৬.
অপর পক্ষে, যে গুণে ফরাসি ভাষা রুশীয় জর্মান প্রভৃতি ভাষার উপর প্রভুত্ব করেছে, সেই গুণেই তা এযাবৎ স্বীয় সুনীতি ও সুরুচি রক্ষা করে এসেছে। ফরাসি হচ্ছে বড় ঘরের সন্তান, প্রাচীন ল্যাটিনের বংশধর; সুতরাং এ ভাষা তার আত্মজ্ঞান কখনোই হারায় নি, তার আভিজাত্যের অহংকারই তার আত্মরক্ষার কারণ হয়েছে। ফরাসি প্রভৃতি ল্যাটিন জাতিরা বহুকাল যাবৎ জর্মানদের বর্বর বলেই উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করে এসেছিল। বর্বর শব্দের মৌলিক অর্থ হচ্ছে সেই জাতি, যার ভাষা বোঝা যায় না। সুতরাং এ জাতি যে কস্মিনকালেও অজ্ঞাতকুলশীল জর্মান ভাষার প্রাধান্য স্বীকার করে নি, তা বলা বাহুল্য।
এমনকি, যে জর্মান দর্শন গত শতাব্দীতে পৃথিবীর শিক্ষিতসমাজের মনের উপর একছত্র এবং অখণ্ড রাজত্ব করেছে সে দর্শনও ফরাসি মনকে বেশিদিন আত্মবশে রাখতে পারে নি। প্রসিদ্ধ ফরাসি লেখক তেইন গত শতাব্দীর মধ্যভাগে এই মত প্রকাশ করেন যে, জর্মানি তৎপূর্ববর্তী এক শ বৎসর যা চিন্তা করেছে, তৎপরবর্তী এক শ বৎসর সমগ্র ইউরোপকে সেই চিন্তার পুনশ্চিন্তা করতে হবে। এ ভবিষ্যদ্বাণী যে খেটেছে, তার প্রমাণ আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েই পাই। এ যুগের যে ইংরেজি দর্শন আমরা চর্চা করি, তা যে গত যুগের জর্মান দর্শনের পুনরাবৃত্তি মাত্র, তার পরিচয় নবকান্টিয়ান, নব-হেগেলিয়ান প্রভৃতি নামেই পাওয়া যায়। আমরা দূর-এশিয়াবাসী হয়েও জর্মান দর্শনকে দূরে রাখতে পারি নি; বরং সত্য কথা বলতে হলে, গত ত্রিশ বৎসর ধরে আমরাও শুধু জর্মানির তৈরি বৈজ্ঞানিক খাদ্য উদরস্থ করছি, আর তার জাবর কাটছি। মনোজগতে যে ল্যাটিন নামক একটি প্রদেশ আছে যা কুয়াশায় ঢাকা নয়, এ কথা আমরা নিজেরা আলোর দেশের লোক হয়েও একরকম ভুলেই গিয়েছিলুম। একবর্ণ জর্মান না জেনেও Nietsche নিশের বই আমরা অনেকেই পড়েছি এবং তার কথার দুকূল-ভাসানো বন্যায় হাবুডুবুও খেয়েছি, কিন্তু ফরাসি দার্শনিক Guyot গুইয়ের নাম আমরা অনেকেই শুনি নি, যদিচ উভয়েই মনোরাজ্যে একই পথের পথিক; দুয়ের ভিতর প্রভেদ এই যে, যে পথে ফরাসি গুইয়ো ধীরপদক্ষেপে অগ্রসর হয়েছেন, সেই পথে জর্মান নিশে তাণ্ডবনৃত্য করেছেন। নকুলীশ-পাশুপতদর্শনে দেখতে পাই যে, পাশুপতসম্প্রদায়ের সাধনমার্গে উপহারসংজ্ঞক ছয় প্রকার ক্রিয়া ছিল। তার মধ্যে প্রধান চারটি হচ্ছে, হা হা করে হাস্য করা, গন্ধর্বশাস্ত্রানুসারে গীত গাওয়া, নাট্যশাস্ত্রানুসারে নৃত্য করা এবং হুড়কার করা অর্থাৎ পুঙ্গবের ন্যায় চীৎকার করা। নিশের লেখা পড়ে আমার মনে হয় যে, নকুলীশ-পাশুপতদর্শন ভারতবর্ষে তার ভবলীলা সংবরণ করে জার্মানিতে আবার পুনর্জন্ম লাভ করেছে। গ্যেটে এবং কান্ট সাহিত্যের জগদ্গুরু হলেও এ কথা নিঃসন্দেহ যে, বিশ্বমানবের মনের উপর আধুনিক জর্মান মনের প্রভাব যেমন অকারণ তেমনি মারাত্মক; কেননা জর্মান দর্শন অপর জাতির মনের আকাশ ঘুলিয়ে দেয়; জর্মান আত্মার। অশেষ গুণের মধ্যে একটি হচ্ছে কুয়াশা সৃষ্টি করবার শক্তি, এবং সে কুয়াশার গতিরোধ করাও যেমন কঠিন, তার প্রকোপে মনের স্বাস্থ্যরক্ষা করাও তেমনি কঠিন। এ সত্য ফরাসি জাতিই সর্বপ্রথমে আবিষ্কার করে। যে সময়ে জর্মান আত্মা আমাদের ঘাড়ে চড়তে শুরু করে, ঠিক সেই সময়ে তা ফরাসিদের ঘাড় থেকে নেমে যেতে শুরু করে। আজ প্রায় ত্রিশ বৎসর পূর্বে তেইন-এর একটি ধনুর শিষ্য মরিস বাররে Maurice Burrés ল্যাটিন মনের উপর জর্মান মনের এই বিজাতীয় উপদ্রবের উচ্ছেদকল্পে লেখনী ধারণ করেন। যে পুস্তকে তিনি মনোজগতে জর্মান শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করেন, সে পুস্তকের নাম। Under the Eyes of the Barbarias। জর্মান জাতির আদিম বর্বরতা যে এ যুগে বৈজ্ঞানিক বর্বরতার আকার ধারণ করেছে, বর্তমান যুদ্ধের বহু পূর্বে তা ফরাসি মনীষীদের কাছে ধরা পড়ে, এবং তাও এক হিসেবে ভাষাসূত্রে। জর্মান সাহিত্যের ফরাসি পাঠকের হঠাৎ আবিষ্কার করেন যে, জর্মান অভিধানে এমন একটি কথা আছে, যা ফরাসি অভিধানে নেই, এবং সে হচ্ছে পরশ্রীকাতরতা। অপর পক্ষে জর্মান অভিধানে liumanity শব্দের সাক্ষাৎ অণুবীক্ষণের সাহায্যেও লাভ করা যায় না। মাতৃভাষা জাতির পৈতৃক প্রাণরক্ষার পক্ষে যে কতদূর সহায়, তারই প্রমাণস্বরূপ, ঈষৎ অবান্তর হলেও, এ ব্যাপারের উল্লেখ করলুম।
৭
আমি ইতিপূর্বে বলেছি যে, লোকভাষা মৃতভাষা এবং বিদেশিভাষার অধীনতাপাশ মোচন করতে পারলেও অক্লেশে সম্পূর্ণ আত্ম প্রতিষ্ঠ হতে পারে না। মৌখিক ভাষার স্বরাজ্যলাভের তৃতীয় পরিপন্থী হচ্ছে পুঁথিগত কৃত্রিম ভাষা, অর্থাৎ সাধুভাষা। এ বিষয়ে এ প্রবন্ধে আমি বেশি বাক্যব্যয় করতে চাই নে, কেননা ইতিপূর্বে এ বিষয়ে আমি বহু বক্তৃতা করেছি। সেসব কথার পুনরুক্তি করা এ ক্ষেত্রে আমার পক্ষে প্রেয়ও নয়, শ্রেয়ও নয়; তবে কথাটা একেবারে হেঁটে দিলে এ প্রবন্ধের অঙ্গহানি হয়, এই কারণে সংক্ষেপে এ বিষয়ে আমার মত বিবৃত করতে বাধ্য হচ্ছি।
মানুষে মৃতভাষা ত্যাগ করে যখন প্রথমে লোকভাষা অর্থাৎ মৌখিক ভাষায় লিখতে আরম্ভ করে, তখন সেই মৃতভাষার রচনাপদ্ধতির আদর্শে ই রচনা করা তার পক্ষে স্বাভাবিক। এর উদাহরণও ইউরোপীয় সাহিত্যে। পাওয়া যায়। পদে ও বাক্যে ল্যাটিনিজমের আমদানি ইংরেজির আদি গদ্যলেখকেরাও যথেষ্ট করেছিলেন। সুতরাং আমরাও যে তা করব, সে তো নিতান্ত স্বাভাবিক। বাংলা গদ্যের বয়েস সবে এক শ বছর হলেও তা এক যুগ পিছনে ফেলে এখন দ্বিতীয় যুগে চলছে। প্রথম যুগে সংস্কৃত গদ্যের অনুকরণে এবং সংস্কৃত শব্দের উপকরণে বাংলা গদ্য লেখা হত। যে যুগ চলছে, তাতে বাংলা গদ্য গঠিত হয়েছে ইংরেজি বাক্যের অনুকরণে এবং সংস্কৃত শব্দের উপকরণে। আমার বিশ্বাস, এখন আমরা তার তৃতীয় যুগের, অর্থাৎ সম্পূর্ণ স্বাধীনতার যুগের, মুখে এসে পৌঁছেছি। আমার এ বিশ্বাস ভুল হতে পারে, কিন্তু এ কথা নিঃসন্দেহ যে, পরভাষার অনুকরণে এবং উপকরণে যে লিখিত ভাষা গঠিত হয়, সেই পুঁথিগত ভাষা অনেক অংশে নির্জীব। তার পর আরএকটি কথা আছে। যার জীবন আছে, তার নিত্যনূতন বদল হয়। জীবন হচ্ছে একটি ধারাবাহিক পরিবর্তনের স্রোত মাত্র; সেই কারণেই জীবন্ত ভাষা ক্রমপরিবর্তনশীল, এবং যুগে যুগে তা নূতন মূর্তি ধারণ করে; অপর পক্ষে লিখিত ভাষা অক্ষরের মধ্যে অক্ষয় হয়ে বসে থাকে। নৈসর্গিক কারণেই লিখিত ভাষার কাছ থেকে কথিত ভাষা কালবশে এতটা দূরে সরে যায় যে, সে দুই ভাষা প্রায় দুটি বিভিন্ন ভাষা হয়ে ওঠে। তখন মৃতভাষার সঙ্গে জীবন্ত ভাষার সেই প্রাচীন বিবাদ আবার নূতন আকারে দেখা দেয়; কেননা পূর্বযুগের লিখিত ভাষা পরযুগের কাছে সম্পূর্ণ মৃত না হলেও অর্ধমৃত তো বটেই। মৃতভাষার সঙ্গে জীবন্ত ভাষার বিরোধের চাইতে সাধুভাষার সঙ্গে চলতি ভাষার কলহের কলরবটা কিছু বেশি, কেননা এ হচ্ছে জ্ঞাতিশত্রুতা। তা ছাড়া লিখিত ভাষাই হচ্ছে সাহিত্যজগতে মৌখিক ভাষার যথার্থ শিক্ষাগুরু। সুতরাং মৌখিক ভাষার পক্ষে সাহিত্যরাজ অধিকার করবার প্রয়াসটা সত্যসত্যই শিষ্যের পক্ষে গুরুকে ছাড়িয়ে ওঠবার চেষ্টা। এ অবস্থায় সাহিত্যের দ্রোণাচার্যেরা যে সাহিত্যের একলব্যদের অঙ্গুলিচ্ছেদের আদেশ দেবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি। এতে অবশ্য ভয় পেলে স্বভাষাকে স্বরা করে তোলা যাবে না। এ কথাটা শ্রুতিকটু হলেও সত্য যে, গুরুভক্তি না থাকলে যেমন সনাতন বিদ্যা অর্জন করা যায় না, তেমনি গুরুমারা বিদ্যে না শিখলেও নূতন সাহিত্যের সর্জন করা যায় না। প্লেটো-অ্যারিস্টটলের যুগ থেকে শুরু করে অদ্যাবধি সকল দেশের সকল যুগের সাহিত্যের ইতিহাস এই সত্যের পরিচয় দিয়ে আসছে। অতএব বইয়ের ভাষার সঙ্গে মুখের ভাষার যুদ্ধটা নিরর্থকও নয়, নিষ্ফলও নয়। মৃতভাষার সঙ্গে জীবন্ত ভাষার, বিদেশি ভাষার সঙ্গে স্বদেশি ভাষার লড়াইও তো ঐ বইয়ের ভাষার সঙ্গে মুখের ভাষার জীবনসংগ্রাম বই আর কিছুই নয়।