আমরা ব্রহ্মকে কখন চাই? একদিন যখন উপলব্ধি করি আমাদের প্রবৃত্তি আমাদের বাসনা মুহূর্তে মুহূর্তে অসৎ সংসারের ধূলিকর্দম আহরণ করিয়া আমাদের আলোকের পথ অবরুদ্ধ করিয়াছে; আমরা সেই নিবিড় মোহান্ধকারে মণি বলিয়া যাহা সংগ্রহ করিতেছি তাহা মুষ্টির মধ্যে ধূলি হইয়া যাইতেছে, সুখ বলিয়া যাহা আলিঙ্গন করিতেছি তাহা সহস্রশিখা জ্বালারূপে আপাদমস্তক দগ্ধ করিতেছে, জল বলিয়া যাহা পান করিতেছি তাহা তৃষাহুতাশনে আহুতি-স্বরূপে বর্ষিত হইতেছে; তখন পাপের বিভীষিকায় ভয়াতুর হইয়া যাঁহাকে ডাকিয়া বলি “তমসো মা জ্যোতির্গময়’ তিনি কি আমাদেরই মতো বাসনা-প্রবৃত্তির দ্বারা জড়িত সুখদুঃখপীড়িত পুরাণকল্পিত তমসাচ্ছন্ন দেবতা?
আমরা ব্রহ্মকে কখন চাই? যখন আমাদের আত্মা ব্রহ্মবাদিনী মৈত্রেয়ীর ন্যায় সমস্ত সংসারকে এক পার্শ্বে সরাইয়া দিয়া বলিয়া উঠে, যেনাহং নামৃতা স্যাম্ কিমহং তেন কুর্যাম্, যাহার দ্বারা আমি অমর না হইব তাহা লইয়া আমি কী করিব? আমরা সংসারের যত সুখ যত ঐশ্বর্য তাহার নিকট আহরণ করি সে বলিতে থাকে, এ তো আমার মৃত্যুর উপকরণ! সে আপন ক্ষুধার অন্ন পিপাসার জল চাহিয়া উচ্চকণ্ঠে ডাকিয়া উঠে। মৃত্যোর্মামৃতং গময়, মৃত্যু হইতে আমাকে অমৃতে লইয়া যাও। মৃত্যুপীড়িত আত্মার সেই অমৃতস্বরূপ কে? —
সত্য জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি।
সত্যস্বরূপ জ্ঞানস্বরূপ অনন্তস্বরূপ ব্রহ্ম, যিনি আনন্দরূপে অমৃতরূপে প্রকাশ পাইতেছেন।
অতএব, যখন আমরা যথার্থরূপে তাহাকে চাই তখন ব্রহ্ম বলিয়াই তাঁহাকে চাই। তিনি যদি সত্যস্বরূপ জ্ঞানস্বরূপ অনন্তস্বরূপ না হইতেন তবে এই অসৎ সংসার, এই অন্ধকার হৃদয়, এই মৃত্যুবীজসংকুল সুখসম্পদের মধ্যে থাকিয়া তাঁহাকে চাহিতাম না। কেন তবে আমরা তর্ক করিয়া থাকি যে, আমরা অপূর্ণ জীব এবং তিনি সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম, অতএব তাঁহাকে আমরা পাইতেই পারি না। এবং সেইজন্য অসত্য অজ্ঞান এবং অন্ধবিশিষ্ট আমরা আকারকে কেন তাঁহার স্থানে আরোপ করি? আমরা অপূর্ণ বলিয়াই সেই পূর্ণস্বরূপকে আমাদের একান্তই চাই, আমরা অপূর্ণ বলিয়াই সেই সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্মই আমাদের একমাত্র আনন্দ– একমাত্র মুক্তি। আমরা অপূর্ণ বলিয়াই আমরা অপূর্ণের পূজা করিব না; অপূর্ণের উপরে আমাদের অমর আত্মার, আমাদের অনন্ত জীবনের প্রতিষ্ঠা স্থাপন করিব না; আমরা এই অসৎ, এই অন্ধকার, এই মর্তবিষয়পুঞ্জের মধ্যস্থলে “শান্তোদান্ত উপরতস্তিতিক্ষুঃ সমাহিতোভূত্বা’ সাধনা করিতে থাকিব যতদিন না বলিতে পারি–
বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তং আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।
মাঘ ১৩০৫
পরিশিষ্ট – শোকসভা
বঙ্কিমের মৃত্যু উপলক্ষে শোকপ্রকাশ করিবার জন্য যাঁহারা সাধারণ সভা আহ্বানের চেষ্টা করিয়াছেন, শুনা যায়, তাঁহারা একটি গুরুতর বাধা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন; সে বাঁধা সর্বাপেক্ষা বিস্ময়জনক এবং তাহা পূর্বে প্রত্যাশা করা যায় নাই।
যাঁহারা বঙ্কিমের বন্ধুত্ব সম্পর্কে আপনাদিগকে গৌরবান্বিত জ্ঞান করেন এমন অনেক খ্যাতনামা লোক সভাস্থলে শোকপ্রকাশ করা কৃত্রিম আড়ম্বর বলিয়া তাহাতে যোগদান করিতে অসম্মত হইয়াছেন এবং সভার উদ্যোগিগণকে ভৎর্সনা করিতেও ক্ষান্ত হন নাই। এরূপ বিয়োগ উপলক্ষে আপন অন্তরের আবেগ প্রকাশ্যে ব্যক্ত করাকে বোধ করি তাঁহারা পবিত্র শোকের অবমাননা বলিয়া জ্ঞান করেন।
বিশেষত আমাদের দেশে কখনো এমন প্রথা প্রচলিত ছিল না,সুতরাং শোকের দিনে একটা অনাবশ্যক বিদেশী আড়ম্বরে মাতিয়া ওঠা কিছু অশোভন এবং অসময়োচিত বলিয়া মনে হইতে পারে।
যখন আমাদের দেশের অনেক শ্রদ্ধেয় লোকের এইরূপ মত দেখা যাইতেছে তখন এ সম্বন্ধে আলোচনা আবশ্যক হইয়াছে।
সাধারণের হিতৈষী কোনো মহৎ ব্যক্তির মৃত্যু হইলে সাধারণ সভায় তাঁহার গুণের আলোচনা করিয়া তাঁহার নিকটে কৃতজ্ঞতা স্বীকারপূর্বক শোকপ্রকাশ করার মধ্যে ভালোমন্দ আর যাহাই থাক্, তাহা যে য়ুরোপীয়তা-নামক মহদ্দোষে দুষ্ট সে কথা স্বীকার করিতেই হইবে। কিন্তু সেইসঙ্গে এ কথাও ভাবিয়া দেখিতে হইবে যে, য়ুরোপীয়দের সংসর্গবশতই হউক বা অন্যান্য নানা কারণে ইচ্ছাক্রমে ও অনিচ্ছাক্রমে আমাদের বাহ্য অবস্থা এবং মনের ভাবের কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটিতেছে; কেবল রাগ করিয়া অস্বীকার করিয়া বিরক্ত হইয়া তাহাকে লোপ করা যায় না। নূতন আবশ্যকের জন্য নূতন উপায়গুলি অনভ্যাসবশত প্রথম-প্রথম যদি বা কাহারো চক্ষে অপরিচিত অপ্রিয় বলিয়া বোধ হয় তথাপি বিবেচক ব্যক্তি ভালোরূপ বিচার না করিয়া তাহার নিন্দা করেন না।
সহৃদয় লোকের নিকট কৃত্রিমতা অতিশয় অসহ্য হইয়া থাকে এ কথা সর্বজনবিদিত। কিন্তু কৃত্রিমতার অনেক প্রকারভেদ আছে। একপ্রকার কৃত্রিমতা ভিত্তিস্বরূপে সমাজকে ধারণ করিয়া রাখে, আর-একপ্রকার কৃত্রিমতা কীটের স্বরূপে সমাজকে জীর্ণ করিয়া ফেলে।
সমাজের প্রতি আমাদের যে-সকল কর্তব্য আছে তাহা পালন করিতে গেলেই কথঞ্চিৎ কৃত্রিমতা অবলম্বন করিতে হইবে। কারণ প্রত্যেকেই যদি নিজের রুচি ও হৃদয়াবেগের পরিমাণ অনুসারে স্বরচিত নিয়মে সামাজিক কর্তব্য পালন করে তবে আর উচ্ছৃঙ্খলতার সীমা থাকে না। সে স্থলে সর্বজনসম্মত একটা বাঁধা নিয়ম আশ্রয় করিতে হয়। যেমন সৃষ্টিকর্তা এই পৃথিবীকে কেবল বিশুদ্ধ ভাবরূপে রাখিয়া দেন নাই কিন্তু ভাবকে ভূরিপরিমাণ ধূলিরাশি দ্বারা ব্যক্ত করিয়াছেন, তেমনি, যাহা-কিছু কেবলমাত্র একাকীর নহে, যাহাকেই সর্বসাধারণের সেব্য এবং যোগ্য করিতে হইবে, তাহাকেই অনেকটা জড় কৃত্রিমতার দ্বারা দৃঢ় আকারবদ্ধ করিয়া লইতে হইবে। অরণ্যের অকৃত্রিম সৌন্দর্য সহৃদয় কবিগণ যতই ভালো বলুন, কৃত্রিম ইষ্টককাষ্ঠরচিত মহানগর লোকসমাজের বাসের পক্ষে যে তদপেক্ষা অনেকাংশে উপযোগী তাহা অস্বীকার করিবার কারণ দেখি না। তরুর প্রত্যেক অংশ সজীব এবং স্বতোবর্ধিত, তাহার শোভা হৃদয়তৃপ্তিকর, তথাপি মনুষ্য আপন সনাতন পূর্বপুরুষ শাখামৃগের প্রতি ঈর্ষা প্রকাশ না করিয়া স্বহস্তরচিত অট্টালিকায় আশ্রয়গ্রহণপূর্বক যথার্থ মনুষ্যত্ব প্রকাশ করিয়াছে।