———————–
* কালীপ্রসন্ন সিংহের প্রকাশিত অনুবাদ প্রশংসিত, এ জন্য সচরাচর আমি মূলের সহিত অনুবাদ না মিলাইয়াই অনুবাদ উদ্ধৃত করিয়াছি। কিন্তু কৃষ্ণের এই উক্তিতে কিছু অসঙ্গতি ঐ অনুবাদে দেখা যায়, যথা, যে কার্যের জন্য পাপভাগী হইতে হয় না এক স্থানে বলিয়াছেন, সেই কার্যকে কয় ছত্র পরে পাপবুদ্ধিজনিত বলিতেছেন। এজন্য মূলের সঙ্গে মিলাইয়া দেখিলাম। মূলে তত অসঙ্গতি দেখা যায় না। মূল উদ্ধৃত করিতেছি
রাজন্নেতে যদি ক্রুদ্ধা মাং নিগৃহ্নীয়ুরোজসা।
এতে বা মামহং বৈনাননুজানীহি পার্থিব ||
এতান্ হি সর্বান্ সংরদ্ধান্নিন্তুমহম্যূৎসহে।
ন চাহং নিন্দিতং কর্ম কুর্যাং পাপং কথঞ্চন ||
পাণ্ডবার্থে হি লুভ্যন্তঃ স্বার্থান্ হাস্যন্তি তে সুতাঃ।
এতে চেদেবমিচ্ছন্তি কৃতকার্যো যুধিষ্ঠিরঃ ||
অদ্যৈব হ্যহমেনাংশ্চ যে চৈনাননু ভারত।
নিগৃহ্য রাজন্ পার্থেভ্যো দদ্যাং কিং দুষ্কৃতঃ ভবেৎ ||
ইদন্তু ন প্রবর্তেয়ং নিন্দিতং কর্ম ভারত।
সন্নিধৌ তে মহারাজ ক্রোধজং পাপবুদ্ধিজম্ ||
এষ দুর্যোধনো রাজন্ যথেচ্ছতি তথাস্তু তৎ।
অহন্ত সর্বাংস্তনয়াননুজানামি তে নৃপ ||
“কিং দুষ্কৃতং ভবেৎ” ইতি বাক্যের অর্থ ঠিক “পাপভাগী হইতে হয় না,” এমত নহে। কথার ভাব ইহাই বুঝা যাইতেছে যে, “দুর্যোধন আমাকে বদ্ধ করিবার চেষ্টা করিতেছে; আমি যদি তাহাকে এখন বাঁধিয়া লইয়া যাই, তাহা হইলে কি এমন মন্দ কাজ হয়?” দুর্যোধনকে বদ্ধ করা মন্দ কাজ হয় না, কেন না, অনেকের হিতের জন্য একজনকে পরিত্যাগ করা শ্রেয় বলিয়া কৃষ্ণ স্বয়ংই ধৃতরাষ্ট্রকে পরামর্শ দিয়াছেন যে, ইহাকে বদ্ধ কর। তবে কৃষ্ণ এক্ষণে স্বয়ং এ কাজ করিলে ক্রোধবশতঃই তিনি ইহা করিতেছেন, ইহা বুঝাইবে। কেন না, এতক্ষণ তিনি নিজে তাহাকে বদ্ধ করিবার অভিপ্রায় করেন নাই। ক্রোধ যাহাতে প্রবর্তিত করে, তাহা পাপবুদ্ধিজনিত, সুতরাং আদর্শ পুরুষের পক্ষে নিন্দিত ও পরিহার্য কর্ম।
০৮ কৃষ্ণকর্ণসংবাদ
অষ্টম পরিচ্ছেদ—কৃষ্ণকর্ণসংবাদ
কৃষ্ণ সর্বভূতে দয়াময়। এই মহাযুদ্ধজনিত যে অসংখ্য প্রাণিক্ষয় হইবে, তাহাতে আর কোন ক্ষত্রিয় ব্যথিত নহে, কেবল কৃষ্ণই ব্যথিত। যখন প্রথম বিরাট নগরে যুদ্ধের প্রস্তাব হয়, তখন কৃষ্ণ যুদ্ধের বিরুদ্ধে মত দিয়াছিলেন। অর্জুন তাঁহাকে যুদ্ধে বরণ করিতে গেলে, কৃষ্ণ এ যুদ্ধে অস্ত্র ধরিবেন না ও যুদ্ধ করিবেন না প্রতিজ্ঞা করিলেন। কিন্তু তাহাতেও যুদ্ধ বন্ধ হইল না। অতএব উপায়ান্তর না দেখিয়া ভরসাশূন্য হইয়াও, সন্ধি স্থাপনের জন্য ধৃতরাষ্ট্র-সভায় গেলেন। তাহাতেও কিছু হইল না, প্রাণিহত্যা নিবারণ হয় না। তখন রাজনীতিজ্ঞ কৃষ্ণ জনসমূহের রক্ষার্থ উপায়ন্তর উদ্ভাবনে প্রবৃত্ত হইলেন।
কর্ণ মহাবীরপুরুষ। তিনি অর্জুনের সমকক্ষ রথী। তাঁহার বাহুবলেই দুর্যোধন আপনাকে বলবান্ মনে করেন। তাঁহার বলের উপর নির্ভর করিয়াই প্রধানতঃ তিনি পাণ্ডবদিগের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে প্রবৃত্ত। কর্ণের সাহায্য না পাইলে তিনি কদাচ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবেন না। কর্ণকে তাহার শত্রুপক্ষের সাহায্যে প্রবৃত্ত দেখিলেই অবশ্যই তিনি যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত হইবেন। যাহাতে তাহা ঘটে, তাহা করিবার জন্য কর্ণকে আপনার রথে তুলিয়া লইলেন। বিরলে কর্ণের সঙ্গে কথোপকথন আবশ্যক।
কৃষ্ণের এই অভিপ্রায় সিদ্ধির উপযোগী অন্যের অজ্ঞাত সহজ উপায়ও ছিল।
কর্ণ অধিরথনামা সূতের পুত্র বলিয়া পরিচিত। বস্তুতঃ তিনি অধিরথের পুত্র নহেন—পালিতপুত্র মাত্র। তাহা তিনি জানিতেন না। তাঁহার নিজ জন্মবৃত্তান্ত তিনি অবগত ছিলেন না। তিনি সূতপত্নী রাধার গর্ভজাত না হইয়া, কুন্তীর গর্ভজাত, সূর্যের ঔরসে তাঁহার জন্ম। তবে কুন্তীর কন্যাকালে তাঁহার জন্ম হইয়াছিল বলিয়া কুন্তী, পুত্র ভূমিষ্ঠ হইবার পরেই তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। বস্তুতঃ তিনি যুধিষ্ঠিরাদি পাণ্ডবগণের সহোদর ও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। এ কথা কুন্তী ভিন্ন আর কেহই জানিত না। আর কৃষ্ণ জানিতেন; তাঁহার অলৌকিক বুদ্ধির নিকটে সকল কথাই সহজে প্রতিভাত হইত। কুন্তী তাঁহার পিতৃষ্বসা; ভোজরাজগৃহে এ ঘটনা হয়, অতএব কৃষ্ণের মনুষ্যবুদ্ধিতেই ইহা জানিতে পারা অসম্ভব নহে।
কৃষ্ণ এই কথা এক্ষণে রথারূঢ় কর্ণকে শুনাইলেন। বলিলেন,
“শাস্ত্রজ্ঞেরা কহেন, যিনি যে কন্যার পাণিগ্রহণ করেন, তিনিই সেই কন্যার সহোঢ় ও কানীনপুত্রের পিতা। হে কর্ণ! তুমিও তোমার জননীর কন্যাকালাবস্থায় সমুৎপন্ন হইয়াছ, তন্নিমিত্ত তুমি ধর্মতঃ পুত্র; অতএব চল, ধর্মশাস্ত্রের বিরুদ্ধেও* তুমি রাজ্যেশ্বর হইবে।” তিনি কর্ণকে বুঝাইয়া দিলেন যে, তিনি জ্যেষ্ঠ, এ জন্য তিনিই রাজা হইবেন, অপর পঞ্চ পাণ্ডব তাঁহার আজ্ঞানুবর্তী হইয়া তাঁহার পরিচর্যায় নিযুক্ত থাকিবে।
কৃষ্ণের এই পরামর্শ সর্বজনের ধর্মবুদ্ধিকর ও হিতকর। প্রথমতঃ কর্ণের পক্ষে হিতকর, কেন না, তিনি রাজ্যেশ্বর হইবেন, এবং তাঁহার পক্ষে ধর্মানুমত, কেন না, ভ্রাতৃগণের প্রতি শত্রুভাব পরিত্যাগ করিয়া মিত্রভাব অবলম্বন করিবেন। ইহা দুর্যোধনাদির পক্ষেও পরম হিতকর, কেন না, যুদ্ধ হইলে তাঁহারা কেবল রাজ্যভ্রষ্ট নহে, সবংশে নিপাতপ্রাপ্ত হইবারই সম্ভাবনা। যুদ্ধ না হইলে তাঁহাদের প্রাণও বজায় থাকিবে, রাজ্যও বজায় থাকিবে, কেবল পাণ্ডবের ভাগ ফিরাইয়া দিতে হইবে। ইহাতে পাণ্ডবদিগেরও হিত ও ধর্ম, কেন না যুদ্ধরূপ নৃশংস ব্যাপারে প্রবৃত্ত না হইয়া, আত্মীয় স্বজন জ্ঞাতি বধ না করিয়াও, স্বরাজ্য কর্ণের সহিত ভোগ করিবেন। আর এ পরামর্শের পরম ধর্ম্যতা ও হিতকারিতা এই যে, ইহা দ্বারা অসংখ্য মনুষ্যগণের প্রাণ রক্ষা হইতে পারিবে।
কর্ণও কৃষ্ণের কথার উপযোগিতা স্বীকার করিলেন। তিনিও বুঝিয়াছিলেন যে, এ যুদ্ধে দুর্যোধনাদির রক্ষা নাই। কিন্তু কৃষ্ণের কথায় সম্মত হইলে তাঁহাকে কোন কোন গুরুতর অপরাধে অপরাধী হইতে হয়। অধিরথ ও রাধা তাঁহাকে প্রতিপালন করিয়াছে। তাহাদের আশ্রয়ে থাকিয়া তিনি সূতবংশে বিবাহ করিয়াছেন, এবং সেই ভার্যা হইতে তাঁহার পুত্র পৌত্রাদি জন্মিয়াছে। তাহাদিগকে কোন মতেই কর্ণ পরিত্যাগ করিতে পারেন না। আর তিনি ত্রয়োদশ বৎসর দুর্যোধনের আশ্রয়ে থাকিয়া রাজ্যভোগ করিয়াছেন; দুর্যোধন তাঁহারই ভরসা করেন; এখন দুর্যোধনকে পরিত্যাগ করিয়া পাণ্ডবপক্ষে গেলে লোকে তাঁহাকে কৃতঘ্ন, পাণ্ডবদিগের ঐশ্বর্যলোলুপ বা তাহাদের ভয়ে ভীত কাপুরুষ বলিবে। এই জন্য কর্ণ কোন মতেই কৃষ্ণের কথায় সম্মত হইলেন না।
কৃষ্ণ বলিলেন, “যখন আমার কথা তোমার হৃদয়ঙ্গম হইল না, তখন নিশ্চয়ই এই বসুন্ধরার সংহারদশা সমুপস্থিত হইয়াছে।”
কর্ণ উপযুক্ত উত্তর দিয়া, কৃষ্ণকে গাঢ় আলিঙ্গন করিয়া বিষণ্ণভাবে বিদায় গ্রহণ করিলেন।
কৃষ্ণচরিত্র বুঝিবার জন্য কর্ণচরিত্রের বিস্তারিত সমালোচনার প্রয়োজন নাই; এজন্য আমি তৎসম্বন্ধে কিছু বলিলাম না। কর্ণচরিত্র অতি মহৎ ও মনোহর।