যেমন আমাদের দেশে পিতৃশ্রাদ্ধ প্রকাশ্য সভায় অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে এবং প্রত্যেক পিতৃহীন ব্যক্তির পিতৃশোক ব্যক্ত করা প্রকাশ্য কর্তব্যস্বরূপে গণ্য হয় তেমনি পাব্লিকের হিতৈষী কোনো মহৎ ব্যক্তির মৃত্যুতে প্রকাশ্য সভায় শোকজ্ঞাপন একটা সামাজিক কর্তব্যের মধ্যে গণ্য হওয়া উচিত। গার্হস্থ্যপ্রধান সমাজে প্রায় প্রত্যেক পিতাই বীর। তাঁহাদিগকে বিচিত্র কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে হয় এবং সমস্ত পরিবারের জন্য পদে পদে ত্যাগস্বীকার করিয়া আত্মসুখ বিসর্জনপূর্বক চলিতে হয়। যাহাদের হিতের জন্য তাঁহারা ধৈর্যের সহিত বীর্যসহকারে আমৃত্যুকাল সংসারের কঠিন কর্তব্যসকল সাবধানে পালন করিয়া চলেন তাহারা সর্বসমক্ষে সেই আত্মসুখে উদাসীন হিতব্রত গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি প্রদর্শন করিবে ইহা সমাজের শাসন। তেমনি, যাঁহারা কেবল আপনার ঘরের জন্য নহে, পরন্তু পাব্লিকের হিতের জন্য আপন জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন, মৃত্যুর পরে তাঁহাদের প্রতি প্রকাশ্য ভক্তি স্বীকার করা কি পাব্লিকের কর্তব্য নহে? এবং প্রকাশ্যে ভক্তি স্বীকার করিতে গেলেই কি ব্যক্তিগত শোককে সংযমে আনা আবশ্যক হয় না। এবং একজন বিশেষ বন্ধু রুদ্ধদ্বার গৃহের মধ্যে যেরূপ ভাবে শোকোচ্ছ্বাসকে মুক্ত করিয়া থাকেন সাধারণের নিকট কি কখনো সেরূপ শোকপ্রকাশ প্রত্যাশা করা যায়? এবং সাধারণের পক্ষে সেরূপ শোক সম্ভব নহে বলিয়াই কি সাধারণ শোকের কোনো মূল্য নাই এবং তাহা নিন্দনীয়?
এ কথা আমি অস্বীকার করি না যে, আমাদের দেশের পাব্লিক আমাদের দেশীয় মহাত্মা লোকের বিয়োগে যথোচিত শোক অনুভব করে না। আমাদের এই অল্পবয়স্ক পাব্লিক অনেকটা বালক-স্বভাব। সে আপনার হিতৈষীদিগকে ভালো করিয়া চেনে না, যে উপকারগুলি পায় তাহার সম্পূর্ণ মূল্য বুঝে না, বন্ধুদিগকে অতিশীঘ্রই বিস্মৃত হয় এবং মনে করে আমি কেবল গ্রহণ করিব মাত্র কিন্তু তাহার পরিবর্তে আমার কোনো কর্তব্য নাই।
আমি বলি, এইরূপ পাব্লিকেরই শিক্ষা আবশ্যক এবং সভা আহ্বান ও সেই সভায় আলোচনাই শিক্ষার প্রধান উপায়। যাঁহারা চিন্তাশীল সহৃদয় ভাবুক ব্যক্তি তাঁহারা যদি লোকহিতৈষী মহোদয় ব্যক্তিদিগের বিয়োগশোককে নিজের হৃদয়ের মধ্যে আবদ্ধ রাখিয়া দেন, তাহাকে যদি সাধারণ শোকের উদার বৃহত্ত্ব দান না করেন, তাঁহারা যদি সাধারণকে ক্ষুদ্র ও চপল বলিয়া ঘৃণা করিয়া দেশের বড়ো বড়ো ঘটনার সময় শিক্ষাদানের অবসরকে অবহেলা করেন, এমন-কি, যখন দেশের লোক সুসময়ে দুঃসময়ে তাঁহাদের দ্বারে গিয়া সমাগত হয় তখন বিমুখ হইয়া তাহাদিগকে নিরাশ ও নিরস্ত করিতে চেষ্টা করেন এবং সেই তিরস্কৃত সম্প্রদায় নিজের স্বল্প বুদ্ধি ও সামর্থ্য অনুসারে তাঁহাদের বিনা সাহায্যে যাহা-কিছু করে তাহাকে তুচ্ছ বলিয়া ধিক্কার করেন, তবে তাঁহারা আমাদের বর্তমান সমাজকে বর্তমানকালোপযোগী একটি প্রধান শিক্ষা হইতে বঞ্চিত করিয়া থাকেন।
বিশেষত আমাদের দেশে সাহিত্য-সমাজ নাই এবং সমাজের মধ্যে সাহিত্যের চর্চা নাই। য়ুরোপে যেরূপভাবে সামাজিকতার চর্চা হয় তাহাতে যশস্বী লোকেরা নানা উপলক্ষে নানা সভায় উপস্থিত হন। তাঁহারা কেবলমাত্র আপন পরিবার এবং গুটিকতক বন্ধুর নিকটেই প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত নহেন। তাঁহারা নিয়তই সাধারণের সমক্ষে অবস্থিতি করিতেছেন। তাঁহারা স্বদেশীয় নরনারীর নিকটবর্তী, সম্মুখবর্তী, দৃষ্টিগোচর। এইজন্য তাঁহারা যখন লোকান্তরিত হন তখন তাঁহাদের মৃত্যুর ছায়া গোধূলির অন্ধকারের মতো সমস্ত দেশের উপর আসিয়া পড়ে। তাঁহাদের বিচ্ছেদজনিত অভাব সমাজের মধ্যে অত্যন্ত স্পষ্টরূপে দৃশ্যমান হইতে থাকে।
আমাদের সমাজ সেরূপ ঘন নহে। কর্তব্যপরম্পরায় আকৃষ্ট হইয়া পরিবারের বাহিরে বিচরণ করিতে কেহ আমাদিগকে বাধ্য করে না। এবং আমাদের বহিঃসমাজে রমণীদের স্থান না থাকাতে সেখানে সামাজিকতা অত্যন্ত অসম্পূর্ণ। এরূপ অবস্থায় আমাদের দেশের বড়োলোকেরা আপন ঘরের বাহিরে যথেষ্ট এবং যথার্থ-রূপে পরিচিত ও নানা সম্বন্ধে বদ্ধ হইতে পারেন না। তাঁহারা সর্বদাই অন্তরালে থাকেন।
মানুষকে বাদ দিয়া কেবল মানুষের কাজটুকু গ্রহণ করা সাধারণের পক্ষে বড়ো দুঃসাধ্য। উপহারের সঙ্গে সঙ্গে যদি একটি স্নেহহস্ত দেখা যায় তবে সেই উপহারের মূল্য অনেক বাড়িয়া যায় এবং তাহার স্মৃতি হৃদয়ে মুদ্রিত হইয়া যায়। মানুষের পক্ষে মানুষ বড়ো আদরের বড়ো আকাঙক্ষার ধন। মানবহৃদয় ও মানবজীবনের সহিত মিশ্রিত হইয়া যাহা আমাদের নিকট উপস্থিত হয় তাহা অতি সহজে এবং সানন্দে আমরা গ্রহণ করিতে পারি। যখন একটি সজীব মানবকণ্ঠ মধুরস্বরে গান করে তখন সেই গানের সৌন্দর্যের মধ্যে একটি ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মানবহৃদয়ের জীবন্ত সম্পর্ক অনুভব করিয়া আমরা প্রবলতর আনন্দ সম্ভোগ করি– যন্ত্রের মধ্য হইতে অবিকল সেই সংগীত শ্রবণ করিলে আনন্দের অনেকটা হ্রাস হয়। তখন আমরা যন্ত্রবাদককে অথবা সংগীতরচয়িতাকে গানের ভাবোচ্ছ্বাসের সহিত জড়িত করিয়া থাকি। যেমন করিয়া হউক, কর্মের সহিত কর্তাকে অব্যবহিতভাবে দেখিলে কর্মটি সজীব সচেতন হইয়া উঠে এবং আমাদের চেতনার সহিত সহজে মিশ্রিত হয়।
এইজন্য কোনা কার্য আমাদের মনোরম বোধ হইলে তাহার কর্তার সহিত পরিচিত হইবার জন্য আমাদের আগ্রহ জন্মে। নতুবা আমাদের হৃদয় যেন তাহারা পুরা খাদ্যটি পায় না। তাহার অর্ধেক ক্ষুধা থাকিয়া যায়।