মা উঠিলেন না। উঠিবেন না কি?
এস, ভাই সকল! আমরা এই অন্ধকার কালস্রোতে ঝাঁপ দিই। এস, আমরা দ্বাদশ কোটি ভুজে ঐ প্রতিমা তুলিয়া, ছয় কোটি মাথায় বহিয়া, ঘরে আনি। এস, অন্ধকারে ভয় কি? ঐ যে নক্ষত্রসকল মধ্যে মধ্যে উঠিতেছে, নিবিতেছে, উহারা পথ দেখাইবে-চল! চল! অসংখ্য বাহুর প্রক্ষেপে, এই কাল-সমুদ্র তাড়িত, মথিত, ব্যস্ত করিয়া, আমরা সন্তরণ করি-সেই স্বর্ণপ্রতিমা মাথায় করিয়া আনি। ভয় কি? না হয় ডুবিব মাতৃহীনের জীবনে কাজ কি? আইস, প্রতিমা তুলিয়া আনি, বড় পূজার ধুম বাধিবে। দ্বেষক ছাগকে হাড়িকাটে ফেলিয়া সংকীর্ত্তি খড়্গে মায়ের কাছে বলি দিব-কত পুরাবৃত্তাকার ঢাকী, ঢাক ঘাড়ে করিয়া, বঙ্গের বাজনা বাজাইয়া আকাশ ফাটাইবে-কত ঢোল, কাঁসি, কাড়া, নাগরায় বঙ্গের জয় বাদিত হইবে। কত সানাই পোঁ ধরিয়া গাইবে “কত নাচ গো!”- বড় পূজার ধুম বাধিবে। কত ব্রাহ্মণপণ্ডিত লুচি মণ্ডার লোভে বঙ্গপূজায় আসিয়া পাতড়া মারিবে-কত দেশী বিদেশী ভদ্রাভদ্র আসিয়া মায়ের চরণে প্রণামি দিবে-কত দীন দুঃখী প্রসাদ খাইয়া উদর পূরিবে। কত নর্ত্তকী নাচিবে, কত গায়কে মঙ্গল গায়িবে, কত কোটি ভক্তে ডাকিবে, মা! মা! মা!-
জয় জয় জয় জয়া জয়দাত্রি ।
জয় জয় জয় বঙ্গজগদ্ধাত্রি ।।
জয় জয় জয় সুখদে অন্নদে ।
জয় জয় জয় বরদে শর্ম্মদে ।।
জয় জয় জয় শুভে শুভঙ্করি ।
জয় জয় জয় শান্তি ক্ষেমঙ্করি ।।
দ্বেষকদলনি, সন্তানপালিনি ।
জয় জয় দুর্গে দুর্গতিনাশিনি ।।
জয় জয় লক্ষ্মি বারীন্দ্রবালিকে ।
জয় জয় কমলাকান্তপালিকে ।।
জয় জয় ভক্তিশক্তিদায়িকে।
পাপতাপভয়শোকনাশিকে ।।
মৃদুল গম্ভীর ধীর ভাষিকে ।
জয় মা কালি করালি অম্বিকে ।।
জয় হিমালয়নগবালিকে ।
অতুলিত পূর্ণচন্দ্রভালিকে ।।
শুভে শোভনে সর্ব্বার্থসাধিকে ।
জয় জয় শান্তি শক্তি কালিকে ।।
জয় মা কমলাকান্তপালিকে ।।
নমোহস্তু তে দেবি বরপ্রদে শুভে ।
নমোহস্তু তে কামচরে সদা ধ্রবে ।।
ব্রহ্মাণী রুদ্রাণি ভূতভব্যে যশস্বিনি।
ত্রাহিং মাং সর্ব্বদুঃখেভ্যো দানবানাং ভয়ঙ্করি ।।
নমোহস্তু তে জগন্নাথে জনার্দ্দনি নমোহস্তু তে ।
প্রিয়দান্তে জগন্মাতঃ শৈলপুত্রি বসুন্ধারে ।।
ত্রায়স্ব মাং বিশালাক্ষি ভক্তানামার্ত্তিনাশিনি ।
নমামি শিরসা দেবীং বন্ধনোহস্তু বিমোচিতঃ ।।14
——————–
14 আর্য্যাস্তোত্র দেখ
১২. একটি গীত
দ্বাদশ সংখ্যা-একটি গীত
“শোন্ প্রসন্ন, তোকে একটি গীত শুনাইব।”
প্রসন্ন গোয়ালিনী বলিল, “আমার এখন গান শুনিবার সময় নয়-দুধ যোগাবার বেলা হলো।”
কমলাকান্ত। “এসো এসো বঁধু এসো।”
প্রসন্ন। “ছি ছি ছি! আমি কি তোমার বঁধু?”
কমলাকান্ত। “বালাই! ষাট, তুমি কেন বঁধু হইতে যাইবে? আমার গীতে আছে”-
এসো এসো বঁধু এসো আধ আঁচরে বসো-
সুর করিয়া আমি কীর্ত্তন ধরাতে প্রসন্ন দুধের কেঁড়ে রাখিয়া বসিল, আমি গীতটি আদ্যোপান্ত গায়িলাম।
এসো এসো বঁধু এসো আধ আঁচরে বসো-
নয়ন ভরিয়ে তোমায় দেখি।
অনেক দিবসে, মনের মানসে,
তোমার ধনে মিলাইল বিধি।
মণি নও মাণিক নও যে হার ক’রে গলে পরি
ফুল নও যে কেশের করি বেশ।.
নারী না করিত বিধি, তোমা হেন গুণনিধি,
লইয়া ফিরিতাম দেশ দেশ ।।
বঁধু তোমায় যখন পড়ে মনে,
আমি চাই বৃন্দাবন পানে,
আলুইলে কেশ নাহি বাঁধি।
রন্ধনশালাতে যাই, তুয়া বঁধু গুণ গাই,
ধুঁয়ার ছলনা করি কাঁদি।”
মিল ত চমৎকার, “দেখি” আর “বিধি” মিলিল! কিন্তু বাঙ্গালা ভাষায়, এইরূপ মোহ মন্ত্র আর একটি শুনিব, মনে বড় সাধ রহিয়াছে। যখনই এই গান প্রথম কর্ণ ভরিয়া শুনিয়াছিলাম, মনে হইয়াছিল, নীলাকাশতলে ক্ষুদ্র পক্ষী হইয়া এই গীত গাই-মনে হইয়াছিল, সেই বিচিত্র সৃষ্টিকুশলী কবির সৃষ্টি দৈববংশী লইয়া, মেঘের উপর যে বায়ূস্তর-শব্দশূন্য, দৃশ্যশূন্য, পৃথিবী যেখান হইতে দেখা যায় না, সেইখানে বসিয়া, সেই মুরলীতে, একা এই গীত গাই-এই গীত কখন ভুলিতে পারিলাম না; কখন ভুলিতে পারিব না।
“এসো এসো বঁধু এসো”15
লোকের মনে কি আছে বলিতে পারি না, কিন্তু আমি কমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী, বুঝিতে পারি না যে, ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তিতে কিছু সুখ আছে। যে পশু ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তি জন্য পরসন্দর্শনের আকাঙ্ক্ষী, সে যেন কখন কমলাকান্ত শর্ম্মার দপ্তর-মুক্তাবলী পড়িতে বসে না। আমি বিলাস-প্রিয়ের মুখে “এসো এসো বঁধু এসো” বুঝিতে পারি না। কিন্তু ইহা বুঝিতে পারি যে, মনুষ্য মনুষ্যের জন্য হইয়াছিল-এক হৃদয় অন্য হৃদয়ের জন্য হইয়াছিল-সেই হৃদয়ে হৃদয়ে সংঘাত হৃদয়ে হৃদয়ে মিলন, ইহা মনুষ্য-জীবনের সুখ। ইহজন্মে মনুষ্যহৃদয়ে একমাত্র তৃষা, অন্যহৃদয়-কামনা। মনুষ্যহৃদয় অনবরত হৃদয়ান্তরে ডাকিতেছে, “এসো এসো বঁধু এসো।” ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রবৃত্তিসকল শরীর রক্ষার্থ-মহতী প্রবৃত্তিসকলের উদ্দেশ্য, “এসো এসো বঁধু এসো।” তুমি চাকরি কর, খাইবার জন্য-কিন্তু যশের আকাঙ্ক্ষা কর, পরের অনুরাগ লাভ করিবার জন্য, জন সমাজের হৃদয়কে তোমার হৃদয়ের সঙ্গে মিলিত করিবার জন্য। তুমি যে পরোপকার কর, সে পরের হৃদয়ের ক্লেশ আপন হৃদয়ে অনুভূত কর বলিয়া। তুমি যে রাগ কর, সে তোমার মনোমত কার্য্য হইল না বলিয়া; হৃদয়ে হৃদয় আসিল না বলিয়া। সর্ব্বত্র এই রব-“এসো এসো বঁধু এসো।” সর্ব্বকর্ম্মের এই মন্ত্র, “এসো এসো বঁধু এসো।” জড় জগতের নিয়ম আকর্ষণ। বৃহৎ গ্রহ উপগ্রহকে ডাকিতেছে, “এসো এসো বঁধু এসো।” সৌরপিণ্ড বৃহৎ গ্রহকে ডাকিতেছে, “এসো এসো বঁধু এসো।” জগৎ জগদন্তরকে ডাকিতেছে, “এসো এসো বঁধু এসো।” পরমাণু পরমাণুকে অবিরত ডাকিতেছে “এসো এসো বঁধু এসো।” জড়পিণ্ডসকল, গ্রহ উপগ্রহ ধূমকেতু-সকলেই এই মোহমন্ত্রে বাঁধা পড়িয়া ঘুরিতেছে। প্রকৃতি পুরুষকে ডাকিতেছে, “এসো এসো বঁধু এসো।” জগতের এই গম্ভীর অবিশ্রান্ত ধ্বনি-“এসো এসো বঁধু এসো।” কমলাকান্তের বঁধু কি আসিবে?