অতএব এই বিশ্বসংসার একটি বৃহৎ বাজার-সকলেই সেখানে আপনাপন দোকান সাজাইয়া বসিয়া আছে। সকলেরই উদ্দেশ্য মূল্যপ্রাপ্তি। সকলেই অনবরত ডাকিতেছে, “আমার দোকানে ভাল জিনিষ-খরিদ্দার চলে আয়”-সকলেরই একমাত্র উদ্দেশ্য, খরিদ্দারের চোখে ধূলা দিয়া রদি মাল পাচার করিবে। দোকানদার খরিদ্দারে কেবল যুদ্ধ, কে কাকে ফাঁকি দিতে পারে। সস্তা খরিদের অবিরত চেষ্টাকে মনুষ্যজীবন বলে।
ভাবিয়া চিন্তিয়া, মনের দুঃখে আফিমের মাত্রা চড়াইলাম। তখন জ্ঞাননেত্র ফুটিল। সম্মুখে ভবের বাজার সুবিস্তৃত দেখিলাম। দেখিলাম, অসংখ্য দোকানদার, দোকান সাজাইয়া বসিয়া আছে-অসংখ্য খরিদ্দারে খরিদ করিতেছে-দেখিলাম, সেই অসংখ্য দোকানদারে অসংখ্য খরিদ্দারে পরস্পরকে অসংখ্য অঙ্গুষ্ঠ দেখাইতেছে। আমি গামছা কাঁধে করিয়া, বাজার করিতে বাহির হইলাম। প্রথমেই রূপের দোকানে গেলাম। যে জিনিস ঘরে নাই, সেই দোকানে আগে যাইতে হয়-দেখিলাম যে, সংসারে সেই মেছো হাটা। পৃথিবীর রূপসীগণ মাছ হইয়া ঝুড়ি চুপড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়াছেন। দেখিলাম, ছোট বড় রুই, কাতলা, মৃগেল, ইলিস, চুনো পুঁটি, কই, মাগুর খরিদ্দারের জন্য লেজ আছড়াইয়া ধড়ফড় করিতেছে; যত বেলা বাড়িতেছে, তত বিক্রয়ের জন্য খাবি খাইতেছে।-মেছনীরা ডাকিতেছে, “মাছ নেবে গো! কুল পুকুরের সস্তা মাছ, অমনি ছাড়বো-বোঝা বিক্রি হলেই বাঁচি।” কেহ ডাকিতেছে, “মাছ নেবে গো!-ধন সাগরের মিঠা মাছ-যে কেনে, তার পুনর্জন্ম হয় না-ধর্ম্ম অর্থ কাম মোক্ষ বিবির মুণ্ডে পরিণত হইয়া তার ঘর দ্বারে ছড়াছড়ি যায়, যার সাধ্য থাকে কিনিবে। সোণার হাঁড়িতে চোখের জলে সিদ্ধ করিয়া হৃদয়-আগুনে কড়া জ্বাল দিয়া রাঁধিতে হয়-কে খরিদ্দার সাহস করিস্-আয়। সাবধান! হীরার কাঁটা-নাতি ঝাঁটা-গলায় বাঁধলে শাশুড়ীরূপী বিড়ালের পায়ে পড়িতে হয়-কাঁটার জ্বালায়, খরিদ্দার হলে কি পলায়! কেহ ডাকিতেছে, “ওরে আমার সরম পুঁটি, বিক্রি হলেই উঠি। ঝোলে ঝালে অম্বলে, তেলে ঘিয়ে জলে, যাতে দিবে ফেলে, রান্না যাবে চলে,-সংসারের দিন সুখে কাটাবে, আমার এই সরম পুঁটির বলে।” কেহ বলিতেছে, “কাদা ছেঁচে চাঁদা এনেছি-দেখে খরিদ্দার পাগল হয়! কিনে নিয়ে ঘর আলো কর।”
এইরূপ দেখিয়া শুনিয়া মাছ কিনিতে প্রবৃত্ত হইলাম-কেন না, আমার নিরামিষ ঘরকরনা। দেখিলাম, মাছের দালাল আছে; নাম পুরোহিত। দালাল খাড়া হইলে পর জিজ্ঞাসা করিলাম-শুনিলাম, দর “জীবন সর্ব্বস্ব।” যে মাছ ইচ্ছা, সেই মাছ কেন, একই দর “জীবন সর্ব্বস্ব।” জিজ্ঞাসা করিলাম, “ভাল, এ মাছ কত দিন খাইব?” দালাল বলিল, “দু দিন চারি দিন, তার পর পচিয়া গন্ধ হইবে” তখন “এত চড়া দরে, এমন নশ্বর সামগ্রী কেন কিনিব?” ভাবিয়া আমি মেছো হাটা হইতে পলায়ন করিলাম। দেখিয়া মেছনীরা গামছা কাঁধে মিনসেকে গালি পাড়িতে লাগিল।
রূপের বাজার ছাড়িয়া বিদ্যার বাজারে গেলাম। দেখিলাম, এখানে ফলমূল বিক্রয় হয়। এক স্থানে দেখিলাম, কতকগুলি ফোঁটা-কাটা টিকিওয়ালা ব্রাহ্মণ তসর গরদ পরিয়া নামাবলি গায়ে, ঝুনা নারিকেলের দোকান খুলিয়া বসিয়া খরিদ্দার ডাকিতেছেন-“বেচি আমরা ঘটত্ব পটত্ব ষত্ব ণত্ব-ঘরে চাল থাকিলেই স্ব-ত্ব, নইলে ন-ত্ব। দ্রব্যত্ব জাতির গুণত্ব পদার্থ-বাপের শ্রাদ্ধে বিদায় না দিলেই তুই বেটা অপদার্থ। পদার্থতত্ত্ব নামে ঝুনা নারিকেল-খাইতে বড় কঠিন-তাহার প্রথম ছোবড়ায় লেখ যে, ব্রাহ্মণীই পরম পদার্থ। অভাব নামে নারিকেল চতুর্ব্বিধ।13- তোমার ঘরে ধন আছে, আমার ঘরে নাই ইহা অন্যোন্যাভাব। যতক্ষণ না পাই, ততক্ষণ প্রাগভাগ; খরচ হইয়া গেলেই ধ্বংসাভাব; আর আমাদের ঘরে সর্ব্বদাই অত্যন্ত অভাব। অভাব নিত্য, কি অনিত্য যদি সংশয় থাকে, তবে আমাদের ভাণ্ডারে উঁকি মার-দেখিবে, নিত্যই অভাব। অতএব আমাদের ঝুনা নারিকেল কেন। ব্যাপ্য, ব্যাপক ব্যাপ্ত, এ নারিকেলের শাঁস, ব্রাহ্মণের হস্ত হইল ব্যাপ্য রজত হইল ব্যাপক; আর তুমি দিলেই ঘটিল ব্যাপ্তি; এই ঝুনা নারিকেল কেন, এখনই বুঝিবে। দেখ বাপু, কার্য্য কারণ সম্বন্ধ বড় গুরুতর কথা; টাকা দাও, এখনই একটা কার্য্য হইবে, কম দিলেই অকার্য্য। আর কারণ বুঝাইব কি, এই যে দুই প্রহর রৌদ্রে ঝুনা নারিকেল বেচিতে আসিয়াছি ব্রাহ্মণীই তাহার কারণ-কিছু যদি না কেন, তবে নারিকেল বহা,-অকারণ। অতএব নারিকেল কেন, নহিলে এই ঝুনা নারিকেল মাথায় ঠুকিয়া মরিব।”
ব্রাহ্মণদিগের সেই প্রখর তপনতপ্ত ঘর্ম্মাক্ত ললাট এবং বাগবিতণ্ডাজনিত অধরসুধাবৃষ্টি দেখিয়া দয়া হইল-জিজ্ঞাসা করিলাম, “হ্যাঁ ভট্টাচার্য্য মহাশয়! ঝুনা নারিকেল কিনিতে আপত্তি নাই, কিন্তু দোকানে দা আছে? ছুলিবে কি প্রকারে?”
“না বাপু, দা রাখি না।”
“তবে নারিকেল ছোল কিসে?”
“আমরা ছুলি না-আমরা কামড়াইয়া ছোবড়া খাই।”
শুনিয়া, আমি ব্রাহ্মণদিগকে নমস্কার করিয়া পাশের দোকানে গেলাম।
দেখিলাম, ইহাদিগের সম্মুখেই এক্সপেরিমেন্টেল সায়েন্সের দোকান। কতকগুলি সাহেব দোকানদার, ঝুনা নারিকেল, বাদাম, পেস্তা, সুপারি প্রভৃতি ফল বিক্রয় করিতেছেন। ঘরের উপরে বড় বড় পিতলের অক্ষরে লেখা আছে।
MESSRS BROWN JONES AND
ROBINSON
NUT SUPPLIERS
ESTABLISHED 1757
ON THE FIELD OF PLASSEY.
MESSRS BROWN JONES AND ROBINSON
Offer to the Indian Public
A Large Assorment of
NUTS.
PHYSICAL, METAPHYSICAL,
LOGICAL, ILLOGICAL,
AND
SUFFICIENT TO BREAK THE JAWS
AND
DISLOCATE THE TEETH OF
ALL INDIAN YOUTHS
WHO STAND IN NEED OF HAVING THEIR
DENTAL SUPERFLUITIES CURTAILED.