————-
* বঙ্গদর্শন, ১২৮৮ জ্যৈষ্ঠ।
# ৭১ সালের লোকসংখ্যাগণনায় স্থির হইয়াছে যে, বাঙ্গালার যে অংশে বাঙ্গালাভাষা প্রচলিত, তাহাতে ৩০৬০০০০০ লোক বসতি করে—তন্মধ্যে ১১ লক্ষ মাত্র ব্রাহ্মণ।
————-
দেখিয়াছি যে, বাঙ্গালা ভাষার এমন একটি ভাগ আছে যে, অনার্য্যভাষাই তাহার মূল বলিয়া বোধ হয়। আরও দেখিয়াছি যে, বাঙ্গালী শূদ্রদিগের মধ্যে এমন অনেকগুলি জাতি আছে যে, অনার্য্যগণকে তাহাদের পূর্ব্বপুরুষ বলিয়া বোধ হয়।
পরিশেষে ইহাও প্রমাণ করা গিয়াছে যে, বাঙ্গালী শূদ্রের কিয়দংশ অনার্য্যসম্ভূত হইলেও অপরাংশ আর্য্যবংশীয়। কেহ বিশুদ্ধ আর্য্য, যেমন অম্বষ্ঠ, কায়স্থ; কেহ আর্য্য অনার্য্য উভয়কুলজাত, যেমন চণ্ডাল।
এক্ষণে এই বাঙ্গালী জাতি কি প্রকারে উৎপন্ন হইল, তাহা আমরা বুঝিয়াছি। প্রথম কোলবংশীয় অনার্য্য, তারপর দ্রাবিড়বংশীয় অনার্য্য, তারপর আর্য্য; এই তিনে মিশিয়া আধুনিক বাঙ্গালী জাতির উৎপত্তি হইয়াছে। সাক্সন্, ডেন্ ও নর্ম্মান্ মিশিয়া ইংরেজ জন্মিয়াছে। কিন্তু ইংরেজের গঠনে ও বাঙ্গালীর গঠনে দুইটি বিশেষ প্রভেদ আছে। টিউটন্ হউক বা নির্ম্মাণ হউক যতগুলি জাতির সংমিশ্রণে ইংরেজ জাতি প্রস্তুত হইয়াছে, সকলগুলিই আর্য্যবংশীয়। বাঙ্গালী যে কয়েকটি জাতিতে গঠিত হইয়াছে, তাহার কেহ আর্য্য, কেহ অনার্য্য | দ্বিতীয় প্রভেদ এই যে, ইংলণ্ডে টিউটন্ ও ডেন্ ও নর্ম্মান্, এই তিন জাতির রক্ত একত্রে মিশিয়াছে। পরস্পরের সহিত বিবাহাদি সম্বন্ধের দ্বারা মিলিত হইয়া তাহাদিগের পার্থক্য লুপ্ত হইয়াছে। তিনে এক জাতি দাঁড়াইয়াছে, বাছিয়া তিনটি পৃথক্ করিবার উপায় নাই। মোটের উপর এক ইংরেজজাতি কেবল পাওয়া যায়। কিন্তু ভারতীয় আর্য্যদিগের বর্ণধর্ম্মিত্বহেতু বাঙ্গালায় তিনটি পৃথক্ স্রোত মিশিয়া একটি প্রবল প্রবাহে পরিণত হয় নাই; আর্য্যসম্ভূত ব্রাহ্মণ অনার্য্যসম্ভূত অন্য জাতি হইতে সম্পূর্ণ পৃথক্ রহিয়াছেন। যদি কোন স্থানে আর্য্যে অনার্য্যে বৈধ বিবাহ বা অবৈধ সংসর্গের দ্বারা সংমিশ্রণ ঘটিয়াছে, সেখানে সেই সংমিশ্রণে উৎপন্ন সন্তানেরা আর্য্য অনার্য্য হইতে আর একটি পৃথক্ জাতি হইয়া রহিয়াছে। চণ্ডালেরা ইহার উদাহরণ। ইংরেজ একজাতি, বাঙ্গালীরা বহুজাতি। বাস্তবিক এক্ষণে যাহাদিগকে আমরা বাঙ্গালী বলি, তাহাদিগের মধ্যে চারি প্রকার বাঙ্গালী পাই। এক আর্য্য, দ্বিতীয় অনার্য্য হিন্দু, তৃতীয় আর্য্যান্যার্য্য হিন্দু, আর তিনের বার এক চতুর্থ জাতি বাঙ্গালী মুসলমান। চারি ভাগ পরস্পর হইতে পৃথক্ থাকে। বাঙ্গালীসমাজের নিম্নস্তরেই বাঙ্গালী অনার্য্য বা মিশ্রিত আর্য্য ও বাঙ্গালী মুসলমান; উপরের স্তরে প্রায় কেবল আর্য্য। এই জন্যে দূর হইতে দেখিতে বাঙ্গালীজাতি অমিশ্রিত আর্য্যজাতি বলিয়াই বোধ হয় এবং বাঙ্গালার ইতিহাস এক আর্য্যবংশীয় জাতির ইতিহাস বলিয়া লিখিত হয়।
বাহুবল ও বাক্যবল
সামাজিক দুঃখ নিবারণের জন্য দুইটি উপায় মাত্র ইতিহাসে পরিকীর্ত্তিত—বাহুবল ও বাক্যবল। এই দুই বল সম্বন্ধে আমার যাহা বলিবার পূর্ব্বে সামাজিক দুঃখের উৎপত্তি সম্বন্ধে কিছু বলা আবশ্যক।
মনুষ্যের দুঃখের কারণ তিনটি। (১) কতকগুলি দুঃখ জড়পদার্থের দোষগুণঘটিত। বাহ্য জগৎ কতকগুলি নিয়মাধীন হইয়া চলিতেছে; কতকগুলি শক্তিকর্ত্তৃক শাসিত হইতেছে। মনুষ্যও বাহ্য জগতের অংশ; সুতরাং মনুষ্যও সেই সকল শক্তিকর্ত্তৃক শাসিত। নৈসর্গিক নিয়মসকল উল্লঙ্ঘন করিলে রোগাদিতে কষ্ট ভোগ করিতে হয়, ক্ষুৎপিপাসায় পীড়িত হইতে হয়, এবং নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক দুঃখভোগ করিতে হয়।
(২) বাহ্য জগতের ন্যায় অন্তর্জগৎও আরও একটি মনুষ্যদুঃখের কারণ। কেহ পরশ্রী দেখিয়া সুখী, কেহ পরশ্রীতে দুঃখী। কেহ ইন্দ্রিয়সংযমে সুখী, কাহারও পক্ষে ইন্দ্রিয়সংযম ঘোরতর দুঃখ। পৃথিবীর কাব্যগ্রন্থসকলের, এই দ্বিতীয় শ্রেণীর দুঃখই আধার।
(৩) মনুষ্যদুঃখের তৃতীয় মূল, সমাজ। মনুষ্য সুখী হইবার জন্য সমাজবদ্ধ হয়; পরস্পরের সহায়তায় পরস্পরের অধিকতর সুখী হইবে বলিয়া, সকলে মিলিত হইয়া বাস করে। ইহাতে বিশেষ উন্নতিসাধন হয় বটে, কিন্তু অনেক অমঙ্গলও ঘটে। সামাজিক দুঃখ আছে। দারিদ্র্য দুঃখ সামাজিক দুঃখ। যেখানে সমাজ নাই, সেখানে দারিদ্র্য নাই।
কতকগুলি সামাজিক দুঃখ, সমাজ সংস্থাপনেরই ফল-যথা দারিদ্র্য। যেমন আলো হইলে, ছায়া তাহার আনুষঙ্গিক ফল আছেই আছে—তেমনি সমাজবদ্ধ হইলেই দারিদ্র্যাদি কতকগুলি সামাজিক দুঃখ আছেই আছে।# এ সকল সামাজিক দুঃখের উচ্ছেদ কখনও সম্ভবে না। কিন্তু আর কতকগুলি সামাজিক দুঃখ আছে, তাহা সমাজের নিত্যফল নহে; তাহা নিবার্য্য, এবং তাহার উচ্ছেদ সামাজিক উন্নতির প্রধান অংশ। সামাজিক মনুষ্য সেই সকল সামাজিক দুঃখের তাহার উচ্ছেদজন্য বহুকাল হইতে চেষ্টিত। সেই চেষ্টার সভ্যতার ইতিহাসের প্রধান অংশ, এবং সমাজনীতি ও রাজনীতি, এই দুইটি শাস্ত্রের একমাত্র উদ্দেশ্য।
এই দ্বিবিধ সামাজিক দুঃখ, আমি কয়েকটি উদাহরণের দ্বারা বুঝাইতে চেষ্টা করিব। স্বাধীনতার হানি, একটি দুঃখ সন্দেহ নাই। কিন্তু সমাজে বাস করিলে অবশ্যই স্বাধীনতার ক্ষতি স্বীকার করিতে হইবে, যতগুলি মনুষ্য সমাজসম্ভুক্ত, আমি সমাজে বাস করিয়া, ততগুলি মনুষ্যেরই কিয়দংশে অধীন—এবং সমাজের কর্ত্তৃগণের বিশেষ প্রকারে অধীন। অতএব স্বাধীনতার হানি একটি সামাজিক নিত্যদুঃখ।