১২.
অতএব দেখা গেল যে, পরভাষা, তা মৃতই হোক আর বিদেশিই হোক, লোকভাষার উপর প্রভুত্ব করে এই গুণে যে, তা জ্ঞানবিজ্ঞানের ভাষা, এক কথায় বিদ্যাশিক্ষার ভাষা; বলা বাহুল্য, ধর্মের ভাষাও আসলে বিদ্যার ভাষা। অপর বিদ্যার সঙ্গে এ বিদ্যার প্রভেদ এই যে, তা অপর বিদ্যা নয়, তা হচ্ছে। থিয়োলজি অর্থাৎ ব্রহ্মবিদ্যা। এই গুণেই ইংরেজি আজ বাংলার উপর প্রভুত্ব করছে। এ প্রভুত্ব হতে মুক্তিলাভ করবার একমাত্র উপায় হচ্ছে বাংলাকে বিদ্যাশিক্ষার ভাষা, অধ্যয়ন-অধ্যাপনার ভাষা, এক কথায় বিদ্যালয়ের ভাষা করে তোলা। আমাদের উচ্চ আশা এই যে, ভবিষ্যতে বাংলা উচ্চশিক্ষার ভাষা হবে; শুধু বাল্যবিদ্যালয়ে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়েও এ ভাষা পাবে প্রথম আসন, এবং ইংরেজি দ্বিতীয় আসন গ্রহণ করবে। যতদিন বাংলা, হয় বিদ্যালয়ের বহিভূত হয়ে থাকবে, নয় ইংরেজির অনুচর কিংবা পার্শ্বচর হিসাবে সেখানে স্থান পাবে, ততদিন বাংলা সাহিত্য সর্বাঙ্গসুন্দর ও সর্ব শক্তিশালী হয়ে উঠবে না। এবং বাঙালির প্রতিভাও ততদিন পূর্ণবিকাশ লাভ করবার পূর্ণ সুযোগ পাবে না। সাহিত্যেই জাতীয় মনের প্রকাশ, অতএব সাহিত্যের ঐশ্বর্যেই জাতীয় মনের ঐশ্বর্যের পরিচয়। আমি পূর্বেই বলেছি, ভাষা ও মন একই বস্তুর এপিঠ আর ওপিঠ। বাংলা ভাষাকে বিদ্যালয়ের ভাষা করে তোলবার পথে কত এবং কি গুরুতর বাধা আছে, সে বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ সচেতন। তৎসত্ত্বেও আমি বলি, সেসকল বাধা আমাদের অতিক্রম করতেই হবে, নচেৎ বাঙালির মন চিরকাল অর্ধপক অবস্থাতেই থেকে যাবে। বঙ্গসাহিত্যের গুরুগম্ভীর প্রবন্ধনিবন্ধাদি পাঠ করলেই দেখা যায় যে, সেসকল রচনা কোনো অংশে পাকা আর কোনো অংশে কাঁচা। এসব লেখার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থীদের উত্তরপত্রের একটা পারিবারিক সাদৃশ্য আছে। পঠিত পুস্তকের স্মৃতি লেখকদের যেখানে অক্ষুণ্ণ সেখানে লেখা পাকা, আর যেখানে ক্ষুণ্ণ সেখানে কাঁচা। রবীন্দ্রনাথের কাব্যে যে-মনের পরিচয় পেয়ে ইউরোপ যুগপৎ বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছে, সেই পকষায় মন আমাদের শিক্ষিতসম্প্রদায়ের মধ্যে একান্ত দুর্লভ। এর কারণ, আমাদের মনকে দিবারাত্র পরভাষার জাগ দিয়ে অকালপক্ক করে তোলা হচ্ছে।
বিদ্যালয়ের ভাষা না হলে আমাদের ভাষা যে তার পূর্ণ শ্ৰী পূর্ণ শক্তি লাভ করবে না, এ কথাও যেমন সত্য, অপর পক্ষে আমাদের সাহিত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের সাহিত্য না হলেও যে তা বিদ্যালয়ে গ্রাহ্য হবে না, এ কথাও তেমনি সত্য। বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদর্শনের পত্ৰসূচনায় লিখেছেন
এদিকে কোন সুশিক্ষিত বাঙ্গালিকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, “মহাশয় আপনি বাঙ্গালি বাঙ্গল। গ্রন্থ বা পত্রাদিতে আপনি এত হতাদর কেন?” তিনি উত্তর করেন, “কোন্ বাঙ্গলা গ্রন্থে বা পত্রে আদর করিব? পাঠ্য রচনা পাইলে অবশ্য পড়ি।” আমরা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করি, যে এ কথার উত্তর নাই।
আজকের দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষেরা যদি আমাদের ঐরূপ প্রশ্ন করেন, তাহলে আমাদেরও, মুক্তকণ্ঠে না হোক, রুদ্ধকণ্ঠে স্বীকার করতে হবে যে, সে প্রশ্নের উত্তর নেই। তবে আমাদের এ ক্ষেত্রে কর্তব্য যে কি, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলা ভাষায় আমাদের বিদ্যার সাহিত্য গড়ে তুলতে হবে, এবং সেজন্য বহু শিক্ষিত লোককে কায়মনোবাক্যে বহুদিন ধরে পরিশ্রম করতে হবে। ইতিমধ্যেই আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মাতৃভাষাতেই ইতিহাস এবং দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধসকল রচনা করতে প্রবৃত্ত হয়েছেন; কিন্তু সে সাহিত্যের যে তেমন কিছু গৌরব কিংবা সৌরভ নেই তার কারণ, এক দিকে ইংরেজি ভাবের আর-এক দিকে সংস্কৃত ভাষার চাপের মধ্যে পড়ে আমরা অকুণ্ঠিতচিত্তে ভাবতেও পারি নে, মুক্তহস্তে লিখতেও পারি নে।
১৩
উপসংহারে আমার বক্তব্য এই যে, মৃতভাষা ও পরভাষার প্রভুত্ব থেকে মাতৃভাষাকে আমি মুক্ত করতে চাই বলে এ ভুল যেন কেউ না করেন যে, আমি সংস্কৃত ও ইংরেজির পঠনপাঠন বন্ধ করে দিতে চাই। আমার বিশ্বাস, তা করলে বঙ্গসাহিত্যে ইভলিউশন হওয়া দূরে থাক্, একটা বিষম ও সম্ভবত ভীষণ রিভার্শন এসে পড়বে। সংস্কৃত ও ইংরেজি সাহিত্যের চর্চা থেকেই আমরা সেই মনের বল ও হাতের কৌশল লাভ করব, যা আমাদের সাহিত্যের মুক্তির কারণ হবে। বর্তমানে ইউরোপের সকল ভাষাই গ্রীক-ল্যাটিনের অধীনতা হতে মুক্তিলাভ করেছে, কিন্তু তাই বলে সে দেশে গ্রীক-ল্যাটিনের অধ্যয়ন-অধ্যাপনা বন্ধ হয় নি। বরং সাহিত্যরাজ্যে ইউরোপের এই স্বদেশি যুগে উপরোক্ত দুটি ক্ল্যাসিকের চর্চা যত গভীর ও বিস্তৃত হয়েছে, ক্ল্যাসিক-শাসিত যুগে তার সিকির সিকিও হয় নি।
যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে, ক্ল্যাসিক চর্চা করবার সার্থকতা কি, তাহলে। সে দেশের কাব্যরসের রসিক উত্তর দেবেন যে, ঐ দুটি প্রাচীন ভাষায় যে কাব্যামৃত সঞ্চিত রয়েছে, তার রসাস্বাদ না করলে মানবজনম বিফল হয়; দার্শনিক বলবেন, মনের উদারতা ও হৃদয়ের গভীরতা লাভ করবার জন্য অতীতের সাহিত্যের পরিচয় লাভ করা একান্ত প্রয়োজন; বৈজ্ঞানিক প্রমাণ। করতে উদ্যত হবেন যে, অতীতের সভ্যতার সঙ্গে সাক্ষাৎ-সম্বন্ধে পরিচয় না থাকলে আমরা বর্তমান সভ্যতার যথার্থ প্রকৃতি ও মতিগতির পরিচয় পাব না, কেননা বর্তমান ক্রমগঠিত হয়েছে অতীতের গর্ভে; এবং আর্টিস্ট দেখিয়ে দেবেন যে, ক্ল্যাসিক সাহিত্যের এমন-একটি গুণ আছে যা বর্তমান সাহিত্যে পাওয়া দুর্ঘট এবং সে গুণের নাম হচ্ছে আভিজাত্য। এসকল উক্তিই সত্য, সুতরাং সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্যের সম্যক্ চর্চা আমাদের চিরদিনই করতে হবে। বলা বাহুল্য, পৃথিবীর অসংখ্য মৃতভাষার মধ্যে গ্রীক ল্যাটিন ও সংস্কৃত, এই তিনটি আর্যভাষাই ক্ল্যাসিক, অপর কোনোটিই নয়। এ স্থানে একটি কথার উল্লেখ করা দরকার। অলংকারশাস্ত্রের ভাষায় বলতে গেলে, ইউরোপে গ্রীক-ল্যাটিনের বাণী সেকালে ছিল প্রভুসম্মিত, একালে তা হয়েছে সুহৃদ্সম্মিত; অর্থাৎ আগে যা ছিল বেদবাক্য, এখন তা হয়েছে ন্যায়কথা। আশা করি, কালে সংস্কৃতসরস্বতীর বাণীও আমাদের কাছে তার প্রভুসম্মিত চরিত্র হারিয়ে সুহৃদ্সম্মিত হয়ে উঠবে। তা যে দূর-ভবিষ্যতেও কান্তাবাণী হয়ে উঠবে, সে ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। এই তিনটি ক্ল্যাসিকের মহা গুণ এই যে, তার প্রত্যেকটিই পুরুষালি সাহিত্য, মেয়েলি নয়; সে সাহিত্যে আধআধ ভাষ কিংবা গদ্গদ ভাষের স্থান নেই; সে সাহিত্য যেখানে কোমল সেখানে দুর্বল নয়, যেখানে সানুরাগ সেখানে সানুনাসিক নয়। এ কারণেও সংস্কৃতের চর্চা আমাদের পক্ষে অত্যাবশ্যক এবং অবশ্যকর্তব্য, কেননা বাংলার বাণীর কান্তাসম্মিত হয়ে পড়বার দিকে একটা স্বাভাবিক ঝোঁক এবং রোখ আছে।