অগ্নিকে দ্বিতীয় উদাহরণস্বরূপ গ্রহণ করা যাউক। পৃথিবীতে, বিশেষতঃ আশিয়া প্রদেশে, অগ্নির উপাসনা বড় প্রবলতা প্রাপ্ত হইয়াছিল। আমেরিকার দিলাবরেরা অগ্নিদেবতাকে আমেরিকার আদিমবাসীদিগের আদি পুরুষ (মনু) বলিয়া বৎসরে বৎসরে উপাসনা করে। অর্ভিঙের লিখিত পুস্তকে জানা যায় যে, চিনুক নামে আমেরিকার প্রান্তবাসী আদিমজাতিরা অগ্নির পূজা করিত। সভ্য মেক্সিকোবাসীদিগের মধ্যে অগ্নি একজন প্রধান দেবতা ছিলেন ; কিন্তু তাঁহার নামটি এত দুরুচ্চার্য্য যে, আমরা তাহা বাঙ্গালায় লিখিতে পারিলাম না।1 পলিনেসিয়াতে মহুইকা নামে এবং আফ্রিকার ডাহোমে প্রদেশে জো নামে অগ্নি পূজিত। আশিয়া প্রদেশে কঞ্চড়লেরা শব পূজা করে এবং অগ্নিও পূজা করে। জাপান প্রদেশস্থ য়েসো প্রদেশে অগ্নিই প্রধান দেবতা। তুঙ্গজ মোগল এবং তুর্ক জাতীয়েরা অগ্নির উপাসনা করিয়া থাকে। টইলর সাহেব মোগলদিগের2 একটি বিবাহমন্ত্র উদ্ধৃত করিয়াছেন, তাহা পড়িয়া ঋগ্বেদের অগ্নিসূক্ত মনে পড়ে।
ইতিহাসে বিখ্যাত আসিরিয়া, কালদিয়া, ফিনিসিয়া প্রভৃতি দেশের লোকেরা প্রধানতঃ অগ্নির উপাসক ছিল। প্রাচীন পারস্যবাসীরা বিখ্যাত অগ্নির উপাসক এবং তাহাদিগের বংশ, বোম্বাইয়ের পার্সীর অদ্যাপিও বিখ্যাত অগ্নির উপাসক। ইউরোপেও গ্রীকদিগের মধ্যে Vulcan, Hephaistos, Hestia অগ্নিদেবতা। তৎপরবর্ত্তী ইউরোপীয়দের মধ্যে একটু একটু অগ্নিপূজা আছে। উদাহরণস্বরূপ টইলর সাহেবের গ্রন্থ হইতে একটু উদ্ধৃত করিলাম।!
সূর্য্যোপাসনা জগতে অতিশয় বিস্তৃত। সভ্য এবং অসভ্য সকলেই তাঁহার উপাসনা করে। আমেরিকায় অসভ্য জাতিদিগের মধ্যে হডসন বের উপকূলবাসী আদিমজাতিরা প্রাতঃসূর্য্যের উপাসনা করে। বঙ্কুবর দ্বীপবাসীরা মধ্যাহ্নসূর্য্যের উপাসনা করে। দিলাবরদিগের দ্বাদশ দেবতার মধ্যে সূর্য্য দ্বিতীয় দেবতা। বর্জিনিয়ার আদিমবাসীরা উদয় এবং অস্তকালে সূর্য্যের উপাসনা করিত। পোত্তবিতুমিরা ছাদের উপর উঠিয়া সূর্য্যের ভোগ দিত। আলগোঙ্কুইনদিগের চিত্রলিপি মধ্যে সূর্য্যের চিত্র প্রধান দেবতার চিত্রের স্বরূপ লিখিত হইয়াছে। সিউস জাতিরা সূর্য্যকে জগতের সৃজনকর্ত্তা ও পালনকর্ত্তা স্বরূপ বিবেচনা করে। ক্রীক্ জাতিরা সূর্য্যকে ঈশ্বরের প্রতিমাস্বরূপ বিবেচনা করে। আরৌকানিয়েরা সূর্য্যকে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ দেবতা বলিয়া উপাসনা করে। পুয়েল্চেরা সূর্য্যের নিকট সকল মঙ্গল কামনা করে। টুকুমানবাসীরা সূর্য্যের মন্দির গঠন করিয়া, তন্মধ্যে তাঁহার উপাসনা করে। লুইসিয়ানাবাসী নাচেজ জাতিদিগের মধ্যে সূর্য্যের পুরোহিতেরাই রাজা হইত এবং সূর্য্যের মন্দির নির্ম্মাণপূর্ব্বক রীতিমত প্রত্যহ তাঁহার উপাসনা করিত। ফ্লোরিদার আদিমবাসী অপলশেরা প্রকৃত সৌর ছিল। তাহারা প্রত্যহ প্রাতে ও সন্ধ্যাকালে সূর্য্য উপাসনা করিত এবং বৎসরে চারিবার সূর্য্যের উৎসব করিত। এদেশে দুর্গাপূজায় যেমন ঘটা, মেক্সিকো নিবাসী অজতেকদিগের মধ্যে সূর্য্যপূজার সেইরূপ ঘটা ছিল। তাহাদিগের নির্ম্মিত সূর্য্যের বৃহৎ স্তূপ অদ্যাপি বর্ত্তমান আছে এবং প্রেস্কটের মনোহর রচনায় এই সূর্য্যের ভীষণ উপাসনা চিরস্মরণীয় হইয়া গিয়াছে। ফলতঃ সূর্য্যকেই অজতেকেরা ঈশ্বর বলিয়া মানিত। দক্ষিণ আমেরিকার বেগোটা নিবাসী মুইস্কা জাতিরা সূর্য্যর নিকট নরবলি দিত। পিরুর সূর্য্যোপাসনা অতি বিখ্যাত এবং পিরুবাসীদিগের জীবনের সমস্ত কর্ম্ম এই সূর্য্যোপাসনার দ্বারা শাসিত হইত। পিরুর রাজা আমাদিগের রামচন্দ্রাদির ন্যায় সূর্য্যবংশীয় বলিয়া পরিচিত ছিলেন। তাঁহারা সূর্য্যের প্রতিনিধি বলিয়া রাজত্ব করিতেন। পিরুদেশে স্বর্ণ খচিত অসংখ্য সূর্য্যমন্দিরে সূর্য্যের স্বর্ণনির্ম্মিত প্রতিমূর্ত্তি সকল সর্ব্বলোকের দ্বারা উপাসিত হইত।
ভারতবর্ষীয় অসভ্য জাতিদিগের মধ্যে বোড়ো ও ধীমাল জাতিরা সূর্য্য উপাসনা করে। বাঙ্গালার প্রান্তবাসী কোল, মুণ্ডা, ওরাঁও এবং সাঁওতাল জাতিরা সিংবোঙ্গা নামে সূর্য্যদেবের উপাসনা করে। উড়িষ্যার খন্দদিগের মধ্যে সূর্য্যেদেবের নাম বুড়াপেন্নু। তিনি স্রষ্টা এবং বিধাতা। তদ্ভিন্ন তাতার, মঙ্গল, তুঙ্গুজ, সাইবিরিয়াবাসীরা এবং লাপ জাতিরা সূর্য্যের উপাসনা করিয়া থাকে।
আর্য্যজাতিদিগের মধ্যে প্রাচীন পারসিকদিগের সূর্য্যপাসনার কথা বলিয়াছি। গ্রীকদিগের মধ্যে সূর্য্যদেবতা হিলিয়স্ বা আপোলন নামে উপাসিত হইতেন। সক্রেটিস্ প্রভৃতিও তাঁহার উপাসনা করিতেন। আধুনিক ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা অনেকেই বলেন যে, গ্রীক প্রভৃতি আর্য্যজাতিদিগের দেবোপাখ্যান সকল অধিকাংশই সৌরোপন্যাস-সূর্য্যরূপক। তাঁহারা এ বিষয়ে কিছু বাড়াবাড়ি করিয়াছেন, পাঠকেরা তাহা অবগত থাকিতে পারেন।
প্রাচীন মিশরবাসীদিগের মধ্যে সূর্য্যোপাসনার বড় প্রাধান্য ছিল। বৈদিক হিন্দুদিগের ন্যায় তাঁহারাও সূর্য্যের নানা মূর্ত্তির উপাসনা করিতেন। এক মূর্ত্তি রা আর এক মূর্ত্তি ওসাইরিস, তৃতীয় মূর্ত্তি হার্পক্রোতি।3 প্রাচীন সিরীয়, ও আসিরীয় ও টিরীয়দিগের মধ্যে সূর্য্য বালস্মেস্, বেল বা বাল নামে উপাসিত হইতেন। সিরিয়া হইতে সূর্য্যোপাসনা রোমকে আনীত হইয়াছিল। এই সূর্য্যদেবের নাম এলোগবল্। তাঁহার পুরোহিত হেলিওগবলস্ রোমকের একজন সম্রাট হইয়াছিলেন। পরে রোমক খৃষ্টান হইলেও খৃষ্টোপাসনার সঙ্গে সঙ্গে স্থানে স্থানে সূর্য্যোপাসনা চলিয়াছিল এবং এখনও চলিতেছে। যেখানে সূর্য্যোপাসনা লুপ্ত হইয়াছে, সেখানেও খৃষ্টমাস্ প্রভৃতি উৎসবে তাঁহার উপাসনার চিহ্ন অদ্যাপি বর্ত্তমান আছে। পক্ষান্তরে, বিডুইন আরবেরা মুসলমান হইয়াও অদ্যাপি সূর্য্যের উপাসনা করিয়া থাকে।
চতুর্থ উদাহরণস্বরূপ আমরা বায়ুদেবতাকে গ্রহণ করি। ইন্দ্রাগ্নিসূর্য্যের ন্যায় বায়ুরও উপাসনা বহুদেশে প্রচলিত। আলাগঙ্কুইন জাতিদিগের বায়ুদেবচতুষ্টয়ের উপাখ্যান লংফেলো কৃত Hiawatha নামক কাব্যে বর্ণিত আছে। দিলাবরদিগের দ্বাদশ দেবতার মধ্যে উত্তর, পশ্চিম, পূর্ব্ব, দক্ষিণ, এই চারিটি দেবতা চারি প্রকার বায়ু মাত্র। ইরকোয়া জাতিদিগের মধ্যে বায়ুর অধিপতি দেবতার নাম গাওঃ। বেদে যেমন বায়ু এবং মরুদ্গণ পৃথক্ পৃথক্ দেবতা, অসভ্য জাতিদিগের মধ্যেও তেমনি কোথাও বায়ু কোথাও মরুদ্গণ পূজিত। পলিনেসীয়দিগের মধ্যে মরুদ্গণের পূজা আছে। তাহাদিগের মধ্যে প্রধান বেরোমতৌতরু এবং তৈরিবু। বন্ধুজন ঝড়ের সময় সমুদ্রে থাকিলে উহারা এই মরুদ্গণের পূজা করে। উহাদিগের বিশ্বাস, ঐ পূজায় প্রার্থনামত ঝড় বন্ধ হয় এবং প্রার্থনামত ঝড় উপস্থিত হয়। অষ্ট্রেলেসিয়ার উপদ্বীপ মধ্যে মৌই প্রধান দেবতা। তিনি কোন কোন স্থানে বায়ুদেবতা বলিয়া পূজিত হন। টাহিটিতে তিনি পূর্ব্ব বায়ু। নবজিল্যাণ্ডে তিনি বায়ুগণের শাসনকর্ত্তা। ফিন্জাতিদিগের প্রধান দেবতা উক্কো ঝড়ের অধিপতি। গ্রীকদিগের মধ্যে বোরিয়স্, জেফিরস এবং ইয়লস্ বায়ুদেবতা। হার্পিগণ মরুদ্দেবতা। স্ক্যাণ্ডিনেভীয়দিগের বিখ্যাত ওডিন মরুদ্দেবতা। এই মরুদ্দেবের পূজার চিহ্ন আজও ইউরোপে বর্ত্তামান আছে। কারিন্থিয়ার কৃষকেরা মাংসপূর্ণ কাষ্ঠপাত্র গাছে ঝুলাইয়া দিয়া বায়ুদেবতাকে ভোগ দেয়। জার্ম্মানির অন্তর্গত স্বাবিয়া, টাইরোল এবং উপর-পালাটিনেট প্রদেশে ঝড় হইলে ঝড়কে ঐরূপ মাংস উপহার দিয়া শান্ত করিবার চেষ্টা করে।
বেদে বরুণ প্রধানতঃ আকাশদেবতা, কিন্তু তিনি স্থানে স্থানে জলেশ্বর বলিয়াও অভিহিত হইয়াছেন। পুরাণে তিনি কেবল জলেশ্বর। গ্রীকদিগের মধ্যে বরুণ এইরূপ দুই ভাগ হইয়াছেন। বুরেনস্ (Uranos) আকাশ বরুণ এবং পোসাইডন (Poseidon) বা নেপচুন (Neptune) জলবরুণ। অসভ্য জাতিদের মধ্যেও এই দ্বিবিধ বরুণের উপাসনা আছে। আকাশ বরুণের কথা আমরা পরে বলিব, এক্ষণে জলেশ্বর বরুণের কথা বলি। পলিনেসিয়া প্রদেশে তুয়ারাতাই এবং রুয়াহাতু এই দুই জলেশ্বর বরুণ উপাসিত হইয়া থাকেন। আফ্রিকায় বোসমান জাতিদিগের মধ্যে জলেশ্বরের পূজা খুব ধুমধামের সহিত হইয়া থাকে। আফ্রিকার অন্যান্য প্রদেশেও জলেশ্বরের পূজা আছে। দক্ষিণ আমেরিকায় পিরুবাসীরা মামাকোচা নামে সমুদ্রদেবের পূজা করে। পূর্ব্ব আসিয়ার কামচকট্কা প্রদেশে মিৎক্ নামে জলেশ্বর উপাসিত হইয়া থাকেন। জাপানে দ্বিবিধ জলেশ্বর আছেন। স্থলমধ্যগত জলেশ্বরের নাম মিধসুনোকামি, এবং জলমধ্যগত জলেশ্বরের নাম জেবিসু।
আগামী সংখ্যায় আমরা আর দুইটি দেবতাকে উদাহরণস্বরূপ গ্রহণ করিব। পরে যে তত্ত্ব বুঝাইবার জন্য এই সকল উদাহরণ সংগ্রহ করিতেছি, তাহার অবতারণা করিব।-‘প্রচার’, ১ম বর্ষ, পৃ. ৩০১-১০।