- বইয়ের নামঃ মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত
- লেখকের নামঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত – ০২
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
যশোদার আর দিন যায় না। যজমানদিগের পৌরাহিত্য কে করে? কৈবর্ত্তেরা আর এক ঘর বামন আনিল। যশোদা অন্নকষ্টে-ধান ভানিতে আরম্ভ করিলেন।
যখন মুচিরামের বয়স দশ বৎসর, কৈবর্ত্তেরা চাঁদা করিয়া একটা বারোইয়ারি পূজা করিল। যাত্রা দিবার জন্য বারোইয়ারি; কৈবর্ত্তেরা শস্তা দরে হারাণ অধিকারীকে তিন দিনের জন্য বায়না করিয়া আনিয়া, কলাগাছের উপর সরা জ্বালিয়া, তিন রাত্রি যাত্রা শুনিল। মুচিরাম এই প্রথম যাত্রা শুনিল। যাত্রার গান, যাত্রার গল্প অনেক শুনিয়াছিল-কিন্তু একটা আস্ত-যাত্রা এই প্রথম শুনিল; চূড়া ধড়া ঠেঙ্গা লাঠি সহিত সাক্ষাৎ কৃষ্ণ এই প্রথম দেখিল। আহ্লাদে উছলিয়া উঠিল। নিশ্চিত সম্বাদ রাখি যে, পরদিন মুচিরাম, গালাগালি মারামারি বা চুরি বা মাতাকে প্রহার, এ সকলের কিছুই করে নাই।
মুচিরামের একটা গুণ ছিল, মুচিরাম সুকণ্ঠ। প্রথম দিন যাত্রা শুনিয়া, বহু যত্নে একটা গানের মোহাড়াটা শিখিয়াছিল। পরদিন হইতে মাঠে মাঠে সেই গান গাইয়া ফিরিতে লাগিল। দৈবাৎ হারাণ অধিকারী লোটা হাতে, পুষ্করিণীতে হস্তমুখপ্রক্ষালনাদির অনুরোধে যাইতেছিলেন-প্রভাতবায়ুপরিচালিত হইয়া মুচিরামের সুস্বর অধিকারী মহাশয়ের কাণের ভিতর গেল। কাণে যাইতে যাইতে মনের ভিতর গেল,-মনের ভিতর গিয়া, কল্পনার সাহায্যে টাকার সিন্দুকের ভিতরেও প্রবেশ করিল। অধিকারী মহাশয়ের নিকট গলার আওয়াজ, টাকার আওয়াজে পরিণত হয়। সে দোষে অধিকারী মহাশয় একা দোষী নহেন-জিজ্ঞাসা করিলে অনেক উকীল মহাশয়েরা ইহার কিছু নিগূঢ় তত্ত্ব বলিয়া দিতে পারিবেন। তাঁহাদের কাছেও গলার আওয়াজ টাকার আওয়াজে পরিণত হয়। উকীলবাবুদেরই বা দোষ কি-Glorious British Constitution! হায়! গলাবাজি সার!
অধিকারী মহাশয়-মানুষের সঙ্গে প্রেম করেন না-ব্রিটিষ পার্লিয়মেণ্টের মত এবঞ্চ কুরঙ্গিণীসদৃশ, মনুষ্যকণ্ঠেই মুগ্ধ-অতএব তিনি হাত নাড়িয়া মুচিরামকে ডাকিলেন। মুচিরাম আসিল। তাহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিয়া বলিলেন, “তুমি আমার যাত্রার দলে থাকিবে?”
মুচিরাম আহ্লাদে আটখানা। মাকে জিজ্ঞাসার অপেক্ষা রাখিল না-তখনই সঙ্গে যায়। কিন্তু অধিকারী মনে করিল যে, পরের ছেলে না বলিয়া লইয়া যাওয়া কিছু নয়। অতএব মুচিরামকে সঙ্গে করিয়া তাহার মার নিকট গেল।
শুনিয়া যশোদা বড় কাঁদা কাটা আরম্ভ করিল-সবে একটি ছেলে-আর কেহ নাই-কি প্রকারে ছাড়িয়া দিবে? এদিকে আবার অন্ন জুটে না-যদি একটা খাবার উপায় হইতেছে-কেমন করিয়াই বা না বলে? বিধাতা কি আর এমন সুযোগ করিযা দিবেন? আমি না দেখিতে পাই, তবু ত মুচিরাম ভাল খাইবে, ভাল থাকিবে, ভাল পরিবে। যশোদা যাত্রাওয়ালার দু:খ জানিত না। অগত্যা পাঁচ টাকা মাসিক বেতন রফা করিয়া যশোদা মুচিরামকে হারাণ অধিকারীর হস্তে সমর্পণ করিল। তার পর আছাড়িয়া পড়িয়া স্বামীর জন্য কাঁদিতে লাগিল।
মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত – ০৩
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
মুচিরাম অল্পদিনেই জানিল যে, যাত্রাওয়ালার জীবন সুখের নয়। যাত্রাওয়ালা কেবল কোকিলের মত গান করিয়া ডালে ডালে মুকুল ভোজন করিয়া বেড়ায় না। অল্পদিনে মুচিরামের শরীর শীর্ণ হইল। এ গ্রাম ও গ্রাম ছুটাছুটি করিতে সকল দিন আহার হয় না; রাত্রি জাগিয়া প্রাণ ওষ্ঠাগত; চুলের ভারে মাথায় উকুনে ঘা করিল; গায়ে খড়ি উড়িতে লাগিল; অধিকারীর কাণমলায় কাণমলায় দুই কাণে ঘা হইল। শুধু তাই নয়; অধিকারী মহাশয়ের পা টিপিতে হয়, তাঁকে বাতাস করিতে হয়, তামাক সাজিতে হয়, আরও অনেক রকম দাসত্ব করিতে হয়। অল্পদিনেই মুচিরামের সোণার মেঘ বাষ্পরাশিতে পরিণত হইল।
মুচিরামের আরও দুর্ভাগ্য এই যে, বুদ্ধিটা বড় তীক্ষ্ণ নহে। গীতের তাল যে, পুষ্করিণীতীরস্থ দীর্ঘ বৃক্ষে ফলে না, ইহা বুঝিতে তাহার বহুকাল গেল। ফলে তালিমের সময়ে তালের কথা পড়িলে, মুচিরাম অন্যমনস্ক হইত-মনে পড়িত, মা কেমন তালের বড়া করে!-মুচিরামের চক্ষু দিয়া এবং রসনা দিয়া জল বহিয়া যাইত।
আবার গান মুখস্থ করা আরও দায়-কিছুতেই মুখস্থ হইত না-কাণমলায় কাণমলায় কাণ রাঙ্গা হইয়া গেল। সুতরাং আসরে গায়িবার সময়ে পিছন হইতে তাহাকে বলিয়া দিতে হইত। তাহাতে মধ্যে মধ্যে বড় গোল বাঁধিত-সকল সময়ে ঠিক শুনিতে বা বুঝিতে পারিত না। একদিন পিছন হইতে বলিয়া দিতেছে-
“নীরদকুন্তলা-লোচনচঞ্চলা
দধতি সুন্দররূপং”
মুচিরাম গায়িল-“নীরদ কুন্তলা__” থামিল-আবার পিছন হইতে বলিল, “লোচনচঞ্চলা”-মুচিরাম ভাবিয়া চিন্তিয়া গায়িল, “লুচি চিনি ছোলা”। পিছন হইতে বলিয়া দিল, “দধতি সুন্দররূপং”-মুচিরাম না বুঝিয়া গায়িল, “দধিতে সন্দেশ রূপং”। সেদিন আর গায়িতে পাইল না।
মুচিরামকে কৃষ্ণ সাজিতে হইত-কিন্তু কৃষ্ণের বক্তব্য সকল তাহাকে পিছন হইতে বলিয়া দিতে হইত-“আ-বা-আ-বা ধবলী”টি মুখস্থ ছিল। একদিন মানভঞ্জন যাত্রা হইতেছে-পিছন হইতে মুচিরামকে বক্তৃতা শিখাইয়া দিতেছে। কৃষ্ণকে বলিতে হইবে, “মানময়ি রাধে! একবার বদন তুলে কথা কও |” সেই সময়ে বেহালাওয়ালা মৃদঙ্গীর হাতে তামাকের কল্কে দিয়া বলিতেছিল, “গুড়ুক খাও___” শুনিয়া মুচিরাম বলিল, “রাধে-একবার বদন তুলে-গুড়ক খাও |” হাসির চোটে যাত্রা ভাঙ্গিয়া গেল।
মুচিরাম প্রথমে বুঝিতে পারিল না-হাসি কিসের-যাত্রা ভাঙ্গিল কেন? কিন্তু যখন দেখিল, অধিকারী সাজঘরে আসিয়া একগাছা বাঁক সাপটিয়া ধরিয়া, তাহার দিকে ধাবমান হইলেন, তখন মুচিরাম হঠাৎ বুঝিল যে, এই বাঁক তাহার পৃষ্ঠদেশে অবতীর্ণ হইবার কিছু গুরুতর সম্ভাবনা-অতএব কথিত পৃষ্ঠদেশ স্থানান্তরে লইয়া যাওয়া আশু প্রয়োজন। এই ভাবিয়া মুচিরাম অকস্মাৎ নিষ্ক্রান্ত হইয়া নৈশ অন্ধকারে অন্তর্হিত হইল।
অধিকারী মহাশয় বাঁকহস্তে তৎপশ্চাৎ নিষ্ক্রান্ত হইয়া, তাহাকে না দেখিতে পাইয়া, তাহার ও তাহার পিতৃপিতামহ, মাতা ও ভগিনীর নানাবিধ অযশ কীর্ত্তন করিতে লাগিলেন। মুচিরামও এক বৃক্ষান্তরালে থাকিয়া অস্ফুটস্বরে অধিকারী মহাশয়ের পিতৃমাতৃ সম্বন্ধে তদ্রূপ অপবাদ রটনা করিতে লাগিল। অধিকারী মুচিরামের সন্ধান না পাইয়া, সাজঘরে গিয়া বেশ ত্যাগ করিয়া, দ্বার রুদ্ধ করিয়া শয়ন করিয়া রহিলেন। দেখিয়া মুচিরাম বৃক্ষচ্ছায়া ত্যাগ করিয়া, রুদ্ধদ্বারসমীপে দাঁড়াইয়া অধিকারীকে নানাবিধ অবক্তব্য কদর্য্য ভাষায় মনে মনে সম্বোধন করিতে লাগিল; এবং উভয় হস্তের অঙ্গুষ্ঠ উত্থিত করিয়া তাহাকে কদলীভোজনের অনুমতি করিল। তৎপরে রুদ্ধ কবাটকে বা কবাটের অন্তরালস্থিত অধিকারীর বদনচন্দ্রকে একটি লাথি দেখাইয়া, মুচিরাম ঠাকুরবাড়ীর মন্দিরের রোয়াকে গিয়া শয়ন করিয়া রহিল।
প্রভাতে উঠিয়া অধিকারী মহাশয় গ্রামান্তরে যাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। শুনিলেন, মুচিরাম আইসে নাই-কেহ কেহ বলিল, তাহাকে খুঁজিয়া আনিব? অধিকারী মহাশয় গালি দিয়া বলিলেন, “জুট্তে হয়, আপনি জুট্বে, এখন আমি খুঁজে বেড়াতে পারি নে |” দয়ালুচিত্ত বেহালাওয়ালা বলিল, “ছেলেমানুষ-যদি নাই জুট্তে পারে-আমি খুঁজে আনিব।” অধিকারী ধমকাইলে-মনে মনে ইচ্ছা, মুচিরামের হাত হইতে উদ্ধার পান, এবং সেই সঙ্গে তাহার পাওনা টাকাগুলি ফাঁকি দেন। বেহালাওয়ালা ভাবিল-মুচিরাম কোনরূপে জুটিবে। আর কিছু বলিল না।
যাত্রার দল চলিয়া গেল-মুচিরাম জুটিল না। রাত্রিজাগরণ-দেবালয়বরণ্ডে সে অকাতরে নিদ্রা যাইতেছিল। উঠিয়া দল চলিয়া গিয়াছে শুনিয়া, কাঁদিতে আরম্ভ করিল। এমন বুদ্ধি নাই যে, অধিকারী কোন্ পথে গিয়াছে, সন্ধান করিয়া সেই পথে যায়। কেবল কাঁদিতে লাগিল। পূজারি বামন অনুগ্রহ করিয়া বেলা তিন প্রহরে দুইটি ঠাকুরের প্রসাদ খাইতে দিল। খাইয়া, মুচিরাম কান্নার দ্বিতীয় অধ্যায় আরম্ভ করিল। যত রাত্রি নিকট হইতে লাগিল, তত ভাবিতে লাগিল-আমি কেন পালাইলাম! আমি কেন দাঁড়াইয়া মার খাইলাম না!
গ্রন্থকার ভনে, এবার যখন বাঁক উঠিতে দেখিবে, পিঠ পাতিয়া দিও। তোমার গোষ্ঠীর বাপচৌদ্দপুরুষ বুড়া সেনরাজার আমল হইতে কেবল পিঠ পাতিয়া দিয়াই আসিতেছে। তুমি পলাইবে কোথায়? এ সুসভ্য জগতের অধিকারীরা মুচিরাম দেখিলে বাঁকপেটাই করিয়া থাকে-মুচিরামেরা পিঠ পাতিয়াই দেয়। কেহ পালায় না-রাখাল ছাড়া কি গোরু থাকিতে পারে হে বাপু? ঘাস জলের প্রয়োজন হইলেই, তোমাদের যখন রাখাল ভিন্ন উপায় নাই, তখন পাঁচনবাড়িকে প্রাতঃপ্রণাম করিয়া গোজন্ম সার্থক কর!
মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত – ০৪
চতুর্থ পরিচ্ছেদ