“ব্রহ্মার মানসসরে
ফুটে ঢল ঢল করে
নীল জলে মনোহর সুবর্ণনলিনী,
পাদপদ্ম রাখি তায়
হাসি হাসি ভাসি যায়
ষোড়শী রূপসী বামা পূর্ণিমাযামিনী।
কোটি শশী উপহাসি
উথলে লাবণ্যরাশি,
তরল দর্পণে যেন দিগন্তে আবরে;
আচম্বিতে অপরূপ
রূপসীর প্রতিরূপ
হাসি হাসি ভাসি ভাসি উদয় অম্বরে।’
এই সারদা দেবীর Spirit of Beauty-র নব-অভ্যুদিত করুণা-বালিকামূর্তি এবং সর্বত্রব্যাপ্ত সুন্দরী ষোড়শীমূর্তির বর্ণনা সমাপ্ত করিয়া কবি গাহিয়া উঠিয়াছেন–
“তোমারে হৃদয়ে রাখি
সদানন্দ মনে থাকি,
শ্মশান অমরাবতী দু’ই ভালো লাগে।–
গিরিমালা, কুঞ্জবন,
গৃহ, নাট-নিকেতন,
যখন যেখানে যাই, যাও আগে আগে। …
যত মনে অভিলাষ
তত তুমি ভালোবাসো,
তত মনপ্রাণ ভরে আমি ভালোবাসি।
ভক্তিভরে একতানে
মজেছি তোমার ধ্যানে,
কমলার ধনে মানে নহি অভিলাষী।’
এই মানসীরূপিণী সাধনার ধনকে পরিপূর্ণরূপে লাভ করিবার জন্য কাতরতা প্রকাশ করিয়া কবি প্রথম সর্গ সমাপ্ত করিয়াছেন।
তাহার পর-সর্গ হইতে প্রেমিকের ব্যাকুলতা। কখনো অভিমান কখনো বিরহ, কখনো আনন্দ কখনো বেদনা, কখনো ভর্ৎসনা কখনো স্তব। দেবী কবির প্রণয়িনী রূপে উদিত হইয়া বিচিত্র সুখদুঃখে শতধারে সংগীত উচ্ছ্বসিত করিয়া তুলিতেছেন। কবি কখনো তাঁহাকে পাইতেছেন কখনো তাঁহাকে হারাইতেছেন– কখনো তাঁহার অভয়রূপ কখনো তাঁহার সংহারমূর্তি দেখিতেছেন। কখনো তাঁহার অভয়রূপ কখনো তাঁহার সংহারমূর্তি দেখিতেছেন। কখনো তিনি অভিমানিনী, কখনো বিষাদিনী, কখনো আনন্দময়ী।
কবি বিষাদিনীকে বলিতেছেন–
“অয়ি, এ কী, কেন কেন,
বিষণ্ণ হইলে হেন–
আনত আনন-শশী, আনত নয়ন,
অধরে মন্থরে আসি
কপোলে মিলায় হাসি
থরথর ওষ্ঠাধর, স্ফোরে না বচন!
তেমন অরুণ-রেখা
কেন কুহেলিকা-ঢাকা,
প্রভাত-প্রতিমা আজি কেন গা মলিন?
বলো বলো চন্দ্রাননে,
কে ব্যথা দিয়েছে মনে,
কে এমন– এক এমন হৃদয়বিহীন!
বুঝিলাম অনুমানে,
করুণা-কটাক্ষ দানে
চাবে না আমার পানে, কবেও না কথা।
কেন যে কবে না হায়
হৃদয় জানিতে চায়,
শরমে কি বাধে বাণী, মরমে বা বাজে ব্যথা।
যদি মর্মব্যথা নয়,
কেন অশ্রুধারা বয়।
দেববালা ছলাকলা জানে না কখন–
সরল মধুর প্রাণ,
সতত মুখেতে গান,
আপন বীণার তানে আপনি মগন।
অয়ি, হা, সরলা সতী
সত্যরূপা সরস্বতী,
চির-অনুরক্ত ভক্ত হয়ে কৃতাঞ্জলি
পদপদ্মাসন-কাছে
নীরবে দাঁড়ায়ে আছে,
কী করিবে, কোথা যাবে, দাও অনুমতি।
স্বরগকুসুম মালা,
নরক-জ্বলন-জ্বালা,
ধরিবে প্রফুল্লমুখে মস্তক সকলি।
তব আজ্ঞা সুমঙ্গল,
যাই যাব রসাতল,
চাই নে এ বরমালা, এ অমরাবতী।’
কবি অভিমানিনী সরস্বতীকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন–
“আজি এ বিষণ্ণ বেশে
কেন দেখা দিলে এসে,
কাঁদিলে কাঁদালে, দেবি, জন্মের মতন!
পূর্ণিমাপ্রমোদ-আলো,
নয়নে লেগেছে ভালো,
মাঝেতে উথলে নদী, দু পারে দুজন–
চক্রবাক্ চক্রবাকী দু পারে দুজন।
নয়নে নয়নে মেলা,
মানসে মানসে-খেলা,
অধরে প্রেমের হাসি বিষাদে মলিন।
হৃদয়বীণার মাঝে
ললিত রাগিণী বাজে,
মনের মধুর গান মনেই বিলীন।
সেই আমি সেই তুমি,
সেই এ স্বরগভূমি,
সেই-সব কল্পতরু সেই কুঞ্জবন,
সেই প্রেম সেই স্নেহ,
সেই প্রাণ সেই দেহ–
কেন মন্দাকিনী-তীরে দু পারে দুজন!’
কখনো মুহূর্তের জন্য সংশয় আসিয়া বলে–
“তবে কি সকলি ভুল?
নাই কি প্রেমের মূল–
বিচিত্র গগনফুল কল্পনালতার?
মন কেন রসে ভাসে,
প্রাণ কেন ভালোবাসে
আদরে পরিতে গলে সেই ফুলহার?
শত শত নরনারী
দাঁড়ায়েছে সারি সারি–
নয়ন খুঁজিছে কেন সেই মুখখানি!
হেরে হারানিধি পায়,
না হেরিলে প্রাণ যায়–
এমন সরল সত্য কী আছে না জানি!’
কখনো-বা প্রেমোপভোগের আদর্শ চিত্র মানসপটে উদিত হয়–
নন্দননিকুঞ্জবনে
বসি শ্বেতশিলাসনে
খোলা প্রাণে রতি-কাম বিহরে কেমন!
আননে উদার হাসি,
নয়নে অমৃতরাশি,
অপরূপ আলো এক উজলে ভুবন।…
কী এক ভাবেতে ভোর;
কী যেন নেশার ঘোর,
টলিয়ে ঢলিয়ে পড়ে নয়নে নয়ন–
গলে গলে বাহুলতা,
জড়িমা-জড়িত কথা,
সোহাগে সোহাগে রাগে গলগল মন।
করে কর থরথর,
টলমল কলেবর,
গুরুগুরু দুরুদুরু বুকের ভিতর–
তরুণ অরুণ ঘটা
আননে আরক্ত ছটা,
অধর-কমলদলে কাঁপে থরথর।
প্রণয় পবিত্র কাম
সুখস্বর্গ মোক্ষধাম।
আজি কেন হেরি হেন মাতোয়ারা বেশ!
ফুলধনু ছড়াছড়ি
দূরে যায় গড়াগড়ি,
রতির খুলিয়ে খোঁপা আলুথালু কেশ!
বিহ্বল পাগলপ্রাণে
চেয়ে সতী পতিপানে,
গলিয়ে গড়িয়ে কোথা চলে গেছে মন!
মুগ্ধ মত্ত নেত্র দুটি,
আধ ইন্দিবর ফুটি,
দুলুদুলু ঢুলুঢুলু করিছে কেমন!
আলসে উঠিছে হাই,
ঘুম আছে, ঘুম নাই,
কী যেন স্বপনমত চলিয়াছে মনে!
সুখের সাগরে ভাসি
কিবে প্রাণ-খোলা হাসি
কী এক লহরী খেলে নয়নে নয়নে!
উথুলে উথুলে প্রাণ
উঠিছে ললিত তান,
ঘুমায়ে ঘুমায়ে গান গায় দুই জন।
সুরে সুরে সম্ রাখি
ডেকে ডেকে ওঠে পাখি,
তালে তালে ঢ’লে ঢ’লে চলে সমীরণ।
কুঞ্জের আড়ালে থেকে
চন্দ্রমা লুকায়ে দেখে,
প্রণয়ীর সুখে সদা সুখী সুধাকর।
সাজিয়ে মুকুলে ফুলে
আহ্লাদেতে হেলে দুলে
চৌদিকে নিকুঞ্জলতা নাচে মনোহর।
সে আনন্দে আনন্দিনী,
উথলিয়ে মন্দাকিনী,
করি করি কলধ্বনি বহে কুতুহলে।’
এইরূপ বিষাদ-বিরহ-সংশয়ের পর কবি হিমালয়শিখরে প্রণয়িনী দেবীর সহিত আনন্দমিলনের চিত্র আঁকিয়া গ্রন্থ শেষ করিয়াছেন। আরম্ভ-অংশ ব্যতীত হিমালয়েরবর্ণনা প্রশংসার যোগ্য নহে, সেই বর্ণনা বাদ দিয়া অবশিষ্ট অংশ উদ্ধৃত করি–