——————
* নকিরস্য তানি ব্রতা: দেবস্য সবিতুর্মিনন্তি। ন যস্য ইন্দ্রো বরুণো ন মিত্রো ব্রতং অর্য্যমান্ মিনন্তি রুদ্রা:। অস্যহি সর্ব্বশাস্তারাং সবিতু: কচ্চন প্রিয়ং। ন মিনন্তি স্বরাজ্যং ২।৩৮।৭।৯।-৫।৮২।২
† আপশ্চিদস্য ব্রতে আনিমৃগ্রা অয়ঞ্চিৎ বাতো রমতে পরিজ্মন্।২।৩৮।২।
‡ যস্য প্রয়ানমন্বয়ে ইদ্যিযুর্দেবা:।৫।৮১।৩।
§ অপি স্তুত: সবিতা দেবো অস্তুয়ং আচিদ্বিশ্বেবসবো গৃণান্তি। অভি যং দেবী অদিতির্গণাতি সবং দেবস্য সবিতুর্জুষাণা। অভিসম্রাজো বরুণো গৃণন্তি অভিমিত্রাসো অর্য্যমা। সযোষা:।৭।৩৮।৩, ৪।
# তস্য কালো যদা দ্যৌরপহততমস্কাকীর্ণরশ্মির্ভবতি।
†† উদয়াৎ পূর্ব্বভাষী সবিতা। উদয়াস্তমধ্যবর্ত্তী সূর্য্য ইতি। * “গায়ত্র্যা অর্থমাহ যোগী যাজ্ঞবল্ক্য:। দেবস্য সবিতুর্বর্চ্চো ভর্গমন্তর্গতং বিভুং। ব্রহ্মবাদিন এবাহুর্ব্বরণ্যেঞ্চাস্য ধীমহি। চিন্তয়ামো বয়ং ভর্গং ধিয়ো যো ন: প্রচোদয়াৎ। ধর্ম্মার্থকামমোক্ষেষু বুদ্ধিবৃত্তী: পুন: পুন:। বুদ্ধেশ্চেদয়িতা যস্তু চিদাত্মা পুরুষো বিরাট্। বরণ্যেং বরণীয়ঞ্চ জন্মসংসারভীরুভি:। আদিত্যান্তর্গতং যচ্চ ভর্গাখ্যংতন্মুমুক্ষভি:। জন্মমৃত্যুবিনাশায় দু:খস্য ত্রিয়তস্য চ। ধ্যানেন পুরুষো যশ্চ দ্রষ্টব্য: সূর্য্যমণ্ডলে। মন্ত্রার্থমপি চৈবায়ং জ্ঞাপয়ত্যেবমেবহি। তেন গায়ত্র্যা অয়মর্থ:। দেবস্য সবিতুর্ভগস্বরূপান্তর্য্যামি ব্রহ্ম বরেণ্যং বরণীয়ং জন্মমৃত্যুভীরুভি: তদ্বিনাশায় উপাসনীয়ং। ধীমহি প্রাগুক্তেন সোহহস্মীত্যনেন চিন্তায়াম:, যো ভর্গ: সর্ব্বান্তর্য্যামীশ্বরো নোহস্মাকং সর্ব্বেষাং সংসারিণং ধিয়ো বুদ্ধী: প্রচোদয়াৎ ধর্ম্মার্থকামমোক্ষেষু প্রেরয়তি। তথাচ ভগবদ্গীতায়াং। “ঈশর: সর্ব্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জ্জুন তিষ্ঠতি, ভ্রাময়ন্ সর্ব্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া।” ঈশ্বরোহন্তর্য্যামী হৃদ্দেশে অন্ত:করণে ভ্রাময়ন্ তত্তৎকর্ম্মসু প্রেরয়ন্ দারুযন্ত্রতুল্যশরীরারূঢ়ানি ভূতানি প্রাণিনো জীবানিতি যাবৎ মায়য়া অঘটনঘটনপটীয়স্যা নিজশক্তা। তথাচাশ্বতরাণাং মন্ত্র:। “একো দেব: সর্ব্বভূতেষু গূঢ় সর্ব্বব্যাপী সর্ব্বভূতান্তরাত্মা। কর্ম্মাধ্যক্ষ: সর্ব্বভূতাধিবাস: সাক্ষী চেতা কেবলো নির্গুণশ্চ।”
হিন্দু কি জড়োপাসক?
যতক্ষণ আমার অঙ্গুলিটি আমা হইতে বিচ্ছিন্ন নহে ততক্ষণ ঐ অঙ্গুলিটি চেতনাময়, কিন্তু অঙ্গুলিটি কাটিয়া ফেলিলে, উহা আমা হইতে বিচ্ছিন্ন হইলে, উহাতে আর চেতনা থাকে না, তখন উহা অচেতন জড় পদার্থ।
এই সমগ্র বিশ্ব চৈতন্যময় এক পুরুষের দেহ। ভিন্ন ভিন্ন প্রকার শক্তির আধার সকল, অর্থাৎ অগ্নি বায়ু ইত্যাদি সকল সেই দেবতার অঙ্গবিশেষ। অগ্নিকে যদি সেই এক চৈতনময় পুরুষের অঙ্গ বলিয়া জানি, অগ্নিকে যদি সেই চৈতন্যময় পুরুষ হইতে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখি, তবে অগ্নির চেতনা আছে বলিয়া বুঝিব। আর যিনি অগ্নির সহিত সেই চৈতন্যময়ের কোন সম্বন্ধ দেখিতে পান না তাঁহার কাছেই অগ্নি জড় পদার্থ।
আজকালকার পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতগণ অগ্নিকে (Igneous principle) জড় বলিয়া জানেন কিন্তু প্রাচীন হিন্দুগণ অগ্নির সহিত চৈতন্যের সম্বন্ধ বুঝিয়া উহাকে চেতন বলিয়া বুঝিতেন। আজকালকার পাশ্চাত্ত্যগণ অগ্নিগত শক্তিকেই (Heat) জগতের আদি শক্তি বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করিতেছেন। হিন্দু ঋষিগণও এই অগ্নিকে জগতের আদি শক্তি বলিয়া স্থির করিয়াছিলেন, তবে প্রভেদ এই পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতদিগের অগ্নি জড়শক্তি, প্রাচীন হিন্দু ঋষিদের অগ্নি চেতনাযুক্ত।
প্রণব মন্ত্র হইতে এই জগতের সৃষ্টি স্থিতি লয় কার্য্য চলিতেছে। এই প্রণব মন্ত্রের দেবতা অগ্নি। হিন্দুরা বুঝিয়াছিলেন যে, এই অগ্নিগত শক্তি হইতেই এই জগৎচক্র ঘুরিতেছে। কিন্তু এই অগ্নিগত শক্তি যে চৈতন্য সম্বন্ধ রহিত ইহা তাঁহারা কখনও ভাবিতেন না। হিন্দুদের কাছে প্রণব মন্ত্রের লক্ষ্য অগ্নিগত শক্তি ব্রহ্মচৈতন্যে চেতনাযুক্ত।
ওঁকারস্য ব্রহ্মঋষিঃ গায়ত্রীচ্ছন্দোহগ্নির্দেবতা সর্ব্বকর্ম্মারম্ভে বিনিয়োগঃ।
প্রণব মন্ত্রের লক্ষ্য অগ্নিগত শক্তি সম্বন্ধে যিনি চিন্তা করিতে চান, অথবা উক্ত শক্তির সাহায্যে যিনি কোন কর্ম্ম করিতে চান, তাঁহাকে সর্ব্বপ্রথমে উক্ত মন্ত্রের ঋষি কে-তাহা জানিতে হইবে। মন্ত্রের ঋষি কে-ইহা না জানিয়া অর্থাৎ মন্ত্রের লক্ষ্যশক্তি কিরূপ চেতনাযুক্ত ইহা না জানিয়া যিনি মন্ত্র সাহায্য গ্রহণ করেন তাঁহাকে পাপভাক্ হইতে হয়, ইহা শ্রুতির কথা।
যোহহরহরবিদিতঋষিচ্ছন্দো দৈবতাবিনিয়োগেন ব্রাহ্মণেন বা মন্ত্রেণ বা যজাতি যাজয়তি বা অধীতে অধ্যাপয়তি বা হোমে কর্ম্মাণি অন্তর্জলাদৌ বা স পাপীয়ান্ ভবতি।
এখন দেখ বেদোক্ত ধর্ম্মাচারী ঋষিগণকে জড়োপাসক বলা কি কোন ক্রমে সঙ্গত হয়? যে পাশ্চাত্ত্যগণ হিন্দুদের জড়োপাসক বলেন, প্রকৃতপক্ষে তাঁহারাই জড়োপাসক। পাশ্চাত্ত্যগণ আজকাল নানা প্রকার প্রাকৃতিক শক্তির সাহায্য অবলম্বন করিয়া নানাবিধ কর্ম্মা প্রবৃত্ত হইয়াছেন; কিন্তু ঐ সকল শক্তি যে চৈতন্যময়ের চেতনাযুক্ত, ইহা একবারও ভাবেন না। জগতে ঐ সকল শক্তি দ্বারা চৈতন্যময়ের কি প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধিত হইবে পাশ্চাত্ত্যগণ তাহা একবার অনুসন্ধান করেন না। পাশ্চাত্ত্যগণ ঋষি বিনিয়োগাদি না জানিয়া প্রাকৃতিক শক্তির সহিত খেলা করিতেছেন। শ্রুতি মতে উঁহারা পাপভাগী হইতেছেন।
আমার বোধ হয় যেদিন হইতে ডাইনামাইট সৃষ্টি হইয়াছে সেই দিন হইতে পাশ্চাত্ত্যগণের উক্ত পাপের ফল ফলিবার সূত্রপাত হইয়াছে।
হিন্দুরা জড়োপাসক নহে। চেতনাবিহীন পদার্থ হিন্দুদের কাছে অস্পৃশ্য পদার্থ। আজকাল যাহাকে জড় পদার্থ বলা হয়, যেমন অগ্নি বায়ু নদী পর্ব্বত ইত্যাদি, ইহারা হিন্দুদের কাছে চৈতন্যময়ের চেতনাযুক্ত পদার্থ। চেতনাবিহীন পদার্থ আর মৃত শরীর এই দুইটি কথায় হিন্দু একই অর্থ বুঝিয়া থাকেন। মৃত শরীরের সংস্পর্শে হিন্দু থাকিতে চান না।-‘প্রচার’, ১ম বর্ষ, পৃ. ৪২৭-৩০।
হিন্দুধর্ম্ম
সম্প্রতি সুশিক্ষিত বাঙ্গালিদিগের মধ্যে হিন্দুধর্ম্মের আলোচনা দেখা যাইতেছে। অনেকেই মনে করেন যে, আমরা হিন্দুধর্ম্মের প্রতি ভক্তিমান্ হইতেছি। যদি এ কথা সত্য হয়, তবে আহ্লাদের বিষয় বটে। জাতীয় ধর্ম্মের পুনবন ব্যতীত ভারতবর্ষের মঙ্গল নাই, ইহা আমাদিগের দৃঢ় বিশ্বাস। কিন্তু যাঁহারা হিন্দুধর্ম্মের প্রতি এইরূপ অনুরাগযুক্ত, তাঁহাদিগকে আমাদের গোটাকত কথা জিজ্ঞাস্য আছে। প্রথম জিজ্ঞাস্য, হিন্দুধর্ম্ম কি? হিন্দুয়ানিতে অনেক রকম দেখিতে পাই। হিন্দু হাঁচি পড়িলে পা বাড়ায় না, টিকটিকি ডাকিলে “সত্য সত্য” বলে, হাই উঠিলে তুড়ি দেয়, এ সকল কি হিন্দুধর্ম্ম? অমুক শিয়রে শুইতে নাই, অমুক আস্যে খাইতে নাই, শূন্য কলসী দেখিলে যাত্রা করিতে নাই, অমুক বারে ক্ষৌরী হইতে নাই, অমুক বারে অমুক কাজ করিতে নাই, এ সকল কি হিন্দুধর্ম্ম? অনেকে স্বীকার করিবেন যে, এ সকল হিন্দুধর্ম্ম নহে। মূর্খের আচার মাত্র। যদি ইহা হিন্দুধর্ম্ম হয়, তবে আমরা মুক্তকণ্ঠে বলিতে পারি যে, আমরা হিন্দুধর্ম্মের পুনর্জ্জীবন চাহি না।1
এক্ষণে শুনিতে পাইতেছি যে, হিন্দুধর্ম্মের নিয়মগুলি পালন করিলে শরীর ভাল থাকে। যথা একাদশীর ব্রত স্বাস্থ্যরক্ষার একটি উত্তম উপায়। তবে শরীররক্ষার ব্রতই কি হিন্দুধর্ম্ম? আমরা একটি জমিদার দেখিয়াছি। তিনি জাতিতে ব্রাহ্মণ এবং অত্যন্ত হিন্দু। তিনি অতি প্রত্যূষে গাত্রোত্থান করিয়া কি শীত কি বর্ষা প্রত্যহ প্রাতঃস্নান করেন এবং তখনই পূজাহ্নিকে বসিয়া বেলা আড়াই প্রহর পর্য্যন্ত অনন্যমনে তাহাতে নিযুক্ত থাকেন। পূজাহ্নিকের কিছুমাত্র বিঘ্ন হইলে, মাথায় রবজ্রাঘাত হইল, মনে করেন। তার পর অপরাহ্নে নিরামিষ শাকান্ন ভোজন করিয়া একাহারে থাকেন,-ভোজনান্তে জমিদারী কার্য্যে বসেন। তখন কোন্ প্রজার সর্ব্বনাশ করিবেন, কোন্ অনাথা বিধবার সর্ব্বস্ব কাড়িয়া লইবেন, কাহার ঋণ ফাঁকি দিবেন, মিথ্যা জাল করিয়া কাহাকে বিনাপরাধে জেলে দিতে হইবে, কোন্ মোকদ্দমার কি মিথ্যা প্রমাণ প্রস্তুত করিতে হইবে, ইহাতে তাঁহার চিত্ত নিবিষ্ট থাকে, এবং যত্ন পর্য্যাপ্ত হয়। আমরা জানি যে, এ ব্যক্তির পূজা আহ্নিকে, ক্রিয়া কর্ম্মে, দেবতা ব্রাহ্মণে আন্তরিক ভক্তি, সেখানে কপটতা কিছু নাই। জাল করিতে করিতেও হরিনাম করিয়া থাকেন। মনে করেন, এ সময় হরি-স্মরণ করিলে এ জাল করা আমার অবশ্য সার্থক হইবে। এ ব্যক্তি কি হিন্দু?
আর একটি হিন্দুর কথা বলি। তাঁহার অভক্ষ্য প্রায় কিছুই নাই। যাহা অস্বাস্থ্যকর, তাহা ভিন্ন সকলই খান। এবং ব্রাহ্মণ হইয়া এক আধটু সুরাপান পর্য্যন্ত করিয়া থাকেন। যে কোন জাতির অন্ন গ্রহণ করেন। যবন ও ম্লেচ্ছের সঙ্গে একত্র ভোজনে কোন আপত্তি করেন না। সন্ধ্যা আহ্নিক ক্রিয়া কর্ম্ম কিছুই করেন না। কিন্তু কখন মিথ্যা কথা কহেন না। যদি মিথ্যা কথা কহেন, তবে মহাভারতীয় কৃষ্ণোক্তি স্মরণপূর্ব্বক যেখানে লোকহিতার্থে মিথ্যা নিতান্ত প্রয়োজনীয়-অর্থাৎ যেখানে মিথ্যাই সত্য হয়, সেইখানেই মিথ্যা কথা কহিয়া থাকেন। নিষ্কাম হইয়া দান ও পরহিত সাধন করিয়া থাকেন। যথাসাধ্য ইন্দ্রিয় সংযম এবং অন্তরে ঈশ্বরকে ভক্তি করেন। কাহাকে বঞ্চনা করেন না, কখন পরস্ব কামনা করেন না। ইন্দ্রিয়াদি দেবতা আকাশাদি ঈশ্বরের মূর্ত্তি স্বরূপ এবং শক্তি ও সৌন্দর্য্যের বিকাশ স্বরূপ বিবেচনা করিয়া, সে সকলের মানসিক উপাসনা করেন। এবং পুরাণকথিত শ্রীকৃষ্ণে সর্ব্বগুণসম্পন্ন ঈশ্বরে প্রকৃতি পর্য্যালোচনা করিয়া আপনাকে বৈষ্ণব বলিয়া পরিচিত করেন। হিন্দুধর্ম্মানুসারে গুরুজনে ভক্তি, পুত্র কলত্রাদির সস্নেহ প্রতিপালন, পশুর প্রতি দয়া করিয়া থাকেন। তিনি অক্রোধ ও ক্ষমাশীল। এ ব্যক্তি কি হিন্দু? এ দুই ব্যক্তির মধ্যে কে হিন্দু? ইহাদের মধ্যে কেহই কি হিন্দু নয়? যদি না হয়-তবে কেন নয়? ইহাদের মধ্যে কাহাতেও যদি হিন্দুয়ানি পাইলাম না, তবে হিন্দুধর্ম্ম কি? এক ব্যক্তি ধর্ম্মভ্রষ্ট, দ্বিতীয় ব্যক্তি আচারভ্রষ্ট। আচার ধর্ম্ম, না ধর্ম্মই ধর্ম্ম? যদি আচার ধর্ম্ম না হয়, ধর্ম্মই ধর্ম্ম হয়, তবে এই আচারভ্রষ্ট ধার্ম্মিক ব্যক্তিকেই হিন্দু বলিতে হয়। তাহাতে আপত্তি কি?