শাস্ত্রে বলে ‘যঃ পলায়তে স জীবতি’। আর শাস্ত্রবচন যে মিথ্যা নয়, তার প্রমাণ উক্ত যুদ্ধক্ষেত্র হতে যে-দুটি মুসলমান সেনাধ্যক্ষ পলায়ন করেছিলেন, তারা দুজনেই বেঁচেছিলেন। এই কারণে এ বিষয়ে আবুল ফজল তাঁর আকবরনামায় যা লিখেছেন, it seeins to me, সেই কথাটাই সত্য। তার কথা এই–
In the conflict 500 men perished. Among them was Rajah Birbal, whose loss the Iimperor greatly deplored.
যদি স্মিথ সাহেব বলেন যে, আবুল ফজলের উক্তি অগ্রাহ, কেননা তাতে বীরবলের প্রতি গালিগালাজ নেই; তাহলে বলি আবুল ফজল বলেছেন যে, বীরবল মরেছেন–আর মরার বাড়া গাল নেই।
৯.
বীরবল কি ভাবে মরেছিলেন— শুয়ে কি বসে, দাঁড়িয়ে কিংবা দৌড়তে দৌড়তে–তা জানবার কোনোরূপ কৌতূহল আমার নেই। আমি জানতে চাই তার জীবন, তার মৃত্যু নয়। কেননা মৃত্যুতে আমরা সবাই এক, শুধু জীবনে বিভিন্ন।
তাঁর মৃত্যুর কথাটা তুলেছি এই জন্য যে, উক্ত ঘটনায় আর পাঁচজনে কতটা আনন্দিত বা দুঃখিত হন, তার থেকে তার চরিত্র কতকটা অনুমান করা যায়।
বীরবলের মৃত্যুসংবাদে আকবর যে শোকে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন, সে বিষয়ে সকল ঐতিহাসিক একই সাক্ষ্য দিয়েছেন। অপরপক্ষে বীরবলের মৃত্যুতে দেশের পাপ গেল মনে করে বাদাউনি প্রমুখ মৌলবীর দল তাদের উল্লাস যে কি রকম তারস্বরে ব্যক্ত করেছিলেন, তার পরিচয় তো বাদাউনির পূর্বোক্ত কথাতেই পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, বীরবল জীবনে যেসকল জঘন্য কাজ করেছিলেন, সেইসব পাপের শাস্তিস্বরূপ তিনি নরকের কুকুরশ্রেণীভুক্ত হয়েছেন। এই জঘন্য কাজগুলি কি?
আকবরশাহ স্বধর্মের মায়া কাটিয়ে স্বকল্পিত এক নতুন ধর্মের সৃষ্টি করেছিলেন। বাদাউনির বিশ্বাস বীরবলই তাকে ধর্মভ্রষ্ট করে।
আকবরের সভায় মোল্লা মহম্মদ ইয়াজিজি নামক এক ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে সুন্নি মতের নানারূপ নিন্দা করে বাদশাহকে শিয়া মতাবলম্বী করতে প্রাণপণ চেষ্টা করে, পরে বাদাউনির ভাষায়
This man was soon left behind by Birbal, that bastard, and by Shaik Abul-Fazal.
এঁদের কুপরামর্শে আকবর শাহ কতদূর ধর্মভ্রষ্ট হয়েছিলেন, তার পরিচয় বাদাউনির বক্ষ্যমান কথাগুলিতেই পাওয়া যায়–
The daily prayers, the fasts and prophecies were all pronounced delusions, as being opposed to sense. Reason and not revelation was declared to be the basis of religion.
আর এ সবই বীরবলের কুবুদ্ধিতে। আকবর যে একজন রিজ্নএর ভক্ত অর্থাৎ র্যাশনালিস্ট হয়েছিলেন, এ কথা সহজেই বিশ্বাস হয়। কারণ বৈষয়িক লোকমাত্রেই দার্শনিক হতে গেলেই ন্যাশনালিস্ট হয়। ন্যাশনালিস্ট হলে মানুষের মাথা খোলে না, কিন্তু তার হৃদয় খুব উদার হয়। আকবরেরও তাই হয়েছিল। তিনি র্যাশনালিস্ট হবার পর প্রকাশ্য দরবারে বলেন যে, ‘আমি পূর্বে বহু ব্রাহ্মণকে জোর করে মুসলমান করেছি, আর তারা প্রাণভয়ে সে ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। এখন বুঝছি যে, আমি অতি গর্হিত কাজ করেছি।‘ তাঁর এ কথায় সকলেই সায় দেবে।
১০.
ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে কোনো ব্যক্তিবিশেষের মনের অথবা মতের কি বদল হয়, তাতে অপরের কিছু যায় আসে না, যতক্ষণ সে অপরের ক্রিয়াকলাপের উপর হস্তক্ষেপ না করে। আকবর শাহ তাঁর নব মতানুসারে যেসব হুকুম প্রচার করেন, তার দরুনই স্বধর্ম-নিরত মুসলমানগুণ ক্ষোভে আক্রোশে অধীর হয়ে উঠেছিল। স্মিথ সাহেব তাঁর গ্রন্থে এইসব নব রাজশাসনের যে ফর্দ দিয়েছেন, সংক্ষেপে তার পরিচয় দিচ্ছি—
১ কোনো বালকের ‘মহম্মদ’ এই নাম রাখা হবে না। যদি কারও নাম মহম্মদ থাকে তো তার সে নাম বদলে নতুন নাম দিতে হবে;
২ তাঁর রাজ্যে কোনো নূতন মসজিদ কেউ নির্মাণ করতে পারবে না আর জীর্ণ মসজিদের কোনোরূপ সংস্কার কেউ করতে পারবে না;
৩ তার রাজ্যে গোহত্যা নিষিদ্ধ। আর এ অজ্ঞা অমান্য করবার শাস্তি প্রাণদণ্ড। উপরন্তু বৎসরের তিন শ পঁয়ষটি দিনের মধ্যে এক শ দিন মাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ;
৪ তার রাজ্যে দাড়ি কেউ রাখতে পারবে না, সকলকেই তা কামাতে হবে;
৫ পিঁয়াজ রশুন ও গোমাংস ভক্ষণ তার রাজ্যে নিষিদ্ধ;
৬ উপাসনার সময় হিন্দুমুসলমান নিবিচারে সকলকে পট্টবস্ত্র ও স্বর্ণ ধারণ করতে হবে।
এইরকম আরও অনেক খামখেয়ালি রাজাজ্ঞা তিনি প্রচার করেছিলেন। পুঁথি বেড়ে যায় বলে সেসবের আর উল্লেখ করলুম না। স্মিথ সাহেব বলেছেন যে–
The whole gist of the regulations was to further the adoption of Ilindu, Jaina, and Parsce practices, while discouraging or positively probibiting essential Muslim rites.
স্মিথ সাহেব যখন এসকল বিধিনিষেধকে silly regulations বলেছেন, তখন বাদাউনি যে তাকে abominable deeds বলবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি। আর র্যাশনালিস্ট-এর এইসব বাদশাহী পাগলামির জন্য বাদাউনি বীরবলকেই প্রধানতঃ দায়ী মনে করেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, ফৈজী, আবুল ফজল ও বীরবল, এই তিন গ্রহ একত্র মিলে আকবরের কুবুদ্ধি ঘটায়; আর এ তিনের মধ্যে শনি ছিলেন বীরবল।
১১.
অপরপক্ষে সেকালের হিন্দুরা যে বীরবলের মহাভক্ত ছিলেন, তার পরিচয় পাওয়া যায় কেশবদাসের কবিতায়। আকবর শাহের আমলে তুলসীদাস প্রমুখ অনেক হিন্দি কবির আবির্ভাব হয়, কেশবদাস তাদের অন্যতম। কেশবদাস রামসিংহ নামক বুন্দেলখণ্ডের জনৈক রাজার ভ্রাতা ইন্দ্রজিত সিংহের সভাকবি ছিলেন। তিনি রসিকপ্রিয়া নামক একখানি কাব্য হিন্দি ভাষায় রচনা করেন। হিন্দিভাষীরা এ কাব্যকে আজও হিন্দি কাব্যসাহিত্যের একখানি রত্ন বলে মনে করেন।