আসল কথা এই যে, দর্শনে আমরা ব্যষ্টি ও সমষ্টি এই দুইটি ভাবকে পৃথক্ করে নিলেও এ বিশ্ব ব্যস্তসমস্ত। তাই সমষ্টির জ্ঞানের ভিতর ব্যষ্টির জ্ঞান প্রচ্ছন্ন থাকে, এবং ব্যষ্টির জ্ঞান সমষ্টির জ্ঞানের অপেক্ষা রাখে। কেননা বস্তুতঃ ও-দুই একসঙ্গে জড়ানো। তত্ত্বজ্ঞানে ও বিজ্ঞানে প্রভেদ এই যে, সমষ্টিজ্ঞান পরাবিদ্যায় একভাবে পাওয়া যায়, আর অপরাবিদ্যায় আর-একভাবে পাওয়া যায়। পরাবিদ্যার সমষ্টিজ্ঞান হচ্ছে মূলতঃ একত্বের জ্ঞান। অপর পক্ষে বহুকে যোগ দিয়ে যে সমষ্টি পাওয়া যায়, তারই জ্ঞান হচ্ছে বিজ্ঞানানুমোদিত সমষ্টিজ্ঞান। তত্ত্বজ্ঞানী এক জেনে সব জানতে চান, আর বৈজ্ঞানিক সবকে একত্র করে জানতে চান। এ দুয়ের ভিতর পার্থক্য আছে কিন্তু বিরোধ নেই। সুতরাং বিজ্ঞানের চর্চায় পারমার্থিক সত্যের নাশের ভয় নেই, ভয় আছে শুধু মিথ্যা জ্ঞানের উচ্ছেদের। যারা মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চান তারাই শুধু বিজ্ঞানকে ডরান।
পূর্বে বলা হয়েছে যে, প্রাতিভাসিক সত্য হচ্ছে ভ্ৰমজ্ঞান। এ কথা শুনে লোকের এই ধোঁকা লাগতে পারে যে, কি করে একই জ্ঞান যুগপৎ সত্য ও ভ্রম হতে পারে। প্রাতিভাসিক সত্য যে এক হিসাবে সত্য আর-এক হিসাবে মিথ্যা, এর স্পষ্ট প্রমাণ আছে। সম্মিলনের সভাপতিমহাশয় যে-দুটি উদাহরণ দিয়েছেন, তারই সাহায্যে প্রাতিভাসিক সত্যের স্বরূপ নির্ণয় করতে চেষ্টা করব।
সূর্য পৃথিবীর চার দিকে ঘুরছে, এটি হচ্ছে প্রাতিভাসিক সত্য; আর পৃথিবী যে সূর্যের চার দিকে ঘুরছে, এটি হচ্ছে বৈজ্ঞানিক সত্য। পৃথিবী চ্যাপটা, এটি হচ্ছে প্রাতিভাসিক সত্য; আর পৃথিবী গোলাকার, এটি হচ্ছে বৈজ্ঞানিক সত্য। পৃথিবী চ্যাপটা ও সূর্যের যে উদয়াস্ত হয়, এ দুটিই হচ্ছে প্রত্যক্ষ সত্য, অর্থাৎ আমাদের চোখের পক্ষে ও আমাদের চলাফেরার পক্ষে সম্পূর্ণ সত্য। যতখানি জমি বাংলাদেশে চোখে দেখা যায় তা যে সমতল, এর চাইতে খাঁটি সত্য আর নেই। সুতরাং পৃথিবীর যে খণ্ডদেশ আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ, তা চ্যাপটা, গোলাকার নয়। সমগ্র পৃথিবীটি গোলাকার, কিন্তু সমগ্র পৃথিবীটি প্রত্যক্ষ নয়। আমরা যখন প্রত্যক্ষের সীমা লঙ্ঘন করে অপ্রত্যক্ষের বিষয় প্রত্যক্ষজ্ঞানের সাহায্যে জানতে চাই, তখনই আমরা ভ্রমে পড়ি। কারণ, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান হচ্ছে সমষ্টির জ্ঞান, অসংখ্য খণ্ড খণ্ড প্রত্যক্ষজ্ঞানের যোগাযোগ করে সে জ্ঞান পাওয়া যায়। অসংখ্য চ্যাপটা খণ্ডকে ঠিক দিলে তা গোল হয়ে। ওঠে। এক মুহূর্তে একদেশদর্শিতাই হচ্ছে প্রত্যক্ষজ্ঞানের ধর্ম, সুতরাং কোনো একটি বিশেষ প্রত্যক্ষজ্ঞানের উপর নির্ভয়ে বৈজ্ঞানিক সত্যকে দাঁড় করানো যায় না।
ইন্দ্রিয় বাহ্যবস্তুর যে পরিচয় দেয়, সাধারণতঃ মানুষে তাই নিয়েই সন্তুষ্ট। থাকে, কারণ তাতেই তার কাজ চলে যায়; কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্ৰহ্মাণ্ডকে একটি প্রকাণ্ড সমষ্টি হিসেবে দেখতে চায়; বিশ্বে একটা নিয়ম আছে এই বিশ্বাসে, সে সেই নিয়মের সন্ধানে ফেরে। বস্তুসকলকে পৃথভাবে না দেখে যুক্তভাবে দেখতে গিয়ে বিজ্ঞান দেখতে পায় যে, প্রতিভাসিক সত্য সমগ্র সত্য নয়। পৃথিবী যে চ্যাপটা ও সূর্য যে পৃথিবীর চার দিকে ঘুরছে, প্রত্যক্ষজ্ঞানের হিসেবে। এ দুটি হচ্ছে সম্পূর্ণ পৃথক্ এবং সম্পৰ্করহিত সত্য। কিন্তু বিজ্ঞানের কাছে এ দুটি হচ্ছে এক সত্যের দুইটি বিভিন্ন রূপ। পৃথিবী-নামক মৃৎপিণ্ডটি যে কারণে সূর্যের চার পাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, সেই কারণেই সেটি তাল পাকিয়ে গেছে। ত্রিকোণ বা চতুষ্কোণ কিংবা চ্যাপটা হলে ওভাবে ঘোরা তার পক্ষে অসাধ্য হত। সুতরাং প্রত্যক্ষজ্ঞানের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো বিরোধ নেই, কারণ এ উভয়ের অধিকার স্বতন্ত্র। বিজ্ঞানের সাহায্যে আমরা জানতে চাই বস্তুজগতের সামান্য গুণ, আর প্রত্যক্ষজ্ঞানের সাহায্যে আমরা দেখতে চাই বস্তুর বিশেষ রূপ। অতএব বিজ্ঞানের চর্চা করলে আমাদের তত্ত্বজ্ঞান মারা যাবে না অর্থাৎ আমাদের ধর্ম নষ্ট হবে না; এবং আমাদের বাহ্যজ্ঞানও নষ্ট হবে না অর্থাৎ কাব্য-শিল্পও মারা যাবে না। যা তত্ত্বজ্ঞানও নয় বিজ্ঞানও নয় প্রত্যক্ষজ্ঞানও নয়, তাই হচ্ছে যথার্থ মিথ্যা; এবং তারই চর্চা করে আমরা ধর্ম সমাজ কাব্য শিল্প, এক কথায় সমগ্র মানবজীবন, সমূলে ধ্বংস করতে বসেছি।
৩.
বিজ্ঞান শুধু একপ্রকার বিশেষজ্ঞানের নাম নয়; একটি বিশেষ প্রণালী অবলম্বন করে যে জ্ঞান লাভ করা যায়, আসলে তারই নাম হচ্ছে বিজ্ঞান। আমরা বিজ্ঞানকে যতই কেন সাধাসাধি করি নে, সে কখনোই এ দেশে ফিরে আসবে না, যদি-না আমরা তার সাধনা করি। সুতরাং সেই সাধনপদ্ধতিটি আমাদের জানা দরকার। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিটি যে কি, সে সম্বন্ধে আমি দুইএকটি কথা বলতে চাই। বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য থেকেই তার উপায়েরও পরিচয় পাওয়া যাবে। তত্ত্বজ্ঞানের জিজ্ঞাস্য বিষয় হচ্ছে এক সত্য’, অথচ প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বহুর অস্তিত্ব তত্ত্বজ্ঞানীরাও অস্বীকার করতে পারেন না। তাই বৈদান্তিকেরা বলেন, যা পূর্বে এক ছিল তাই এখন বহুতে পরিণত হয়েছে। সাংখ্যের মতে সৃষ্টি একটি বিকার মাত্র, কেননা ত্রিগুণের সাম্যাবস্থাই প্রকৃতির সুস্থ অবস্থা। সৃষ্টিকে বিকার হিসেবে দেখা আশ্চর্য নয়, কেননা আপাতসুলভ জ্ঞানে এ বিশ্ব একটি ভাঙাচোরা, ছাড়ানো ও ছড়ানো ব্যাপার। বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই অসংখ্য পৃথক পৃথক্ বস্তুর পরস্পরের সম্বন্ধ নির্ণয় করা, জড়জগতের ভগ্নাংশগুলিকে যোগ দিয়ে একটি মন দিয়ে ধরবার-ছোঁবার মত সমষ্টি গড়ে তোেল। এই ভগ্নাংশগুলিকে পরস্পরের সঙ্গে যোগ করতে হলে আঁকজোখ চাই। সুতরাং দুইয়ে দুইয়ে চার করার নামই হচ্ছে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। দুইয়ে দুইয়ে পাঁচ আর-যে-দেশেই হোক, বিজ্ঞানের রাজ্যে হয় না। বিজ্ঞানের কারবার শুধু বস্তুর সংখ্যা নিয়ে নয়, পরিমাণ নিয়েও। সুতরাং বিজ্ঞানে মাপজোখও করা চাই। বিনা মাপে বিনা আঁকে যে সত্য পাওয়া যায়, তা বৈজ্ঞানিক সত্য নয়। বিজ্ঞানের যা-কিছু মর্যাদা, গৌরব ও মূল্য, তা সবই এই পদ্ধতির দরুন। আমাদের কাছে কোনো বৈজ্ঞানিক সত্যের বিশেষ কিছু মূল্য নেই, যদি আমরা কি উপায়ে সেটি পাওয়া গেছে তা না জানি। পৃথিবী কমলালেবুর মত, এটি হচ্ছে বৈজ্ঞানিক সত্য। কিন্তু কি মাপজোখের কি যুক্তির সাহায্যে এই সত্য নির্ণীত হয়েছে, সেটি না জানলে ও-সত্য আমাদের মনের হাতে কমলালেবু নয়, ছেলের হাতে মোয়া; অর্থাৎ তা আমাদের এতই কম করায়ত্ত যে, যে-খুশি-সেই কেড়ে নিতে পারে। বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তসকলের ক্রমান্বয় ভুল বেরচ্ছে, আবার তা সংশোধন করা হচ্ছে। কিন্তু সে ভুলের আবিষ্কার ও সংশোধন ঐ একই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে সাধিত হচ্ছে।