতপ্রকার কৌশলে মানুষের মনকে ভুলাইয়া একেবারে আটেঘাটে বাঁধা যায় তাহার কোনোটাই ত্রুটি নাই। এবং এতপ্রকার সুদৃঢ় স্থূল শৃঙ্খলে চতুর্দিক হইতে সযত্ন বন্ধনকে গ্রন্থকার যদি তাঁহার নিগুZ ব্রহ্মলাভের সোপান বলিয়া গণ্য করেন তবে মাছির পক্ষে মাকড়সার জালে পড়াই আকাশে উড়িবার উপায় মনে করা অসংগত হইবে না।

দেবচরিত্র সম্বন্ধে যে-সকল ভ্রষ্ট আদর্শের কল্পনা আমাদের দেশে শাখাপল্লবিত হইয়া চারি দিকে শিকড় বিস্তার করিয়াছে, তাহা কল্পনার বিকার; গ্রন্থকার বোধ করি তাহা হিন্দুসমাজের অধোগতির ফল বলিয়া জ্ঞান করেন এবং সম্ভবত তাহা সংশোধন করিয়া লইতে উপদেশ দেন। সংশোধনের উপায় কী? তিনি এক স্থলে বলিয়াছেন–

“সকল শাস্ত্রের মূলে এক বেদ, এক শ্রুতি– এক শ্রুতি দ্বারা সকল শাস্ত্রের বিরোধ ভঞ্জন করিবার বিধি রহিয়াছে।’

বিধি রহিয়াছে কিন্তু কেহ কখনো চেষ্টা করিয়াছেন? পৌরাণিক ধর্মের সহিতবৈদিক ধর্মের সামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া কোনো পণ্ডিত আজ পর্যন্ত হিন্দুধর্মের একটা অখণ্ড আদর্শ প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন কি? ইহা কি সকলের দ্বারা সাধ্য?

পৌরাণিক ধর্ম ঐতিহাসিক হিন্দুধর্ম। কালক্রমে হিন্দুর অনেক পরিবর্তন হইয়াছে। বৈদিক আর্যগণ যে সমাজ, যে রীতি, যে বিশ্বাস, যে মানসিক প্রকৃতি লইয়া ভারতবর্ষে প্রবেশ করিয়াছিলেন অনার্যদের সংঘর্ষে মিশ্রণে বিচিত্র অবস্থান্তরে স্বভাবের নিয়মে ক্রমশই তাহা রূপান্তরিত হইয়া আসিয়াছে। সেই-সকল নব নব অভিব্যক্তি নব নব পুরাণে আপনাকে আকারবদ্ধ করিয়াছে। বেদ যে অবস্থার শাস্ত্র, পুরাণ সে অবস্থার শাস্ত্র নহে। সুতরাং বেদকেই যদি প্রমাণ বলিয়া মানা যায় তবে পুরাণকে ছাড়িতে হয় এবং পুরাণকে প্রবল বলিয়া মানিলে বেদকে পরিহার করিতে হয়। এমন-কি, গ্রন্থকার নিজে বলিয়াছেন এবং ফলেও দেখা যায়, এক পুরাণকে মানিলে অন্য পুরাণের সহিত বিরোধ বাধিয়া উঠে। বর্তমানে হিন্দুসমাজ বেদকে মুখে মান্য করিয়া কাজের বেলা পুরাণকে অবলম্বন করে। উভয়ের মধ্যে যে কোনোপ্রকার অসামঞ্জস্য আছে সে তর্ক উত্থাপিত হয় না।

হিন্দুধর্মের এই ঐতিহাসিক অভিব্যক্তি আজ পর্যন্ত চলিয়া আসিতেছে। কারণ, পুরাণ কেবল সংস্কৃত ভাষায় বদ্ধ নহে, প্রচলিত ভাষাতেও রচিত হয়। মনসার ভাসান, সত্যপীরের কথা প্রভৃতি তাহার দৃষ্টান্ত। মেয়েদের ব্রতকথাও তাহার উদাহরণ। অন্নদামঙ্গলে যদিও পৌরাণিক শিবদুর্গার লীলা বর্ণিত, এবং যদিও তাহার রচয়িতা ভারতচন্দ্র শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, তথাপি তাহার মধ্যে জনসাধারণ-প্রচলিত আধুনিক, কল্পনাবিকার সহজেই স্থানলাভ করিয়াছে। কবিকঙ্কণচণ্ডীতেও তাহাই। হরপার্বতীর কোন্দল, কোঁচ-নারীদের প্রতি শিবের আসক্তি, নিজের গাত্রমল দিয়া দুর্গাকর্তৃক খেলার পুত্তলি নির্মাণ ও তাহা হইতে গণেশের জন্ম এ-সমস্ত কাহিনী আধুনিক প্রাদেশিক; শ্রুতি ইহার মূল নহে, লোকের কল্পনাই ইহার মূল, দেবতাকে নিজ পরিমাপে নির্মাণচেষ্টাই ইহার প্রধান কারণ। ইহার মধ্যে উচ্চ অঙ্গের আধ্যাত্মিক রূপক বাহির করা সাধারণ লোকের পক্ষে অসাধ্য এবং অসাধারণ লোকের পক্ষেও দুঃসাধ্য।

সংক্ষেপে আমাদের শেষ বক্তব্য এই যে, যে-সকল ভক্ত মহাপুরুষ চিরপ্রথাগত সাকার উপাসনা ত্যাগ করেন নাই তাঁহারা অসামান্য প্রতিভাবলে উদ্দীপ্ত ভাবাবেগে দৃষ্টিগোচরকেও দৃষ্টিপথাতীত করিয়া তুলিয়াছেন, বাধা তাঁহাদের নিকট বাধা নহে, র‍্যন্ট্‌গেন-আবিষ্কৃত রশ্মির ন্যায় তাঁহাদের মন শতপ্রাচীরবেষ্টিত জড় আবরণ অনায়াসে ভেদ করিয়া চলিয়া যাইতে পারে। কিন্তু সাধারণ লোকের কাছে বাধা যে বাধা তাহাতে সন্দেহ নাই। তাহাদের মনের স্বাভাবিক জড়ত্ব জড়কে আশ্রয় করিতে চায়, তাহাকে অতিক্রম করিতে পারে না। ইহা তাহাদিগকে অগ্রসর করে না, বিক্ষিপ্ত করিয়া দেয়। ইহা দ্বারা সে ভক্তিসুখ লাভ করিতে পারে কিন্তু তাহা মুক্তিসুখ নহে।

সকল সম্প্রদায়েরই অধিকাংশ লোক সমাজের অনুসরণে অভ্যস্ত আচার পালন করেন। ব্রাহ্মদের মধ্যে অনেকে নিয়মিত কতকগুলি শব্দ উচ্চারণ করেন এবং শব্দ শুনিয়া যান এবং মূর্তি-উপাসকদের অনেকে বাহ্যিক পূজা ও মৌখিক জপ করিয়া কর্তব্য সারিয়া দেন। কিন্তু যাঁহারা কেবল সামাজিক ব্রাহ্ম নহেন, আধ্যাত্মিক ব্রাহ্ম, তাঁহাদের উপাসনাকে গ্রন্থকার যেরূপ উদ্‌ভ্রান্ত মনে করেন তাহা সেরূপ নহে।

আশ্বিন ১৩০৫

সিরাজদ্দৌলা

শ্রীঅক্ষয়কুমার মৈত্রেয়-প্রণীত

স্কুলে যাঁহাদিগকে ইতিহাস মুখস্থ করিতে হইয়াছে তাঁহাদের সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে, ভারত-ইতিবৃত্তে ইংরাজ-শাসনকালের বিবরণ সর্বাপেক্ষা নীরস। তাহার একটা কারণ, এই বিবরণে মানবস্বভাবের লীলা পরিস্ফুট দেখা যায় না। গবর্নর আসিলেন, যুদ্ধ হইল, জয়পরাজয় হইল, পাঁচ বৎসর কাটিয়া গেল, গবর্নর চলিয়া গেলেন।

অবশ্য ব্যাপারটা সত্যই এমন সম্পূর্ণ হৃদয়সম্পর্কশূন্য কলের কাণ্ড নহে। ভারত-শতরঞ্চমঞ্চে সাদা ও কালো ঘরে নানা পক্ষে যে-সকল বিচিত্র চাল চালিতেছিলেন, তাহার মধ্যে ভুলভ্রান্তি-রাগদ্বেষ-লোভমোহের হাত ছিল না এমন নহে। কিন্তু রাজভক্তি ও পাঠ্যসমিতির প্রতি লক্ষ রাখিয়া লেখকদিগকে সংকীর্ণ সীমায় সভয়ে পদক্ষেপ করিতে হয়। সেইজন্য অন্তত বাংলায় রচিত ইতিহাসে ইংরাজশাসনের অধ্যায় অত্যন্ত শুষ্ক এবং শীর্ণ।

আরো একটা কথা আছে। মোগল-পাঠানের সময় প্রত্যেক সম্রাট স্বতন্ত্র প্রভুরূপে স্বেচ্ছামতে রাজ্যশাসন করিতেন, সুতরাং তাঁহাদের স্বাধীন ইচ্ছার আন্দোলনে ভারত-ইতিবৃত্তে পদে পদে রসবৈচিত্র্য তরঙ্গিত হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু ইংরাজের ভারতবর্ষে ইংলণ্ডের রাজতন্ত্রের শাসন। তাহার মধ্যে হৃদয়ের লীলা অত্যন্ত গৌণ ব্যাপার। মানুষ নাই, রাজা নাই, কেবল একটা পলিসি অতি দীর্ঘ পথ দিয়া ডাক বসাইয়া চলিয়াছে, প্রতি পাঁচ বৎসর অন্তর তাহার বাহক বদল হয় মাত্র।

সেই পলিসি কিরূপ সূক্ষ্ম জটিল সুদূরব্যাপী, এই মাকড়সাজালের সূত্রগুলি জিব্রল্টার ইজিপ্ট এডেন প্রভৃতি দেশদেশান্তর হইতে লম্বমান হইয়া কেমন করিয়া ভারতবর্ষকে আপাদমস্তক ছাঁকিয়া ধরিয়াছে তাহার বিবরণ আমাদের পক্ষে কৌতুকাবহ সন্দেহ নাই– এবং সেই বিবরণ লায়াল সাহেবের ভারতসাম্রাজ্য গ্রন্থে যেমন সংক্ষেপে ও মনোরম আকারে বিবৃত হইয়াছে এমন আর-কোথাও দেখি নাই।

কিন্তু এই বিবরণ মানববুদ্ধির নৈপুণ্যব্যঞ্জক ঐতিহাসিক যন্ত্রতত্ত্ব– তাহা পাঠকের চিরকৌতুকাবহ ঐতিহাসিক হৃদয়তত্ত্ব নহে। পশ্চিমদেশের কল পূর্বদেশে কিরূপ পুতুলবাজি করাইতেছে তাহার মধ্যে কিঞ্চিৎ হাস্যরস কিঞ্চিৎ করুণরস এবং প্রভূত পরিমাণে বিস্ময়রস আছে, কিন্তু প্রত্যক্ষ হৃদয়ের সহিত হৃদয়ের সংঘর্ষে যে নাট্যরসভূয়িষ্ঠ সাহিত্যের উপাদান জন্মে ইহাতে তাহা স্বল্প।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে সেই ঐতিহাসিক উপন্যাস-রস, ইংরাজিতে যাহাকে রোম্যান্স বলে তাহা যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। তখন ইংরাজের স্বাভাবিক দূরদর্শী রাজ্যবিস্তারনীতির মধ্যেও ব্যক্তিগত স্বার্থলোভ রাগদ্বেষের লীলায় ইতিহাসকে চঞ্চল ও উত্তপ্ত করিয়া তুলিয়াছিল।

শ্রীযুক্ত বাবু অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় তাঁহার “সিরাজদ্দৌলা’ গ্রন্থে ঐতিহাসিক রহস্যের যেখানে যবনিকা উত্তোলন করিয়াছেন সেখানে মোগল-সাম্রাজ্যের পতনোন্মুখ প্রাসাদদ্বারে ইংরাজ বণিকসম্প্রদায় অত্যন্ত দীনভাবে দণ্ডায়মান। তখন ভারতক্ষেত্রে সংহারশক্তি যতপ্রকার বিচিত্র বেশে সঞ্চরণ করিয়া ফিরিতেছিল তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা সাধু শান্ত ও দরিদ্র বেশ ছিল ইংরাজের। মারাঠি অশ্বপৃষ্ঠে দিগ্‌দিগন্তরে কালানল জ্বালাইয়া ফিরিতেছিল, শিখ ভারতের পশ্চিমপ্রান্তে আপন দুর্জয় শক্তিকে পুঞ্জীভূত করিয়া তুলিতেছিল, মোগল-সম্রাটের রাজপ্রতিনিধিগণ সেই-যুগান্তরের সন্ধ্যাকাশে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্রোহের রক্তধ্বজা আন্দোলন করিতেছিল, কেবল কয়েকজন ইংরাজ সওদাগর বাণিজ্যের বস্তা মাথায় করিয়া সম্রাটের প্রাসাদসোপানে প্রসাদচ্ছায়ায় অত্যন্ত বিনম্রভাবে আশ্রয় লইয়াছিল।

মাতামহ আলিবর্দির ক্রোড়ে নবাব-রাজহর্ম্যে সিরাজদ্দৌলা যখন শিশু, তখন ভাবী ইংরাজ-রাজমহিমাও কলিকাতায় সওদাগরের কুঠিতে ভূমিষ্ঠ হইয়া অসহায় শিশুলীলা যাপন করিতেছিল। উভয়ের মধ্যে একটি অদৃষ্ট বন্ধন বাঁধিয়া দিয়া ভবিতব্য আপন নিদারুণ কৌতুক গোপন করিয়া রাখিয়াছিল।

প্রমোদের মোহমত্ততায় এই প্রলয়নাট্যের আরম্ভ হইল। ভাগীরথীতটে হীরাঝিলের নিকুঞ্জবনে বিলাসিনীর কলকণ্ঠ এবং নর্তকীর নূপুরধ্বনি মুখরিত হইয়া উঠিল। লালসার লুব্ধহস্ত গৃহস্থের রুদ্ধগৃহের মধ্যেও প্রসারিত হইল।

এ দিকে নেপথ্যে মাঝে মাঝে বর্গিদলের অশ্বখুরধ্বনি শুনা যায়, অস্ত্রঝঞ্ঝনা বাজিয়া উঠে। তাহাদের আক্রমণ ঠেকাইবার জন্য বৃদ্ধ আলিবর্দি দশ দিকে ছুটাছুটি করিতে লাগিলেন। এই উৎপাতের সুযোগে ইংরাজ বণিক কাশিমবাজারে একটি দুর্গ ফাঁদিল এবং স্থানে স্থানে আত্মরক্ষার উপযোগী সৈন্য সমাবেশ করিতে লাগিল।

বণিকদের স্পর্ধাও বাড়িতে লাগিল। তাহারা দেশী-বিদেশী মহাজনদিগের নৌকা জাহাজ লুঠতরাজ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। কোম্পানির কর্মচারিগণ আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবসহ বিনাশুল্কে নিজ হিসাবে বাণিজ্য চালাইতে প্রবৃত্ত হইল।

এমন সময়ে সিরাজদ্দৌলা যৌবরাজ্য গ্রহণ করিলেন এবং ইংরাজের স্বেচ্ছাচারিতা দমন করিবার জন্য কঠিন শাসন বিস্তার করিলেন।

রাজমর্যাদাভিমানী নবাবের সহিত ধনলোলুপ বিদেশী বণিকের দ্বন্দ্ব বাধিয়া উঠিল। এই দ্বন্দ্বে বণিক-পক্ষে গৌরবের বিষয় কিছুই নাই। সিরাজদ্দৌলা যদিচ উন্নতচরিত্র মহৎ ব্যক্তি ছিলেন না, তথাপি এই দ্বন্দ্বের হীনতা-মিথ্যাচার প্রতারণার উপরে তাঁহার সাহস ও সরলতা, বীর্য ও ক্ষমা রাজোচিত মহত্ত্বে উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়াছে। তাই ম্যালিসন তাঁহার উল্লেখ করিয়া বলিয়াছেন, “সেই পরিণামদারুণ মহানাটকের প্রধান অভিনেতাদের মধ্যে সিরাজদ্দৌলাই একমাত্র লোক যিনি প্রতারণা করিবার চেষ্টা করেন নাই। ”

দ্বন্দ্বের আরম্ভটি পত্রযুগলসমন্বিত তরুর অঙ্কুরের ন্যায় ক্ষুদ্র ও সরল, কিন্তু ক্রমশ নানা লোক ও নানা মতলবের সমাবেশ হইয়া তাহা বৃহৎ বনস্পতির ন্যায় বিস্তৃত ও জটিল হইয়া পড়িল।

নিপুণ সারথি যেমন এককালে বহু অশ্ব যোজন্য করিয়া রথ চালনা করিতে পারে, অক্ষয়বাবু তেমনি প্রতিভাবলে এই বহুনায়কসংকুল জটিল দ্বন্দ্ববিবরণকে আরম্ভ হইতে পরিণাম পর্যন্ত সবলে অনিবার্যবেগে ছুটাইয়া লইয়া গিয়াছেন।

তাঁহার ভাষা যেরূপ উজ্জ্বল ও সরস, ঘটনাবিন্যাসও সেইরূপ সুসংগত, প্রমাণ-বিশ্লেষণও সেইরূপ সুনিপুণ। যেখানে ঘটনাসকল বিচিত্র এবং নানাভিমুখী, প্রমাণসকল বিক্ষিপ্ত এবং পদে পদে তর্কবিচারের অবতারণা আবশ্যক হইয়া পড়ে, সেখানে বিষয়টির সমগ্রতা সর্বত্র রক্ষা করিয়া তাহাকে ক্ষিপ্রগতিতে বহন করিয়া লইয়া যাওয়া ক্ষমতাশালী লেখকের কাজ। বিশেষত প্রমাণের বিচারে গল্পের সূত্রকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেয়, কিন্তু সেই-সকল অনিবার্য বাধাসত্ত্বেও লেখক তাঁহার ইতিবৃত্তকে কাহিনীর ন্যায় মনোরম করিয়া তুলিয়াছেন, এবং ইতিহাসের চিরাপরাধী অপবাদগ্রস্ত দুর্ভাগা সিরাজদ্দৌলার জন্য পাঠকের করুণা উদ্দীপন করিয়া তবে ক্ষান্ত হইয়াছেন।

কেবল একটা বিষয়ে তিনি ইতিহাস-নীতি লঙ্ঘন করিয়াছেন। গ্রন্থকার যদিচ সিরাজচরিত্রের কোনো দোষ গোপন করিতে চেষ্টা করেন নাই, তথাপি কিঞ্চিৎ উদ্যমসহকারে তাহার পক্ষ অবলম্বন করিয়াছেন। শান্তভাবে কেবল ইতিহাসের সাক্ষ্য দ্বারা সকল কথা ব্যক্ত না করিয়া সঙ্গে সঙ্গে নিজের মত কিঞ্চিৎ অধৈর্য ও আবেগের সহিত প্রকাশ করিয়াছেন। সুদৃঢ় প্রতিকূল সংস্কারের সহিত যুদ্ধ করিতে গিয়া এবং প্রচলিত অন্ধ অন্যায়পরতার দ্বারা পদে পদে ক্ষুব্ধ হইয়া তিনি স্বভাবতই এইরূপ বিচলিত ভাব প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু ইহাতে সত্যের শান্তি নষ্ট হইয়াছে এবং পক্ষপাতের অমূলক আশঙ্কায় পাঠকের মনে মধ্যে মধ্যে ঈষৎ উদ্‌বেগের সঞ্চার করিয়াছে।

শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয়ের “সিরাজদ্দৌলা’ পাঠ করিয়া কোনো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পত্র ক্রোধ প্রকাশ করিয়াছেন।

স্বজাতি সম্বন্ধে পরের নিকট হইতে নিন্দোক্তি শুনিলে ক্রোধ হইতেই পারে। সমূলক হইলেও।

কিন্তু আমাদের সহিত উক্ত পত্রসম্পাদকের কত প্রভেদ! আমাদিগকে বিদেশীলিখিত নিন্দোক্তি বাধ্য হইয়া অধ্যয়ন করিতে হয়, তাহা মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিতে হয়। কিন্তু অক্ষয়বাবুর সিরাজদ্দৌলা কোনো কালে সম্পাদক মহাশয়ের সন্তানবর্গের পাঠ্যপুস্তকরূপে নির্ধারিত হইবার সম্ভাবনা দেখি না। বিশেষত অক্ষয়বাবু এই গ্রন্থ যখন বাংলায় রচনা করিয়াছেন তখন ইংরাজ পাঠককে ব্যথিক করিবার সম্ভাবনা আরো সুদূরপরাহত হইয়াছে।

কিন্তু এই বাংলা রচনাতেই সমালোচক আক্রোশের কারণ আরো অধিক দেখিতে পাইয়াছেন। তিনি আশঙ্কা করেন, ভাষানভিজ্ঞতাবশত যে-সকল বাঙালি পাঠকের নিকট মূল দলিল এবং ঐতিহাসিক প্রমাণ-সকল আয়ত্তাতীত, “সিরাজদ্দৌলা’ গ্রন্থ পাঠে ইংরাজদিগের আচরণের প্রতি তাহাদের অশ্রদ্ধা জন্মিতে পারে।

কিন্তু ইহা ইতিহাস; যুক্তির দ্বারা প্রমাণের দ্বারা ইহাকে আক্রমণ করিয়া ধ্বংস করিয়া দেওয়া কঠিন নহে। এমন-কি আইনের কোনো অভাবনীয় ব্যাখ্যায় ইতিহাসসমেত ঐতিহাসিককেও লোপ করিয়া দেওয়া অসম্ভব না হইতে পারে। কিন্তু জিজ্ঞাস্য এই যে, তুলনায় কোন্‌টা গুরুতর– ইংরাজ লেখকগণ গল্পে প্রবন্ধে ভ্রমণবৃত্তান্তে প্রাচ্যজাতীয়দের প্রতি নানা আকারে যে নিন্দা ও অবজ্ঞা প্রকাশ করিতেছেন, যাহা অধিকাংশ স্থলেই যুক্তিগত তথ্যগত নহে, জাতীয় সংস্কারগত — অধিকাংশ স্থলেই যাহার সুগভীর মূল কারণ স্পেক্‌টেটর যাহাকে বলিয়াছেন ” The dislike for aliens “– ইহাই, অথবা বাংলা ইতিহাস যাহা শিক্ষিত বাঙালিদেরও বারো-আনা লোক বাংলায় লিখিত বলিয়াই পড়িতে অনাদর করিবে, তাহা?

আমাদের প্রতি ইংরাজের যে ধারণা জন্মিয়া থাকে তাহার ফল প্রত্যক্ষ — কারণ,আমরা নিরুপায়ভাবে ইংরাজের হস্তগত। একে দুর্বল অধীন আজ্ঞাবহের প্রতি স্বভাবতই উপেক্ষা জন্মে এবং সেই উপেক্ষা সদ্‌বিচারের ব্যাঘাত না করিয়া থাকিতে পারে না, তাহার পরে শিশুকাল হইতে ইংরাজসন্তান যে-সকল গ্রন্থ পাঠ করে তাহাতে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে বীভৎসা এবং বিভীষিকার উদ্রেক করিয়া দেয়। ভারতবর্ষের ধর্ম, সমাজ এবং লোকচরিত্র সম্বন্ধে ভূয়োভূয় কাল্পনিক মিথ্যাবাদ ও অত্যুক্তি দ্বারা পরিপূর্ণ ইংরাজি গ্রন্থের পত্রসংখ্যার সহিত তুলিত হইলে বঙ্গসাহিত্যের ভালোমন্দ পাঠ্য অপাঠ্য সমস্ত গ্রন্থ আপন ক্ষীণতাক্ষোভে লজ্জিত হইয়া উঠে।

ইংরাজ আমাদের ক্ষমতাশালী প্রভু। সেই ক্ষমতা ও প্রভাবের প্রত্যক্ষ আকর্ষণ অত্যন্ত অধিক। এত অধিক যে, অন্যায় ও অত্যাচারও যদি ঘটে তথাপি তাহা দুর্বল ব্যক্তিদিগকে ভয়ে বিস্ময়ে এবং একপ্রকার অন্ধ আসক্তিতে অভিভূত করিয়া রাখে। অতএব দেড়শত বৎসর পূর্বে ইংরাজ বণিক তৎকালীন রাজস্থানীয়দের প্রতি কিরূপ আচরণ করিয়াছিল তাহা পাঠ করিয়া ইংরাজের প্রতি অশ্রদ্ধা পোষণ করিতে থাকিবে এমন ভারতবাসী নাই। মুখে যাহাই বলি, কোনোদিন বিশেষ আঘাতের ক্ষোভে বিশেষ কারণে যেমনই তর্ক করি, ইংরাজের প্রবল প্রতাপের আকর্ষণ ছেদন করা আমাদের পক্ষে সহজ নহে।

অতএব যতদিন আমরা দুর্বল এবং ইংরাজ সবল ততদিন আমাদের মুখের নিন্দায় তাঁহাদের ক্ষতি নাই বলিলেই হয়, তাঁহাদের মুখের নিন্দা আমাদের পক্ষে সাংঘাতিক। ততদিন আমাদের সংবাদপত্র কেবল তাঁহাদের ও তাঁহাদের মেমসাহেবদের কর্ণপীড়া উৎপাদন করে মাত্র এবং তাঁহাদের সংবাদপত্র আমাদের মর্মস্থানের উপর বন্দুকের গুলি বর্ষণ করে।

কিন্তু ইংরাজি সাহিত্যে একটা অন্যায় আচরিত হয় বলিয়া আমাদের তাহার অন্যায় প্রতিশোধ লইব ইহা সুযুক্তির কথা নহে– বিশেষত দুর্বলের পক্ষে সবলের অনুকরণ ভয়াবহ।

ইংরাজের অন্যায় নিন্দা “সিরাজদ্দৌলা’ গ্রন্থের উদ্দেশ্য নহে। তবে, এমন-একটা প্রসঙ্গের উত্থাপন করায় কী প্রয়োজন ছিল! সেই প্রয়োজনীয়তা সমালোচক ঠিকভাবে বুঝিবেন এবং যথার্থভাবে গ্রহণ করিবেন কি না সন্দেহ।

ঘাতপ্রতিঘাতের একটা স্বাভাবিক নিয়ম আছে। প্রাচ্য চরিত্র, প্রাচ্য শাসননীতি সম্বন্ধে ইংরাজি গ্রন্থে ছোটো-বড়ো স্পষ্ট-অস্পষ্ট, সংগত-অসংগত অজস্র কটুক্তি পাঠ করিয়া শিক্ষিত-সাধারণের মনে যে-একটা অবমাননাজনিত ক্ষোভ জন্মিতে পারে এ কথা অল্প ইংরাজই কল্পনা করেন।

অথচ, প্রথম শিক্ষাকালে ইংরাজের গ্রন্থ আমরা বেদবাক্যস্বরূপ গ্রহণ করিতাম। তাহা আমাদিগকে যতই ব্যথিত করুক তাহার যে প্রতিবাদ সম্ভবপর, তাহার যে প্রমাণ-আলোচনা আমাদের আয়ত্তগত এ কথা আমাদের বিশ্বাস হইত না। নীরবে নতশিরে আপনাদের প্রতি ধিক্কার-সহকারে সমস্ত লাঞ্ছনাকে সম্পূর্ণ সত্যজ্ঞানে বহন করিতে হইত।

এমন অবস্থায় আমাদের দেশের যে-কোনো কৃতী গুণী ক্ষমতাশালী লেখক সেই মানসিক বন্ধন ছেদন করিয়াছেন, যিনি আমাদিগকে অন্ধ অনুবৃত্তি হইতে মুক্তিলাভের দৃষ্টান্ত দেখাইতে পারিয়াছেন তিনি আমাদের দেশের লোকের কৃতজ্ঞতাপাত্র।

তাহা ছাড়া প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সংঘর্ষে আমাদের ভাগে যে কেবলই কলঙ্ক সেটা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করা এবং বিরুদ্ধ প্রমাণ আনয়ন করা আমাদের নতশির ক্ষতহৃদয়ের পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয়।

অক্ষয়বাবু যে অন্ধকূপহত্যার সহিত গ্লেনকোর হত্যাকাণ্ড ও সিপাহিবিদ্রোহকালে অমৃতসরের নিদারুণ নিধন-ব্যাপারের তুলনা করিয়াছেন ইতিহাসবিবৃতিস্থলে তাহা অপ্রাসঙ্গিক হইতে পারে এবং ইংরাজ সমালোচকের তৎপ্রতি ক্রুদ্ধ কটাক্ষপাতও সংগত হইতে পারে, কিন্তু আমরা ইহাকে নিরর্থক বলিতে পারি না। এইজন্য পারি না যে, যে-সকল সমূলক, অমূলক ও অতিরঞ্জিত বিবরণ পাঠ করিয়া প্রাচ্য-চরিত্রের নির্দয় বর্বরতায় ইংরাজ-সন্তানগণ বংশানুক্রমে কন্টকিত হইয়া আসিতেছেন এবং উচ্চ ধর্মমঞ্চ হইতে আমাদের প্রতি ভৎর্সনা উদ্যত করিয়া রাখিয়াছেন, অন্ধকূপহত্যা তাহার মধ্যে একটা প্রধান। সেই আঘাতের একটা প্রতিঘাত করিতে না পারিলে আত্মাবমাননার হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় না। সুযোগ বুঝিয়া এ কথা বলিবার প্রলোভন আমরা সম্বরণ করিতে পারি না যে,শত্রুর প্রতি অন্ধ হিংস্রতা বিকৃত মানবচরিত্রের পশুপ্রবৃত্তি, তাহা বিশেষরূপে প্রাচ্য-চরিত্রের নহে। সমালোচকের ধর্মমঞ্চ কেবল একা কোনো জাতির নহে। অবসর পাইলে আমরাও তাহার উপর চড়িয়া বিচারক মহাশয়ের কলঙ্ককালিমায় তর্জনী নির্দেশ করিতে পারি। খৃস্টানশাস্ত্রে বলে পরকে বিচার করিলে নিজেকেও বিচারাধীনে আসিতে হয়। স্বীকার করি ইহা ইতিহাসনীতি নহে, কিন্তু ইহা স্বভাবের নিয়ম।

অবশ্য ইহাও স্বভাবের নিয়ম যে, সবল দুর্বলকে যেমন স্বচ্ছন্দে নিশ্চিন্তচিত্তে বিচার করিয়া থাকে, দুর্বল সবলকে তেমন করিয়া বিচার করিতে গেলে সবলের যুগল ভ্রূকুটিল এবং মুষ্টিযুগল উদ্যত হইয়া উঠিতে পারে। অক্ষয়বাবু হয়তো আদিম প্রকৃতির সেই রূঢ় নিয়মের অধীন আসিয়াছেন কিন্তু বাংলা ইতিহাসে তিনি যে স্বাধীনতার যুগ প্রবর্তন করিয়াছেন সেজন্য তিনি বঙ্গসাহিত্যে ধন্য হইয়া থাকিবেন।

সমালোচক মহাশয় এ কথা স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন যে, মুসলমান-রাজ্যকালে এরূপ গ্রন্থ অক্ষয়বাবু লিখিতে পারিতেন না। হয়তো পারিতেন না। মুসলমান রাজ্যকালে বিজিত হিন্দুগণ প্রধান মন্ত্রী, প্রধান সেনাপতি, রাজস্বসচিব প্রভৃতি উচ্চতর রাজকার্যে অধিকারবান ছিলেন কিন্তু কোনো নবাবি আমলে উক্ত নবাবের দেড়শতাব্দ-পূর্ববর্তী ইতিহাস, বাহিরের প্রমাণ ও অন্তরের বিশ্বাস অনুসারে তাঁহারা হয়তো লিখিতে পারিতেন না। ইংরাজ-রাজত্বকালে অক্ষয়বাবু যদি সেই অধিকার লাভ করিয়া থাকেন তবে তাহা ইংরাজশাসনের গৌরব, কিন্তু তবে কেন সেই অধিকার ব্যবহারের জন্য সমালোচক মহাশয় চক্ষু রক্তবর্ণ করিতেছেন? এবং যদি সে অধিকার অক্ষয়বাবুর না থাকে, যদি তিনি আইনের মর্যাদা লঙ্ঘন করিয়া থাকেন, তবে কেন সমালোচক মহাশয় অধিকারদানের ঔদার্য লইয়া গৌরব প্রকাশ করিতেছেন?

ফলত এই অধিকারের রেখা এতই সূক্ষ্ম ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছে যে, যাঁহারা আইনের অনুবীক্ষণ নিপুণভাবে প্রয়োগ করিতে পারেন তাঁহারাও সীমানির্ণয়ে মতভেদ প্রকাশ করিয়া থাকেন– এমন অবস্থায় অন্তত আরো কিছুদিন এ সম্বন্ধে কোনো কথা না বলাই ভালো।

জ্যৈষ্ঠ ১৩০৫

Exit mobile version