৩.
ইংরেজের শিষ্য আমরা যেমন কর্মের উপাসক, শ্ৰীধরের শিষ্য নীলকণ্ঠও তেমনি ভক্তির উপাসক ছিলেন, তথাপি তিনিও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে–
ভারতে সর্ববেদার্থো ভারতার্থশ্চ কৃৎস্নশ।
গীতায়ামস্তি তেনেয়ং সর্বশাস্ত্রময়ী মতা।।
কর্মোপাস্তিজ্ঞানভেদৈঃ শাস্ত্র কাণ্ডত্ৰয়াত্মকম্।
অন্যে তূপাসনাকাণ্ডাতৃতীয়ো নাতিরিচ্যতে।।
তদেব ব্রহ্ম বিদ্ধি ত্বং নেদং যত্তদুপাসতে।
ইতি শ্রুত্যৈব বেদ্যস্য হ্যুপাস্যদন্যতেরিতা।।
ইয়মষ্টাদশাধ্যায়ী ক্ৰমাৎ ষটত্রিকেণ হি।
কর্মোপাস্তিজ্ঞানকাণ্ডত্ৰিতয়াত্ম৷ নিগদ্যতে।।
নীলকণ্ঠের এই সরল কথাই হচ্ছে সত্যকথা। গীতার প্রথম ছয় অধ্যায় যে কর্মকাণ্ডের, মধ্যের ছয় অধ্যায় যে ভক্তিকাণ্ডের, আর শেষ ছয় অধ্যায় যে জ্ঞানকাণ্ডের অন্তর্গত, এ রকম তিন অংশে সমান ও পরিপাটি ভাগবাটোয়ারার হিসেব আমরা না মানলেও, এ কথা সকলেই মানতে বাধ্য যে, ও-শাস্ত্রে জ্ঞান কর্ম ও ভক্তি তিনই আছে। ও-গ্রন্থ একে তিন, কিন্তু তিনে এক নয়। গীতায় ও ত্ৰিকাণ্ডের রাসায়নিক যোগের ফলে কোনো একটি নবকাণ্ডের সৃষ্টি হয় নি। এই কারণে গীতার এমন কোনো এক ব্যাখ্যা হতে পারে না, যা চূড়ান্ত হিসেবে সর্বলোকগ্রাহ্য হবে। কেননা এ ক্ষেত্রে তিন রকম ব্যাখ্যারই সমান অবসর। আছে। গীতার অন্তরে নানারূপ ধাতু আছে। কোনো ভাষ্যকারই তাকে ব্যাখ্যার বলে তার মনোমত এক ধাতুতে পরিণত করতে কৃতকার্য হবেন না। তা সে ধাতু জ্ঞানের স্বর্ণ ই হোক আর কর্মের লৌহই হোক। পূর্বাচার্যের প্রধানতঃ গীতাভাষ্যে জ্ঞানভক্তিমার্গ ই অবলম্বন করেছিলেন; গীতার ধর্ম যে মুখ্যতঃ সন্ন্যাসের ধর্ম নয়, ভগবদ্গীতা যে অবধূত-গীতা ও অষ্টাবক্র-গীতার জ্যেষ্ঠ সহোদর নয়, এ কথা কিন্তু আজ আমরা জোর করে বলতে পারি।
গীতার মতকে কর্মযোগ বলবার আমাদের অবাধ অধিকার আছে। আর যুগধর্মানুসারে আমরা গীতা নিংড়ে সেই মতই বার করবার চেষ্টা করব। আর, এ প্রযত্ন মহাত্মা তিলকের তুল্য আর-কে করতে পারেন? এ যুগের তিনিই যে হচ্ছেন অদ্বিতীয় কর্মযোগী, এ সত্য আর শিক্ষিত অশিক্ষিত কোন্ ভারতবাসীর নিকট অবিদিত? এই গীতাভাষ্যও মহাত্মা তিলকের কর্মযোগের অদ্ভুত ক্রিয়া। জ্ঞানের তরফ থেকে শংকরের ভাষ্য যেমন একমেবাদ্বিতীয়ম্, কর্মের তরফ থেকে মহাত্মা তিলকের ভাষ্যও, আমার বিশ্বাস, তেমনি একমেবাদ্বিতীয়ম্ হয়ে থাকবে।
৪.
গীতা কর্মমার্গের, জ্ঞানমার্গের কি ভক্তিমার্গের শাস্ত্র, এ তর্ক হচ্ছে এ দেশের ও সেকালের। কিন্তু এই গ্রন্থ নিয়ে এ যুগে এক নূতন তর্কের সৃষ্টি হয়েছে। সে তর্কটা যে কি মহাত্মা তিলকের ভাষাতেই বিবৃত করছি–
গ্রন্থ কোথায় রচিত হইয়াছে, কে রচনা করিয়াছে, তাঁহার ভাষা কিরূপ–কাব্যদৃষ্টিতে তাহাতে কতট। মাধুর্য ও প্রসাদগুণ আছে, গ্রন্থের রচনা ব্যাকরণশুদ্ধ অথবা তাহাতে কতকগুলি আর্মপ্রয়োগ আছে, তাহাতে কোন্ কোন্ মতের, স্থলের কিংবা ব্যক্তির উল্লেখ আছে, এইসকল ধরিয়া গ্রন্থের কাল নির্ণয় করা যাইতে পারে কি না…
এরূপ আলোচনাকে মহাত্মা তিলক বহিরঙ্গ পর্যালোচনা বলেন। এ আলোচনা আমরা অবশ্য বিলেত থেকে আমদানি করেছি।
পরন্তু, এক্ষণে পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতদের অনুকরণে এ দেশের আধুনিক বিদ্বানের। গীতার বাহাঙ্গেরই বিশেষ অনুশীলন করিতেছেন।
এরূপ আলোচনার প্রতি যারা আসক্ত তাদের প্রতি মহাত্মা তিলক যে আসক্ত নন, তার পরিচয় তিনি নিজ মুখেই দিয়েছেন। তিনি বলেন–
বাগদেবীর রহস্যজ্ঞ ও তাঁহার বহিরঙ্গ-সেবক, এই উভয়ের ভেদ দর্শন করিয়া মুরারি কবি এক সরস দৃষ্টান্ত দিয়াছেন—
অব্ধিলঙ্ঘিত এব বানরভটৈঃ কিং ত্বস্য গম্ভীরতাম।
আপাতালনিমগ্নপীবরতনুর্জানাতি মন্থাচলঃ।।
আর গ্রন্থরহস্য মধ্যে মন্দার পর্বতের মত আপাতাল-নিমজ্জিত হওয়ারই নাম অন্তরঙ্গ পর্যালোচনা। মুরারি কবির এই সরস উক্তিটি অবশ্য দেশি বিলেতি বহিরঙ্গ-সেবকদের কর্ণে একটু বিরস ঠেকবে। কিন্তু এ বিষয়ে যারা মদমত্ত জর্মান পাণ্ডিত্যের উল্লম্ফন নিরীক্ষণ করেছেন, তাঁদের পক্ষে মুরারি কবির উক্তির পুনরুক্তি করবার লোভ সংবরণ করা কঠিন।
কাব্যের অন্তরঙ্গের সাধনা ও বহিরঙ্গের সেব। এ দুটি ক্রিয়ার ভিতর যে শুধু প্রভেদ আছে তাই নয়, এর একটি প্রযত্ন অপরটির অন্তরায়। কাব্যের ভিতর থেকে ইতিহাস উদ্ধার করতে বসলে দেখা যায় যে, তার কাব্যরস শুকিয়ে এসেছে আর তার ভিতর নিমজ্জিত ঐতিহাসিক উপলখণ্ড সব দন্তবিকাশ করে হেসে উঠেছে। আমাদের মত কাব্যরসিকরা কাব্যের সমগ্র রূপ দেখেই মোহিত হই, অপরপক্ষে পণ্ডিতরা কাব্যের রস জিনিসটিকে উপেক্ষা করেন, অন্ততঃ জর্মান পণ্ডিতরা কাব্যের সম্মুখীন হবামাত্র তাকে সম্বোধন করে বলেন–
মাইরি রস ঘুরে বোস্,
দাঁত দেখি তোর বয়েস কত।
এরই নাম স্কলারশিপ।
তবে এ রকম ঐতিহাসিক কৌতূহল যখন মানুষের মনে একবার জেগেছে, তখন কাব্যের ঐ বহিরঙ্গ-পর্যালোচনায় যোগ দেবার প্রবৃত্তি দমন করা অসম্ভব, বিশেষতঃ আধুনিক বিদ্বান ব্যক্তিদের পক্ষে। অন্যে পরে কা কথা, মহাত্মা তিলকও গীতার বহিরঙ্গ-পর্যালোচনার মায়া কাটাতে পারেন নি। তিনি তাঁর গীতাভাষ্যর পরিশিষ্টে অতি বিস্তৃত ভাবেই এই বাহবিচার করেছেন। এতে আমি মোটেই আশ্চর্য হই নি। এই পাশ্চাত্ত্য পদ্ধতিতে শাস্ত্ৰবিচারের এ দেশে রাজা ছিলেন স্বর্গীয় রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকর। আর মহাত্মা তিলক যে-পুরীকে পুণ্যপুনাপুর বলেন, সেই পুরীই হচ্ছে রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকরের বাজধানী এবং সেই পুরীতেই এ দেশের যত বড় বড় ওরিয়েন্টালিস্ট অবতীর্ণ হয়েছেন। কর্মযোগে যতসব ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের উল্লেখ আছে সেসবই মহারাষ্ট্রীয়, একটিও বঙ্গদেশীয় নয়। স্বয়ং মহাত্মা তিলক হচ্ছেন এই বিলেতিদস্তুর-পণ্ডিতদের মধ্যে অগ্রগণ্য। এ বিষয়ে তাঁর কৃতিত্ব এতই অসামান্য যে, পাশ্চাত্ত্য ওরিয়েন্টালিস্ট সমাজেও তিনি অতি উচ্চ আসন লাভ করেছেন।