————-
* বঙ্গদর্শন, ১২৮৪, আশ্বিন।
# স্বীকার করি, কিয়ৎপরিমাণে ধনাকাঙ্ক্ষা সমাজের মঙ্গলকর। ধনের আকাঙ্ক্ষা মাত্র অমঙ্গলজনক, এ কথা বলি না, ধন মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্য হওয়াই অমঙ্গলকর।
————–
কদাচিৎ কখনও এমন কেহ জন্মগ্রহণ করেন যে, তিনি সম্পদ্কে মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্যমধ্যে গণ্য করা দূরে থাকুক, জীবনোদ্দেশ্যের প্রধান বিঘ্ন বলিয়া ভাবিয়া থাকেন। যে রাজ্যসম্পদ্কে অপর লোকে জীবনসফলকর বিবেচনা করে, শাক্যসিংহ তাহা বিঘ্নকর বলিয়া প্রত্যাখান করিয়াছিলেন। ভারতবর্ষে বা ইউরোপে এমন অনেকেই মুনিবৃত্ত মহাপুরুষ জন্মিয়াছেন যে, তাঁহারা বাহ্য সম্পদ্কে ঐরূপ ঘৃণা করিয়াছেন। ইঁহারা প্রকৃত পথ অবলম্বন করিয়াছিলেন, এমত কথা বলিতে পারিতেছি না। শাক্যসিংহ শিখাইলেন যে, ঐহিক ব্যাপারে চিত্তনিবেশ মাত্র অনিষ্টপ্রদ, মনুষ্য সর্ব্বত্যাগী হইয়া নির্ব্বাণাকাঙ্ক্ষী হউক। ভারতে এই শিক্ষার ফল বিষময় হইয়াছে। এইরূপ আরও অনেকানেক মুনিবৃত্ত মহাপুরুষ মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ভ্রান্ত হওয়াতে, ঐহিক সম্পদে অননুরক্ত হইয়াও, সমাজের ইষ্টসাধনে বিশেষ কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই। সামান্যতঃ সন্ন্যাসী প্রভৃতি সর্ব্বদেশীয় বৈরাগীসম্প্রদায় সকলকে উদারহণ স্বরূপ নির্দ্দিষ্ট করিলেই, একথা যথেষ্ট প্রমাণীকৃত হইবে।
স্থূল কথা এই যে, ধনসঞ্চায়াদির ন্যায় সুখশূন্য, শুভফলশূন্য, মহত্ত্বশূন্য ব্যাপার প্রয়োজনীয় হইলেও কখনই মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্য বলিয়া গৃহীত হইতে পারে না। এ জীবন ভবিষ্যৎ পারলৌকিক জীবনের জন্য পরীক্ষা মাত্র—পৃথিবী স্বর্গলাভের জন্য কর্ম্মভূমি মাত্র—এ কথা যদি যথার্থ হয়, তবে পরলোকে সুখপ্রদ কার্য্যের অনুষ্ঠানই জীবনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত বটে। কিন্তু প্রথমতঃ সেই সকল কার্য্য কি, তদ্বিষয়ে মতভেদ, নিশ্চয়তার একেবারে উপায়াভাব; দ্বিতীয়তঃ, পরলোকের অস্তিত্বেরই প্রমাণাভাব।
তৃতীয়তঃ, পরলোক থাকিলে, এবং ইহলোক পরীক্ষাভূমিমাত্র হইলেও ঐহিক এবং পারত্রিক শুভের মধ্যে ভিন্নতা হইবার কোন কারণ দেখা যায় না। যদি পরলোক থাকে, তবে যে ব্যবহারে পরলোকে শুভ নিষ্পত্তির সম্ভাবনা, সেই কার্য্যেই ইহলোকেও শুভ নিষ্পত্তির সম্ভাবনা কেন নহে, তাহার যথার্থ হেতুনির্দ্দেশ এ পর্য্যন্ত কেহ করিতে পারে নাই। ধর্ম্মাচরণ যদি মঙ্গলপ্রদ হয়, তবে যে উহা কেবল পরলোকে মঙ্গলপ্রদ, ইহলোকে মঙ্গলপ্রদ নহে, এ কথা কিসে সপ্রমাণীকৃত হইতেছে? ঈশ্বর স্বর্গে বসিয়া কাজির মত বিচার করিতেছেন, পাপীকে নরককুণ্ডে ফেলিয়া দিতেছেন, পুণ্যাত্মাকে স্বর্গে পাঠাইয়া দিতেছেন, এ সকল প্রাচীন মনোরঞ্জন উপন্যাসকে প্রমাণ বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে না। যাঁহারা বলেন যে, ইহলোকে অধার্ম্মিকের শুভ, এবং ধার্ম্মিকের অশুভ দেখা গিয়া থাকে, তাঁহাদিগের চক্ষে কেবল ধনসম্পদাদিই শুভ। তাঁহাদিগের বিচার এই মূল ভ্রান্তিতে দূষিত। যদি পুণ্যকর্ম্ম পরকালে শুভপ্রদ হয়, তবে ইহলোকেও পুণ্যকর্ম্ম শুভপ্রদ। কিন্তু বাস্তবিক কেবল পুণ্যকর্ম্ম কি পরলোকে, কি ইহলোকে শুভপ্রদ হইতে পারে না। যে প্রকার মনোবৃত্তির ফল পুণ্যকর্ম্ম, তাহাই উভয় লোকে শুভপ্রদ হওয়াই সম্ভব। কেহ যদি কেবল ম্যাজিষ্ট্রেট্ সাহেবের তাড়নার বশীভূত হইয়া, অথবা যশের লালসায় অপ্রসন্নচিত্তে দুর্ভিক্ষনিবারণের জন্য লক্ষ মুদ্রা দান করে, তবে তাহার পারলৌকিক মঙ্গলসঞ্চয় হইল কি? দান পুণ্যকর্ম্ম বটে, কিন্তু এরূপ দানে পরলোকের কোন উপকার হইবে, ইহা কেহই বলিবে না। কিন্তু এরূপ দানে পরলোকের কোন উপকার হইবে, ইহা কেহই বলিবে না। কিন্তু যে অর্থাভাবে দান করিতে পারিল না, কিন্তু দান করিতে পারিল না বলিয়া কাতর, সে ইহলোকে, এবং পরলোক থাকিলে পরলোকে, সুখী হওয়া সম্ভব।
অতএব মনোবৃত্তিসকল যে অবস্থায় পরিণত হইলে পুণ্যকর্ম্ম তাহার স্বাভাবিক ফলস্বরূপ স্বতঃ নিষ্পাদিত হইতে থাকে, পরলোক থাকিলে তাহাই পরলোকে শুভদায়ক বলিলে কথা গ্রাহ্য করা যাইতে পারে। পরলোক থাকুক বা না থাকুক, ইহলোকে তাহাই মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্য বটে। কিন্তু কেবল তাহাই মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্য হইতে পারে না। যেমন কতকগুলি মানসিক বৃত্তির চেষ্টা কর্ম্ম, এবং যেমন সে সকলগুলি সম্যক্ মার্জ্জিত ও উন্নত হইলে, স্বভাবতঃ পুণ্যকর্ম্মের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্তি জন্মে, তেমনি আর কতকগুলি বৃত্তি আছে, তাহাদের উদ্দেশ্য কোন প্রকার কার্য্য নহে—জ্ঞানই তাহাদিগের ক্রিয়া কার্য্যকারিণী বৃত্তিগুলির অনুশীলন যেমন মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্য, জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তিগুলিরও সেইরূপ অনুশীলন জীবনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। বস্তুতঃ সকল প্রকার মানসিক বৃত্তির সম্যক্ অনুশীলন, সম্পূর্ণ স্ফূর্ত্তি ও যথোচিত উন্নতি ও বিশুদ্ধিই মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্য।
এই উদ্দেশ্যমাত্র অবলম্বন করিয়া, সম্পদাদিতে উপযুক্ত ঘৃণা দেখাইয়া, জীবন নির্ব্বাহ করিয়াছেন, এরূপ মনুষ্য কেহ জন্মগ্রহণ করেন নাই, এমত নহে। তাঁহাদিগের সংখ্যা অতি অল্প হইলেও, তাহাদিগের জীবন-বৃত্ত মনুষ্যগণের অমূল্য শিক্ষাস্থল। জীবনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে এরূপ শিক্ষা আর কোথাও পাওয়া যায় না। নীতিশাস্ত্র, ধর্ম্মশাস্ত্র, বিজ্ঞান, দশর্ন প্রভৃতি সর্ব্বাপেক্ষা এই প্রধান শিক্ষা। দুর্ভাগ্যবশতঃ ইঁহাদিগের জীবনের গূঢ় তত্ত্ব সকল অপরিজ্ঞেয়। কেবল দুই জন আপন আপন জীবন-বৃত্ত লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। একজন গেটে, দ্বিতীয় জন্ ষ্টুয়ার্ট্ মিল্।
রামধন পোদ
বাঙ্গালার সাহিত্যারণ্যে একই রোদন শুনিতে পাই—বাঙ্গালীর বাহুতে বল নাই। এই অভিনব অভ্যুত্থানকালে বাঙ্গালীর ভগ্ন কণ্ঠে একই অস্ফুট বোল— “হায়! বাঙ্গালীর বাহুতে বল নাই।” বাঙ্গালীর যত দুঃখ, তার একই মূল—বাহুতে বল নাই।
যদি অনুসন্ধান করা যায়, বাঙ্গালীর বাহুতে বল নাই কেন? তাহার একই উত্তর পাইব—বাঙ্গালী খাইতে পায় না—বাঙ্গালায় অন্ন নাই। যেমন এক মার গর্ভে বহু সন্তান হইলে কেহই উদর পূরিয়া স্তন্য পায় না, তেমনি আমাদের জন্মভূমি বহুসন্তানপ্রসবিনী বলিয়া তাঁহার শরীরোৎপন্ন খাদ্যে সকলের কুলায় না। পৃথিবীর কোন দেশই বুঝি বাঙ্গালার মত প্রজাবহুলা নহে। বাঙ্গালার অতিশয় প্রজাবুদ্ধিই বাঙ্গালার প্রজার অবনতির কারণ। প্রজাবাহুল্য হইতে অন্নাভাব, অন্নাভাব হইতে অপুষ্টি, শীর্ণশরীরত্ব,—জ্বরাদি পীড়া এবং মানসিক দৌর্ব্বল্য।
অনেকে বলিবেন—দেখ, দেশে অনেক বড় মানুষের ছেলে আছে—তাহাদের আহারের কোন কষ্ট নাই, কিন্তু কই, তাহারা ত অনাহারী চণ্ডাল পোদের অপেক্ষাও দুর্ব্বল—বড় মানুষের ছেলেরাই প্রকৃত মর্কটাকার। সত্য বটে, কিন্তু এক পুরুষে অন্নাভাবের দোষ খণ্ডে না। যাহারা পুরুষানুক্রমে মর্কটাকার, দুই এক পুরুষ তাহারা পেট ভরিয়া খাইতে পাইলেই মনুষ্যাকার ধারণ করে না। বিশেষ বড়মানুষের ছেলের কথা ছাড়িয়া দাও—তাঁহারা নড়িয়া বসেন না—সুতরাং ক্ষুধাভাবে প্রস্তুত আহার খাইতে পান না—ভুক্ত আহার জীর্ণ করিতে পারেন না। সকল দেশেই বাবুর দল মর্কটসম্প্রদায়বিশেষ। শ্রমজীবী, সাধারণ দরিদ্র লোকের বাহুবলই দেশের বাহুবল।
আবার অনেকে রাগ করিয়া বলিবেন, “এ রকম কঠিনহৃদয় মাল্থসি বুলি রাখিয়া দাও! ও ছাই আমরা অনেকবার শুনিয়াছি। কেন, যদি খাবার কুলায় না, তবে ভিন্ন দেশে এত চাউল গম রপ্তানি হয় কি প্রকারে?” এ সম্প্রদায়ের লোকে বুঝেন না যে, দেশে অকুলান থাকিলেও বিদেশে জিনিস রপ্তানি হইতে পারে। যে আমায় বেশী টাকা দিবে, তাহাকেই আমি জিনিষ বেচিব।
যদি এ দেশে কোন খাদ্য কুলান হয়, তবে সে চাউল। চাউল জুটিল না বলিয়া খাইতে পাইল না—এরূপ দূরবস্থা যে সকল লোকের ঘটে, তাহাদের সংখ্যা এ দেশে নিতান্ত অল্প। অধিকাংশ লোকের আর যাহারই অভাব থাক না কেন, চাউলের অপ্রতুল নাই। পেট ভরিয়া প্রায় সকলেই ভাত খাইতে পায়। কিন্তু পেট ভরিয়া ভাত খাইতে পাইলেই আহার হইল না। শুধু ভাতে জীবন রক্ষা হইলেই হইতে পারে—কিন্তু সে জীবনরক্ষা মাত্র। শরীরের পুষ্টি হয় না। চাউলে বলকারক সার পদার্থ শতাংশে সাত ভাগ আছে মাত্র। চরবি—যাহা শরীরপুষ্টির পক্ষে নিতান্ত প্রয়োজনীয়, চাউলে তাহা কিছুমাত্র নাই।
শুধু ভাত খায়, এমন লোক অতি অল্প না হউক, বেশীও নয়। বাঙ্গালার অধিকাংশ লোকে ভাতের সঙ্গে একটু ডালের ছিটা, মাছের বিন্দু, শাক বা আলু কাঁচকলার কণিকা দিয়া ভোজন করে। ইহার নাম “ভাত ব্যঞ্জন”। এই ভাত ব্যঞ্জনের মধ্যে ভাতের ভাগ পনের আনা সাড়ে ঊনিশ গণ্ডা—ব্যঞ্জনের ভাগ দুই কড়া। সুতরাং ইহাকেও শুধু ভাত বলা যাইতে পারে। বাঙ্গালার চৌদ্দ আনা লোক এইরূপ শুধু ভাত খায়। তাহাতে কোন উপসর্গ না থাকিলে জীবনরক্ষা হইতে পারে-হইয়াও থাকে—কিন্তু এরূপ শরীরে রোগ অতি সহজেই প্রাধান্য স্থাপন করে,— (সাক্ষী ম্যালেরিয়া জ্বর)—আর এরূপ শরীরে বল থাকে না। সেই জন্য বাঙ্গালীর বাহুতে বল নাই।