৩.
তিনি যে জ্ঞানকর্মের সমন্বয় করতে ব্ৰতী হয়েছিলেন তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ এই, সেকালে তার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ ছিল যে, তিনি গৃহী হয়েও ব্ৰহ্মজ্ঞানী হবার ভান করতেন, এক কথায় তিনি ছিলেন একজন ‘ভাক্তজ্ঞানী’।
এই ‘ভাক্ত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে গৌণ, অপ্রধান ইত্যাদি। এই বিশেষণে বিশেষিত হতে রামমোহন রায় কখনোই আপত্তি করেন নি। তিনি মুক্তকণ্ঠে বলেছেন যে, তিনি যে ব্রহ্মের স্বরূপ জানেন, এমন স্পর্ধা তিনি কখনোই রাখেন নি। তবে গৃহীর পক্ষে যে বাহ্যিক ক্রিয়াকলাপই একমাত্র সেব্য ধর্ম এবং গৃহস্থের পক্ষে যে ব্ৰহ্মনিষ্ঠ হওয়া অসম্ভব, এ কথা যেমন ন্যায়বিরুদ্ধ, তেমনি অশাস্ত্রীয়। এ কথার উত্তরে ধর্মসংস্থাপনাকাঙ্ক্ষীরা যোগবশিষ্ঠের একটি বচন তার গায়ে ছুড়ে মেরেছিলেন। সে বচনটি হচ্ছে এই–
সংসারবিষয়াসক্ত ব্ৰহ্মজ্ঞোস্মীতিবাদিনম্।
কর্মব্রহ্মোভয়ভ্রষ্টং তং ত্যজেদন্ত্যজং যথা।।
অর্থাৎ যে ব্যক্তি সংসার সুখে আসক্ত হইয়া আমি ব্ৰহ্মজ্ঞানী ইহা কহে, সে কর্ম-ব্ৰহ্ম উভয় ভ্রষ্ট, অতএব অন্ত্যজের ন্যায় ত্যাজ্য হয়।
এ সম্বন্ধে রামমোহন রায় বলেন—
যোগবাশিষ্ঠে ভাক্তজ্ঞানীর বিষয়ে যাহা লিখিয়াছেন, তাহা যথার্থ বটে।
এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করবার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই দেখিয়ে দেওয়া যে, কর্ম ও ব্রহ্মজ্ঞানের একসঙ্গে চর্চা করা যেতে পারে কি না, এইটিই ছিল সে যুগের আসল বিবাদস্থল। এ বিবাদ আমরা আজ করি নে, কেননা দেশ সুদ্ধ লোক এখন গী তাপন্থী; এবং আপনারা সকলেই জানেন যে, লোকের ধারণা যে, গীতায় শুধু জ্ঞানকর্মের নয়, সেই সঙ্গে ভক্তিরও সমন্বয় করা হয়েছে। দেশসুদ্ধ লোক আজ যে পথের পথিক হয়েছে, সে পথের প্রদর্শক হচ্ছেন রামমোহন রায়। সুতরাং ধর্মমত সম্বন্ধেও তিনিই হচ্ছেন এ যুগের সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান মহাজন। যে শাস্ত্রের বচনসকল আজ শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকল লোকের মুখে মুখে ফিরছে, রামমোহন রায়কে সেই বেদান্তশাস্ত্রের আবিষ্কর্তা বললেও অত্যুক্তি হয় না। আপনারা শুনে আশ্চর্য হয়ে যাবেন যে, সেকালে একদল পণ্ডিত তাঁর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনেন যে, উপনিষদ বলে সংস্কৃত ভাষায় কোনো শাস্ত্রই নেই, ঈশ কেন কঠ প্রভৃতি নাকি তিনি রচনা করেছিলেন। এ অভিযোগ এত লোকে সত্য বলে বিশ্বাস করেন যে, রামমোহন এই মিথ্যা অভিযোগের হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভ করবার জন্য প্রকাশ্যে এই জবাবু দিতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, এই কলিকাতা শহরে শ্রীযুক্ত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের বাড়িতে গেলেই সকলে দেখতে পাবেন যে, বেদান্তশাস্ত্রের সকল পুঁথিই তার ঘরে মজুত আছে। বিশেষ করে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের নাম উল্লেখ করবার কারণ এই যে, তিনি ছিলেন রামমোহন রায়ের বিপক্ষদলের সর্বাগ্রগণ্য পণ্ডিত।
স্কচ দার্শনিক ড্যুগাল্ড স্টুয়ার্ট Dugald Stewart বলেছিলেন যে, সংস্কৃত বলে কোনো ভাষাই নেই, ইংরেজদের ঠকাবার জন্য ব্রাহ্মণেরা ঐ একটি জাল ভাষা বার করেছে। এ কথা শুনে এককালে আমরা সবাই হাসতুম, কেননা সেকালে আমরা জানতুম না যে, এই বাংলাদেশেই এমন একদল টোলের পণ্ডিত ছিলেন, যাদের মতে বেদান্ত বলে কোনো শাস্ত্রই নেই, বাঙালিদের ঠকাবার জন্য রামমোহন রায় ঐ একটি জাল শাস্ত্র তৈরি করেছেন। এই জালের অপবাদ থেকে রামমোহন রায় আজও মুক্তি পান নি। আমাদের শিক্ষিতসমাজে আজও এমন-সব লোকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, যাদের বিশ্বাস মহানির্বাণতন্ত্র রামমোহন রায় এবং তার গুরু হরিহরানন্দনাথ তীর্থস্বামী এই উভয়ে মিলে জাল করেছেন। এরা ভুলে যান যে, দলিল লোকে জাল করে শুধু আদালতে পেশ করবার জন্য। এই কারণেই টোলের পণ্ডিতমহাশয়ের দত্তকচন্দ্রিকা নামক একখানি গোটা স্মৃতিগ্ৰন্থ রাতারাতি জাল করে ইংরেজের আদালতে পেশ করেছিলেন। সে জাল তখন ধরা পড়ে নি, পড়েছে এদানিক। ঈশ কেন কঠ, এমনকি মহানির্বাণতন্ত্র পর্যন্ত, কোনো আদালতে গ্রাহ্য হবে না, ওসবই irrelevant বলে rejected হবে। সুতরাং রামমোহম রায়ের পক্ষে মোক্ষশাস্ত্র জাল করবার কোনোই প্রয়োজন ছিল না। তবে যে লোকে মহানির্বাণকে জাল মনে করে, তার কারণ তারা বোধ হয় দত্তকচন্দ্রিকাকেও genuine মনে করে। এই শ্রেণীর বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের মূলে আছে। একমাত্র জনশ্রুতি। এই এক শ বৎসরের শিক্ষাদীক্ষার বলে আমাদের বিচারবুদ্ধি যে আজও ফণা ধরে ওঠে নি, তার কারণ উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সে বুদ্ধি স্বল্পজ্ঞানের সংকীর্ণ গণ্ডির ভিতর আটকে পড়েছিল, আর এই বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে সে বুদ্ধি আমাদের অতিজ্ঞানের চাপে মাথা তুলতে পারছে না। আমি আশা করি, একবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে বাঙালির বিদ্যার বোঝা কতকটা লঘু হয়ে আসবে, আর তখন বাঙালির বুদ্ধি স্বচ্ছন্দে খেলে বেড়াবার একটু অবসর পাবে।
৪.
রামমোহন রায় সম্বন্ধে আর-একটি লৌকিক ভুল ধারণা এই যে, তিনি ছিলেন ইংরেজি শিক্ষার একটি product, অর্থাৎ ইউরোপের কাব্য ইতিহাস দর্শন বিজ্ঞানের প্রভাবেই তাঁর মন তৈরি হয়েছিল, এক কথায় তিনি আমাদেরই জাত। আমার ধারণা যে অন্যরূপ সে কথা আমি পূর্বেই বলেছি। আমি আজ বছর তিনেক আগে এই মত প্রকাশ করি যে–
Rengal produced in the last century a inan of colossal intellect and is marvellous clairvoyance — Rajah Ram Mohan Roy….British India up to now has not procluced a greater mind, and he remains for all time the supreme representative of the spirit of the new age and the genuancentd əkda kuranation from the pinnacle of Indian culture and saw and welcomed all that was living and life-giving in it.