———————
১ “যা হউক তা হউক |” এই কথার কত অর্থগাম্ভীর্য্য! বিদ্যাসাগর মহাশয় এই বাক্যের টীকায় লিখিয়াছেন যে, “আমার পাণিস্পর্শে আর্য্যপুত্র বাঁচিবেন কি না, জানি না, কিন্তু ভগবতী বলিতেছেন বলিয়া আমি স্পর্শ করিব |” ইহাতে এই বুঝিতে হইতেছে যে, পাণিস্পর্শ সফল হইবে কি না, এই সন্দেহেই সীতা বলিলেন,“যা হউক তা হউক!” কিন্তু আমাদিগের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বোধ যে সন্দেহে সীতা বলেন নাই যে, “যা হবার হউক!” সীতা ভাবিয়াছিলেন, “রামকে স্পর্শ করিবার আমার কি অধিকার? রাম আমাকে ত্যাগ করিয়াছেন, তিনি আমাকে বিনাপরাধে বিসর্জ্জন করিয়াছেন,- বিসর্জ্জন করিবার সময়ে একবার আমাকে ডাকিয়াও বলেন নাই যে, আমি তোমাকে ত্যাগ করিলাম—আজি বার বৎসর আমাকে ত্যাগ করিয়া সম্বন্ধ রহিত করিয়াছেন, আজি আবার তাঁহার প্রিয়পত্নীর মত তাঁহার গাত্রস্পর্শ করিব কোন্ সাহসে? কিন্তু তিনি ত মৃতপ্রায়! যা হউক তা হউক, আমি তাঁহাকে স্পর্শ করিব |” তাই ভাবিয়া সীতাস্পর্শে রাম চেতনাপ্রাপ্ত হইলে, সীতা বলিলেন, “ভঅবদি তমসে! ওসরহ্ম, জই দাব মৎ পেক্খিস্মদি তদো তণব্ভণুণ্ণাদসণ্ণিধাণেণ অহিঅদরং মম মহারাও কুবিস্মদি |” তবু “মম মহারাও!”
২ যে নবোদ্গত মৃণালপল্লবের ন্যায় কোমল দন্ত দ্বারা তোমার কর্ণদেশ হইতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লবলীপল্লব টানিয়া লইত, সেই তোমার পুত্র মদমত্ত বারণগণকে জয় করিল, সুতরাং এখনই সে যুবাবয়সের কল্যাণভাজন হইয়াছে। * * সতি বাসন্তি, দেখ, বাছা কেমন নিজ কান্তার মনোরঞ্জননৈপুণ্যও শিখিয়াছে। খেলা করিতে করিতে মৃণালকাণ্ড উৎপাটিত করিয়া তাহার গ্রাসের অংশে সুগন্ধি পদ্মসুবাসিত জলের গণ্ডূষ মিশাইয়া দিতেছে; এবং শুণ্ডের দ্বারা পর্য্যাপ্ত জলকণায় তাহাকে সিদ্ধ করিয়া, স্নেহে অবক্রদণ্ড নলিনীপত্রের আতপত্র ধরিতেছে।
———————
এদিকে পত্রীকৃত করী দেখিয়া সীতার গর্ভজ পুত্রদিগকে মনে পড়িল। কেবল স্বামিদর্শনে বঞ্চিতা নহেন,—পুত্রমুখ দর্শনেও বঞ্চিতা। সেই মাতৃমুখনির্গত পুত্রমুখ-স্মৃতিবাক্য উদ্ধৃত করিতেছি।
মম পুত্তকাণং ইসিবিরলকোমলধঅলদসণুজ্জলকবোলং অণুবদ্ধমুদ্ধকাঅলি-বিহসিদং ণিবদ্ধকাকসিহণ্ডঅং অমলমুহপুণ্ডরীঅজুঅলং ণ পরিচুম্বিদং উজ্জউ-ত্তেণ। ১
সেই গোদাবরীশীকরশীতল পঞ্চবটী বনে, রাম, বাসন্তীর আহ্বানে উপবেশন করিলেন। দূরে, গিরিগহ্বর গোদাবরীর বারিরাশির গদগদ নিনাদ শুনা যাইতেছে। সম্মুখে পরস্পর প্রতিঘাতসঙ্কুল উত্তালতরঙ্গ সরিৎসঙ্গম দেখা যাইতেছে। দক্ষিণে শ্যামচ্ছবি অনন্ত কাননশ্রেণী চলিয়া গিয়াছে। চারি দিকে সীতার পূর্ব্বসহবাসচিহ্ন সকল বিদ্যমান রহিয়াছে। তথায় একটি কদলীবনমধ্যবর্ত্তী শিলাতলে, পূর্ব্বপ্রবাস-কালে, রাম সীতার সঙ্গে শয়ন করিতেন; সেইখানে বসিয়া সীতা হরিণশিশুগণকে তৃণ খাওয়াইতেন; এখনও হরিণেরা সেই প্রেমে সেইখানে ফিরিয়া বেড়াইতেছে। বাসন্তী সেইখানে রামকে বসিতে বলিলেন। রাম সেখানে না বসিয়া, অন্যত্র উপবেশন করিলেন। সীতা, পূর্ব্বে পঞ্চবটীবাসকালে একটি ময়ূরশিশু প্রতিপালন করিয়াছিলেন। একটি কদম্ববৃক্ষ সীতা স্বহস্তে রোপণ করিয়া, স্বয়ং বর্দ্ধিত করিয়াছিলেন। রাম দেখিলেন যে, সেই কদম্ববৃক্ষে দুই একটি নবকুসুমোদ্গম হইয়াছে। তদুপরি আরোহণ করিয়া সীতাপালিত সেই ময়ূরটি নৃত্যান্তে ময়ূরী সঙ্গে রব করিতেছিল। বাসন্তী রামকে সেই ময়ূরটি দেখাইলেন। দেখিয়া রামের মনে পড়িল, সীতা তাহাকে করতালি দিয়া নাচাইতেন, নাচাইবার সময়ে তালের সহিত সীতার চক্ষুও পল্লবমধ্যে ঘুরিত। এইরূপে বাসন্তী রামকে সেই পূর্ব্বস্মৃতিপীড়িত করিয়া,—সখীনির্ব্বাসনজনিত রাগেই এইরূপ পীড়িত করিয়া, প্রথমে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ! কুমার লক্ষ্মণ ভাল আছেন ত?” কিন্তু সে কথা রামের কাণে গেল না—তিনি সীতাকরকমলবিকীর্ণ জলে পরিবর্দ্ধিত বৃক্ষ, সীতাকরকমলবিকীর্ণ নীবারে পুষ্ট পক্ষী, সীতাকরকমলবিকীর্ণ তৃণে প্রতিপালিত হরিণগণকেই দেখতেছিলেন। বাসন্তী আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ! লক্ষ্মণ কেমন আছেন?” এবার রাম কথা শুনিতে পাইলেন, কিন্তু ভাবিলেন, “বাসন্তী মহারাজ!” বলিয়া সম্বোধন করিলেন কেন? এ তো নিষ্প্রণয় সম্বোধন। আর কেবল কুমার লক্ষ্মণের কথাই জিজ্ঞাসিলেন, তবে বাসন্তী সীতাবিসর্জ্জনবৃত্তান্ত জানেন। রাম প্রকাশ্যে কেবল বলিলেন, “কুমারের কুশল,” এই বলিয়া নীরবে রোদন করিতে লাগিলেন। বাসন্তী তখন মুক্তাকণ্ঠা হইয়া কহিলেন, “দেব! এত কঠিন হইলে কি প্রকারে?
ত্বং জীবিতং ত্বমসি মে হৃদয়ং দ্বিতীয়ং
ত্বং কৌমুদী নয়নয়োরমৃতং ত্বমঙ্গে।
তুমি আমার জীবন, তুমি আমার দ্বিতীয় হৃদয়, তুমি নয়নের কৌমুদী, অঙ্গে তুমি আমার অমৃত,—এইরূপ শত শত প্রিয় সম্বোধনে যাহাকে ভুলাইতে,—তাহাকে—” বলিতে বলিতে সীতাস্মৃতিমুগ্ধা বাসন্তী আর বলিতে পারিলেন না; অচেতন হইলেন। রাম তাহাকে আশ্বস্তা করিলেন। চেতনা পাইয়া বাসন্তী কহিলেন, “আপনি কেমন করিয়া এ কাজ করিলেন?”
রাম। লোকে বুঝে না বলিয়া।
বাসন্তী। কেন বুঝে না?
রাম। তাহারাই জানে।
তখন বাসন্তী আর সহিতে পারিলেন না। বলিলেন, “নিষ্ঠুর! দেখিতেছি, কেবল যশঃ তোমার অত্যন্ত প্রিয় |”
——————
১ আমার সেই পুত্র দুটির অমলমুখপদ্মযুগল, যাহাতে কপোলদেশ ঈষদ্বিরল এবং কোমল ধবল দশনে উজ্জ্বল, যাহাতে মৃদুমধুর হাসির অব্যক্তধ্বনি অবিরল লাগিয়া রহিয়াছে, যাহাতে কাকপক্ষ নিবদ্ধ আছে, তাহা আর্য্যপুত্র কর্ত্তৃক পরিচুম্বিত হইল না!
——————