সে সাহস কী শব্দনির্বাচনে, কী ছন্দোরচনায়, কী ভাববিন্যাসে সর্বত্র অক্ষুণ্ন। সে সাহস আমাদিগকে বারংবার চকিত করিয়া তুলিয়াছে– আমাদের মনকে শেষ পর্যন্ত তরঙ্গিত করিয়া রাখিয়াছে।
কাব্যে যে নয় রস আছে, অনেক কবিই সেই ঈর্ষান্বিত নয় রসকে নয় মহলে পৃথক করিয়া রাখেন — দ্বিজেন্দ্রলালবাবু অকুতোভয়ে এক মহলেই একত্র তাহাদের উৎসব জমাইতে বসিয়াছেন। তাঁহার কাব্যে হাস্য, করুণা, মাধুর্য, বিস্ময়, কখন কে কাহার গায়ে আসিয়া পড়িতেছে, তাহার ঠিকানা নাই।
এইরূপে “মন্দ্র’ কাব্যের প্রায় প্রত্যেক কবিতা নব নব গতিভঙ্গে যেন নৃত্য করিতেছে, কেহ স্থির হইয়া নাই; ভাবের অভাবনীয় আবর্তনে তাহার ছন্দ ঝংকৃত হইয়া উঠিতেছে এবং তাহার অলংকারগুলি হইতে আলোক ঠিকরিয়া পড়িতেছে।
কিন্তু নর্তনশীলা নটীর সঙ্গে তুলনা করিলে “মন্দ্র’ কাব্যের কবিতাগুলির ঠিক বর্ণনা হয় না। কারণ ইহার কবিতাগুলির মধ্যে পৌরুষ আছে। ইহার হাস্য, বিষাদ, বিদ্রুপ, বিস্ময় সমস্তই পুরুষদের– তাহাতে চেষ্টাহীন সৌন্দর্যের সঙ্গে একটা স্বাভাবিক সবলতা আছে। তাহাতে হাবভাব ও সাজসজ্জার প্রতি কোনো নজর নাই।
বরং উপমা দিতে হইলে শ্রাবণের পূর্ণিমারাত্রির কথা পাড়া যাইতে পারে। আলোক এবং অন্ধকার, গতি এবং স্তব্ধতা, মাধুর্য ও বিরাটভাব আকাশ জুড়িয়া অনায়াসে মিলিত হইয়াছে। আবার মাঝে মাঝে এক-এক পসলা বৃষ্টিও বাতাসকে আর্দ্র করিয়া ঝর্ঝর্ শব্দে ঝরিয়া পড়ে। মেঘেরও বিচিত্র ভঙ্গি– তাহা কখনো চাঁদকে অর্ধেক ঢাকিতেছে, কখনো পুরা ঢাকিতেছে, কখনো-বা হঠাৎ একেবারে মুক্ত করিয়া দিতেছে — কখনো-বা ঘোরঘটায় বিদ্যুতে স্ফুরিত ও গর্জনে স্তনিত হইয়া উঠিতেছে।
দ্বিজেন্দ্রলালবাবু বাংলাভাষায় একটা নূতন শক্তি আবিষ্কার করিয়াছেন। প্রতিভাসম্পন্ন লেখকের সেই কাজ। ভাষাবিশেষের মধ্যে যে কতটা ক্ষমতা আছে, তাহা তাঁহারাই দেখাইয়া দেন– পূর্বে যাহার অস্তিত্ব কেহ সন্দেহ করে নাই, তাহাই তাঁহারা প্রমাণ করিয়া দেন। দ্বিজেন্দ্রলালবাবু বাংলা কাব্যভাষার একটি বিশেষ শক্তি দেখাইয়া দিলেন। তাহা ইহার গতিশক্তি। ইহা যে কেমন দ্রুতবেগে, কেমন অনায়াসে তরল হইতে গভীর ভাষায়, ভাব হইতে ভাবান্তরে চলিতে পারে, ইহার গতি যে কেবলমাত্র মৃদুমন্থর আবেশভারাক্রান্ত নহে, তাহা কবি দেখাইয়াছেন।
ছন্দ সম্বন্ধেও যেন স্পর্ধাভরে কবি যথেচ্ছ ক্ষমতা প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহার “আশীর্বাদ’ ও “উদ্বোধন’ কবিতায় ছন্দকে একেবারে ভাঙিয়া চুড়িয়া উড়াইয়া দিয়া ছন্দোরচনা করা হইয়াছে। তিনি যেন সাংঘাতিক সংকটের পাশ দিয়া গেছেন– কোথাও যে কিছু বিপদ ঘটে নাই, তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু এই দুঃসাহস কোনো ক্ষমতাহীন কবিকে আদৌ শোভা পাইত না।
এইবার নমুনা উদ্ধৃত করিবার সময় আসিয়াছে। কিন্তু আমরা ফুল ছিঁড়িয়া বাগানের শোভা দেখাইবার আশা করি না। পাঠকগণ কাব্য পড়িবেন– কেবল সমালোচনা চাখিয়া ভোজের পূর্ণসুখ নষ্ট করিবেন না।
কার্তিক ১৩০৯
মুসলমান রাজত্বের ইতিহাস
ভারতবর্ষে মুসলমান-প্রবেশের অনতিপূর্বে খৃষ্টশতাব্দীর আরম্ভকালে ভারত-ইতিহাসে একটা রোমাঞ্চকর মহাশূন্যতা দেখা যায়। দীর্ঘ দিবসের অবসানের পর একটা যেন চেতনাহীন সুষুপ্তির অন্ধকার সমস্ত দেশকে আচ্ছন্ন করিয়াছিল– সেটুকু সময়ের কোনো জাগ্রত সাক্ষী কোনো প্রামাণিক নিদর্শন পাওয়া যায় না। গ্রীক এবং শকগণের সহিত সংঘাত তাহার পূর্বেই সমাপ্ত হইয়া গিয়াছিল। যে দ্বন্দ্বসংঘাতে চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য শালিবাহন সমস্ত ভারতবর্ষের চূড়ার উপরে জাগিয়া উঠিয়াছিলেন তাহা কেমন করিয়া একেবারে শান্ত নিরস্ত নিস্তরঙ্গ হইয়াছিল। নিকটবর্তী সময়ের মধ্যে কোনো মহৎ ব্যক্তি বা বৃহৎ উদ্বোধনের আবির্ভাব হয় নাই। মুসলমানগণ যখন ভারতবর্ষের ইতিহাস-যবনিকা সবলে ছিন্ন করিয়া উদ্ঘাটন করিল তখন রাজপুত নামক এক আধুনিক সম্প্রদায় দেশের সমুদয় উচ্চ স্থানগুলি অধিকার করিয়া মানঅভিমানের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিরোধে দেশকে বিচ্ছিন্ন করিয়া তুলিতেছিল। সে জাতি কখন গঠিত হইল, কখন প্রবল হইল, কখন পশ্চিম হইতে পূর্বদেশ পর্যন্ত ব্যাপ্ত হইল, তাহারা কাহাকেও দূরীকৃত করিয়া কাহার স্থান অধিকার করিল, তা সমস্তই ভারতবর্ষে সেই ঐতিহাসিক অন্ধরজনীর কাহিনী; তাহার আনুপূর্বিকতা প্রচ্ছন্ন। মনে হয়, ভারতবর্ষ তদানীং সহসা কোথা হইতে একটা নিষ্ঠুর আঘাত একটা প্রচণ্ড বেদনা পাইয়া নিঃশব্দ মূর্ছিত হইয়াছিল। তাহার পর হইতে আর সে নিজের পূর্বাবস্থা ফিরিয়া পায় নাই; আর তাহার বীণায় সংগীত বাজে নাই, কোদণ্ডে টংকার জাগে নাই, হোমাগ্নিদীপ্ত তপোবনে ঋষিললাট হইতে ব্রহ্মবিদ্যা উদ্ভাসিত হয় নাই।
এ দিকে অনতিপূর্বে ভারতবর্ষের প্রতিবেশে বহুতর খণ্ডবিচ্ছিন্ন জাতি মহাপুরুষ মহম্মদের প্রচণ্ড আকর্ষণবলে একীভূত হইয়া মুসলমান নামক এক বিরাট কলেবর ধারণ করিয়া উত্থিত হইয়াছিল। তাহার যেন ভিন্ন ভিন্ন দুর্গম মরুময় গিরিশিখরের উপরে খণ্ড তুষারের ন্যায় নিজের নিকটে অপ্রবুদ্ধ এবং বাহিরের নিকটে অজ্ঞাত হইয়া বিরাজ করিতেছিল। কখন প্রচণ্ড সূর্যের উদয় হইল এবং দেখিতে দেখিতে নানা শিখর হইতে ছুটিয়া আসিয়া তুষারস্রুত বন্যা একবার একত্র স্ফীত হইয়া তাহার পরে উন্মত্ত সহস্র ধারায় জগৎকে চতুর্দিকে আক্রমণ করিতে বাহির হইল।