আরও আছে। যাহা সুন্দর, তাহা আমরা বড় ভালবাসি। সুন্দর হইতে আমরা সাক্ষাৎ সম্বন্ধে, কোন উপকার পাই না, তবু আমরা সুন্দরের আদর করি। যে ছেলে চন্দ্র হইতে কি উপকার বা অপকার পাওয়া যায়, তাহার কিছুই জানে না, সেও চাঁদ ভালবাসে। যে ছবির পুতুল, আমাদিগের ভাল মন্দ কিছুই করিতে পারে না, তাহাকেও আদর করি। সুন্দর ফুলটি, সুন্দর পাখিটি, সুন্দর মেয়েটিকে বড় আদর করি। চন্দ্র কেবল সৌন্দর্য্য গুণেই দেবতা, সাতাইশ নক্ষত্র তাহার মহিষী।
প্রকৃত পক্ষে ইহা উপাসনা নহে, কেবল আদর। কিন্তু অনেক সময় ইহা উপাসনা বলিয় গণিত হয়। বৈদিক ধর্ম্ম সম্বন্ধে তাই অনেক সময়ে হইয়াছে। কথাটা ঊনবিংশ শতাব্দীর ভাষায় অনুবাদ করা যাউক তাহা হইলেই অনেকেই বুঝিতে পারিবেন।
যাহা শক্তিশালী, তাহা নৈসর্গিক পদার্থের কোন বিশেষ সম্বন্ধ বিশিষ্ট বলিয়াই শক্তিশালী। কার্ব্বনের প্রতি অম্লজানের নৈসর্গিক অনুরাগই অগ্নির শক্তির কারণ। তাপ, জল, ও বায়ু এই তিন পদার্থের পরস্পরে বিশেষ কোন সম্বন্ধ বিশিষ্ট হওয়াতেই মেঘের শক্তি।
এই যে জাগতিক পদার্থের পরস্পরের সম্বন্ধের কথা বলিলাম, এই সম্বন্ধের বৈজ্ঞানিক নাম সত্য। সত্যই শক্তি। কেবল জড়শক্তি, আধ্যাত্মিক শক্তি সম্বন্ধেও এই কথা সত্য। যীশু বা শাক্যসিংহের উক্তি সকল বা কর্ম্ম সকল সমাজের সহিত নৈসর্গিক শক্তিবিশিষ্ট, অর্দ্ধেক জগৎ আজিও তাঁহাদের বশীভূত।
যাহা হিতকর, শক্তিশালী হউক বা না হউক, কেবল হিতকর, ঊনবিংশ শতাব্দী তাহার নাম দিয়াছে, শিব! সুন্দর বা সৌম্যের নূতন নাম কিছু হয় নাই, সুন্দর সুন্দরই আছে, সৌম্য সৌম্যই আছে।
এই সত্য (The True), শিব (The Good) এবং সুন্দর (The Beautiful) এই ত্রিবিধ ভাব মানুষের উপাস্য। এই উপাসনা দ্বিবিধ হইতে পারে। উপাসনার সময়ে অচেতন উপাস্যকে সচেতন মনে করিয়া উপাসনা করা যাইতে পারে, আদিম মনুষ্য তাহাই করিয়া থাকে। এই উপাসনা-পদ্ধতি ভ্রান্ত, কাজেই অহিতকর। দ্বিতীয়বিধ উপাসনায়, অচেতনকে অচেতন বলিয়া জ্ঞান থাকে। গেটে (Goethe) বা বর্ডস্বর্থ (Wordsworth) এই জাতীয় জড়োপাসক। ইহা অহিতকর নহে, বরং হিতকর, কেন না, ইহার দ্বারা কতকগুলি চিত্তবৃত্তির স্ফূর্ম্ম ও পরিণতি সাধিত হয়। ইহা অনুশীলন বিশেষ। এখনকার দেশী পণ্ডিতেরা (বিশেষ বালকেরা) তাহা বুঝিতে পারিয়া উঠে না, কিন্তু কতকগুলি বৈদিক ঋষি তাহা বুঝিতেন। বেদে দ্বিবিধ উপাসনাই আছে।
‘প্রচারে’র প্রথম সংখ্যা হইতে বৈদিক দেবতাতত্ত্ব সম্বন্ধে আমরা কি কি বলিলাম তাহা একবার স্মরণ করিয়া যাউক।
১। ইন্দ্রাদি বৈদিক দেবতা, আকাশ, সূর্য্য, অগ্নি, বায়ু প্রভৃতি জড়ের বিকাশ ভিন্ন লোকাতীত চৈতন্য নহেন।
২। এই সকল দেবতাদিগের উপাসনা যেমন বেদে আছে, এবং ভারতবর্ষীয়েরা যেমন ইঁহাদিগের দেবতা বলিয়া মানিয়া থাকে, সেইরূপ পৃথিবীর অন্যান্য জাতিগণ করিত বা করে।
৩। ইহার কারণ এই যে, প্রথমাবস্থায় মনুষ্য জড়ে চৈতন্য আরোপণ করিয়া, তাহার শক্তি হিতকারিতা, বা সৌন্দর্য্য অনুসারে, তাহার উপাসনা করে।
৪। সেই উপাসনা ইষ্টকারী এবং অনিষ্টকারী উভয়বিধ হইতে পারে। এখন দেখিতে হইবে, বেদে কিরূপ উপাসনা আছে। তাহা হইলেই আমরা বৈদিক দেবতাতত্ত্ব সমাপ্ত করি।-‘প্রচার’, ১ম বর্ষ, পৃ. ৩৭৪-৮৩।
—————–
* এই কথা শুনিয়া সর আলফ্রেড লায়েল লিখিলেন, কি ভয়ানক উপধর্ম্ম! এমন নিকৃষ্ট জাতির কি গতি হইবে। কাজেই বুদ্ধির জোরে লেফটেনেণ্ট গবর্ণর হইলেন।
দেবতত্ত্ব
আমরা দেখিয়াছি যে, বেদের ইন্দ্রাদি দেবতারা কেহ বা আকাশ, কেহ বা সূর্য্য, কেহ বা অগ্নি, কেহ বা নদী ; এইরূপ অচেতন জড়পদার্থ মাত্র। বেদে এইরূপ অচেতন জড়পদার্থের উপাসনা কেন? এরূপ উপাসনা কোথা হইতে আসিল? ইহার উৎপত্তির কি কোন কারণ আছে? অদ্য এই বিষয়ের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব।
বিস্ময়ের বিষয় এই যে, কেবল বৈদিক হিন্দুরাই এই ইন্দ্রাদির উপাসনা করিতেন না। পৃথিবীর অনেক সভ্য এবং অসভ্য জাতি ইঁহাদিগের উপাসনা করিত এবং এখনও করিয়া থাকে। সেই সকল জাতিমধ্যে এই দেবতাদিগের নাম ভিন্ন প্রকার বটে, কিন্তু উপাস্য দেবতা একই। আমরা কেবল প্রাচীন আর্য্যজাতিসম্ভূত যেন, রোমক প্রভৃতি জাতিদিগের কথা বলিতেছি না। হিন্দুরা যে জাতি হইতে জন্মগ্রহণ করিয়াছে তাহারাও সেই জাতি হইতে জন্মগ্রহণ করিয়াছিল ; সুতরাং একই বংশে একই দেবতার উপাসনা যে প্রচলিত থাকিবে ইহা বিস্ময়কর নহে। বিস্ময়কর এই যে, সকল জাতির সঙ্গে আর্য্যবংশীয়দিগের বংশত, স্থানগত, বা অন্য কোনপ্রকার ঐতিহাসিক সম্বন্ধ নাই, তাহাদিগের মধ্যেও এই ইন্দ্রাদির উপাসনা প্রচলিত। আমেরিকা, আফ্রিকা, অষ্ট্রেলিয়া বা পলিনেসিয়ার অভ্যন্তরবাসীদিগের মধ্যেও এই সকল দেবতাদিগের উপাসনা প্রচলিত। আমরা কতকগুলি উদাহরণ দিব। অধিক উদাহরণ সঙ্কলনের জন্য প্রচারের স্থান নাই। উদাহরণ দিবার পূর্ব্বে আমাদিগের দুইটি কথা বলিবার আছে।
প্রথম, হিন্দুধর্ম্মের ব্যাখ্যায় আমরা পাশ্চাত্ত্য লেখকদিগের সাহায্য গ্রহণ করিতে অতিশয় অনিচ্ছুক। ইংরেজভক্ত পাঠকদিগের তুষ্টির জন্য দুই একবার আপন মতের পোষকতায় পাশ্চাত্ত্য লেখকের মত উদ্ধৃত করিয়াছি বটে, কিন্তু সে অনিচ্ছাপূর্ব্বক। এবং আপনার মতের সঙ্গে তাহাদিগের মত না মিলিলে সেরূপ সাহায্য গ্রহণ করি নাই। কিন্তু এখানে ইউরোপের সাহায্য ব্যতীত আমাদের চলিবার উপায় নাই, কেন না কোন হিন্দুই আমেরিকা, আফ্রিকা, অষ্ট্রেলিয়া ও পলিনেসিয়ার আদিবাসীদিগকে দেখিয়া আইসে নাই।
দ্বিতীয়, আমরা প্রধানতঃ অসভ্য জাতিদিগের মধ্য হইতেই অধিকাংশ উদাহরণ গ্রহণ করিব। ইহাতে কেহ মনে না করেন যে, আমরা হিন্দুদিগকে অথবা প্রাচীন বৈদিক হিন্দুদিগকে, অসভ্য জাতি মধ্যে গণ্য করি। ইহা আমরা বলিতে স্বীকৃত আছি যে, বৈদিক হিন্দুরা যে সকল কথা বুঝিয়াছিলেন, ইউরোপে সভ্য জাতিরাও তাহার অনেক কথা এখনও বুঝেন নাই। তবে সাদৃশ্য এই যে, বৈদিক ধর্ম্ম হিন্দুধর্ম্মের প্রথম অবস্থা, আর আমরা যে সকল অসভ্য জাতিদের কথা বলিব, তাহাদেরও ধর্ম্মের প্রথম অবস্থা।
এক্ষণে আমরা উদাহরণ সঙ্কলনে প্রবৃত্ত হই। প্রথমতঃ ইন্দ্রদেবতাই আমাদের উদাহরণ হউন। প্রমাণ করিয়াছি যে, ইন্দ্র বৃষ্টি-দেবতা। শ্বেত-নীল-নদীতীরবাসী দিঙ্ক নামে জাতি ইন্দ্রকে দেন্দিদ নামে উপাসনা করে। তিনি ইন্দ্রের ন্যায় বৃষ্টি-দেবতা এবং ইন্দ্রের ন্যায় স্বর্গবাসী প্রধান দেবতা। ‘ডমর’ নামে অসভ্য জাতিদিগের মধ্যে ‘ওমাকুরু’ নামে দেবতা বৃষ্টিদেবতাও বটে, সর্ব্বপ্রধান দেবতাও বটে। ইনিই ডমরদিগের ইন্দ্র। আমেরিকার আদিম জাতিদিগের মধ্যে দুইটি সভ্যজাতি ছিল,-মেক্সিকোর আদিবাসী ‘অজতেক’ এবং পিরু’র আদিমবাসী ‘ইঙ্কা’দিগের প্রজা। অজতেকেরা তলালোকের উপাসনা করিত। তিনি ইন্দ্রের ন্যায় আকাশ-দেবতা এবং ইন্দ্রের বৃষ্টি-দেবতা এবং ইন্দ্রের ন্যায় বজ্রী। পিরুবাসীদিগের মধ্যে ইন্দ্র, দেব নহেন, দেবী। নিকারগুয়াবাসীদিগের মধ্যে বৃষ্টি-দেবতার পূজা আছে। ভারতবর্ষীয় অসভ্যজাতিদিগের মধ্যে উড়িষ্যার খন্দেরা পিজ্জুপেন্নু নামে বৃষ্টি-দেবতা পূজা করে। কোলেদের বড় পর্ব্বতকে তাহারা মরংবুরূ বলে। তিনিই ইহাদের বৃষ্টি-দেবতা। পূর্ব্বে আমরা স্থানান্তরে বলিয়াছি যে, রোমকদিগের জুপিটার আমাদিগের দ্যৌষ্পিতৃ। কিন্তু দ্যৌঃ ত কেবল আকাশ, রোমকেরা কেবল আকাশের উপাসনায় সন্তুষ্ট নহেন। বৃষ্টিকারী আকাশের উপাসনা চাই। এইজন্য তাঁহারা জুপিটার প্লুবিয়স, অর্থাৎ বৃষ্টিকারী আকাশের উপাসনা করিতেন। ইনি রোমকদিগের ইন্দ্র।