“ইদমুচ্ছ্বসিতালকং মুখং
তব বিশ্রান্তকথং দুনোতি মাম্।
নিশি সুপ্তমিবৈকপঙ্কজং
বিরতাভ্যন্তরষট্ পদস্বনম্।।”18
এটি যৌবনের কান্না।-
তারপর রতিবিলাপে,
“গত এব ন তে নিবর্ত্ততে স সখা দীপ ইবানিলাহতঃ।
অহমস্য দশেব পশ্য মামবিসহ্যব্যসনেন ধূমিতাম্।।”19
এটি বুড়া বয়সের কান্না।-
তা যাই হউক, কালিদাস বুড়া বয়সের গৌরব বুঝিলেও কখন বৃদ্ধের কপালে মুনিবৃত্তি লিখিতেন না। বিস্মার্ক, মোলটকে ও ফ্রেডেরিক বুড়া; তাঁহারা মুনিবৃত্তি অবলম্বন করিলে-জর্ম্মান ঐকজাত্য কোথা থাকিত? টিয়র প্রাচীন-টিয়র মুনিবৃত্তি অবলম্বন করিলে ফ্রান্সের স্বাধীনতা এবং সাধারণতন্ত্রাবলম্বন কোথা থাকিত? গ্লাডষ্টোন এবং ডিশ্রেলি বুড়া-তাঁহারা মুনিবৃত্তি অবলম্বন করিলে পার্লিয়ামেণ্টের রিফর্ম এবং আয়রিশ্ চর্চ্চের ডিসেষ্টাব্লিশমেণ্ট কোথা থাকিত?
প্রাচীন বয়সই বিষয়ৈষার সময়। আমি অন্ত্র-দন্তহীন ত্রিকালের বুড়ার কথা বলিতেছি না-তাঁহারা দ্বিতীয় শৈশবে উপস্থিত। যাঁহারা আর যুবা নাই বলিয়াই বুড়া, আমি তাঁহাদিগের কথা বলিতেছি। যৌবন কর্ম্মের সময় বটে, কিন্তু তখন কাজ ভাল হয় না। একে বুদ্ধি অপরিপক্ক, তাহাতে আবার রাগ দ্বেষ ভোগাসক্তি, এবং স্ত্রীগণের অনুসন্ধানে তাহা সতত হীনপ্রভ; এজন্য মনুষ্য যৌবন সচরাচর সেই কার্য্যক্ষম হয় না। যৌবন অতীতে মনুষ্য বহুদর্শী, স্থিরবুদ্ধি, লব্ধপ্রতিষ্ঠ, এবং ভোগাসক্তির অনধীন, এজন্য সেই কার্য্যকারিতার সময়। এই জন্য, আমার পরামর্শ যে, বুড়া হইয়াছি বলিয়া, কেহ স্বকার্য্য পরিত্যাগ করিয়া মুনিবৃত্তির ভান করিবে না। বার্দ্ধক্যেও বিষয়চিন্তা করিবে।
তোমরা বলিবে, এ কথা বলিতে হইবে না; কেহই জীবন থাকিতে ও শক্তি থাকিতে বিষয়-চেষ্টা পরিত্যাগ করে না। মাতৃস্তনপান অবধি উইল করা পর্য্যন্ত আবালবৃদ্ধ কেবল বিষয়ান্বেষণে বিব্রত। সত্য, কিন্তু আমি সেরূপ বিষয়ানুসন্ধানে বৃদ্ধকে নিযুক্ত করিতে চাহিতেছি না। যৌবনে যে কাজ করিয়াছি, সে আপনার জন্য; তার পর যৌবন গেলে যত কাজ করিবে, পরের জন্য। ইহাই আমার পরামর্শ। ভাবিও না যে, আজিও আপনার কাজ করিয়া উঠিতে পারিলাম না-পরের কাজ করিব কি? আপনার কাজ ফুরায় না-যদি মনুষ্যজীবন লক্ষ বর্ষ পরিমিত হইত-তবু আপনার কাজ ফুরাইত না-মনুষ্যের স্বার্থপরতার সীমা নাই-অন্ত নাই। তাই বলি, বার্দ্ধক্যে আপনার কাজ ফুরাইয়াছে, বিবেচনা করিয়া পরহিতে রত হও। এই মুনিবৃত্তি যথার্থ মুনিবৃত্তি। এই মুনিবৃত্তি অবলম্বন কর।
যদি বল, বার্দ্ধক্যেও যদি আপনার জন্য হউক, বিষয়-কার্য্যে নিরত থাকিব, তবে ঈশ্বরচিন্তা করিব কবে?- পরকালের কাজ করিব কবে? আমি বলি, আশৈশব পরকালের কাজ করিবে, শৈশব হইতে জগদীশ্বরকে হৃদয়ে প্রধান স্থান দিবে। যে কাজ সকল কাজের উপর কাজ, তাহা প্রাচীন কালের জন্য তুলিয়া রাখিবে কেন? শৈশবে, কৈশোরে, যৌবনে, বার্দ্ধক্যে, সকল সময়েই ঈশ্বরকে ডাকিবে। ইহার জন্য বিশেষ অবসরের প্রয়োজন নাই-ইহার জন্য অন্য কোন কার্য্যের ক্ষতি নাই। বরং দেখিবে, ঈশ্বরভক্তির সঙ্গে মিলিত হইলে সকল কার্য্যই মঙ্গলপ্রদ, যশস্কর এবং পরিশুদ্ধ হয়।
আমি বুঝিতে পারিতেছি, অনেকের এ সকল কথা ভাল লাগিতেছে না। ইঁহারা এতক্ষণ বলিতেছেন, তরঙ্গিণী যুবতীর কথা হইতেছিল-হইতে হইতে আবার ঈশ্বরের নাম কেন? এই মাত্র বুড়া বয়সের ঢেঁকি পাতিয়া, বঙ্গদর্শনের জন্য ধান ভানিতেছিলে-আবার এ শিবের গীত কেন? দোষ হইতেছে স্বীকার করি, কিন্তু মনে মনে বোধ হয়, সকল কাজেই একটু একটু শিবের গীত ভাল।
ভাল হউক বা না হউক, প্রাচীনের অন্য উপায় নাই। তোমার তরঙ্গিণী হেমাঙ্গিণী সুরঙ্গিণী কুরঙ্গিণী দল আর আমার দিকে ঘেঁষিবে না। তোমার মিল, কোমত, সেপন্সর, ফূয়রবাক মনোরঞ্জন করিতে পারে না। তোমার দর্শন, বিজ্ঞান, সকলই অসার-সকলই অন্ধের মৃগয়া। আজিকার বর্ষার দুর্দিনে-আজি এ কালরাত্রির শেষ কুলগ্নে,-এ নক্ষত্রহীন অমাবস্যার নিশির মেঘাগমে,-আমায় আর কে রাখিবে? এ ভবনদীর তপ্ত সৈকতে, প্রখরবাহিনী বৈতরিণীর আবর্ত্ত-ভীষণ উপকূলে-এ দুস্তর পারাবারের প্রথম তরঙ্গমালার প্রঘাতে, আর আমায় কে রক্ষা করিবে? অতি বেগে প্রবল বাতাস বহিতেছে-অন্ধকার, প্রভো! চারি দিকেই অন্ধকার! আমার এ ক্ষুদ্র ভেলা দুষ্কৃতের ভরে বড় ভারি হইয়াছে। আমায় কে রক্ষা করিবে?
————————-
18 বায়ূবশে অলকাগুলিন চালিত হইতেছে-অথচ বাক্যহীন তোমার এই মুখ রাত্রিকালে প্রমুদিত, সুতরাং অভ্যন্তরে ভ্রমর-গুঞ্জন-রহিত একটি পদ্মের ন্যায় আমাকে ব্যথিত করিতেছে।
19 তোমার সেই সখা বায়ূতাড়িত দীপের ন্যায় পরলোকে গমন করিয়াছেন, আর ফিরিবেন না। আমি নির্ব্বপিত দীপের দশাবৎ অসহ্য দুঃখে ধূমিত হইতেছি দেখ।
০৫. কমলাকান্তের বিদায়
পঞ্চম সংখ্যা-কমলাকান্তের বিদায়
সম্পাদক মহাশয়!
বিদায় হইলাম, আর লিখিব না। বনিল না। আপনার সঙ্গে বনিল না, পাঠকের সঙ্গে বনিল না, এ সংসারের সঙ্গে আমার বনিল না। আপনার সঙ্গে আর আমার বনিল না। আর কি লেখা হয়? বেসুরে কি এ বাঁশি বাজে? বাঁশী বাজি বাজি করে, তবু বাজে না-বাঁশী ফাটিয়াছে। আবার বাজ দেখি, হৃদয়ের বংশী! হায়! তুই কি আর তেমনি করিয়া বাজিতে জানিস্? আর কি সে তান মনে আছে? না, তুই সেই আছিস-না আমি সেই আমি আছি, তুই ঘুনে ধরা বাঁশী-আমি ঘুনে ধরা কি, কি ছাই তা আমি জানি না। আমার সে স্বর নাই-আর বাজাইব কি? আর সে রস নাই, শুনিবে কে? একবার বাজ দেখি, হৃদয়! এই জগৎ সংসারে-বধির, অর্থচিন্তায় বিব্রত, মূঢ় জগৎ সংসারে, সেইরূপ আমার মনের লুকান কথাগুলি তেমনি করিয়া বল্ দেখি? বলিলে কেহ শুনিবে কি? তখন বয়স ছিল-কত কাল হইল সে দপ্তর লিখিয়াছিলাম-এখন সে বয়স, সে রস নাই-এখন সে রস ছাড়া কথা কেহ শুনিবে কি? আর সে বসন্ত নাই-এখন গলা-ভাঙ্গা কোকিলের কুহুরব কেহ শুনিবে কি?
ভাই, আর কথায় কাজ নাই-আর বাজিয়া কাজ নাই-ভাঙ্গা বাঁশের মোটা আওয়াজে আর কুক্কুর-রাগিণী ভাঁজিয়া কাজ নাই। এখন হাসিলে কেহ হাসিবে না-কাঁদিলে বরং লোকে হাসিবে। প্রথম বয়সের হাসিকান্নায় সুখ আছে-লোকে সঙ্গে সঙ্গে হাসে কাঁদে;-এখন হাসিকান্না। ছি!-কেবল লোক হাসান!
হে সম্পাদককুলশ্রেষ্ঠ! আপনাকে স্বরূপ বলিতেছি-কমলাকান্তের আর সে রস নাই। আমার সে নসী বাবু নাই-অহিফেনের অনটন-সে প্রসন্ন কোথায় জানি না-তাহার সে মঙ্গলা গাভী কোথায় জানি না। সত্য বটে, আমি তখনও একা-এখনও একা- কিন্তু তখন আমি একায় এক সহস্র-এখন আমি একায় আধখানা। কিন্তু একার এত বন্ধন কেন? যে পাখীটি পুষিয়াছিলাম-কবে মরিয়া গিয়াছে-তাহার জন্য আজিও কাঁদি; যে ফুলটি ফুটাইয়াছিলাম-কবে শুকাইয়াছে, তাহার জন্য আজিও কাঁদি; যে জলবিম্ব, একবার জলস্রোতে সূর্য্যরশ্মি সম্প্রভাত দেখিয়াছিলাম-তাহার জন্য আজিও কাঁদি। কমলাকান্ত অন্তরে অন্তরের সন্ন্যাসী-তাহার এত বন্ধন কেন? এ দেহ পচিয়া উঠিল-ছাই ভস্ম মনের বাঁধনগুলো পচে না কেন? ঘর পুড়িয়া গেল-আগুন নিভে না কেন? পুকুর শুকাইয়া আসিল-এ পঙ্কে পঙ্কজ ফুটে না কেন? ঝড় থামিয়াছে-দরিয়ায় তুফান কেন? ফুল শুকাইয়াছে-এখনও-গন্ধ কেন? সুখ গিয়াছে-আশা কেন? স্মৃতি কেন? জীবন কেন? ভালবাসা গিয়াছে-যত্ন কেন? প্রাণ গিয়াছে-পিণ্ডদান কেন? কমলাকান্ত গিয়াছে-যে কমলাকান্ত চাঁদ বিবাহ করিত, কোকিলের সঙ্গে গায়িত, ফুলের বিবাহ দিত, এখন আবার তার আফিঙ্গের বরাদ্দ কেন? বাঁশী ফাটিয়াছে-আবার সা, ঋ, গ, ম কেন? প্রাণ গিয়াছে, ভাই, আর নিশ্বাস কেন? সুখ গিয়াছে, ভাই, আর কান্না কেন?
তবু কাঁদি। জন্মিবা মাত্র কাঁদিয়াছিলাম, কাঁদিয়া মরিব। এখন কাঁদিব, লিখিব না।