——————-
১ অহো! এই বনদেবতা ফলপুষ্পপল্লবার্ঘের দ্বারা আমার অভ্যর্থনা করিতেছেন।
২ গুরু বুদ্ধিমান্কে যেমন শিক্ষা দেন, জড়কেও তদ্রূপ দিয়া থাকেন। কাহারও জ্ঞানের বিশেষ সাহায্য বা ক্ষতি করেন না। কিন্তু তথাপি তাহাদের মধ্যে ফলের তারতম্য ঘটে। কেবল নির্ম্মল মণিই প্রতিবিম্ব গ্রহণ করিতে পারে; মৃত্তিকা তাহা পারে না।
——————-
হরেস্ হেমান উইলসন্ বলেন যে, উত্তরচরিতে কতকগুলি এমত সুন্দর ভাব আছে যে, তদপেক্ষা সুন্দর ভাব কোন ভাষাতেই নাই। উপরে উদ্ধৃত কবিতা এই কথার উদাহরণস্বরূপ তিনি উল্লেখ করিয়াছেন।
রামচন্দ্র শম্বুকের সন্ধান করিতে করিতে পঞ্চবটীর বনে শাম্বুককে পাইলেন, এবং খড়্গদ্বারা তাহাকে প্রহার করিলেন। শাম্বুক দিব্য পুরুষ; রামের প্রহারে শাপমুক্ত হইয়া রামকে প্রণিপাত করিল। এবং জনস্থানাদি রামচন্দ্রের পূর্ব্বপরিচিত স্থান সকল দেখাইতে লাগিল। উভয়ের কথোপকথনের বনবর্ণনা অতি মনোহর।
স্নিগ্ধশ্যামাঃ ক্কচিদপরতো ভীষণাভোগরুক্ষাঃ
স্থানে স্থানে মুখরককুভো ঝাঙ্কৃতৈর্রনর্ঝরাণাম্।
এতে তীর্থশ্রমগিরিসরিদ্গর্ত্তকান্তরমিশ্রাঃ
সন্দৃশ্যন্তে পরিচিতভুবো দণ্ডকারণ্যভাগাঃ ||
এতানি খলু সর্ব্বভূতলোমহর্ষণানি উন্মত্তচণ্ডশ্বাপদকুলসঙ্কুলগিরিগহ্বরাণি জনস্থান- পর্য্যন্তদীর্ঘারণ্যানি দক্ষিণাং দিশমভিবর্ত্তন্তে।
তথাহি
নিষ্কূজস্তিমিতাঃ ক্কচিৎ ক্কচিদপি প্রোচণ্ডসত্ত্বস্বনাঃ
স্বেচ্ছাসুপ্তগভীরভোগভুজগশ্বাসপ্রদীপ্তাগ্নয়ঃ।
সীমানঃপ্রদরোদরেষু বিলসৎস্ববল্পাম্ভসো যাস্বয়ং
তষ্যাদ্ভিঃ প্রতিসূর্য্যকৈরজগরস্বেদদ্রবঃ পীয়তে ||
* * * *
অথৈতানি মদকলময়ূরকণ্ঠকোমলচ্ছবিভিরবকীর্ণানি পর্য্যন্তৈরবিরলনিবিষ্টন-নীলবহলচ্ছায়তরুণতরুষণ্ডমণ্ডিতানি অসম্ভ্রান্তবিবিধমৃগযূথানি। পশ্যতু মহানুভাবঃ প্রশান্তগম্ভীরাণি মধ্যমারণ্যকানি
ইহ সমদশকুন্তাক্রান্তবানীরবীরুৎ-
প্রসবসুরভিশীতস্বচ্ছতোয়া বহন্তি।
ফলভরপরিণামশ্যামজম্বুনিকুঞ্জ-
স্খলনমুখরভূরিস্রোতসো নির্ঝরিণ্যঃ ||
অপিচ
দধতি কুহরভাজামত্র ভল্লুকযূনা-
মনুরসিতগুরূণি স্ত্যানমম্বূকৃতানি।
শিশিরকটুকষায়ঃ স্ত্যায়তে শল্লকীনা-
মিভদলিতবিকীর্ণগ্রন্থিনিষ্যন্দগন্ধঃ ||১
———————
১ এই যে পরিচিতভূমি দণ্ডাকারণ্য ভাগ দেখা যাইতেছে। কোথাও স্নিগ্ধশ্যাম, কোথাও ভয়ঙ্কর রুক্ষদৃশ্য, কোথাও বা নির্ঝরগণের ঝরঝরশব্দে দিক্ সকল শব্দিত হইতেছে; কোথাও পুণ্যতীর্থ, কোথাও মুনিগণের আশ্রমপদ, কোথাও পর্ব্বত, কোথাও নদী এবং মধ্যে মধ্যে অরণ্য।
ঐ যে জনস্থান পর্য্যন্ত দীর্ঘ অরণ্য সকল দক্ষিণদিকে চলিতেছে। এ সকল সর্ব্বলোকলোমহর্ষণ—অস্ত্র গিরিগহ্বর উন্মত্ত প্রচণ্ড হিংস্র পশুগণে সমাকুল। কোথাও বা একেবারে নিঃশব্দ; কোথাও পশুদিগের প্রচণ্ড গর্জ্জনপরিপূর্ণ; কোথাও বা স্বেচ্ছাসুপ্ত গভীর গর্জ্জনকারী ভুজঙ্গের নিঃশ্বাসে অগ্নি প্রজ্বলিত। কোথাও গর্ত্তে অল্প জল দেখা যাইতেছে। কৃষিত কৃকলাসেরা অজগরের ঘর্ম্মবিন্দু পান করিতেছে।
**** দেখুন, এই মধ্যমারণ্য সকল কেমন প্রশান্ত গম্ভীর! মদকল ময়ূরের কন্ঠের ন্যায় কোমলচ্ছবি পর্ব্বতে অবকীর্ণ; ঘননিবিষ্ট, নীলপ্রধান কান্তি, অনতিপ্রৌঢ় বৃক্ষসমূহে শোভিত; এবং ভয়শূন্য বিবিধ মৃগযূথে পরিপূর্ণ। স্বচ্ছতোয়া নির্ঝরিণীসকল বহুস্রোতে বহিতেছে, আনন্দিত পক্ষী সকল তত্রস্থ বেতসলতার উপর বসিতেছে, তাহাতে বেতসের কুসুম বৃন্তচ্যুত হইয়া সেই জলে পড়িয়া জলকে সুগন্ধি এবং সুশীতল করিতেছে; স্রোতঃ পরিপক্কফলময় শ্যামজম্বুবনান্তে স্খলিত হওয়াতে শব্দিত হইতেছে। গিরিবিবরবাসী যুবা ভল্লুকদিগের থুৎকারশব্দ প্রতিধ্বনিতে গম্ভীর হইতেছে। এবং গজগণের দ্বারা ভগ্ন শল্লকী বৃক্ষের নিক্ষিপ্ত গ্রন্থি হইতে শীতল কটু কষায় সুগন্ধ বাহির হইতেছে।
——————–
প্রবন্ধের অসহ্য দৈর্ঘ্যাশঙ্কায় আর অধিক উদ্ধৃত করিতে পারিলাম না।
শম্বুক বিদায়ের পর পুনরাগমনপূর্ব্বক রামকে জানাইলেন যে, অগস্ত্য রামাগমন শুনিয়া তাঁহাকে আশ্রমে আমন্ত্রিত করিতেছেন। শুনিয়া রাম তথায় চলিলেন। গমনকালীন ক্রৌঞ্চাবত পর্ব্বতাদির বর্ণনা অতি মনোহর। আমরা সচরাচর অনুপ্রাসালঙ্কারের প্রশংসা করি না, কিন্তু এরূপ অনুপ্রাসের উপর বিরক্ত হওয়াও যায় না।
গুঞ্জৎকুঞ্জকুটীরকৌশিকঘটাঘুৎকারবৎকীচক-
স্তম্বাড়ম্বরমূকমৌকুলিকুলঃ ক্রৌঞ্চাবতোহয়ং গিরিঃ।
এতস্মিন্ প্রচলাকিনাং প্রচলতামুদ্বেজিতাঃ কূজিতৈ-
রুদ্বেল্লন্তি পুরাণরোহিণতরুস্কন্ধেষু কুম্ভীনসাঃ ||
এতে তে কুহরেষু গদ্গদনদদ্গোদাবরীবারয়ো
মেঘালঙ্কৃতমৌলিনীলশিখরাঃ ক্ষৌণীভৃতো দক্ষিণাঃ।
অন্যোন্যোপ্রতিঘাতসঙ্কুলচলৎ কল্লোলকোলাহলৈ-
রুত্তালাস্ত ইমে গভীরপয়সঃ পুণ্যাঃ সরিৎসঙ্গমাঃ ||১
তৃতীয়াঙ্ক অতি মনোহর। সত্য বটে যে, এই উৎকৃষ্ট নাটকে ক্রিয়াপারম্পর্য্য বড় মনোহর নহে, এবং তৃতীয়াঙ্ক সেই দোষে বিশেষ দৃষ্ট। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম অঙ্ক যেরূপ বিস্তৃত, তদনুরূপ বহুল ক্রিয়াপরম্পরা নায়ক নায়িকাগণ কর্ত্তৃক সম্পন্ন হয় নাই। যিনি মাক্বেথ পাঠ করিয়াছেন, তিনি জানেন যে, নাটকে বর্ণিতা ক্রিয়া সকলের বাহুল্য, পারম্পর্য্য এবং শীঘ্র সম্পাদন, কি প্রকার চিত্তকে মন্ত্রমুগ্ধ করে। কার্য্যগত এই গুণ নাটকের একটি প্রধান গুণ। উত্তরচরিতে তাহার
বিরলপ্রচার; বিশেষতঃ প্রথম ও তৃতীয়াঙ্কে। তথাপি ইহাতে কবি যে অপূর্ব্ব কবিত্ব প্রকাশ করিয়াছেন, সেই গুণে আমরা সে সকল দোষ বিস্মৃত হই।
দ্বিতীয়াঙ্কের বিষ্কম্ভক যেমন মধুর, তৃতীয়াঙ্কের বিষ্কম্ভক ততোধিক। গোদাবরী সংমিলিতা, তমসা, ও মুরলা নাম্নী দুইটি নদী রূপ ধারণ করিয়া রামসীতাবিষয়িণী কথা কহিতেছে।
অদ্য দ্বাদশ বৎসর হইল, রামচন্দ্র সীতাকে বিসর্জ্জন করিয়াছেন। প্রথম বিরহে তাঁহার যে গুরুতর শোক উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা পূর্ব্বে বর্ণিত হইয়াছে। কালসহকারে সে শোকের লাঘব জন্মিবার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তাহা ঘটে নাই; সর্ব্বসন্তাপহর্ত্তা কাল এই সন্তাপের শমতা সাধিতে পারে নাই।
অনির্ভিন্নো গভীরত্বাদন্তর্গূঢ়ঘনব্যথঃ।
পুটপাকপ্রতীকাশো রামস্য করুণো রসঃ || ২