কিন্তু কথাটা বড় সোজা। ইন্দ্র সহস্রাক্ষ। কিন্তু ইন্দ্র আকাশ। আকাশের সহস্র চক্ষু কে না দেখিতে পায়? সাহেবরা কি দেখিতে পান না যে, আকাশে তারা উঠে? সহস্র তারাযুক্ত আকাশ, সহস্রাক্ষ ইন্দ্র। কথাটা আমি নূতন গড়িতেছি না-অনেক সহস্র বৎসরের কথা। প্রাচীন গ্রীসেও এ কথা প্রচলিত ছিল। তবে আমরা বলি, ইন্দ্র সহস্রাক্ষ ; তাহারা বলে, আর্গস শতাক্ষ।5
পাঠক বলিতে পারেন, তাহা হউক, কিন্তু অহল্যার কথাটা আসিল কোথা হইতে? সকলেই জানেন হল বলে লাঙ্গলকে। অহল্যা অর্থাৎ যে ভূমি হলের দ্বারা কর্ষিত হয় না-কঠিন, অনুর্ব্বর। ইন্দ্র বর্ষণ করিয়া সেই কঠিন ভূমিকে কোমল করেন,-জীর্ণ করেন, এই জন্য ইন্দ্র অহল্যা-জার। জৃধাতু হইতে জার শব্দ নিষ্পন্ন হয়। বৃষ্টির দ্বারা ইন্দ্র তাহাতে প্রবেশ করেন, এই জন্য তিনি অহল্যাতে অভিগমন করেন। কুমারিলভট্ট এ উপন্যাসের আর একটি ব্যাখ্যা দিয়াছেন তাহা নোটে# উদ্ধৃত করিলাম। উপরি-কথিত ব্যাখ্যাগুলির জন্য লেখক নিজে দায়ী।
এখন বোধ হয় পাঠক কতক কতক বুঝিয়া থাকিবেন যে, হিন্দুধর্ম্মের ইন্দ্রাদি দেবতা কোথা হইতে আসিয়াছেন এবং পুরাণেতিহাসের উপাখ্যান সকলই বা কোথা হইতে আসিয়াছে। বেদের অন্যান্য দেবতা সম্বন্ধেও আমরা কিছু কিছু বলিব।
এখন জিজ্ঞাস্য এই যে, এই ইন্দ্রকে পূজা না করিব কেন? ইনি অচেতন, বর্ষণকারী আকাশ মাত্র, কিন্তু ইহাতে কি জগদীশ্বরের শক্তি, মহিমা, দয়ার আশ্চর্য্য পরিচয় পাই না? যদি আমি আকাশ সচেতন, স্বয়ং সুখদুঃখের বিধানকর্ত্তা বলিয়া, তাঁহার উপাসনা করি, যদি তাই ভাবিয়া, তাঁহার কাছে প্রার্থনা করি যে, হে ইন্দ্র! ধন দাও, গোরু দাও, ভার্য্যা দাও, শত্রুসংহার কর, তবে আমার উপাসনা, দুষ্ট, অলীক, উপধর্ম্ম মাত্র। কিন্তু যদি আমার মনে থাকে যে, এই আকাশ নিজে অচেতন বটে, কিন্তু জগদীশ্বরের বর্ষণ-শক্তির বিকাশস্থল ; যে অনন্ত কারুণ্যের গুণে পৃথিবী বৃষ্টি পাইয়া শীতলা, জলশালিনী, শস্যশালিনী, জীবশালিনী হয়, সেই কারুণ্যের দৃষ্টিপথবর্ত্তিনী প্রতিমা, তবে তাহাকে ভক্তি করিলে, পূজা করিলে, ঈশ্বরের পূজা করা হইল। ঈশ্বরকে আমরা দেখিতে পাই না ; তবে তাঁহাকে আমরা জানিতে পারি কিসে? তাঁহার কার্য্য দেখিয়া, তাঁহার শক্তি ও দয়ার পরিচয় পাইয়া। যেখানে সে শক্তি দেখিব, সে পরিচয় পাইব, সেইখানে তাঁহার উপাসনা করিব, নহিলে তাঁহার প্রতি আন্তরিক ভক্তির সম্পূর্ণ স্ফূর্ত্তি হইবে না। আর যদি চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তিগুলির স্ফূর্ত্তি সুখের হয়, তবে জগতে যাহা মহৎ, যাহা সুন্দর, যাহা শক্তিমান্, তাহার উপাসনা করিতে হয়। যদি এ সকলের প্রতি ভক্তিমান্ না হইব, তবে চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তিগুলি লইয়া কি করিব? এ উপাসনা ভিন্ন হৃদয় মরুভূমি হইয়া যাইবে। এগুলি বাদ দিয়া যে ঈশ্বরোপাসনা, সে পত্রহীন বৃক্ষের ন্যায় অঙ্গহীন উপাসনা। হিন্দুধর্ম্মে এ উপাসনা আছে। ইহা হিন্দুধর্ম্মের শ্রেষ্ঠতার লক্ষণ। তবে দুর্ভাগ্যবশতঃ ক্রমে হিন্দুধর্ম্মের বিকৃতি হইয়াছে, ইন্দ্র যে বর্ষণকারী আকাশ, তাহা ভুলিয়া গিয়া তাঁহাকে স্বয়ং সুখদুঃখের বিধাতা, অথচ ইন্দ্রিয়পরবশ, কুকর্ম্মশালী, স্বর্গস্থ একটা জীবে পরিণত করিয়াছি। হিন্দুধর্ম্মের সেইটুকু এখন বাদ দিতে হইবে-হিন্দুধর্ম্মে যে একমাত্র ঈশ্বর ভিন্ন দেবতা নাই, ইহা মনে রাখিতে হইবে। তবে ইহাও মনে রাখিতে হইবে যে, ঈশ্বর বিশ্বরূপ ; যেখানে তাঁহার রূপ দেখিব, সেইখানে তাঁহার পূজা করিব। সেই অর্থে ইন্দ্রাদির উপাসনা পুণ্যময়-নহিলে অধর্ম্ম। ‘প্রচার’, ১ম বর্ষ, পৃঃ ১৪৫-৫৬।
—————-
1 আচার্য্য রোথ বলেন-
“Aditi Eternity or the Eternal, is the element which sustains and is sustained by the Adityas. This conception, owing to the character of what it embraces, had not in the Vedas been carried out into a definite personification, though the beginnings of such are not wanting. *** This eternal and inviolable principle in which in which the Adityas live and which constitutes their essence is the Celestial Light.”
মূর সাহেব কৃতানুবাদ।
২। মোক্ষমূলর বলেন-
“Aditi, an ancient God or Goddess, is in reality the earliest name invented to express the Infinite; not the Infinite as the result of a long process of abstract reasoning but the visible Infinite, visible by the naked eye, the endless expanse beyond the earth beyond the clouds beyond the sky.”
Translations from the Rig-Veda. I, 230.
সায়নাচার্য্যের মত ভিন্ন প্রকার, কিন্তু তিনি জানেন যে, অদিতি চৈতন্যযুক্তা দেবী-বিশেষ নহেন। তিনি বলেন, “অদিতিং অখণ্ডনীয়াং ভূমিং দিতিং খণ্ডিতাং প্রজাদিকাং।” কেহ কেহ অদিতিকে পৃথিবী মনে করিতেন, তাহা পূর্ব্বে বলা হইয়াছে।
2 পাঠকের স্মরণ থাকে যেন প্রথমে অদিতি অনন্তসত্তা বা প্রকৃতি নহেন-প্রথমে অদিতি অনন্ত আকাশ মাত্র। “অনন্ত” ইতিজ্ঞান, প্রথমে আকাশ হইতে জন্মিয়া পরিণামে সমস্ত সত্তায় পৌঁছে।
3 মাও আকাশ, ছেলেও আকাশ, ইহাও বিস্ময়কর নহে। প্রথম যখন আকাশ “অদিতি” এবং আকাশ “ইন্দ্র” বলিয়া কল্পিত হয়, তখন ইহাদিগের মাতা পুত্র সম্বন্ধ কল্পিত হয় নাই। ঋগ্বেদে তিনি অদিতির পুত্রদিগের মধ্যে গণিত হন নাই; কেবল এক স্থানে মাত্র ঋগ্বেদে আদিত্য বলিয়া অভিহিত হইয়াছেন। সে সূক্তটিও বোধ হয় আধুনিক।