———————-
১ “হা দেবি যজ্ঞভূমিসম্ভবে! হা জন্মগ্রহণপবিত্রিতবসুন্ধরে! হা নিমি এবং জনকবংশের আনন্দদাত্রি! হা অগ্নি বশিষ্ঠদেব এবং অরুন্ধতীসদৃশ প্রশংসনীয়চরিতে! হা রামময়জীবিতে! হা মহাবনবাসপ্রিয়সহচরি! হা মধুরভাষিণি! হা মিতবাদিনি! এইরূপ হইয়াও শেষে তোমার অদৃষ্টে এই ঘটিল |” — নৃসিংহবাবুর অনুবাদ।
———————-
তস্যৈবং ভাষিতং শ্রুত্বা রাঘবঃ পরমার্ত্তবৎ।
উবাচ সুহৃদঃ সর্ব্বান্ কথমেতদ্বদন্তু মাম্ ||
সর্ব্বে তু শিরসা ভূমাবভিবাদ্য প্রণম্য চ।
প্রত্যুচূ রাঘবং দীনমেবমেতন্ন সংশয়ঃ ||
শ্রুত্বা তু বাক্যং কাকুৎস্থঃ সর্ব্বেষাং সমুদীরিতম।
বিসর্জ্জয়ামাস তদা বয়স্যান্ শত্রুসূদনঃ||
বিসৃজ্য তু সুহৃদ্বর্গং বুদ্ধ্যা নিশ্চিত্য রাঘবঃ।
সমীপে দ্বাস্থমাসীনমিদং বচনব্রবীৎ ||
শীঘ্রমানয় সৌমিত্রিং লক্ষ্মণং শুভলক্ষণং।
ভরতং চ মহাভাগং শত্রুঘ্নমপরাজিতং ||
* * *
তে তু দৃষ্ট্বা মুখং তথ্য সগ্রহং শশিনং যথা।
সন্ধ্যাগতমিবাদিত্যং প্রভয়া পরিবর্জ্জিতং ||
বাষ্পপূর্ণে চ নয়নে দৃষ্ট্বা রামস্য ধীমতঃ।
হতশোভং যথা পদ্মং মুখম্বীক্ষ্য চ তস্য তে ||
ততোহভিবাদ্য ত্বরিতাঃ পাদৌ রামস্য মূর্দ্ধভিঃ।
তস্থুঃ সমাহিতাঃ সর্ব্বেব রামস্ত্বশ্রূণ্যবির্ত্তিয়ৎ ||
তান্ পরিষ্বজ্য বাহুভ্যামুত্থাপ্য চ মহাবলঃ।
আসনেষ্বাসতেত্যুক্ত্বা ততো বাক্যং জগাদ হ ||
ভবন্তো মম সর্ব্বস্বং ভবন্তো জীবিতং মম।
ভবদ্ভিশ্চ কৃতং রাজ্যং পালয়ামি নরেশ্বরাঃ ||
ভবন্তঃ কৃতশাস্ত্রার্থা বুদ্ধ্যা চ পরিনিষ্ঠতাঃ।
সংভূয় চ মদর্থাহয়ন্বেষ্টব্যো নরেশ্বরাঃ ||
তথা বদতি কাকুৎস্থে অবধানপরায়ণাঃ।
উদ্বিগ্নগমনসঃ সর্ব্বে কিন্নু রাজাভিধাস্যতি ||
তেষাং সমুপবিষ্টানাং সর্ব্বেষাং দীনচেতসাম্।
উবাচ বাক্যং কাক্যুৎস্থো মুখেন পরিশুষ্যতা ||
সর্ব্বে শৃণীত ভদ্রং বো মা কুরধ্বং মনোহন্যথা।
পৌরাণাং মম সীতায়া যাদৃশী বর্ত্ততে কথা ||
পৌরাপবাদঃ সুমহান্ তথা জনপদস্য চ।
বর্ত্ততে ময়ি বীভৎসা সা মে মর্ম্মাণি কৃন্ততি ||
অহং কিল কুলে জাত ইক্ষ্বাকূণাং মহাত্মনাম্।
সীতাপি সৎকুলে জাতা জনকানাং মহাত্মনাম্ ||
* * *
অন্তরাত্মা চ মে বেত্তি সীতাং শুদ্ধাং যশস্বিনীম্।
ততো গৃহীত্মা বৈদেহীমযোধ্যামহমাগতঃ ||
অয়ং তু মে মহান্ বাদঃ শোকশ্চ হৃদি বর্ত্ততে।
পৌরাপবাদঃ সুমহাংস্তথা জনপদস্য চ।
অকীর্ত্তির্যস্য গীয়েত লোকে ভূতস্য কস্যচিৎ ||
পতত্যেবাধমাল্লোঁকান্ যাবচ্ছব্দঃ প্রকীর্ত্ত্যতে।
অকীর্ত্তির্নিন্দ্যতে দেবৈঃ কীর্ত্তির্লোকেষু পূজ্যতে ||
কীর্ত্রর্থং তু সমারম্ভঃ সর্ব্বেষাং সুমহাত্মনাম্।
অপ্যহং জীবিতং জহ্যাং যুষ্মান্ বা পুরুষর্ষভাঃ ||
[অপবাদভয়াদ্ভীতঃ কিং পুনর্জনকাত্মজাম্।]
তস্মাদ্ভবন্তঃ পশ্যন্তু পতিতং শোকসাগরে ||
নহি পশ্যাম্যহং ভূতে কিঞ্চিদ্দুঃখমতোহধিকং।
স ত্বং প্রভাতে সৌমিত্রে সুমন্ত্রাধিষ্ঠিতং রথং ||
আরুহ্য সীতামারোপ্য বিষয়ান্তে সমুৎসৃজ।
গঙ্গায়াস্তু পরে পারে বাল্মীকেস্তু মহাত্মনঃ ||
আশ্রমো দিব্যসঙ্কোশস্তমসাতীরমাশ্রিতঃ।
তত্রৈনাম্বিজনে দেশে বিসৃজ্য রঘুনন্দন ||
শীঘ্রমাগচ্ছ সৌমিত্রে কুরুষ্ব বচনং মম।
ন চাস্মিন্ প্রতিবক্তব্য সীতাং প্রতি কথঞ্চন ||
তস্মাত্ত্বং গচ্ছ সৌমিত্রে কার্য্যা বিচারণা।
অপ্রীতির্হি পরা মহ্যং ত্বয়ৈতং প্রতিবারিতে ||
শাপিতা হি ময়া যূয়ং পাদাভ্যাং জীবনেন চ।
যে মাং বাক্যান্তরে ব্রুয়ুরনুনেতুং কথঞ্চন।
অহিতানাম তে নিত্যং মদভীষ্টবিঘাতনাৎ ||
মানয়ন্তু ভবন্তো মাং যদি মচ্ছাসনে স্থিতাঃ |
ইতোহদ্য নীয়তাং সীতা কুরুষ্ব বচনং মম ||১
এই রচনা অতি মনোমোহিনী। রামায়ণের রাম ক্ষত্রিয়, মহোজ্জ্বলকুলসম্ভূত, মহাতেজস্বী। তিনি পৌরাপবাদ শ্রবণে, হৃদ্বিদ্ধ সিংহের ন্যায় রোষে দুঃখে গর্জ্জন করিয়া উঠিলেন। ভবভূতির রামচন্দ্র তৎপরিবর্ত্তে স্ত্রীলোকের মত পা ছড়াইয়া কাঁদিতে বসিলেন। তাঁহার ক্রন্দনের কিয়দংশ পূর্ব্বেই উদ্ধৃত করিয়াছি। রামায়ণের সঙ্গে তুলনা করিবার জন্য অবিশিষ্টাংশও উদ্ধৃত করিলাম।
রাম। হা কষ্টমতিবীভৎসকর্ম্মা নৃশংসোহৃস্মি সংবৃত্তঃ
শৈশবাৎ প্রভৃতি পোষিতাং প্রিয়াং
সৌহৃদাদপৃথগাশয়ামিমাম্।
ছদ্মনা পরিদদামি মৃত্যবে
সৌনিকো গৃহশকুন্তিকামিব ||
তৎ কিমস্পর্শনীয়ঃ পাতকী দেবীং দূষষামি।
[সীতায়াঃ শিরঃ স্বৈরমুন্নময্য বাহুমাকর্ষন্]
অপূর্ব্বকর্ম্মচাণ্ডালময়ি মুগ্ধে বিমুঞ্চ মাম্।
শ্রিতাসি চন্দনভ্রান্ত্যা দুর্ব্বিপাকং বিষদ্রুমম্ ||
———————
১ অনুবাদ। তাহার এই মত কথা শুনিয়া রাম, পরম দুঃখিতের ন্যায় সুহৃৎ সকলকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন, এইরূপ কি আমাকে বলে?” সকলে ভূমিতে মস্তক নত করিয়া অভিবাদন ও প্রণাম করিয়া, দুঃখিত রাঘবকে প্রত্যুত্তরে কহিল, “এইরূপই বটে—সংশয় নাই |” তখন শত্রুদমন রামচন্দ্র সকলের এই কথা শুনিয়া বয়স্যবর্গকে বিদায় দিলেন। বন্ধুবর্গকে বিদায় দিয়া, বুদ্ধির দ্বারা অবধারিত করিয়া সমীপে আসীন দৌবারিককে এই কথা বলিলেন যে, শুভলক্ষণ সুমিত্রা-নন্দন লক্ষ্মণকে ও মহাভাগ ভরতকে ও অপরাজিত শত্রুঘ্নকে শীঘ্র আন। * * * তাঁহারা রামের মুখ, রাহুগ্রস্ত চন্দ্রের ন্যায় এবং সন্ধ্যাকালীন আদিত্যের ন্যায় প্রভাহীন দেখিলেন। ধীমান্ রামচন্দ্রের নয়নযুগল বাষ্পপূর্ণ এবং মুখ হতশোভ পদ্মের ন্যায় দেখিলেন। তাঁহারা ত্বরিত তাঁহার অভিবাদন করিয়া এবং তাঁহার পদযুগল মস্তকে ধারণ করিয়া সকলের সমাহিত হইয়া রহিলেন। রাম অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন। পরে বাহুযুগলের দ্বারা তাঁহাদিগকে আলিঙ্গন ও উত্থানপূর্ব্বক মহাবল রামচন্দ্র তাঁহাদিগকে “আসনে উপবেশন কর” এই বলিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে নরেশ্বরগণ! আমার সর্ব্বস্ব তোমরা; তোমরা আমার জীবন; তোমাদিগের কৃত রাজ্য আমি পালন করি। তোমরা শাস্ত্রার্থ অবগত; এবং তোমাদের বুদ্ধি পরিমার্জ্জিত করিয়াছ। হে নরেশ্বরগণ, তোমরা মিলিত হইয়া, যাহা বলি তাহার অর্থানুসন্ধান কর |” রামচন্দ্র এই কথা বলিলে অবধানপরায়ণ ভ্রাতৃগণ, “রাজা কি বলেন” ইহা ভাবিয়া উদ্বিগ্নচিত্ত হইয়া রহিলেন।
তখন সেই দীনচেতা উপবিষ্ট ভ্রাতৃগণকে পরিশুষ্কমুখে রামচন্দ্র বলিতে লাগিলেন, “তোমাদিগের মঙ্গল হউক! আবার সীতার সম্বন্ধে পৌরজনমধ্যে যেরূপ কথা বর্ত্তিয়াছে, তাহা শুন—মন অন্যথা করিও না। জনপদে এবং পৌরজনমধ্যে আমার সুমহান্ অপবাদরূপ বীভৎস কথা রটিয়াছে, আমার তাহাতে মর্ম্মচ্ছেদ করিতেছে। আমি মহাত্মা ইক্ষ্বাকুদিগের কুলে জন্মিয়াছি, সীতাও মহাত্মা জনকরাজের সৎকুলে জন্মিয়াছেন। আমার অন্তরাত্মাও জানে যে, যশস্বিনী সীতা শুদ্ধচরিত্রা।
* * *
তখন আমি বৈদেহীকে গ্রহণ করিয়া অযোধ্যায় আসিলাম। এক্ষণে এই মহান্ অপবাদে আমার হৃদয়ে শোক বর্ত্তিতেছে। পৌরজনমধ্যে এবং জনপদে সুমহান্ অপবাদ হইয়াছে। লোকে যাহার অকীর্ত্তিগান করে, যাবৎ সেই অকীর্ত্তি লোকে প্রকীর্ত্তিত হইবে, তাবৎ সে অধমলোকে পতিত থাকিবে। দেবতারা অকীর্ত্তির নিন্দা করেন, এবং কীর্ত্তিই সকল লোকে পূজনীয়া। সকল মহাত্মা ব্যক্তিদের যত্ন কীর্ত্তিরই জন্য। হে পুরুষর্ষভগণ, আমি অপবাদভয়ে ভীত হইয়া জীবন ত্যাগ করিতে পারি, সীতার ত কথাই নাই।
অতএব তোমরা দেখ, আমি কি শোকসাগরে পতিত হইয়াছি! আমি ইহার অধিক দুঃখ জগতে আর দেখি না। অতএব হে সৌমিত্রে? তুমি কল্য প্রভাতে সুমন্ত্রাধিষ্ঠিত রথে সীতাকে আরোপণ করিয়া স্বয়ং আরোহণ করিয়া, তাঁহাকে দেশান্তরে ত্যাগ করিয়া আইস। গঙ্গার অপর পারে তমসা নদীর তীরে মহাত্মা বাল্মীকি মুনির স্বর্গতুল্য আশ্রম। হে রঘুনন্দন! সেই বিজনদেশে তুমি ইঁহাকে ত্যাগ করিয়া শীঘ্র আইস,—আমার বচন রক্ষা কর—সীতাপরিত্যাগ বিষয়ে তুমি ইহার প্রতিবাদ কিছুই করিও না। অতএব হে সৌমিত্রে! যাও—এ বিষয়ে আর কিছু বিচার করিবার প্রয়োজন নাই। তুমি যদি ইহার বারণ কর, তবে আমার পরমাপ্রীতিকর হইবে। আমি চরণের স্পর্শে এবং জীবনের দ্বারা তোমাদিগকে শপথ করাইতেছি যে, যে ইহাতে আমাকে অনুনয় করিবার জন্য কোনরূপ কোন কথা বলিবে, আমার অভীষ্টহানি হেতুক তাহার শত্রু খ্যাতি নিত্য বর্ত্তিবে। যদি আমার আজ্ঞাবহ থাকিয়া, তোমরা আমাকে সম্মান করিতে চাও, তোমরা তবে আমার বচন রক্ষা কর, অদ্য সীতাকে লইয়া যাও।
——————–