সে কে? — এ জগতে কেহ আছে, অতি উচ্চ মোর কাছে
যার প্রতি তুচ্ছ অভিলাষ;
সে কে? — অধীন হইয়ে, তবু রহে যে আমার প্রভু;
প্রভু হয়ে আমি যার দাস;
সে কে? — দূর হতে দূরাত্মীয়, প্রিয়তম হতে প্রিয়,
আপন হইতে যে আপন;
সে কে? — লতা হতে ক্ষীণ তারে বাঁধে দৃঢ় যে আমারে,
ছাড়াতে পারি না আজীবন;
সে কে? — দুর্বলতা যার বল, মর্মভেদী অশ্রুজল;
প্রেম-উচ্চারিত রোষ যার;
সে কে? — যার পরিতোষ মম সফল জনমসম;
সুখ-সিদ্ধি সব সাধনার;
সে কে? — হলে কঠিন চিক শিশুসম স্নেহভীত
যার কাছে পড়ি গিয়া নুয়ে;
সে কে? — বিনা দোষে ক্ষমা চাই যার; অপমান নাই
শতবার পা দুখানি ছুঁয়ে;
সে কে? — মধুর দাসত্ব যার, লীলাময় কারাগার;
শৃঙ্খল নূপুর হয়ে বাজে;
সে কে? — হৃদয় খুঁজিতে গিয়া নিজে যাই হারাইয়া
যার হৃদি-প্রহেলিকা মাঝে।
ইহা কবিতা, কিন্তু গান নহে। সুরসংযোগে গাহিলেও ইহাকে গান বলিতে পারি না। ইহাতে ভাব আছে এবং ভাবপ্রকাশের নৈপুণ্যও আছে কিন্তু ভাবের সেই স্বতউচ্ছ্বসিত সদ্য-উৎসারিত আবেগ নাই যাহা পাঠকের হৃদয়ের মধ্যে প্রহত তন্ত্রীর ন্যায় একটা সংগীতের কম্পন উৎপাদন করিয়া তোলে।
ছিল বসি সে কুসুমকাননে।
আর অমল অরুণ উজল আভা
ভাসিতেছিল সে আননে।
ছিল এলায়ে সে কেশরাশি (ছায়াসম হে);
ছিল ললাটে দিব্য আলোক, শান্তি
অতুল গরিমারাশি।
সেথা ছিল না বিষাদভাষা (অশ্রুভরা গো);
সেথা বাঁধা ছিল শুধু সুখের স্মৃতি
হাসি, হরষ, আশা;
সেথা ঘুমায়ে ছিলরে পুণ্য, প্রীতি,
প্রাণভরা ভালোবাসা।
তার সরল সুঠাম দেহ (প্রভাময় গো, প্রাণভরা গো);
যেন যা-কিছু কোমল ললিত তা দিয়ে
রচিয়াছে তাহে কেহ;
পরে সৃজিল সেথায় স্বপন, সংগীত,
সোহাগ শরম স্নেহ।
যেন পাইল রে উষা প্রাণ (আলোময়ী রে);
যেন জীবন্ত কুসুম, কনকভাতি
সুমিলিত, সমতান।
যেন সজীব সুরভি মধুর মলয়
কোকিলকূজিত গান।
শুধু চাহিল সে মোর পানে (একবার গো);
যেন বাজিল বীণা মুরজ মুরলী
অমনি অধীর প্রাণে;
সে গেল কী দিয়া, কী নিয়া, বাঁধি মোর হিয়া
কী মন্ত্রগুণে কে জানে।
এই কবিতাটির মধ্যে যে রস আছে তাহাকে আমরা গীতরস নাম দিতে পারি। অর্থাৎ লেখক একটি সুখস্মৃতি এবং সৌন্দর্যস্বপ্নে আমাদের মনকে যেরূপভাবে আবিষ্ট করিয়া তুলিতে চাহেন তাহা সংগীত দ্বারা সাধিত হইয়া থাকে এবং যখন কোনো কবিতা বিশেষ মন্ত্রগুণে অনুরূপ ফল প্রদান করে তখন মনের মধ্যে যেন একটি অব্যক্ত গীতধ্বনি গুঞ্জরিত হইতে থাকে। যাঁহারা বৈষ্ণব পদাবলী পাঠ করিয়াছেন, অন্যান্য কবিতা হইতে গানের কবিতার স্বাতন্ত্র্য তাঁহাদিগকে বুঝাইয়া দিতে হইবে না।
আমরা সামান্য কথাবার্তার মধ্যেও যখন সৌন্দর্যের অথবা অনুভবের আবেগ প্রকাশ করিতে চাহি তখন স্বতই আমাদের কথার সঙ্গে সুরের ভঙ্গি মিলিয়া যায়। সেইজন্য কবিতায় যখন বিশুদ্ধ সৌন্দর্যমোহ অথবা ভাবের উচ্ছ্বাস ব্যক্ত হয় তখন কথা তাহার চিরসঙ্গী সংগীতের জন্য একটা আকাঙক্ষা প্রকাশ করিতে থাকে।–
এসো এসো বঁধু এসো, আধো আঁচরে বসো,
নয়ন ভরিয়া তোমায় দেখি!
এই পদটিতে যে গভীর প্রীতি এবং একান্ত আত্মসমর্পণ প্রকাশ পাইয়াছে তাহা কি কথার দ্বারা হইয়াছে? না, আমরা মনের ভিতর হইতে একটা কল্পিত করুণ সুর সংযোগ করিয়া উহাকে সম্পূর্ণ করিয়া তুলিয়াছি? ঐ দুটি ছত্রের মধ্যে যে-কটি কথা আছে তাহার মতো এমন সামান্য এমন সরল এমন পুরাতন কথা আর কী হইতে পারে ? কিন্তু উহার ঐ অত্যন্ত সরলতাই শ্রোতাদের কল্পনার নিকটহইতে সুর ভিক্ষা করিয়া লইতেছে। এইজন্য ঐ কবিতার সুর না থাকিলেও উহা গান। এইজন্যেই–
হরষে বরষ পরে যখন ফিরি রে ঘরে,
সে কে রে আমারি তরে আশা ক’রে রহে বলো;
স্বজন সুহৃদ সবে উজল নয়ন যবে,
কার প্রিয় আঁখি দুটি সব চেয়ে সমুজ্জ্বল!
ইহা কানাড়ায় গীত হইলেও গান নহে, এবং–
চাহি অতৃপ্ত নয়নে তোর মুখপানে
ফিরিতে চাহে না আঁখি;
আমি আপনা হারাই, সব ভুলে যাই
অবাক হইয়ে থাকি!
ইহাতে কোনো রাগিণীর নির্দেশ না থাকিলে ইহা গান।
সর্বশেষে আমরা আর্যগাথা হইতে একটি বাৎসল্য রসের গান উদ্ধৃত করিয়া দিতেছি। ইহাতে পাঠকগণ স্নেহের সহিত কৌতুকের সংমিশ্রণ দেখিতে পাইবেন।
একি রে তার ছেলেখেলা বকি তায় কি সাধে–
যা দেখবে বলবে, “ওমা, এনে দে, ওমা, দে।’
“নেব নেব’ সদাই কি এ?
পেলে পরে ফেলে দিয়ে
কাঁদতে গিয়ে হেসে ফেলে, হাসতে গিয়ে কাঁদে
এত খেলার জিনিস ছেড়ে,
বলে কি না দিতে পেড়ে —
অসম্ভব যা– তারায় মেঘে বিজলিরে চাঁদে!
শুনল কারো হবে বিয়ে,
ধরলো ধুয়ো অমনি গিয়ে
“ও মা, আমি বিয়ে করব’ — কান্নার ওস্তাদ এ!
শোনো কারো হবে ফাঁসি
অমনি আঁচল ধরল আসি–
“ও মা, আমি ফাঁসি যাব’– বিনি অপরাধে!
আষাঢ়ে
লেখক তাঁহার নাম প্রকাশ করেন নাই। সুতরাং আমরাও তাঁহার নাম উল্লেখ করিতে পারিলাম না। কিন্তু ইহা নিশ্চয়, বাংলা-পাঠকসমাজে তাঁহার নাম গোপন থাকিবে না।
“আষাঢ়ে’ কতকগুলি হাস্যরসপ্রধান কবিতা। তাহার অনেকগুলিই গল্প-আকারে রচিত। গল্পগুলিকে “আষাঢ়ে’ আখ্যা দিয়া গ্রন্থকার পাঠকদিগকে পূর্ব হইতেই প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছেন। কারণ, আমরা বাঙালি পাঠকেরা অত্যন্ত গম্ভীর প্রকৃতির লোক। বেরসিক বর যেমন বাসরঘরের অপ্রত্যাশিত রসিকতায় খাপা হইয়া উঠে আমরাও তেমনি ছাপার বই খুলিয়া হঠাৎ আদ্যোপান্ত কৌতুক দেখিতে পাইলে ছিব্লামি সহ্য করিতে পারি না।