যুক্তিযুক্ত ও সত্যমূলক হলে বিদ্রূপ যথেষ্ট ভদ্র হয়েও যে কতদূর সাংঘাতিক হতে পারে, উপরোক্ত বাক্য ক’টি তার একটি চমৎকার উদাহরণ। এই শ্রেণীর মারাত্মক বিপে রামমোহন রায় সিদ্ধহস্ত। বিপক্ষের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে শিষ্টতা তিনি কখনো ত্যাগ করেন নি; কিন্তু ‘হিংসা ত্যাগকে ধর্ম জানা’ তাঁর স্বভাব ও শিক্ষা দুয়েরই বিরুদ্ধে ছিল। প্রসিদ্ধ জর্মান কবি হাইনরিখ হাইনে Heinricli Heine বলে গিয়েছিলেন যে, তার গোরের উপর যেন এই ক’টি কথা লেখা থাকে যে, ‘He was a brave soldier in the war of liberation of humanity’–এ খ্যাতি রামমোহন রায় অনায়াসে আত্মসাৎ করতে পারেন। মানুষের মুক্তির জন্য তিনি জীবনের সকল ক্ষেত্রেই যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিলেন। জৈন বৌদ্ধ প্রভৃতি অহিংসামূলক ধর্ম তার মনের উপর কখনো প্রভুত্ব করে নি, তিনি ছিলেন বেদপন্থী ব্রাহ্মণ, অর্থাৎ রাজসিকতার মাহাত্ম্য তাঁর নিকট অবিদিত ছিল না। তামসিকতা যে অনেক স্থলে সাত্ত্বিকতার ছদ্মবেশ ধারণ করে, এ সত্যও তার সম্পূর্ণ জানা ছিল। আমরা, এ যুগের বাঙালি লেখকেরা, তাঁর কাছ থেকে একটি মহাশিক্ষা লাভ করতে পারি। তর্কক্ষেত্রে সৌজন্য রক্ষা করে কী করে প্রতিপক্ষকে পরাভূত করা যায়, তার সন্ধান আমরা রামমোহন রায়ের লেখার ভিতর পাব, অবশ্য যদি আমরা সাহিত্যে একমাত্র বৈধহিংসার চর্চা করতে প্রস্তুত থাকি। যা অসত্য, যা অন্যায়, যা অবৈধ, তার পক্ষে যিনি লেখনী ধারণ করবেন তার গুরু রামমোহন রায় কখনোই হতে পারেন না। কেননা তার শাস্ত্রশাসিত মন অধর্মযুদ্ধের একান্ত প্রতিকূল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, এ ক্ষেত্রে রামমোহন রায় কিসের বিরুদ্ধে অসি ধারণ করেছিলেন। খৃস্টধর্মের বিরুদ্ধে নয়, কেননা কোনো ধর্মমতের প্রতি তাঁর বিদ্বেষ ছিল না। তাঁর নিজের কথা এই–
… নিন্দা ও তিরস্কারের দ্বারা অথবা লোভ প্রদর্শন দ্বারা ধর্ম সংস্থাপন করা যুক্তি ও বিচারসহ হয় না তবে বিচার বলে হিন্দুর ধৰ্ম্মের মিথ্যাত্ব ও আপন ধৰ্ম্মের উৎকৃষ্টত্ব ইহা স্থাপন করেন সুতরাং ইচ্ছা পূৰ্ব্বক অনেকেই তাঁহাদের ধর্ম গ্রহণ করিবেক অথবা স্থাপন করিতে অসমর্থ হয়েন এরূপ বৃথা ক্লেশ করা ও ক্লেশ দেওয়া হইতে ক্ষমাপন্ন হইবেন, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের ক্ষুদ্র গৃহে নিবাস ও শাকাদি ভোজন ও ভিক্ষোপজীবিকা দেখিয়া তুচ্ছ করিয়া বিচার হইতে যেন নিবৃত্ত না হয়েন যেহেতু সত্য ও ধৰ্ম্ম সর্বদা ঐশ্বৰ্য্য ও অধিকারকে ও উচ্চ পদবী ও বৃহৎ অট্টালিকাকে আশ্রয় করিয়া থাকেন এমন নিয়ম নহে।… [ব্রাহ্মণসেবধি (১৮২১)]
অতএব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, তিনি এ দেশে খৃস্টধর্মের প্রচারের পদ্ধতির বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেছিলেন। কেননা উক্ত উপায়ে লোকের ধর্মমতের পরিবর্তন ঘটানো সকল দেশেই উপদ্রববিশেষ এবং প্রবল রাজার জাতের পক্ষে দুর্বল প্রজার জাতের উপর এরূপ ব্যবহার নিতান্ত অত্যাচার। রামমোহন রায় সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধেই নির্ভীক প্রতিবাদ করেছিলেন। যে যুগে ইংরেজের নামমাত্রে লোকে ভীত হত, সে যুগে ইংরেজের বিরুদ্ধে এই তীব্র প্রতিবাদ করায় তিনি যে অসাধারণ সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন, সে সাহস সকল দেশে সকল যুগেই দুর্লভ।
৮
আজকের দিনে যে মনোভাবকে আমরা জাতীয় আত্মমর্যাদাজ্ঞান বলি, রামমোহন রায়ের এই ক’টি কথায় তার প্রথম পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর সমসাময়িক অপর কোনো ব্যক্তির মনে এ মনোভাবের যে লেশমাত্র ছিল, তার কোনো নিদর্শন নেই। কিন্তু যেটা বিশেষ করে আমাদের চোখে পড়ে সে হচ্ছে এই যে, এর মধ্যে মিছা আত্মশ্লাঘার নামগন্ধও নেই, অপর পক্ষে যথেষ্ট পরিমাণে আত্মগ্লানিও আছে। সে যুগের বাঙালি যে দুর্বল ভয়ার্ত ও দীন ছিল সে কথা তিনি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন, এবং কিসে স্বজাতির দুর্বলতা ভীরুতা ও দীনতা দূর করা যায় সেই ছিল তার একমাত্র ভাবনা, আর তার জাতীয় উন্নতি সাধনের সকল চেষ্টার একমাত্র লক্ষ্য ছিল স্বজাতিকে মনে ও জীবনে শক্তিশালী ও ঐশ্বর্যবান্ করে তোল। এই কথাটি মনে রাখলে তার সকল কথা সকল কার্যের প্রকৃত অর্থ আমরা বুঝতে পারি। তার পর স্বজাতিকে তিনি উন্নতির যে পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন সে পথ সুপথ কি কুপথ তার বিচার করতে হলে রামমোহন রায় কোন্ সত্যের উপর তার মতামতের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার সন্ধান নেওয়া আবশ্যক।
পৃথিবীতে যেসকল লোকের মতামতের কোনো মূল্য আছে তাদের সকল মতামতের মধ্যে একটা সংগতি একটা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে, কেননা তাদের নানা বিষয়ে নানা জাতীয় মতের মূলে আছে একটি বিশেষ মানসপ্রকৃতি। রাজা রামমোহন রায় কি আধ্যাত্মিক, কি সাংসারিক, যে-কোনো বিষয়ে মত প্রকাশ করেছেন সেসকলের ভিতর দিয়ে তাঁর অসামান্য স্বাধীনতাপ্রিয়তা সদর্পে ফুটে বেরিয়েছে। তিনি যে বেদান্তের এত ভক্ত তার কারণ, ও-শাস্ত্র হচ্ছে মোক্ষশাস্ত্র। যে জ্ঞানের লক্ষ্য মুক্তি, ফল মুক্তি, সেই জ্ঞানকে আয়ত্ত করবার উপদেশ তিনি চিরজীবন স্বজাতিকে দিয়েছেন। এ মুক্তি কিসের হাত থেকে মুক্তি? এর দার্শনিক উত্তর হচ্ছে, অবিদ্যার হাত থেকে। এই অবিদ্যা বস্তু যে কি, সে বিষয়ে তর্কের আর শেষ নেই; ফলে অদ্যাবধি কেউ এ বিষয়ে একটা স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন নি। অবিদ্যার মেটাফিজিক্যাল রহস্য ভেদ করবার বৃথা চেষ্টা না করেও সহজ বুদ্ধির সাহায্যে বোঝা যায়— বেদান্তের প্রতিপাদ্য মোক্ষ হচ্ছে ব্ৰহ্মবিষয়ক লৌকিক ধর্মের সংকীর্ণ ধারণা হতে মনের মুক্তি।