সুতরাং বর্তমান অজ্ঞান অবস্থা আমাদের কাছে মোটেই সন্তোষজনক নয়। বঙ্গসরস্বতী কালে যে আমাদের মনোজগতের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হবেন, এই দুরাশাই আমাদের উচ্চ আশা। অতএব কি অবস্থায় এবং কি কারণে লোকভাষা পরবশ হয়ে পড়ে, আর কি অবস্থায় এবং কি উপায়ে তা আত্মবশ হয়ে ওঠে, তারও কিঞ্চিৎ আলোচনা করা দরকার। অবস্থা বুঝলে তার ব্যবস্থা করা সহজ। মাতৃভাষাকে স্বপ্রতিষ্ঠ করবার লোভ যে আমরা কিছুতেই সংবরণ করতে পারি নে, তার কারণ আমরা জানি যে ‘সর্বম্ আত্মবশং সুখ’ আর ‘সর্বং পরবশং দুঃখম্।
১০.
জীবন্ত ভাষার উপর মৃতভাষার প্রভুত্বের কারণ নির্ণয় করবার জন্য ল্যাটিনের উদাহরণ নেওয়া যাক। পুরাকালে ল্যাটিন যে ইউরোপের পশ্চিমভাগের উপর একাধিপত্য করেছিল তার কারণ, সেকালে ল্যাটিন ছিল সে ভূভাগের রাজভাষা। গ্রীক ভাষা সে যুগের রোমানদের বিদ্যাশিক্ষার ভাষা হলেও সে ভাষা রাজভাষা নয় বলে রোমের অধীনস্থ অপর দেশসকলে তা অপরিচিত ছিল। তবে রোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসের পরও ল্যাটিন যে আর এক হাজার বছর ধরে ইউরোপে নির্বিবাদে প্রভুত্ব করে, তার কারণ রোম তার রাজত্ব হারিয়ে স্বর্গত্ব লাভ করল; যে রোম ছিল প্রাচীন যুগের কর্মরাজ্যের কেন্দ্র, সেই রোম হয়ে উঠল মধ্যযুগের ধর্মরাজ্যের ‘ইটারন্যাল সিটি” অর্থাৎ অমরাপুরী। এক কথায়, রোমানরা খৃস্টধর্ম অবলম্বন করবার পর ল্যাটিন হল দেবভাষা। কোনো বিশেষ ধর্মের ভাষা, অর্থাৎ যজনযাজন ধ্যানধারণা উপাসনা-আরাধনা তন্ত্রমন্ত্র স্তবস্তোত্রের ভাষা যে সেই ধর্মাবলম্বী লৌকিক মনের অলৌকিক শ্রদ্ধা ও ভক্তি আকর্ষণ করে, বিশেষতঃ সে ভাষার অর্থ যদি জনগণের জানা না থাকে, এ সত্য তত জগবিখ্যাত। ল্যাটিনের প্রতাপ। ইউরোপে আজও অক্ষুণ্ণ থাকত, যদি না রেনেসাঁ এবং রিফর্মেশন ইউরোপের মনকে রোমান চার্চের একান্ত বশ্যতা থেকে মুক্ত করত। মধ্যযুগের শেষভাগে গ্রীক সাহিত্যের আবিষ্কারের সঙ্গেসঙ্গে ইউরোপ মানুষের স্বাধীন চিন্তা ও স্বােপার্জিত জ্ঞানের সাক্ষাৎ লাভ করলে। এর ফলে, রোমের ধর্মমন্দিরের অটল ভিত টলটলায়মান হল, এবং সেই সঙ্গে ল্যাটিন ভাষারও দৈবশক্তি লোপ পাবার উপক্রম হল। গ্রীক ভাষার প্রভূত ঐশ্বর্য ও অপূর্ব সৌন্দর্যের তুলনায় ল্যাটিন ভাষা ইউরোপের শিক্ষিতসম্প্রদায়ের চোখে ক্ষীণসত্ত্ব ও হীনপ্রভ হয়ে পড়ল। এই গ্রীক সাহিত্যের চর্চায় সে যুগের মনীষিগুণ নূতন দর্শনবিজ্ঞানের সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলেন। কিন্তু স্বাধীনচিন্তাপ্রসূত দর্শনবিজ্ঞান সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্মতন্ত্রকে বিচলিত করতে পারলেও বিপর্যস্ত করতে পারে না। এক ধর্মমতের স্থান অধিকার করতে পারে শুধু আর-এক ধর্মমত। তাই লুথারের প্রবর্তিত রিফর্মেশনই জর্মানিক ভাষাসমূহকে ল্যাটিনের অধীনতা থেকে যথার্থ মুক্তি দান করলে।
১১.
লুথার যেদিন জর্মানির লোকভাষায় বাইবেলের অনুবাদ করলেন, সেই দিনই জর্মান সাহিত্যের পাকা বুনিয়াদের পত্তন হল। ভাষার সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক যে অতি ঘনিষ্ঠ, এ সত্য সকলের নিকট সুস্পষ্ট না হলেও নিঃসন্দেহ। মানুষের মনের বাইরে ভাষা নেই, এবং ভাষার বাইরেও মন নেই। ভাষা ও মন হচ্ছে একই বস্তুর অন্তর ও বাহির। সুতরাং ধর্মমত ভাষান্তরিত হলে রূপান্তরিত হতে বাধ্য। একটি উদাহরণ নেওয়া যাক। ইউরোপ খৃস্টধর্ম অবলম্বন করবার অব্যবহিত কাল পরেই সে দেশে দুটি সম্পূর্ণ পৃথক্ খৃস্টসংঘের সৃষ্টি হল, একটি রোমে, আর-একটি কন্স্টান্টিনোপলে। রোমান সাম্রাজ্য তার অধঃপতনের মুখে যে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল, খৃস্টধর্ম তার অভ্যুত্থানের মুখে ঠিক সেই দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল। এর মূল কারণ যে ভাষার পার্থক্য, তার পরিচয় এ দুটি সংঘের নামেই পাওয়া যায় : একটির নাম গ্রীক চর্চ, অপরটির রোমান। নিউ টেস্টামেন্ট যদি গ্রীক, অর্থাৎ ইউরোপের ভাষায় লেখা না হত, তাহলে এশিয়ার ধর্ম ইউরোপে গ্রাহ্য হত কি না সে বিষয়েও আমার সন্দেহ আছে। ভাষার শক্তিতে আমি এতটাই বিশ্বাস করি। এ দেশের বৌদ্ধধর্মও যে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিল, তার মূলেও ছিল ঐ ভাষার পার্থক্য : মহাযানের ভাষা সংস্কৃত, এবং হীনযানের পালি।
অপর পক্ষে পৃথিবীতে যখন কোনো নূতন ধর্মমত জন্মলাভ করে, তখন তার বাহন হয় একটি নূতন ভাষা। বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হয়েছিল পালিতে, এবং জৈনধর্ম মাগধী প্রাকৃতে; সুতরাং লুথার যখন খৃস্টধর্মের নূতন সংস্করণ প্রকাশ করলেন, তখন তাকে ল্যাটিন ত্যাগ করে জর্মান ভাষারই আশ্রয় নিতে হল। তিনি এ উপায় অবলম্বন না করলে প্রোটেস্টান্টিজুম ইউরোপে একটি স্বতন্ত্র ধর্ম হিসেবে কখনই প্রতিষ্ঠালাভ করতে পারত না। তার প্রমাণ, ল্যাটিনের অপভ্রংশ যাদের মাতৃভাষা, ইউরোপের সেইসকল জাতি আজও রোমান ক্যাথলিক; রোমান ভাষাই রোমান চর্চের সঙ্গে তাদের মনের প্রধান যোগসূত্র। অপর পক্ষে যেসকল জাতির ভাষা জর্মানিক, সেইসকল জাতিই প্রোটেস্টান্ট। একই কারণে বাংলা সংস্কৃতের প্রভুত্ব হতে মুক্তিলাভ করেছে। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পরেই বাংলা সাহিত্যের প্রকৃত অভ্যুদয়ের সূত্রপাত হয়েছে। মহাপ্রভু যেদিন ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে বৈষ্ণবধর্মের, জ্ঞান ও কর্মের উপরে ভক্তির প্রাধান্য প্রচার করতে উদ্যত হলেন, সেদিন তাঁকে সংস্কৃত ত্যাগ করে বাংলার আশ্রয় নিতে হল। চৈতন্যের ধর্মসংস্কারকে বাংলাদেশের রিফর্মেশন বলা অসংগত নয়। তার পর এসেছে আমাদের রেনেসাঁ; ইউরোপ একদিন যেমন গ্রীক সাহিত্য আবিষ্কার করে ল্যাটিন ভাষার একাধিপত্য থেকে মুক্তি লাভ করে, আমরাও তেমনি ইংরেজি সাহিত্য আবিষ্কার করে সংস্কৃত ভাষার একাধিপত্য হতে মুক্তিলাভ করেছি, এবং সে একই কারণে। পশ্চিম ইউরোপে গ্রীক, ধর্মের নয়, বিদ্যাশিক্ষার ভাষা বলেই গ্রাহ্য হয়েছিল; আমাদের কাছেও ইংরেজি তেমনি, ধর্মের নয়, বিদ্যাশিক্ষার ভাষা বলেই গ্রাহ্য হয়েছে। ল্যাটিন অবশ্য তাই বলে ইউরোপে বাতিল হয়ে। যায় নি, সে ভাষার অধ্যয়ন-অধ্যাপনা আজও সে দেশে সজোরে চলছে। কিন্তু সে বিদ্যাশিক্ষার ভাষা হিসাবে। অবশ্য রোমান ক্যাথলিক জাতির কাছে সে ভাষা আজও কতক পরিমাণে ধর্মের ভাষা বলে মান্য, কিন্তু প্রধানতঃ বিদ্যাশিক্ষার ভাষা বলেই গণ্য। আমাদের বাঙালিদের কাছে সংস্কৃত আজকের দিনে ঐ হিসাবেই গণ্য ও মান্য।