আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে এই কারখানাঘরের ধূমধূলিপূর্ণ বায়ু দেশীয় রাজ্যব্যবস্থার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে– সহজকে অকারণে জটিল করিয়া তুলিয়াছে, বাসস্থানকে নির্বাসন করিয়া দাঁড় করাইয়াছে। যাঁহারা ইংরেজের হাতে মানুষ হইয়াছেন তাঁহারা মনেই করিতে পারেন না যে, ইংরেজের সামগ্রীকে যদি লইতেই হয় তবে তাহাকে আপন করিতে না পারিলে তাহাতে অনিষ্টই ঘটে — এবং আপন করিবার একমাত্র উপায় তাহাকে নিজের প্রকৃতির অনুকূলে পরিণত করিয়া তোলা, তাহাকে যথাযথ না রাখা। খাদ্য যদি খাদ্যরূপেই বরাবর থাকিয়া যায় তবে তাহাতে পুষ্টি দূরে থাক, ব্যাধি ঘটে। বিলাতি সামগ্রী যখন আমাদের ভারতপ্রকৃতির দ্বারা জীর্ণ হইয়া তাহার আত্মরূপ ত্যাগ করিয়া আমাদের কলেবরের সহিত একাত্ম হইয়া যায় তখনই তাহা আমাদের লাভের বিষয় হইতে পারে– যতক্ষণ তাহার উৎকট বিদেশীয়ত্ব অবিকৃত থাকে ততক্ষণ তাহা লাভ নহে। বিলাতি সরস্বতীর পোষ্যপুত্রগণ এ কথা কোনোমতেই বুঝিতে পারেন না। পুষ্টিসাধনের দিকে তাঁহাদের দৃষ্টি নাই, বোঝাই করাকেই তাঁহারা পরমার্থ জ্ঞান করেন। এইজন্যই আমাদের দেশীয় রাজ্যগুলিও বিদেশী কার্যবিধির অসংগত অনাবশ্যক বিপুল জঞ্জাল জালে নিজের শক্তিকে অকারণে ক্লিষ্ট করিয়া তুলিতেছে। বিদেশী বোঝাকে যদি অনায়াসে গ্রহণ করিতে পারিতাম, যদি তাহাকে বোঝার মতো না দেখিতে হইত, রাজ্য যদি একটা আপিসমাত্র হইয়া উঠিবার চেষ্টায় প্রতিমুহূর্তে ঘর্মাক্তকলেবর হইয়া না উঠিত, যাহা সজীব হৃৎপিণ্ডের নাড়ির সহিত সম্বন্ধযুক্ত ছিল তাহাকে যদি কলের পাইপের সহিত সংযুক্ত করা না হইত, তাহা হইলে আপত্তি করিবার কিছু ছিল না। আমাদের দেশের রাজ্য কেরানিচালিত বিপুল কারখানা নহে, নির্ভুল নির্বিকার এঞ্জিন নহে– তাহার বিচিত্র সম্বন্ধসূত্রগুলি লৌহদণ্ড নহে, তাহা হৃদয়তন্তু — রাজলক্ষ্মী প্রতিমুহূর্তে তাহার কর্মের শুষ্কতার মধ্যে রসসঞ্চার করেন, কঠিনকে কোমল করেন, তুচ্ছকে সৌন্দর্যে মণ্ডিত করিয়া দেন, দেনাপাওনার ব্যাপারকে কল্যাণের কান্তিতে উজ্জ্বল করিয়া তোলেন এবং ভুলত্রুটিকে ক্ষমার অশ্রুজলে মার্জনা করিয়া থাকেন। আমাদের মন্দভাগ্য আমাদের দেশীয় রাজ্যগুলিকে বিদেশী আপিসের ছাঁচের মধ্যে ঢালিয়া তাহাদিগকে কলরূপে বানাইয়া না তোলে, এই-সকল স্থানেই আমরা স্বদেশলক্ষ্মীর স্তন্যসিক্ত স্নিগ্ধ বক্ষঃস্থলের সজীব কোমল মাতৃস্পর্শ লাভ করিয়া যাইতে পারি– এই আমাদের কামনা। মা যেন এখানেও কেবল কতকগুলো ছাপমারা লেফাফার মধ্যে আচ্ছন্ন হইয়া না থাকেন– দেশের ভাষা, দেশের সাহিত্য, দেশের শিল্প, দেশের রুচি, দেশের কান্তি এখানে যেন মাতৃকক্ষে আশ্রয়লাভ করে এবং দেশের শক্তি মেঘমুক্ত পূর্ণচন্দ্রের মতো আপনাকে অতি সহজে অতি সুন্দরভাবে প্রকাশ করিতে পারে।
শ্রাবণ ১৩১২
নেশন কী
নেশন ব্যাপারটা কী, সুপ্রসিদ্ধ ফরাসী ভাবুক রেনাঁ এই প্রশ্নের আলোচনা করিয়াছেন। কিন্তু এ সম্বন্ধে তাঁহার মত ব্যাখ্যা করিতে হইলে, প্রথমে দুই একটা শব্দার্থ করিয়া লইতে হইবে।
স্বীকার করিতে হইবে, বাংলায় “নেশন’ কথার প্রতিশব্দ নাই। চলিত ভাষায় সাধারণত জাতি বলিতে বর্ণ বুঝায় এবং জাতি বলিতে ইংরাজিতে-যাহাকে ক্ষতদনবলে তাহাও বুঝাইয়া থাকে। আমরা “জাতি’ শব্দ ইংরাজি “রেস ‘শব্দের প্রতিশব্দরূপেই ব্যবহার করিব, এবং নেশনকে নেশনই বলিব। নেশন ও ন্যাশনাল শব্দ বাংলায় চলিয়া গেলে অনেক অর্থদ্বৈধ-ভাবদ্বৈধের হাত এড়ানো যায়।
“ন্যাশনাল কনগ্রেস’ শব্দের তর্জমা করিতে আমরা “জাতীয় মহাসভা’ ব্যবহার করিয়া থাকি– কিন্তু “জাতীয়’ বলিলে বাঙালি-জাতীয়, মারাঠি-জাতীয়, শিখ-জাতীয়, যে-কোনো জাতীয় বুঝাইতে পারে– ভারতবর্ষের সর্বজাতীয় বুঝায় না। মাদ্রাজ ও বম্বাই “ন্যাশনাল’ শব্দের অনুবাদ-চেষ্টায় “জাতি’ শব্দ ব্যবহার করেন নাই। তাঁহারা স্থানীয় ন্যাশনাল সভাকে মহাজনসভা ও সার্বজনিক সভা নাম দিয়াছেন– বাঙালি কোনোপ্রকার চেষ্টা না করিয়া “ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ নাম দিয়া নিষ্কৃতিলাভ করিয়াছে। ইহাতে মারাঠি প্রভৃতি জাতির সহিত বাঙালির যেন একটা প্রভেদ লক্ষিত হয়– সেই প্রভেদে বাঙালির আন্তরিক ন্যাশনালত্বের দুর্বলতাই প্রমাণ করে।
“মহাজন’ শব্দ বাংলায় একমাত্র অর্থে ব্যবহৃত হয়, অন্য অর্থে চলিবে না। “সার্বজনিক’ শব্দকে বিশেষ্য আকারে নেশন শব্দের প্রতিশব্দ করা যায় না। “ফরাসি সর্বজন’ শব্দ “ফরাসি নেশন’ শব্দের পরিবর্তে সংগত শুনিতে হয় না।
“মহাজন’ শব্দ ত্যাগ করিয়া “মহাজাতি’ শব্দ গ্রহণ করা যাইতে পারে। কিন্তু “মহৎ’ শব্দ মহত্ত্বসূচক বিশেষণরূপে অনেকস্থলেই নেশন শব্দের পূর্বে আবশ্যক হইতে পারে। সেরূপ স্থলে “গ্রেট নেশন’ বলিতে গেলে “মহতী মহাজাতি’ বলিতে হয় এবং তাহার বিপরীত বুঝাইবার প্রয়োজন হইলে “ক্ষুদ্র মহাজাতি’ বলিয়া হাস্যভাজন হইবার সম্ভাবনা আছে।
কিন্তু নেশন শব্দটা অবিকৃত আকারে গ্রহণ করিতে আমি কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করি না। ভাবটা আমরা ইংরেজের কাছ হইতে পাইয়াছি, ভাষাটাও ইংরেজি রাখিয়া ঋণ স্বীকার করিতে প্রস্তুত আছি। উপনিষদের ব্রহ্ম, শংকরের মায়া ও বুদ্ধের নির্বাণ শব্দ ইংরেজি রচনায় প্রায় ভাষান্তরিত হয় না, এবং না হওয়াই উচিত।