৫.
মৃতভাষার অধীনতা হতে মুক্তিলাভ করবামাত্র দেশি ভাষা সব সময়ে একেবারে আত্মবশ হয়ে উঠতে পারে না, অনেক ক্ষেত্রে তা আবার একটি বিদেশি ভাষার শাসনাধীন হয়ে পড়ে। কোনো দেশের উপর বিদেশির রাষ্ট্রীয় প্রভুত্ব সেই দেশীয় ভাষার উপর বিদেশীয় ভাষার প্রভুত্বের একটি স্পষ্ট ও প্রধান কারণ। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, একটি বিদেশি ভাষা সরকারি ভাষা হওয়া সত্ত্বেও বিজিত জাতির ভাষা ও সাহিত্যের উপর জয়লাভ করতে পারে না। গ্রীস রোমের অধীন হয়েও পুরাকালে ভাষায় ও সাহিত্যে তার স্বরাজ্য সম্পূর্ণ রক্ষা করেছিল। ফারসিও এ দেশে বহুকাল সরকারি ভাষা ছিল, কিন্তু আমাদের ভাষার উপর ফারসি ভাষার এবং আমাদের সাহিত্যের উপর ফারসি সাহিত্যের প্রভাব একরকম নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না। অপর পক্ষে এমনও দেখা যায় যে, একটি বিদেশি ভাষা রাজভাষা না হয়েও অপর ভাষার উপর একাধিপত্য করেছে। বিজিত গ্রীসের সাহিত্যের হাতের নীচেই রোমের ল্যাটিন সাহিত্য গড়ে ওঠে। একালের ইউরোপেও এ সত্যের যথেষ্ট নিদর্শন আছে। কিছুদিনের জন্য ফরাসি ভাষা ইউরোপে একরা ভাষা হয়ে উঠেছিল, ইউরোপের প্রায় সকল প্রদেশের সাহিত্যই এক যুগে ফরাসি সাহিত্যের প্রতাপে অভিভূত হয়ে পড়েছিল।
কিন্তু ইউরোপের সাহিত্যের ইভলিউশনে ইতালির রিভার্শন reversion যথার্থ ই একটি অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। যারা জীবজগতের ইভলিউশন-তত্ত্ব অবগত আছেন তারাই জানেন যে, জীবের ক্রমোন্নতির ধারা একরোখাও নয়, একটানাও নয়। ইভলিউশনের সঙ্গেসঙ্গে রিভার্শন, উন্নতির পিঠ-পিঠ অবনতিও দেখা দেয়। কিছুদূর এগিয়ে তার পর পিছু হটা বোধ হয় মানবসভ্যতারও নৈসর্গিক ধর্ম, নচেৎ যে ভাষায় দান্তে পেত্রার্ক। বোক্কাচ্চিয়ো মাকিয়াভেল্লি প্রভৃতি জগবিখ্যাত লেখকেরা কাব্যে ও ইতিহাসে সাহিত্যের অক্ষয়কীর্তিসকল রেখে গিয়েছেন, সেই ভাষা অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি ভাষার আনুগত্য স্বেচ্ছায় বরণ করে নিত না। ইতালির নবযুগের আদিকবি আফিয়েরি Alfieri তাঁর আত্মকথায়। লিখেছেন যে, তিনি তার স্বকালের সাধুপদ্ধতি অনুসারে প্রথমে ফরাসি ভাষাতেই নাটক রচনা করতেন, কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ ক্রমে তার এই জ্ঞান জন্মাল যে, সেসকল নাটক কাব্য নয়, শ্রীহীন শক্তিহীন প্রাণহীন কাঠের পুতুল মাত্র। এ কথা শুনে মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রথম-বয়সের কথা মনে পড়ে ইতালির সাহিত্যের খবর আমরা বড়-একটা রাখি নে; তার কারণ, ইতালি আল্পস পর্বতের এপারের দেশ, অর্থাৎ আমাদের এদিকের দেশ। আমাদের বিশ্বাস, একালের ইতালীয়েরা পারে শুধু রাস্তায় রাস্তায় অর্গান বাজাতে, আর রংবেরঙের মিষ্টান্ন তৈরি করতে। কিন্তু সেই সঙ্গে তাদের হাতে কাব্যের অর্গানও যে চমৎকার বাজে, এবং দর্শনের মিষ্টান্নও যে সুন্দর তৈরি হয়, তার প্রমাণ দানুনদজিয়ো D’Annunzio এবং Benedetto Croce বেনেদেত্তো ক্রোচের দক্ষিণ হস্তের কীর্তি।
যে মার্টিন লুথারের প্রচণ্ড আক্রমণে রোমান চর্চ ও ল্যাটিন ভাষার সর্বজনীন প্রভুত্ব চিরদিনের জন্য ক্ষুণ্ণ হয়ে পড়ল, সেই মার্টিন লুথারের স্বদেশ জর্মানির সাহিত্যও আবার পালটে ফরাসি সাহিত্যের মায়ায় আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। সপ্তদশ শতাব্দী ছিল ফরাসি সাহিত্যের একটি স্বর্ণযুগ। এই সাহিত্যের প্রভাব জর্মানির শিক্ষিত মনকে প্রায় এক শ বৎসরের জন্য একেবারে অভিভূত ও মায়ামুগ্ধ করে রেখেছিল। ফলে সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে আরম্ভ করে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ফরাসি সাহিত্যের অনুকরণে জর্মানিতে যে সাহিত্য রচিত হয়, তার কোনোরূপ মূল্য কোনোরূপ মর্যাদা নেই। এই ফরাসি সাহিত্যের গুণে ফরাসি ভাষাও জর্মানদের কাছে একটি নব ক্ল্যাসিক হয়ে ওঠে। নব জর্মানির আদিকর্তা ফ্রেডারিক দি গ্রেট নিজের রসনা ও লেখনীকে সক্লেশে ফরাসি ভাষাতেই বলতে ও লিখতে শিখিয়েছিলেন, অর্থাৎ যিনি ইউরোপে জর্মান জাতির রাষ্ট্রীয় শক্তি সুপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন, স্বয়ং তিনিই বাহোসে বাহালতবিয়তে এবং খোশমেজাজে ফরাসি সাহিত্য ও ফরাসি ভাষার সার্বভৌমিক আধিপত্য শিরোধার্য করে নিয়েছিলেন। কিমাশ্চর্যমতঃপরম্।।
কিন্তু এর চাইতেও আশ্চর্যের বিষয় আছে। শুনতে পাই, জগদূবিখ্যাত জর্মান দার্শনিক লাইবনিৎস্ Leibnitz এই যুগে তার দার্শনিক গ্রন্থসকল ফরাসি ভাষাতেই রচনা করেন সম্ভবতঃ এই বিশ্বাসে যে, তাঁর মাতৃভাষা দর্শনরচনার পক্ষে উপযোগী নয়। এ বিশ্বাস যে কতদূর অমূলক তার প্রমাণ তার পরবর্তী এবং ইউরোপের নবযুগের অদ্বিতীয় দার্শনিক কান্টের গ্রন্থসকল। সেসকল গ্রন্থ যে এ যুগের দর্শনশাস্ত্রের ক্ল্যাসিক হয়ে উঠেছে শুধু তাই নয়, কাণ্টের রচনার প্রসাদে ইউরোপের মনে এমন একটি ধারণা জন্মে গেছে যে, জর্মান ভাষাই হচ্ছে দর্শন রচনা করবার পক্ষে সর্বাপেক্ষা উপযোগী ভাষা। অতএব দেখা গেল, মার্টিন লুথার যেমন প্রথমে ল্যাটিনের হাত থেকে উদ্ধার করে জমান ভাষাকে পায়ের উপর দাঁড় করান, কান্ট তেমনি পরে স্বভাষাকে ফরাসির অধীনতা থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে সে ভাষাকে নিজের পায়ে চলতে শেখান। স্বভাষায় আত্মপ্রকাশ করবার স্বাধীনতা লাভ করে জর্মান সাহিত্য যে কতদূর ঐশ্বর্য লাভ করেছে, সে কথা বলা নিষ্প্রয়োজন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে আরম্ভ করে উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত, এই এক শত বৎসর হচ্ছে জর্মান সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। এ যুগের সাহিত্যবথীদের নামের ফর্দ দিতে হলে পুঁথি অসম্ভবরকম বেড়ে যায়, এবং সে ফর্দ দেবারও কোনো দরকার নেই। কাব্য দর্শন ইতিহাস বিজ্ঞান প্রভৃতি সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে জর্মান মহারথীদের নাম শিক্ষিতসমাজে কার নিকট অবিদিত? জর্মান প্রতিভার এই আকস্মিক এবং অভূতপূর্ব বিকাশের প্রত্যক্ষ কারণ এই যে, জর্মান ভাষা এবং সেই সঙ্গে জর্মান আত্মিা তার স্বরাজ্য লাভ করেছে।