“কৃষ্ণ রাত্রে চন্দ্রমার নবযৌবন (বিকাশ) দেখিয়া এবং রম্যা শারদীয়া নিশা দেখিয়া ক্রীড়াভিলাষী হইলেন। কখনও ব্রজের শুষ্কগোময়াকীর্ণ রাজপথে জাতদর্প বৃষগণকে বীর্যবান্ কৃষ্ণ যুদ্ধে সংযুক্ত করিতেন, কখনও বলদৃপ্ত গোপালগণকে যুদ্ধ করাইতেন, এবং কুম্ভীরের ন্যায় গোগণকে বনমধ্যে গ্রহণ করিতেন। কালজ্ঞ কৃষ্ণ আপনার কিশোর বয়সের সম্মানার্থ যুবতী গোপকন্যাগণের জন্য কাল নির্ণীত করিয়া রাত্রে তাহাদিগের সহিত আনন্দানুভাব করিলেন। সেই গোপসুন্দরীগণ নয়নাক্ষেপ দ্বারা ধরাগত চন্দ্রের মত তাঁহার সুন্দর মুখমণ্ডল পান করিল। সুবসন কৃষ্ণ, হরিতালার্দ্র পীত কৌষেয় বসন পরিহিত হইয়া কান্ততর হইলেন। অঙ্গদসমূহ ধারণপূর্বক বিচিত্র বনমালা দ্বারা শোভিত হইয়া গোবিন্দ সেই ব্রজ শোভিত করিতে লাগিলেন। সেই বাক্যালাপী কৃষ্ণের বিচিত্র চরিত্র দেখিয়া ঘোষমধ্যে গোপকন্যাগণ তখন তাঁহাকে দামোদর বলিত; পয়োধরস্থিতিহেতু ঊর্ধ্বমুখ হৃদয়ের দ্বারা নিপীড়িত করিয়া সেই বরাঙ্গনাগণ ভ্রামিত-চক্ষু বদনের দ্বারা তাঁহাকে দেখিতে লাগিল। ক্রীড়ানুরাগিণী গোপাঙ্গনাগণ পিতা, ভ্রাতা ও মাতা কর্তৃক নিবারিত হইয়াও রাত্রে কৃষ্ণের নিকটে গমন করিল। তাহারা সকলে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া সাজিয়া, মনোহর ক্রীড়া করিল; এবং যুগ্মে যুগ্মে কৃষ্ণচরিত গান করিল। বরাঙ্গনা তরুণীগণ কৃষ্ণলীলানুকারিণী, কৃষ্ণে প্রণিহিতলোচনা; এবং কৃষ্ণের গমনানুগামিনী হইল। কোন কোন ব্রজবালা হস্তাগ্রে তালকুট্টনপূর্বক কৃষ্ণচরিত আচরিত করিতে লাগিল। ব্রজযোষিদ্গণ, কৃষ্ণের নৃত্য, গীত, বিলাসস্মিতবীক্ষণ অনুকরণপূর্বক, সানন্দে ক্রীড়া করিতে লাগিল। কৃষ্ণপরায়ণা বরাঙ্গনাগণ ভাবনিস্যন্দমধুর গান করতঃ ব্রজে গিয়া সুখে বিচরণ করিতে লাগিল। সম্প্রমত্ত হস্তীকে করেণুগণ যেরূপ ক্রীড়া করায়, শুষ্ক গোময় দ্বারা দিগ্ধাঙ্গ সেই গোপীগণ সেইরূপ কৃষ্ণের অনুবর্তন করিল। সহাস্যবদনা কৃষ্ণমৃগলোচনা অন্য বনিতাগণ ভাবোৎফুল্ল লোচনের দ্বারা কৃষ্ণকে অতৃপ্ত হইয়া পান করিতে লাগিল। ক্রীড়ালালসাতৃষিতা গোপকন্যাগণ রাত্রিতে অনন্যক্রীড়াসক্ত হইয়া অব্জসঙ্কাশ কৃষ্ণমুখমণ্ডল পান করিতে লাগিল। কৃষ্ণা হা হা ইতি শব্দ করিয়া গান করিলে কৃষ্ণমুখনিঃসৃত সেই বাক্য, বরাঙ্গনাগণ আহ্লাদিত হইয়া গ্রহণ করিল। সেই গোপযোষিদ্গণের ক্রীড়াশ্রান্তিপ্রযুক্ত আকুলীকৃত সীমন্তগ্রথিত কেশদাম কুচাগ্রে বিস্রস্ত হইতে লাগিল। চক্রবালালঙ্কৃত শ্রীকৃষ্ণ এইরূপ সচন্দ্রা শারদী নিশাতে সুখে গোপীদিগের সহিত আনন্দ করিতে লাগিলেন।”
বিষ্ণুপুরাণ হইতে রাসলীলাতত্ত্ব অনুবাদ কালে ‘রম্’ ধাতু হইতে নিষ্পন্ন শব্দ সকলের যেরূপ ক্রীড়ার্থে অনুবাদ করিয়াছি; এই অনুবাদেও সেই সকল কারণে ঐ সকল শব্দের ক্রীড়ার্থ প্রতিশব্দ ব্যবহার করিয়াছি। জোর করিয়া বলা যাইতে পারে যে, অন্য কোনরূপ প্রতিশব্দ ব্যবহার হইতেই পারে না। যথা—
“তাস্তু পংক্তীকৃতাঃ সর্বা রময়ন্তি মনোরমম্।”
এখানে ক্রীড়ার্থে ভিন্ন রত্যর্থে ‘রময়ন্তি’ শব্দ কোন রকমেই বুঝা যায় না। যাঁহার অনুরূপ অনুবাদ করিয়াছেন, তাঁহারা পূর্বপ্রচলিত কুসংস্কারবশতঃই করিয়াছেন।
এই হল্লীষক্রীড়াবর্ণনা বিষ্ণুপুরাণকৃত রাসবর্ণনার অনুগামী। এমন কি, এক একটি শ্লোক উভয় গ্রন্থে প্রায় একই। যথা, বিষ্ণুপুরাণে আধে —
“তা বার্যমাণাঃ পতিভিঃ পিতৃভিঃ ভ্রাতৃভিস্তথা।
কৃষ্ণং গোপাঙ্গানা রাত্রৌ মৃগয়ন্তে রতিপ্রিয়াঃ ||”
হরিবংশে আছে–
“তা বার্যমাণাঃ পিতৃভিঃ ভ্রাতৃভির্মাতৃভিস্তথা।
কৃষ্ণং গোপাঙ্গনা রাত্রৌ রময়ন্তি রতিপ্রিয়া ||”
তবে বিষ্ণুপুরাণের অপেক্ষা হরিবংশের বর্ণনা সংক্ষিপ্ত। অন্যান্য বিষয়ে সচরাচর সেরূপ দেখা যায় না। সচরাচর দেখা যায়, বিষ্ণুপুরাণে যাহা সংক্ষিপ্ত, হরিবংশে তাহা বিস্তৃত এবং নানা প্রকার নূতন উপন্যাস ও অলঙ্কারে অলঙ্কৃত। হরিবংশে রাসলীলার এইরূপ সংক্ষেপ বর্ণনার একটু কারণও আছে। উভয় গ্রন্থ সবিস্তারে তুলনা করিয়া দেখিলে বুঝা যায় যে, কবিত্বে, গাম্ভীর্যে, পাণ্ডিত্যে এবং ঔদার্যে হরিবংশকার বিষ্ণুপুরাণকারের অপেক্ষা অনেক লঘু। তিনি বিষ্ণুপুরাণের রাসবর্ণনার নিগূঢ় তাৎপর্য এবং গোপীগণকৃত ভক্তিযোগ দ্বারা কৃষ্ণে একাত্মতা প্রাপ্তি বুঝিতে পারেন নাই। তাহা না বুঝিতে পারিয়াই সেখানে বিষ্ণুপুরাণকার লিখিয়াছেন,—
“কাচিৎ প্রবিলসদ্বাহুঃ পরিরভ্য চুচুম্ব তম্।”
সেখানে হরিবংশকার লিখিয়া বসিয়াছেন,
“তাস্তং পয়োধরোত্তানৈরুরোভিঃ সমপীড়য়ন্।” ইত্যাদি
প্রভেদটুকু এই যে, বিষ্ণুপুরাণের চপলা বালিকা আনন্দে চঞ্চলা, আর হরিবংশের এই গোপীগণ বিলাসিনীর ভাব প্রকাশ করিতেছে। হরিবংশকারের অনেক স্থলে বিলাসপ্রিয়তার মাত্রাধিক্য দেখা যায়।
আর আর কথা বিষ্ণুপুরাণে রাসলীলা সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছি, হরিবংশের এই হল্লীষক্রীড়া সম্বন্ধেও বর্তে।
উপরিলিখিত শ্লোকগুলি ভিন্ন হরিবংশে ব্রজগোপীদের সম্বন্ধে আর কিছুই নাই।
০৭ ব্রজ গোপী-ভাগবত – বস্ত্রহরণ
সপ্তম পরিচ্ছেদ—ব্রজ গোপী-ভাগবত
বস্ত্রহরণ
শ্রীমদ্ভাগবতে ব্রজগোপীদিগের সহিত শ্রীকৃষ্ণের সম্বন্ধ কেবল রাসনৃত্যে পর্যাপ্ত হয় নাই। ভাগবতকার গোপীদিগের সহিত কৃষ্ণলীলার বিশেষ বিস্তার করিয়াছেন। সময়ে সময়ে তাহা আধুনিক রুচির বিরুদ্ধে। কিন্তু সেই সকল বর্ণনার বাহ্যদৃশ্য এখনকার রুচিবিগর্হিত হইলেও অভ্যন্তরে অতি পবিত্র ভক্তিতত্ত্ব নিহিত আছে। হরিবংশকারের ন্যায় ভাগবতকার বিলাস-প্রিয়তা-দোষে দূষিত নহেন। তাঁহার অভিপ্রায় অতিশয় নিগূঢ় এবং অতিশয় বিশুদ্ধ।
দশম স্কন্ধের ২১ অধ্যায়ে প্রথমতঃ গোপীদিগের পূর্বরাগ বর্ণিত হইয়াছে। তাহারা শ্রীকৃষ্ণের বেণুরব শ্রবণ করিয়া মোহিত হইয়া পরস্পরের নিকট কৃষ্ণানুরাগ ব্যক্ত করিতেছে। সেই পূর্বানুরাগ বর্ণনায় কবি অসাধারণ কবিত্ব প্রকাশ করিয়াছেন। তার পর তাহা স্পষ্টীকৃত করিবার জন্য একটি উপন্যাস রচনা করিয়াছেন। সেই উপন্যাস “বস্ত্রহরণ” বলিয়া প্রসিদ্ধ। বস্ত্রহরণের কোন কথা মহাভারতে, বিষ্ণুপুরাণে বা হরিবংশে নাই, সুতরাং উহা ভাগবতকারের কল্পনাপ্রসূত বলিয়া বিবেচনা করিতে হইবে। বৃত্তান্তটা আধুনিক রুচিবিরুদ্ধ হইলেও আমরা তাহা পরিত্যাগ করিতে পারিতেছি না, কেন না, ভাগবতব্যাখ্যাত রাসলীলাকথনে আমরা প্রবৃত্ত, এবং সেই রাসলীলার সঙ্গে ইহার বিশেষ সম্বন্ধ।
কৃষ্ণানুরাগবিবশা ব্রজগোপীগণ কৃষ্ণকে পতিভাবে পাইবার জন্য কাত্যায়নীব্রত করিল। ব্রতের নিয়ম এক মাস। এই এক মাস তাহারা দলবদ্ধ হইয়া আসিয়া প্রত্যূষে যমুনাসলিলে অবগাহন করিত। স্ত্রীলোকদিগের জলাবগাহন বিষয়ে একটা কুৎসিত প্রথা এ কালেও ভারতবর্ষের অনেক প্রদেশে প্রচলিত আছে। স্ত্রীলোকেরা অবগাহনকালে নদীতীরে বস্ত্রগুলি ত্যাগ করিয়া, বিবস্ত্রা হইয়া জলমগ্না হয়। সেই প্রথানুসারে এই ব্রজাঙ্গনাগণ কূলে বসন রক্ষা করিয়া বিবস্ত্রা হইয়া অবগাহন করিত। মাসান্তে যে দিন ব্রত সম্পূর্ণ হইবে, সে দিনও তাহারা ঐরূপ করিল। তাহাদের কর্মফল (উভয়ার্থে) দিবার জন্য সেই দিন শ্রীকৃষ্ণ সেইখানে উপস্থিত হইলেন। তিনি পরিত্যক্ত বস্ত্রগুলি সংগ্রহ করিয়া তীরস্থ কদম্ববৃক্ষে আরোহণ করিলেন।
গোপীগণ বড় বিপন্না হইল। তাহারা বিনাবস্ত্রে উঠিতে পারে না; এ দিকে প্রাতঃসমীরণে জলমধ্যে শীতে প্রাণ যায়। তাহারা কণ্ঠ পর্যন্ত নিমগ্ন হইয়া, শীতে কাঁপিতে কাঁপিতে, কৃষ্ণের নিকট বস্ত্রভিক্ষা করিতে লাগিল। কৃষ্ণ সহজে বস্ত্র দেন না—গোপীদিগের “কর্মফল” দিবার ইচ্ছা আছে। তার পর যাহা ঘটিল, তাহা আমরা স্ত্রীলোক বালক প্রভৃতির বোধগম্য বাঙ্গালা ভাষায় কোন মতেই প্রকাশ করিতে পারি না। অতএব মূল সংস্কৃতই বিনানুবাদে উদ্ধৃত করিলাম।
ব্রজগোপীগণ কৃষ্ণকে বলিতে লাগিল;—
মহিনয়ং ভো কৃথাস্ত্বান্তু নন্দগোপসুতং প্রিয়ম্।
জানীমোহঙ্গ ব্রজশ্লাঘ্যং দেহি বাসাংসি বেপিতাঃ ||
শ্যামসুন্দর তে দাস্য করবাম তবোদিতম্।
দেহি বাসাংসি ধর্মজ্ঞ নোচেদ্রাজ্ঞে ব্রুবাম হে ||
শ্রীভগবানুবাচ।
ভবত্যো যদি মে দাস্যো ময়োক্তঞ্চ করিষ্যথ।
অত্রাগত্য স্ববাসাংসি প্রতীচ্ছত শুচিস্মিতাঃ।
নোচেন্নাহং প্রদাস্যে কিং ক্রুদ্ধো রাজা করিষ্যতি ||
ততো জলাশয়ায়ৎ সর্বা দারিকাঃ শীতবেপিতাঃ।
পাণিভ্যাং * * আচ্ছাদ্য প্রোক্তেরুঃ শীতকর্ষিতাঃ ||
ভগবানাহ তা বীক্ষ্য শুদ্ধভাবপ্রসাদিতঃ।
স্কন্ধে নিধায় বাসাংসি প্রীতঃ প্রোবাচ সস্মিতম্ ||
যূয়ং বিবস্ত্রা যদপো ধৃতব্রতা ব্যগাহতৈতত্তদু দেবহেলম্।
বদ্ধাঞ্জলিং মূদ্ধর্ণ্যপনুত্তয়েহংহসঃ কৃত্বা নমো* বসনং প্রগৃহ্যতাম্ ||
ইত্যচ্যুতেনাভিহিতং ব্রজবালা নত্বা বিবস্ত্রাপ্লবনং ব্রতচ্যুতিম্।
তৎপূর্তিকামাস্তদশেষকর্মণাং সাক্ষাৎকৃতং নেমুরবদ্যমৃগ্ যতঃ ||
তাস্তথাবনতা দৃষ্ট্বা ভগবান্ দেবকীসুতঃ।
বাসাংসি তাভ্যঃ প্রাযচ্ছৎ করুণস্তেন তোষিতঃ ||
শ্রীমদ্ভাগবতম্, ১০ম স্কন্দঃ, ২২ অধ্যায়।
অন্তনির্হিত ভক্তিতত্ত্বটা এই। ঈশ্বরকে ভক্তি দ্বারা পাইবার প্রধান সাধনা, ঈশ্বরে সর্বার্পণ। ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলিয়াছেন—
“যৎ করোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদাসি যৎ।
যত্তপস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুষ্ব মদর্পণম্ ||”
গোপীগণ শ্রীকৃষ্ণে সর্বার্পণ করিল। স্ত্রীলোক, যখন সকল পরিত্যাগ করিতে পারে, তখনও লজ্জা ত্যাগ করিতে পারে না। ধন ধর্ম কর্ম ভাগ্য—সব যায়, তথাপি স্ত্রীলোকের লজ্জা যায় না। লজ্জা স্ত্রীলোকের শেষ রত্ন। যে স্ত্রীলোক, অপরের জন্য লজ্জা পরিত্যাগ করিল, সে তাহাকে সব দিল। এই স্ত্রীগণ শ্রীকৃষ্ণে লজ্জাও অর্পিত করিল। এ কামাতুরার লজ্জার্পণ নহে—লজ্জাবিবশার লজ্জার্পণ। অতএব তাহারা ঈশ্বরে সর্বস্বার্পণ করিল। কৃষ্ণও তাহা ভক্ত্যুপহার বলিয়া গ্রহণ করিলেন। তিনি বলিলেন, “আমাতে যাহাদের বুদ্ধি আরোপিত হইয়াছে, তাহাদের কামনা কামার্থে কল্পিত হয় না। যব ভর্জিত এবং ক্কাথিত হইলে, বীজত্বে সমর্থ হয় না।” অর্থাৎ যাহারা কৃষ্ণকামিনী, তাহাদিগের কামাবশেষ হয়। আরও বলিলেন, “তোমরা যে জন্য ব্রত করিয়াছ, আমি তাহা রাত্রে সিদ্ধ করিব।”
এখন গোপীগণ কৃষ্ণকে পতিস্বরূপ পাইবার জন্যই ব্রত করিয়াছিল। অতএব কৃষ্ণ, তাহাদের কামনাপূরণ করিতে স্বীকৃত হইয়া, তাহাদের পতিত্ব স্বীকার করিলেন। কাজেই বড় নৈতিক গোলযোগ উপস্থিত। এই গোপাঙ্গনাগণ পরপত্নী, তাহাদের পতিত্ব স্বীকার করায়, পরদারাভিমর্ষণ স্বীকার করা হইল। কৃষ্ণে এ পাপারোপণ কেন?
ইহার উত্তর আমার পক্ষে অতি সহজ। আমি ভূরি ভূরি প্রমাণের দ্বারা বুঝিয়াছি যে, এ সকল পুরাণকারকল্পিত উপন্যাসমাত্র, ইহার কিছু মাত্র সত্যতা নাই। কিন্তু পুরাণকারের পক্ষে উত্তর তত সহজ নহে। তিনিও পরিক্ষিতের প্রশ্নানুসারে শুকমুখে একটা উত্তর দিয়াছেন। যথাস্থানে তাহার কথা বলিব। কিন্তু আমাকেও এখানে বলিতে হইবে যে, হিন্দুধর্মের ভক্তিবাদানুসারে, কৃষ্ণকে এই গোপীগণপতিত্ব অবশ্য স্বীকার করিতে হয়। ভগবদ্গীতায় কৃষ্ণ নিজে বলিয়াছেন,—
“যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।”
“যে, যে ভাবে আমাকে ভজনা করে, “আমি তাহাকে সেই ভাবে অনুগ্রহ করি।” অর্থাৎ যে আমার নিকট বিষয়ভোগ কামনা করে, তাহাকে আমি তাহাই দিই। যে মোক্ষ কামনা করে, তাহাকে মোক্ষ দিই। বিষ্ণুপুরাণে আছে, দেবমাতা অদিতি কৃষ্ণ(বিষ্ণু)কে বলিতেছেন যে, আমি তোমাকে তোমাকে পুত্রভাবেই পাইয়াছি। এই ভাগবতেই আছে যে, বসুদেব দেবকী জগদীশ্বরকে পুত্রভাবে কামনা করিয়াছিলেন বলিয়াই তাঁহাকে পুত্রভাবে পাইয়াছেন। অতএব গোপীগণ তাঁহাকে পতিভাবে পাইবার জন্য যথোপযুক্ত সাধনা করিয়াছিল বলিয়া কৃষ্ণকে তাহারা পতিভাবে পাইল।
যদি তাই হইল, তবে তাহাদের অধর্ম কি? ঈশ্বর প্রাপ্তিতে অধর্ম আবার কি? পাপের দ্বারা, পুণ্যময়, পুণ্যের আদিভূত স্বরূপ জগদীশ্বরকে কি পাওয়া যায়? পাপ-পুণ্য কি? যাহার দ্বারা জগদীশ্বরের সন্নিধি উপস্থিত হইতে পারি, তাহাই পুণ্য—তাহাই ধর্ম, তাহার বিপরীত যাহা, তাহাই পাপ—তাহাই অধর্ম।
পুরাণকার এই তত্ত্ব বিশদ করিবার জন্য পাপসংস্পর্শের পথমাত্র রাখেন নাই। তিনি ২৯ অধ্যায়ে বলিয়াছেন, যাহারা পতিভাবে কৃষ্ণকে কামনা না করিয়া উপপতিভাবে তাঁহাকে কামনা করিয়াছিল, তাহারা তাঁহাকে সশরীরে পাইল না; তাহাদের পতিগণ তাহাদিগকে আসিতে দিল না; কৃষ্ণচিন্তা করিয়া তাহারা প্রাণত্যাগ করিল।
“তমেব পরমাত্মানাং জারবুদ্ধ্যাপি সঙ্গতাঃ।
জহুর্গুণময়ং দেহং সদ্যঃ প্রক্ষীণবন্ধনা : ||” ১০।২৯।১০
কৃষ্ণপতি ভিন্ন অন্য পতি যাহাদের স্মরণ মাত্রে ছিল, কাজেই তাহারা কৃষ্ণকে উপপতি ভাবিল। কিন্তু অন্য পতি স্মৃতিমাত্রে থাকায়, তাহারা কৃষ্ণ সম্বন্ধে অনন্যচিন্তা হইতে পারিল না। তাহারা সিদ্ধ, বা ঈশ্বরপ্রাপ্তির অধিকারিণী হইল না। যতক্ষণ জারবুদ্ধি থাকিবে, ততক্ষণ পাপবুদ্ধি থাকিবে, কেন না, জারানুগমন পাপ। যতক্ষণ জারবুদ্ধি থাকিবে, ততক্ষণ কৃষ্ণে ঈশ্বরজ্ঞান হইতে পারে না—কেন না, ঈশ্বরে জারজ্ঞান হয় না—ততক্ষণ কৃষ্ণকামনা, কামকামনা মাত্র। ঈদৃশী গোপী কৃষ্ণপরায়ণা হইলেও সশরীরে কৃষ্ণকে পাইতে অযোগ্যা।
অতএব এই পতিভাবে জগদীশ্বরকে পাইবার কামনায় গোপীদিগের পাপমাত্র রহিল না। গোপীদিগের রহিল না, কিন্তু কৃষ্ণের? এই কথার উত্তরে বিষ্ণুপুরাণকার যাহা বলিয়াছেন, ভাগবতকারও তাহাই বলিয়াছেন। ঈশ্বরের আবার পাপপূণ্য কি? তিনি আমাদের মত শরীরী নহেন, শরীরী ভিন্ন ইন্দ্রিয়পরতা বা তজ্জনিত দোষ ঘটে না। তিনি সর্বভূতে আছেন, গোপীগণেও আছেন, গোপীগণের স্বামীতেও আছেন। তাঁহার কর্তৃক পরদারাভিমর্ষণ সম্ভবে না।
এ কথায় আমাদের একটা আপত্তি আছে। ঈশ্বর এখানে শরীরী, এবং ইন্দ্রিয়বিশিষ্ট। যখন ঈশ্বর ইচ্ছাক্রমে মানবশরীর গ্রহণ করিয়াছেন, তখন মানবধর্মাবলম্বী হইয়া কার্য করিবার জন্যই শরীর গ্রহণ করিয়াছেন। মানবধর্মীর পক্ষে গোপবধূগণ পরস্ত্রী, এবং তদভিগমন পরদারপাপ। কৃষ্ণই গীতায় বলিয়াছেন, লোকশিক্ষার্থ তিনি কর্ম করিয়া থাকেন। লোকশিক্ষক পারদারিক হইলে, পাপচারী ও পাপের শিক্ষক হইলেন। অতএব পুরাণকারকৃত দোষক্ষালন খাটে না। এইরূপ দোষক্ষালনের কোন প্রয়োজনও নাই। ভাগবতকার নিজেই কৃষ্ণকে এই রাসমণ্ডলমধ্যে জিতেন্দ্রিয় বলিয়া পরিচিত করিয়াছেন। যথা—
এবং শশাঙ্কাংশুবিরাজিতা নিশাঃ স সত্যকামোহনুরতাবলাগণঃ।
সিষেব আত্মন্যবরুদ্ধসৌরতঃ সর্বাঃ শরৎকাব্যকথারসাশ্রয়াঃ ||
শ্রীমদ্ভাগবতম্, ১০ স্ক, ৩৩ অঃ, ২৬
তবে, বিষ্ণুপুরাণকারের অপেক্ষাও ভাগবতকার প্রগাঢ়তায় এবং ভক্তিতত্ত্বের পারদর্শিতায় অনেক শ্রেষ্ঠ। স্ত্রীজাতী, জগতের মধ্যে পতিকেই প্রিয়বস্তু বলিয়া জানে; যে স্ত্রী, জগদীশ্বরে পরমভক্তিমতী, সে সেই পতিভাবেই তাঁহাকে পাইবার আকাঙ্ক্ষা করিল—ইংরেজি পড়িয়া আমরা যাই বলি—কথাটা অতি রমণীয়!—ইহাতে কত মনুষ্যহৃদয়াভিজ্ঞতার এবং ভগবদ্ভক্তির সৌন্দর্যগ্রাহিতার পরিচয় দেয়। তারপর যে পতিভাবে তাঁহাকে দেখিল, সেই পাইল,—যাহার জারবুদ্ধি রহিল, সে পাইল না, একথাও ভক্তির ঐকান্তিকতা বুঝাইবার কি সুন্দর উদাহরণ! কিন্তু আর একটা কথায় পুরাণকার বড় গোলযোগের সূত্রপাত করিয়াছেন। পতিত্বে একটা ইন্দ্রিয়সম্বন্ধ আছে। কাজে কাজেই সেই ইন্দ্রিয়সম্বন্ধ ভাগবতোক্ত রাসবর্ণনের ভিতরে প্রবেশ করিয়াছে। ভাগবতোক্ত রাস, বিষ্ণুপুরাণের ও হরিবংশের রাসের ন্যায় কেবল নৃত্যগীত নয়। যে কৈলাসশিখরে তপস্বী কপর্দীর রোষানলে ভস্মীভূত, সে বৃন্দাবনে কিশোর রাসবিহারীর পদাশ্রয়ে পুনর্জীবনার্থ ধূমিত। অনঙ্গ এখানে প্রবেশ করিয়াছেন। পুরাণকারের অভিপ্রায় কদর্য নয়; ঈশ্বরপ্রাপ্তিজনিত মুক্ত জীবের যে আনন্দ, যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্ ইতি বাক্য স্মরণ রাখিয়া, তাহাই পরিস্ফুট করিতে গিয়াছেন। কিন্তু লোকে তাহা বুঝিল না। তাঁহার রোপিত ভগবদ্ভক্তিপঙ্কজের মূল, অতল জলে ডুবিয়া রহিল—উপরে কেবল বিকশিত কুসুমদামের ভাসিতে লাগিল। যাহারা উপরে ভাসে—তলায় না, তাহারা কেবল সেই কুসুমদামের মালা গাঁথিয়া, ইন্দ্রিয়পরতাময় বৈষ্ণবধর্ম প্রস্তুত করিল। যাহা ভাগবতে নিগূঢ় ভক্তিতত্ত্ব, জয়দেব গোস্বামীর হাতে তাহা মদনধর্মোৎসব। এত কাল, আমাদের জন্মভূমি সেই মদনধর্মোৎসবভারাক্রান্ত। তাই কৃষ্ণচরিত্রের অভিনব ব্যাখ্যার প্রয়োজন হইয়াছে। কৃষ্ণচরিত্র, বিশুদ্ধিতায়, সর্বগুণময়ত্বে জগতে অতুল্য। আমার ন্যায় অক্ষম, অধম ব্যক্তি সেই পবিত্র চরিত্র গীত করিলেও লোকে তাহা শুনিবে, তাই এই অভিনব কৃষ্ণগীতি রচনায় সাহস করিয়াছি।
০৮ ব্রজগোপী-ভাগবত – ব্রাহ্মাণকন্যা
বস্ত্রহরণের নিগূঢ় তাৎপর্য আমি যেরূপ বুঝাইয়াছি, তৎসম্বন্ধে একটা কথা বাকি আছে।
“যৎ করোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদাসি যৎ।
যত্তপস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুষ্ব মদর্পণম্ ||
ইতি বাক্যের অনুবর্তী হইয়া যে জগদীশ্বরে সর্বস্ব অর্পণ করিতে পারে, সেই ঈশ্বরকে পাইবার অধিকারী হয়। বস্ত্রহরণকালে ব্রজগোপীগণ শ্রীকৃষ্ণে সর্বস্বার্পণ ক্ষমতা দেখাইল, এজন্য তাহারা কৃষ্ণকে পাইবার অধিকারিণী হইল। আর একটি উপন্যাস রচনা করিয়া ভাগবতকার এই তত্ত্ব আরও পরিষ্কৃত করিয়াছেন। সে উপন্যাস এই,—
একদা গোচারণকালে বনমধ্যস্থ গোপালগণ অত্যন্ত ক্ষুধার্ত হইয়া কৃষ্ণের নিকট আহার্য প্রার্থনা করিল। অদূরবর্তী কোন স্থানে কতকগুলি ব্রাহ্মণ যজ্ঞ করিতেছিলেন। কৃষ্ণ গোপালগণকে উপদেশ করিলেন যে, সেইখানে গিয়া আমার নাম করিয়া অন্নভিক্ষা চাও। গোপালেরা যজ্ঞস্থলে গিয়া কৃষ্ণের নাম করিয়া অন্নভিক্ষা চাহিল। ব্রাহ্মণেরা তাহাদিগকে কিছু না দিয়া তাড়াইয়া দিল। গোপালগণ কৃষ্ণের নিকট প্রত্যাগমন করিয়া সেই সকল কথা জানাইল। কৃষ্ণ তখন বলিলেন যে, তোমরা পুনর্বার যজ্ঞস্থলে গিয়া অন্তঃপুরবাসিনী ব্রাহ্মণকন্যাদিগের নিকট আমার নাম করিয়া অন্নভিক্ষা চাও। গোপালেরা তাহাই করিল। ব্রাহ্মণকন্যাগণ কৃষ্ণের নাম শুনিয়া গোপালদিগকে প্রভূত অন্নব্যঞ্জন প্রদান করিল, এবং কৃষ্ণ অদূরে আছেন শুনিয়া তাঁহার দর্শনে আসিল। তাহারা কৃষ্ণকে ঈশ্বর বলিয়া জানিয়াছিল। তাহারা কৃষ্ণকে দর্শন করিলে কৃষ্ণ তাহাদিগকে গৃহে যাইতে অনুমতি করিলেন। ব্রাহ্মণকন্যাগণ বলিলেন, “আমরা আপনার ভক্ত, আমরা পিতা, মাতা, ভ্রাতা, পুত্রাদি ত্যাগ করিয়া আসিয়াছি—তাঁহারা আর আমাদিগকে গ্রহণ করিবেন না। আমরা আপনার পদাগ্রে পতিত হইতেছি, আমাদিগের অন্যা গতি আপনি বিধান করুন।” কৃষ্ণ তাঁহাদিগকে গ্রহণ করিলেন না, বলিলেন, “দেখ, অঙ্গসঙ্গই কেবল অনুরাগের কারণ নহে। তোমরা আমাতে চিত্ত নিবিষ্ট কর, আমাকে অচিরে প্রাপ্ত হইবে। আমার শ্রবণ, দর্শন, ধ্যান, অনুকীর্তনে আমাকে পাইবে—সন্নিকর্ষে সেরূপ পাইবে না। অতএব তোমরা গৃহে ফিরিয়া যাও।” তাহারা ফিরিয়া গেল।
এখন এই ব্রাহ্মণকন্যাগণ কৃষ্ণকে পাইবার যোগ্য কি করিয়াছিলেন? কেবলমাত্র পিত্রাদি স্বজন ত্যাগ করিয়া আসিয়াছিলেন। কুলটাগণ সামান্য জারানুগমনার্থেও তাহা করিয়া থাকে। ভগবানে সর্বস্বার্পণ তাঁহাদিগের হয় নাই, সিদ্ধ হইবার তাঁহারা অধিকারিণী হন নাই। অতএব সিদ্ধ হইবার প্রথম সোপান শ্রবণ-মনন-নিদিধ্যাসনাদির জন্য তাঁহাদিগকে উপদিষ্ট করিয়া কৃষ্ণ তাঁহাদিগকে প্রত্যাখ্যান করিলেন। পবিত্রব্রাহ্মণকুলোদ্ভূতা সাধনাভাবে যাহাতে অধিকারিণী হইল না, সাধনাপ্রভাবে গোপকন্যাগণ তাহাতে অধিকারিণী হইল। পূর্বরাগবর্ণনস্থলে, ভাগবতকার গোপকন্যাদিগের শ্রবণ মনন নিদিধ্যাসন সবিস্তারে বুঝাইয়াছেন।
এক্ষণে আমরা ভাগবতে বিখ্যাত রাসপঞ্চাধ্যায়ে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। কিন্তু এই রাসলীলাতত্ত্ব বস্ত্রহরণোপলক্ষে আমি এত সবিস্তারে বুঝাইয়াছি যে, এই রাসপঞ্চাধ্যায়ের কথা অতি সংক্ষেপে বলিলেই চলিবে।
০৯ ব্রজগোপী-ভাগবত – রাসলীলা
নবম পরিচ্ছেদ—ব্রজগোপী-ভাগবত