গোস্বামী মহাশয় আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, আমি যেখানে নূতন নূতন যাত্রা-কথকতা প্রভৃতি রচনার প্রস্তাব করিয়াছি সে স্থলে “নূতন’ কথাটার তাৎপর্য কী। পুরাতনই যথেষ্ট নহে কেন।
রামায়ণের কবি রামচন্দ্রের পিতৃভক্তি, সত্যপালন, সৌভ্রাত্র, দাম্পত্যপ্রেম, ভক্তবাৎসল্য প্রভৃতি অনেক গুণগান করিয়া যুদ্ধকাণ্ড পর্যন্ত ছয় কাণ্ড মহাকাব্য শেষ করিলেন; কিন্তু তবু নূতন করিয়া উত্তরকাণ্ড রচনা করিতে হইল। তাঁহার ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক গুণই যথেষ্ট হইল না, সর্বসাধারণের প্রতি তাঁহার কর্তব্যনিষ্ঠা অত্যন্ত কঠিনভাবে তাঁহার পূর্ববর্তী সমস্ত গুণের উপরে প্রতিষ্ঠিত হইয়া তাঁহার চরিতগানকে মুকুটিত করিয়া তুলিল।
আমাদের যাত্রা-কথকতার অনেক শিক্ষা আছে, সে শিক্ষা আমরা ত্যাগ করিতে চাই না, কিন্তু তাহার উপরে নূতন করিয়া আরো-একটি কর্তব্য শিক্ষা দিতে হইবে। দেবতা সাধু পিতা গুরু ভাই ভৃত্যের প্রতি আমাদের কী কর্তব্য, তাঁহাদের জন্য কতদূর ত্যাগ করা যায়, তাহা শিখিব; সেইসঙ্গে সাধারণের প্রতি, দেশের প্রতি আমাদের কী কর্তব্য তাহাও নূতন করিয়া আমাদিগকে গান করিতে হইবে– ইহাতে কি কোনো পক্ষের বিশেষ শঙ্কার কারণ কিছু আছে?
একটা প্রশ্ন উঠিয়াছে, সমুদ্রযাত্রার আমি সমর্থন করি কি না, যদি করি তবে হিন্দুধর্মানুগত আচারপালনের বিধি রাখিতে হইবে কি না।
এ সম্বন্ধে কথা এই, পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া পৃথিবীর পরিচয় হইতে বিমুখ হওয়াকে আমি ধর্ম বলি না। কিন্তু বর্তমান প্রসঙ্গে এ-সমস্ত কথাকে অত্যন্ত প্রাধান্য দেওয়া আমি অনাবশ্যক জ্ঞান করি। কারণ, আমি এ কথা বলিতেছি না যে, আমার মতেই সমাজগঠন করিতে হইবে। আমি বলিতেছি, আত্মরক্ষার জন্য সমাজকে জাগ্রত হইতে হইবে, কর্তৃত্ব গ্রহণ করিতে হইবে। সমাজ যে-কোনো উপায়ে সেই কর্তৃত্ব লাভ করিলেই আপনার সমস্ত সমস্যার মীমাংসা আপনি করিবে। তাহার সেই স্বকৃত মীমাংসা কখন কিরূপ হইবে আমি তাহা গণনা করিয়া বলিতে পারি না। অতএব প্রসঙ্গক্রমে আমি দু-চারিটি কথা যাহা বলিয়াছি অতিশয় সূক্ষ্ণভাবে তাহার বিচার করিতে বসা মিথ্যা। আমি যদি সুপ্ত জহুরিকে ডাকিয়া বলি “ভাই, তোমার হীরামুক্তার দোকান সামলাও’ তখন কি সে এই কথা লইয়া আলোচনা করিবে যে, কঙ্কণ-রচনার গঠন সম্বন্ধে তাহার সঙ্গে আমার মতভেদ আছে, অতএব আমার কথা কর্ণপাতের যোগ্য নহে। তোমার কঙ্কণ তুমি যেমন খুশি গড়িয়ো, তাহা লইয়া তোমাতে আমাতে হয়তো চিরদিন বাদপ্রতিবাদ চলিবে, কিন্তু আপাতত চোখ জল দিয়া ধৌত করো, তোমার হীরামুক্তার পসরা সামলাও– দস্যুর সাড়া পাওয়া গেছে এবং তুমি যখন অসাড় অচেতন হইয়া দ্বার জুড়িয়া পড়িয়া আছ তখন তোমার প্রাচীন ভিত্তির প”রে সিঁধেলের সিঁধকাঠি এক মুহূর্ত বিশ্রাম করিতেছে না।
আশ্বিন ১৩১১
য়ুনিভার্সিটি বিল
এতকাল ধরিয়া য়ুনিভার্সিটি বিলের বিধিবিধান লইয়া তন্ন তন্ন করিয়া অনেক আলোচনাই হইয়া গেছে, সেগুলির পুনরুক্তি বিরক্তিকর হইবে। মোটামুটি দুই-একটা কথা বলিতে চাই।
টাকা থাকিলে, ক্ষমতা থাকিলে, সমস্ত অবস্থা অনুকূল হইলে, বন্দোবস্তর চূড়ান্ত করা যাইতে পারে সে কথা সকলেই জানে। কিন্তু অবস্থার প্রতি তাকাইয়া দুরাশাকে খর্ব করিতে হয়। লর্ড কর্জন ঠিক বলিয়াছেন, বিলাতি বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ খুব ভালো– কিন্তু ভারতবন্ধু লাটসাহেব তো বিলাতের সব ভালো আমাদিগকে দিবার কোনো বন্দোবস্ত করেন নাই, মাঝে হইতে কেবল একটা ভালোই মানাইবে কেন?
প্রত্যেকের সাধ্যমত যে ভালো সে-ই তাহার সর্বোত্তম ভালো, তাহার চেয়ে ভালো আর হইতে পারে না– অন্যের ভালোর প্রতি লোভ করা বৃথা।
বিলাতি য়ুনিভার্সিটিগুলাও একেবারেই আকাশ হইতে পড়িয়া অথবা কোনো জবরদস্ত শাসনকর্তার আইনের জোরে এক রাত্রে পূর্ণপরিণত হইয়া উঠে নাই। তাহার একটা ইতিহাস আছে। দেশের অবস্থা এবং ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে তাহারা স্বভাবত বাড়িয়া উঠিয়াছে। ইহার প্রতিবাদে বলা যাইতে পারে, আমাদের য়ুনিভার্সিটি গোড়াতেই বিদেশের নকল– স্বাভাবিক নিয়মের কথা ইহার সম্বন্ধে খাটিতে পারে না।
সে কথা ঠিক। ভারতবর্ষের য়ুনিভার্সিটি দেশের প্রকৃতির সঙ্গে যে মিশিয়া গেছে, আমাদের সমাজের সঙ্গে সম্পূর্ণ একাঙ্গ হইয়া গেছে, তাহা বলিতে পারি না– এখনো ইহা আমাদের বাহিরে রহিয়াছে।
কিন্তু ইহাকে আমরা ক্রমশ আয়ত্ত করিয়া লইতেছি– আমাদের স্বদেশীদের পরিচালিত কলেজগুলিই তাহার প্রমাণ।
ইংরেজের কাছ হইতে আমরা কী পাইয়াছি, তাহা দেখিতে হইলে কেবল দেশে কী আছে তাহা দেখিলে চলিবে না, দেশের লোকের হাতে কী আছে তাহাই দেখিতে হইবে।
রেলওয়ে টেলিগ্রাফ অনেক দেখিতেছি, কিন্তু তাহা আমাদের নহে; বাণিজ্য ব্যবসায়ও কম নহে, কিন্তু তাহারও যৎসামান্য আমাদের। রাজ্যশাসনপ্রণালী জটিল ও বিস্তৃত, কিন্তু তাহার যথার্থ কর্তৃত্বভার আমাদের নাই বলিলেই হয়; তাহার মজুরের কার্যই আমরা করিতেছি, তাহাও উত্তরোত্তর সংকুচিত হইয়া আসিবার লক্ষণ দেখা যাইতেছে।
যে জিনিস যথার্থ আমাদের তাহা কম ভালো হইলেও, তাহার ত্রুটি থাকিলেও, তাহা ভাণ্ডারকর-মহাশয়ের সম্পূর্ণ মনোনীত না হইলেও, তাহাকেই আমরা লাভ বলিয়া গণ্য করিব।
যে বিদ্যা পুঁথিগত, যাহার প্রয়োগ জানা নাই, তাহা যেমন পণ্ড, তেমনি যে শিক্ষাদানপ্রণালী আমাদের আয়ত্তের অতীত তাহাও আমাদের পক্ষে প্রায় তেমনি নিষ্ফল। দেশের বিদ্যাশিক্ষাদান দেশের লোকের হাতে আসিতেছিল, বস্তুত ইহাই বিদ্যাশিক্ষার ফল। সেও যদি সম্পূর্ণ গবর্মেন্টের হাতে গিয়া পড়ে, তবে খুব ভালো য়ুনিভার্সিটিও আমাদের পক্ষে দারিদ্র্যের লক্ষণ।