আপনারা সকলেই জানেন যে, বেদান্তশাস্ত্র নেতিমূলক। বেদান্তের ‘নেতি নেতি’র সার্থকতা সাধারণ লোকের ব্রহ্মবিষয়ক সকল অলীক ধারণার নিরাস করায়। এ বিষয়ে শংকরের মত তার মুখ থেকেই শোনা যাক। বেদান্তের চতুর্থ সূত্রের ভায্যের দুটি বাক্য এখানে উদ্ধৃত করে দিচ্ছি—
তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে।
অস্যার্থ : তুমি তাহাকেই ব্ৰহ্ম বলিয়া জান যিনি ইদন্তারূপে (এই, অমুক) অথবা অন্য কোনো প্রকারে উপাসিত হন না।
ন হি শাস্ত্ৰমিদন্তয়া বিষয়ীভূতং ব্রহ্ম প্রতিপিপাদয়িষতি।
অস্যার্থ : বেদান্তশাস্ত্র তাহাকে ইদন্তারূপে (কোনরূপ বিশেষণ দিয়া) প্রতিপাদন করিতে ইচ্ছুক নহে। শাস্ত্র এইমাত্র প্রতিপাদন করে যে, ব্রহ্মপদার্থ ইদং জ্ঞানের অবিষয়।
বলা বাহুল্য, ধর্মজ্ঞানের রাজ্যে, এহেন মুক্তির বারতা পৃথিবীর অপর কোনো দেশে অপর কোনো শাস্ত্রে পাওয়া যায় না। এ মত কিন্তু নাস্তিক মত নয়, এ মত শুধু সকল প্রকার সংকীর্ণ আস্তিক মতের বিরোধী।
আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা যেমন প্রাচীন ভারতবর্ষের আর্যসভ্যতার চরম বাণী, সামাজিক সভ্যতা তেমনি বর্তমান ইউরোপীয় আর্যসভ্যতার চরম বাণী। এ সত্য আজকের দিনে আমাদের সকলেরই নিকট প্রত্যক্ষ, কেননা এ যুগের ইউরোপীয় সভ্যতার মূলমন্ত্র যে কি, তা ইংরেজি শিক্ষার প্রসাদে আমরা সবাই জানি। কিন্তু এ দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টির বহুপূর্বে, অর্থাৎ এক শ বৎসর পূর্বে, একমাত্র রামমোহন রায়ের চোখে এ সত্য ধরা পড়ে। ইউরোপের ঐ মহামন্ত্রই যে আমাদের যথার্থ সঞ্জীবনী মন্ত্র হবে, এই বিশ্বাসই ছিল তাঁর। সকল কথা সকল ব্যবহারের অটল ভিত্তি। তাই তিনি একদিকে যেমন ইউরোপের পৌরাণিক ধর্ম অগ্রাহ্য করেছিলেন, অপর দিকে তিনি তেমনি ইউরোপের সামাজিক ধর্ম সোৎসাহে সানন্দে অঙ্গীকার করেছিলেন। এই লিবার্টির ধর্মকেই আত্মসাৎ করে ভারতবাসী যে আবার নবজীবন নবশক্তি লাভ করবে এই সত্য প্রচার করাই ছিল তাঁর জীবনের মহাব্রত।
৯.
লিবার্টি শব্দটা আজকের দিনে এত অসংখ্য লোকের মুখে মুখে ফিরছে, এক কথায় এতটা বাজারে হয়ে উঠেছে যে, ভয় হয় যে, অধিকাংশ লোকের মুখে ওটা একটা বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। গীতার নিষ্কাম ধর্মের কথাটাকে আমরা যে একটা বুলিতে পরিণত করেছি, এ কথা তো আর সজ্ঞানে অস্বীকার করা চলে না। যে কথা মুখে আছে মনে নেই, যদিও বা মনে থাকে তো জীবনে নেই, তারই নাম না বুলি? অতএব এ স্থলে, বর্তমান ইউরোপ লিবার্টি শব্দের অর্থে কি বোঝে সে সম্বন্ধে বর্তমান ইতালির একজন অগ্রগণ্য লেখকের কথা এখানে বাংলায় অনুবাদ করে দিচ্ছি
প্রাচীনকালে লিবার্টি শব্দের অর্থে লোকে বুঝত শুধু দেশের গভর্নমেন্টকে নিজের করায়ত্ত করা। বর্তমানে লোকে লিবার্টি বলতে শুধু রাজনৈতিক নয়, সেই সঙ্গে মানসিক ও নৈতিক স্বাধীনতার কথাও বোঝে, অর্থাৎ এ যুগে লিবার্টির অর্থ, চিন্তা করবার স্বাধীনতা, কথা বলবার স্বাধীনতা, লেখবার স্বাধীনতা, নানা লোক একত্র হয়ে দল বাঁধবার স্বাধীনতা, বিচার করবার স্বাধীনতা, নিজের মত গড়বার এবং সে মত প্রকাশ করবার, প্রচার করবার স্বাধীনতা। মানুষমাত্রেই এসকল ক্ষেত্রে সমান স্বাধীনতার স্বভাবতই অধিকারী, এ স্বাধীনতা, কোনো চার্চ (ধর্মসংঘ) কর্তৃকও দত্ত নয়, কোনো রাজশক্তি কর্তৃকও দত্ত নয়। এর উলটো মত হচ্ছে এই যে, হয় ধর্মসংঘ নয় রাজশক্তি সর্বশক্তিমান, অতএব ব্যক্তির ব্যক্তিহিসেবে কোনোই স্বাধীনতা নেই। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র একটা জাতীয় সমূহের অন্তরে লীন হয়ে লুপ্ত হয়ে যায়, সে সমূহ রাজাই হোক আর রাজ্যই হোক, চার্চই হোক আর পোপই হোক।
লেখকের মতে, যে দেশে যে সমাজে ব্যক্তিমাত্রেই এইসকল মানসিক নৈতিক ও আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার অধিকারী নয়, সে দেশের লোমাত্রেই দাস; সে দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা মিছা ও অর্থশূন্য। আমি ইচ্ছা করেই। De Sanctisএর মত আপনাদের কাছে নিবেদন করছি, কেননা উক্ত লেখককে ইতালির রাজনৈতিক স্বাধীনতা উদ্ধারের জন্য আজীবন অশেষ অত্যাচার, বিশেষ শাস্তি ভোগ করতে হয়েছিল।
এ রাজা রামমোহন রায় লিবার্টি শব্দের এই নূতন অর্থ ই গ্রহণ করেছিলেন, এবং স্বজাতিকে মানসিক নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দাসত্ব হতে মুক্তি দিতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন। লিবার্টির নূতন ধারণার ভিতর একটি দার্শনিক তত্ত্ব নিহিত আছে, সে তত্ত্ব এই যে, স্বাধীনতার মধ্যেই ব্যক্তিমাত্রেরই জীবনীশক্তি স্ফুর্তি লাভ করে। এবং বহু লোকের মনে ও জীবনে এই শক্তি স্ফুর্ত হলেই জাতীয় জীবন যুগপৎ শক্তি ও উন্নতি লাভ করে। মানুষকে দাস রেখে মানবসমাজকে স্বাধীন করে তোলার যে কোনো অর্থ নেই এ জ্ঞান রামমোহন রায়ের ছিল, কেননা তিনি হেগেল প্রমুখ জর্মান দার্শনিকদের শিষ্য ছিলেন না।
১০
রামমোহন রায় জানতেন যে, তার স্বজাতি দুর্বল ভয়ার্ত ও দীন, এবং এরূপ হবার কারণ, সে জাতির নয় শ বছরের পূর্ব ইতিহাস এবং এই দুর্বল ভয়ার্ত ও দীন জাতির দুর্বলতা ভয় ও দৈন্য কি উপায়ে দূর করা যায়, এই ছিল তার জীবনের প্রধান ভাবনা। সুতরাং তাকে এক দিকে যেমন গভর্নমেন্টের আইনকানুনের দিকে নজর রাখতে হয়েছিল, অপর দিকে বাঙালির মানসিক ও সামাজিক মুক্তির উপায়ও নির্ধারণ করতে হয়েছিল।