- বইয়ের নামঃ আত্মশক্তি
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
অবস্থা ও ব্যবস্থা
আজ বাংলাদেশে উত্তেজনার অভাব নাই, সুতরাং উত্তেজনার ভার কাহাকেও লইতে হইবে না। উপদেশেরও যে বিশেষ প্রয়োজন আছে তাহা আমি মনে করি না। বসন্তকালের ঝড়ে যখন রাশি রাশি আমের বোল ঝরিয়া পড়ে তখন সে বোলগুলি কেবলই মাটি হয়, তাহা হইতে গাছ বাহির হইবার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। তেমনি দেখা গেছে, সংসারে উপদেশের বোল অজস্র বৃষ্টি হয় বটে, কিন্তু অনেক স্থলেই তাহা হইতে অঙ্কুর বাহির হয় না, সমস্ত মাটি হইতে থাকে।
তবু ইহা নিঃসন্দেহ যে, যখন বোল ঝরিতে আরম্ভ করে তখন বুঝিতে হইবে ফল ফলিবার সময় সুদূরে নাই। আমাদের দেশেও কিছুদিন হইতে বলা হইতেছিল যে, নিজের দেশের অভাবমোচন দেশের লোকের চেষ্টার দ্বারাই সম্ভবপর, দেশের লোকই দেশের চরম অবলম্বন, বিদেশী কদাচ নহে, ইত্যাদি। নানা মুখ হইতে এই-যে বোলগুলি ঝরিতে আরম্ভ হইয়াছিল তাহা উপস্থিতমত মাটি হইতেছিল সন্দেহ নাই, কিন্তু ভূমিকে নিশ্চয়ই উর্বরা করিতেছিল এবং একটা সফলতার সময় যে আসিতেছে তাহারও সূচনা করিয়াছিল।
অবশেষে আজ বিধাতা তীব্র উত্তাপে একটি উপদেশ স্বয়ং পাকাইয়া তুলিয়াছেন। দেশ গতকল্য যে-সকল কথা কর্ণপাত করিবার যোগ্য বলিয়া বিবেচনা করে নাই আজ তাহা অতি অনায়াসেই চিরন্তন সত্যের ন্যায় গ্রহণ করিতেছে। নিজেরা যে এক হইতে হইবে, পরের দ্বারস্থ হইবার জন্য নহে, নিজেদের কাজ করিবার জন্য, এ কথা আজ আমরা একদিনেই অতি সহজেই যেন অনুভব করিতেছি– বিধাতার বাণীকে অগ্রাহ্য করিবার জো নাই।
অতএব, আমার মুখে আজ উত্তেজনা ও উপদেশ অনাবশ্যক হইয়াছে– ইতিহাসকে যিনি অমোঘ ইঙ্গিতের দ্বারা চালনা করেন তাঁহার অগ্নিময় তর্জনী আজ দেশের সকলের চক্ষের সম্মুখে প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিয়াছে।
এখন এই সময়টাকে বৃথা নষ্ট হইতে দিতে পারি না। কপালক্রমে অনেক ধোঁওয়ার পরে ভিজা কাঠ যদি ধরিয়া থাকে, তবে তাহা পুড়িয়া ছাই হওয়ার পূর্বে রান্না চড়াইতে হইবে; শুধু শুধু শূন্য চুলায় আগুনে খোঁচার উপর খোঁচা দিতে থাকিলে আমোদ হইতে পারে, কিন্তু তাহাতে ছাই হওয়ার কালটাও নিকটে অগ্রসর হয় এবং অন্নের আশা সুদূরবর্তী হইতে থাকে। বঙ্গব্যবচ্ছেদের প্রস্তাবে যখন সমস্ত দেশের লোকের ভাবনাকে একসঙ্গে জাগাইয়া তুলিয়াছে তখন কেবলমাত্র সাময়িক উত্তেজনায় আত্মবিস্মৃত না হইয়া কতকগুলি গোড়াকার কথা স্পষ্টরূপে ভাবিয়া লইতে হইবে।
প্রথম কথা এই যে, আমরা স্বদেশের হিতসাধন সম্বন্ধে নিজের কাছে যে-সকল আশা করি না পরের কাছ হইতে সে-সকল আশা করিতেছিলাম। এমন অবস্থায় নিরাশ হওয়াই স্বাভাবিক এবং তাহাই মঙ্গলকর। নিরাশ হইবার মতো আঘাত বারবার পাইয়াছি, কিন্তু চেতনা হয় নাই। এবারে ঈশ্বরের প্রসাদে আর-একটা আঘাত পাইয়াছি, চেতনা হইয়াছে কি না তাহার প্রমাণ পরে পাওয়া যাইবে।
“আমাদিগকে তোমরা সম্মান দাও, তোমরা শক্তি দাও, তোমরা নিজের সমান অধিকার দাও’– এই-যে সকল দাবি আমরা বিদেশী রাজার কাছে নিঃসংকোচে উপস্থিত করিয়াছি ইহার মূলে একটা বিশ্বাস আমাদের মনে ছিল। আমরা কেতাব পড়িয়া নিশ্চয় স্থির করিয়াছিলাম যে, মানুষমাত্রেরই অধিকার সমান এই সাম্যনীতি আমাদের রাজার জাতির।
কিন্তু সাম্যনীতি সেইখানেই খাটে যেখানে সাম্য আছে। যেখানে আমারও শক্তি আছে তোমার শক্তি সেখানে সাম্যনীতি অবলম্বন করে। য়ুরোপীয়ের প্রতি য়ুরোপীয়ের মনোহর সাম্যনীতি দেখিতে পাই; তাহা দেখিয়া আশান্বিত হইয়া উঠা অক্ষমের লুব্ধতামাত্র। অশক্তের প্রতি শক্ত যদি সাম্যনীতি অবলম্বন করে তবে সেই প্রশ্রয় কি অশক্তের পক্ষে কোনোমতে শ্রেয়স্কর হইতে পারে? সে প্রশ্রয় কি অশক্তের পক্ষে সম্মানকর? অতএব, সাম্যের দরবার করিবার পূর্বে সাম্যের চেষ্টা করাই মনুষ্যমাত্রের কর্তব্য। তাহার অন্যথা করা কাপুরুষতা।
ইহা আমরা স্পষ্ট দেখিয়াছি, যে-সকল জাতি ইংরেজের সঙ্গে বর্ণে ধর্মে প্রথায় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র তাহাদিগকে ইঁহারা নিজের পার্শ্বে স্বচ্ছন্দবিহারের স্থান দিয়াছেন এমন ইঁহাদের ইতিহাসে কোথাও নাই। এমন-কি, তাহারা ইঁহাদের সংঘর্ষে লোপ পাইয়াছে ও পাইতেছে এমন প্রমাণ যথেষ্ট আছে। একবার চিন্তা করিয়া দেখো, ভারতবর্ষের রাজাদের যখন স্বাধীন ক্ষমতা ছিল তখন তাঁহারা বিদেশের অপরিচিত লোকমণ্ডলীকে স্বরাজ্যে বসবাসের কিরূপ স্বচ্ছন্দ অধিকার দিয়াছিলেন– তাহার প্রমাণ পার্শিজাতি। ইহারা গোহত্যা প্রভৃতি দুই-একটি বিষয়ে হিন্দুদের বিধিনিষেধ মানিয়া, নিজের ধর্ম সমাজ অক্ষুণ্ন রাখিয়া, নিজের স্বাতন্ত্র্য কোনো অংশে বিসর্জন না দিয়া, হিন্দুদের অতিথিরূপে প্রতিবেশিরূপে প্রভূত উন্নতি লাভ করিয়া আসিয়াছে, রাজা বা জনসমাজের হস্তে পরাজিত বলিয়া উৎপীড়ন সহ্য করে নাই। ইহার সহিত ইংরেজ উপনিবেশগুলির ব্যবহার তুলনা করিয়া দেখিলে পূর্বদেশের এবং পশ্চিমদেশের সাম্যবাদের প্রভেদটা আলোচনা করিবার সুযোগ হইবে।
সম্প্রতি দক্ষিণ-আফ্রিকায় বিলাতি উপনিবেশীদের একটি সভা বসিয়াছিল, তাহার বিবরণ হয়তো অনেকে স্টেট্স্ম্যান-পত্রে পড়িয়া থাকিবেন। তাঁহারা একবাক্যে সকলে স্থির করিয়াছেন যে, এশিয়ার লোকদিগকে তাঁহারা কোনোপ্রকারেই আশ্রয় দিবেন না। ব্যবসায় অথবা বাসের জন্য তাহাদিগকে ঘরভাড়া দেওয়া হইবে না, যদি কেহ দেয় তাহার প্রতি বিশেষরূপ অসন্তোষ প্রকাশ করিতে হইবে। বর্তমানে যে-সকল বাড়ি এশিয়ার লোকদিগকে ভাড়া দেওয়া হইয়াছে, মেয়াদ উত্তীর্ণ হইলেই তাহা ছাড়াইয়া লওয়া হইবে। যে-সকল হৌস ঐশিয়দিগকে কোনোপ্রকারে সাহায্য করে, খুচরা ব্যবসায়ী ও পাইকেরগণ যাহাতে তাহাদের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করে, তাহার চেষ্টা করিতে হইবে। যাহাতে এই নিয়মগুলি পালিত হয় এবং যাহাতে সভ্যগণ ঐশিয় দোকানদার বা মহাজনদের কাছ হইতে কিছু না কেনে বা তাহাদিগকে কোনোপ্রকার সাহায্য না করে, সেজন্য একটা টভফভরতশদন অড়ড়ষদভতঢ়ভষশবা চৌকিদার-দল বাঁধিতে হইবে। সভায় বক্তৃতাকালে একজন সভ্য প্রশ্ন করিয়াছিলেন যে, আমাদের শহরের মধ্যে ঐশিয় ব্যবসায়ীদিগকে যেমন করিয়া আড্ডা গাড়িতে দেওয়া হইয়াছে, এমন কি ইংলণ্ডের কোনো শহরে দেওয়া সম্ভব হইত? ইহার উত্তরে এক ব্যক্তি কহিল, না, সেখানে তাহাদিগকে “লিঞ্চ’ করা হইত। শ্রোতাদের মধ্যে একজন বলিয়াছিল, এখানেও কুলিদিগকে “লিঞ্চ’ করাই শ্রেয়।