কেবল একটা বিষয়ে তিনি ইতিহাস-নীতি লঙ্ঘন করিয়াছেন। গ্রন্থকার যদিচ সিরাজচরিত্রের কোনো দোষ গোপন করিতে চেষ্টা করেন নাই, তথাপি কিঞ্চিৎ উদ্যমসহকারে তাহার পক্ষ অবলম্বন করিয়াছেন। শান্তভাবে কেবল ইতিহাসের সাক্ষ্য দ্বারা সকল কথা ব্যক্ত না করিয়া সঙ্গে সঙ্গে নিজের মত কিঞ্চিৎ অধৈর্য ও আবেগের সহিত প্রকাশ করিয়াছেন। সুদৃঢ় প্রতিকূল সংস্কারের সহিত যুদ্ধ করিতে গিয়া এবং প্রচলিত অন্ধ অন্যায়পরতার দ্বারা পদে পদে ক্ষুব্ধ হইয়া তিনি স্বভাবতই এইরূপ বিচলিত ভাব প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু ইহাতে সত্যের শান্তি নষ্ট হইয়াছে এবং পক্ষপাতের অমূলক আশঙ্কায় পাঠকের মনে মধ্যে মধ্যে ঈষৎ উদ্বেগের সঞ্চার করিয়াছে।
শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয়ের “সিরাজদ্দৌলা’ পাঠ করিয়া কোনো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পত্র ক্রোধ প্রকাশ করিয়াছেন।
স্বজাতি সম্বন্ধে পরের নিকট হইতে নিন্দোক্তি শুনিলে ক্রোধ হইতেই পারে। সমূলক হইলেও।
কিন্তু আমাদের সহিত উক্ত পত্রসম্পাদকের কত প্রভেদ! আমাদিগকে বিদেশীলিখিত নিন্দোক্তি বাধ্য হইয়া অধ্যয়ন করিতে হয়, তাহা মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিতে হয়। কিন্তু অক্ষয়বাবুর সিরাজদ্দৌলা কোনো কালে সম্পাদক মহাশয়ের সন্তানবর্গের পাঠ্যপুস্তকরূপে নির্ধারিত হইবার সম্ভাবনা দেখি না। বিশেষত অক্ষয়বাবু এই গ্রন্থ যখন বাংলায় রচনা করিয়াছেন তখন ইংরাজ পাঠককে ব্যথিক করিবার সম্ভাবনা আরো সুদূরপরাহত হইয়াছে।
কিন্তু এই বাংলা রচনাতেই সমালোচক আক্রোশের কারণ আরো অধিক দেখিতে পাইয়াছেন। তিনি আশঙ্কা করেন, ভাষানভিজ্ঞতাবশত যে-সকল বাঙালি পাঠকের নিকট মূল দলিল এবং ঐতিহাসিক প্রমাণ-সকল আয়ত্তাতীত, “সিরাজদ্দৌলা’ গ্রন্থ পাঠে ইংরাজদিগের আচরণের প্রতি তাহাদের অশ্রদ্ধা জন্মিতে পারে।
কিন্তু ইহা ইতিহাস; যুক্তির দ্বারা প্রমাণের দ্বারা ইহাকে আক্রমণ করিয়া ধ্বংস করিয়া দেওয়া কঠিন নহে। এমন-কি আইনের কোনো অভাবনীয় ব্যাখ্যায় ইতিহাসসমেত ঐতিহাসিককেও লোপ করিয়া দেওয়া অসম্ভব না হইতে পারে। কিন্তু জিজ্ঞাস্য এই যে, তুলনায় কোন্টা গুরুতর– ইংরাজ লেখকগণ গল্পে প্রবন্ধে ভ্রমণবৃত্তান্তে প্রাচ্যজাতীয়দের প্রতি নানা আকারে যে নিন্দা ও অবজ্ঞা প্রকাশ করিতেছেন, যাহা অধিকাংশ স্থলেই যুক্তিগত তথ্যগত নহে, জাতীয় সংস্কারগত — অধিকাংশ স্থলেই যাহার সুগভীর মূল কারণ স্পেক্টেটর যাহাকে বলিয়াছেন ” The dislike for aliens “– ইহাই, অথবা বাংলা ইতিহাস যাহা শিক্ষিত বাঙালিদেরও বারো-আনা লোক বাংলায় লিখিত বলিয়াই পড়িতে অনাদর করিবে, তাহা?
আমাদের প্রতি ইংরাজের যে ধারণা জন্মিয়া থাকে তাহার ফল প্রত্যক্ষ — কারণ,আমরা নিরুপায়ভাবে ইংরাজের হস্তগত। একে দুর্বল অধীন আজ্ঞাবহের প্রতি স্বভাবতই উপেক্ষা জন্মে এবং সেই উপেক্ষা সদ্বিচারের ব্যাঘাত না করিয়া থাকিতে পারে না, তাহার পরে শিশুকাল হইতে ইংরাজসন্তান যে-সকল গ্রন্থ পাঠ করে তাহাতে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে বীভৎসা এবং বিভীষিকার উদ্রেক করিয়া দেয়। ভারতবর্ষের ধর্ম, সমাজ এবং লোকচরিত্র সম্বন্ধে ভূয়োভূয় কাল্পনিক মিথ্যাবাদ ও অত্যুক্তি দ্বারা পরিপূর্ণ ইংরাজি গ্রন্থের পত্রসংখ্যার সহিত তুলিত হইলে বঙ্গসাহিত্যের ভালোমন্দ পাঠ্য অপাঠ্য সমস্ত গ্রন্থ আপন ক্ষীণতাক্ষোভে লজ্জিত হইয়া উঠে।
ইংরাজ আমাদের ক্ষমতাশালী প্রভু। সেই ক্ষমতা ও প্রভাবের প্রত্যক্ষ আকর্ষণ অত্যন্ত অধিক। এত অধিক যে, অন্যায় ও অত্যাচারও যদি ঘটে তথাপি তাহা দুর্বল ব্যক্তিদিগকে ভয়ে বিস্ময়ে এবং একপ্রকার অন্ধ আসক্তিতে অভিভূত করিয়া রাখে। অতএব দেড়শত বৎসর পূর্বে ইংরাজ বণিক তৎকালীন রাজস্থানীয়দের প্রতি কিরূপ আচরণ করিয়াছিল তাহা পাঠ করিয়া ইংরাজের প্রতি অশ্রদ্ধা পোষণ করিতে থাকিবে এমন ভারতবাসী নাই। মুখে যাহাই বলি, কোনোদিন বিশেষ আঘাতের ক্ষোভে বিশেষ কারণে যেমনই তর্ক করি, ইংরাজের প্রবল প্রতাপের আকর্ষণ ছেদন করা আমাদের পক্ষে সহজ নহে।
অতএব যতদিন আমরা দুর্বল এবং ইংরাজ সবল ততদিন আমাদের মুখের নিন্দায় তাঁহাদের ক্ষতি নাই বলিলেই হয়, তাঁহাদের মুখের নিন্দা আমাদের পক্ষে সাংঘাতিক। ততদিন আমাদের সংবাদপত্র কেবল তাঁহাদের ও তাঁহাদের মেমসাহেবদের কর্ণপীড়া উৎপাদন করে মাত্র এবং তাঁহাদের সংবাদপত্র আমাদের মর্মস্থানের উপর বন্দুকের গুলি বর্ষণ করে।
কিন্তু ইংরাজি সাহিত্যে একটা অন্যায় আচরিত হয় বলিয়া আমাদের তাহার অন্যায় প্রতিশোধ লইব ইহা সুযুক্তির কথা নহে– বিশেষত দুর্বলের পক্ষে সবলের অনুকরণ ভয়াবহ।
ইংরাজের অন্যায় নিন্দা “সিরাজদ্দৌলা’ গ্রন্থের উদ্দেশ্য নহে। তবে, এমন-একটা প্রসঙ্গের উত্থাপন করায় কী প্রয়োজন ছিল! সেই প্রয়োজনীয়তা সমালোচক ঠিকভাবে বুঝিবেন এবং যথার্থভাবে গ্রহণ করিবেন কি না সন্দেহ।
ঘাতপ্রতিঘাতের একটা স্বাভাবিক নিয়ম আছে। প্রাচ্য চরিত্র, প্রাচ্য শাসননীতি সম্বন্ধে ইংরাজি গ্রন্থে ছোটো-বড়ো স্পষ্ট-অস্পষ্ট, সংগত-অসংগত অজস্র কটুক্তি পাঠ করিয়া শিক্ষিত-সাধারণের মনে যে-একটা অবমাননাজনিত ক্ষোভ জন্মিতে পারে এ কথা অল্প ইংরাজই কল্পনা করেন।
অথচ, প্রথম শিক্ষাকালে ইংরাজের গ্রন্থ আমরা বেদবাক্যস্বরূপ গ্রহণ করিতাম। তাহা আমাদিগকে যতই ব্যথিত করুক তাহার যে প্রতিবাদ সম্ভবপর, তাহার যে প্রমাণ-আলোচনা আমাদের আয়ত্তগত এ কথা আমাদের বিশ্বাস হইত না। নীরবে নতশিরে আপনাদের প্রতি ধিক্কার-সহকারে সমস্ত লাঞ্ছনাকে সম্পূর্ণ সত্যজ্ঞানে বহন করিতে হইত।