বঙ্গসাহিত্যের পক্ষে এসব অবশ্য খুবই শ্লাঘার বিষয়। কিন্তু আমাদের সাহিত্যের দেহপুষ্টির এইসব প্রত্যক্ষ লক্ষণ দেখে যদি কেউ মনে করেন যে, ‘বাংলা বনাম ইংরেজি’ এই ভাষার মামলায় বাদীর পক্ষে পুরোপুরি জয়লাভ হয়েছে, তাহলে তিনি নিতান্তই ভুল করবেন; যা হয়েছে তা হচ্ছে তরমিম ডিক্রি। ওদিকে একটু দৃষ্টিপাত করলে সকলেই দেখতে পাবেন যে, আমাদের আইন-আদালত স্কুল-কলেজ রাজদরবার-রাজনীতি জ্ঞান-বিজ্ঞান সবই অদ্যাবধি ইংরেজির পুরো দখলে রয়েছে। শুধু তাই নয়, শিক্ষিতসম্প্রদায়ের বেশির ভাগ গণ্যমান্য লোকেরা এসকল ক্ষেত্রে ইংরেজির দখল বজায় রাখাই সংগত ও কর্তব্য মনে করেন। মাতৃভাষা ইংরেজির হাত থেকে সেইটুকু মাত্র ছাড়া পেয়েছে, যেটুকু তার পক্ষে কেঁদে বাঁচবার জন্য দরকার।
এইই যথেষ্ট প্রমাণ যে, বঙ্গসাহিত্যের যে বড়দিন এসেছে, সে দিনে বাংলা ভাষা শিক্ষিতসমাজে অবজ্ঞার পাত্র না হলেও শ্রদ্ধাভাজন হয়ে ওঠে নি। পূর্বে মাতৃভাষাকে শিক্ষিতসম্প্রদায় যে যথেষ্ট অবজ্ঞা করতেন, তার প্রমাণ, তারা অনেকেই বাংলা লিখতেন না; আর আজ যে সেই সম্প্রদায় সে ভাষাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন না, তার প্রমাণ, তাঁরা প্রায় সকলেই বাংলা লেখেন। প্রবৃত্তিরেষা নরাণাং নিবৃত্তিস্তু মহাফলা’ এ শাস্ত্রবচন যে লেখা সম্বন্ধেও খাটে, এ জ্ঞান সকলের থাকলে অনেকে বঙ্গসাহিত্য রচনা করতে প্রবৃত্ত হতেন না। আমি দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি যে, এঁদের অনেকের গান ও গল্প পড়ে আমার মনে হয়, বাংলা লেখাটা এদের পক্ষে একটা শখ মাত্র, অবসরবিনোদনের একটি বিশিষ্ট উপায়, ভাষায় যাকে বলে বিশুদ্ধ আমোদ। কিন্তু সকলেরই মনে রাখা উচিত যে, যা অবকাশরঞ্জিনী তা কাব্য নয়, এবং যা অবসর চিন্তা তা দর্শন নয়। ঐ ধ্যান ঐ জ্ঞান না করলে সাহিত্যের যথার্থ চর্চা করা হয় না। লক্ষ্মীর সেবার অবসরে সরস্বতী সেবা করা যে কর্তব্য, সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই, তবে প্রশ্ন হচ্ছে তার প্রকৃষ্ট পদ্ধতিটি কি। আমার মতে বেশির ভাগ কাজের লোকেরা নিজে না লিখে পরের লেখা পড়েই ছুটির যথেষ্ট সদ্ব্যবহার করতে পারেন। জ্ঞানকর্মের বিভাগটা উপেক্ষা করলে কি জ্ঞান কি কর্ম কিছুরই গুণবৃদ্ধি হয় না। মানুষে সাহিত্যে যে ভাবের-ঘর বাঁধে সে খেলার-ঘর নয়, মনের বাসগৃহ। তাসের ঘর কিন্ডারগার্টেনেই শোভা পায়, সাবালক সমাজে নয়। সুতরাং যারা মাতৃভাষার যথার্থ ভক্ত, তাদের পক্ষে সে ভাষাকে সাহিত্যের রাজপাটে বসাবার জন্য এখনো বহুদিন ধরে বহু চিন্তা বহু চেষ্টা করতে হবে। বঙ্গসরস্বতীর চরণে পুস্পাঞ্জলি দেওয়াই আমাদের একমাত্র কাজ নয়; তাতে ভক্তির পরিচয় দেওয়া হতে পারে, কিন্তু জ্ঞানকর্মের হয় না। অতএব জীবনের সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার স্বত্বস্বামিত্ব সাব্যস্ত করবার জন্য প্রতিপক্ষের সঙ্গে আমাদের পদে পদে তর্ক করতে হবে, বিচার করতে হবে এবং প্রয়োজন হলে বিবাদ-বিসংবাদ করতেও প্রস্তুত হতে হবে। এক কথায় বঙ্গসরস্বতীর সেবককে তার সৈনিকও হতে হবে।
৪.
বিদেশি সাহিত্যের ঐশ্বর্যের তুলনায় আমাদের স্বদেশি সাহিত্যের দারিদ্র্যের পরিচয় লাভ করে হতাশ হবার অবশ্য কোনোই কারণ নেই। লোকভাষা যে কোনো দেশেই রাতারাতি স্বরা হয়ে ওঠে নি, তার প্রমাণ বর্তমান ইউরোপের সকল সাহিত্যের ইতিহাসেই পাওয়া যায়। অপর ভাষা অপর সাহিত্যের অধীনতাপাশ থেকে ইউরোপের কোনো নবভাষাই এক দিনে মুক্তি লাভ করতে পারে নি। সাহিত্যে সম্পূর্ণ আত্মপ্রতিষ্ঠ হবার পূর্বে ইউরোপের অনেক দেশেই দেশি ভাষাকে পর পর তিনটি বাধাকে অতিক্রম করতে হয়েছে। মোটামুটি ধরতে গেলে, লোকভাষার ক্রমোন্নতির ইতিহাস হচ্ছে এই : প্রথমতঃ কোনো মৃতভাষার, দ্বিতীয়তঃ কোনো বিদেশি ভাষার, এবং তৃতীয়তঃ কোনো কৃত্রিম ভাষার চাপ থেকে বেরিয়ে যাওয়া।
প্রায় হাজার বৎসর কাল ল্যাটিন যে ইউরোপের সাহিত্যের ভাষা ছিল, এ সত্য অবশ্য আপনাদের সকলের নিকটই সুবিদিত। এই দীর্ঘকাল ধরে বিজ্ঞান দর্শন ধর্মশাস্ত্র ব্যবহারশাস্ত্র ইতিহাস ভূগোল প্রভৃতি বিষয়সকল একমাত্র ল্যাটিন ভাষাতেই লিখিত হত। অপণ্ডিত লোকে অবশ্য ইউরোপের এই মধ্যযুগেও কথা ও কাহিনী, ছড়া ও পাঁচালি প্রভৃতি নিজ নিজ ভাষাতেই রচনা করত, কিন্তু সেই লোকসাহিত্য শিক্ষিতসমাজে সেকালে সাহিত্য বলে গণ্য হয় নি, সুতরাং সে সাহিত্য সেকালে যে কোনোরূপ পদমর্যাদা লাভ করে নি, সে কথা বলাই বাহুল্য। এই ল্যাটিনের হাত থেকে ইউরোপীয় সাহিত্য যে বেশি দিন মুক্তিলাভ করে নি তার প্রমাণ, বেকন তাঁর নোম অর্গানাম, স্পিনোজা তাঁর এথিক্স, এমনকি নিউটন তার প্রিন্সিপিয়া ল্যাটিন ভাষাতেই রচনা করেন। ইউরোপের কোনো কোনো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাটিন ভাষায় থিসিস লেখবার পদ্ধতি আজও প্রচলিত আছে। আপনারা শুনে আশ্চর্য হবেন যে, বর্তমান যুগের। দিগবিজয়ী দার্শনিক বের্গ তাঁর প্রথম গ্রন্থ আদিতে ল্যাটিন ভাষাতেই রচনা করেন। এ ব্যাপার যথার্থ ই বিস্ময়কর, কেননা ইউরোপের দার্শনিকসমাজে লিপিচাতুর্যে বের্গসঁর সমকক্ষ দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই; তার হাতের কলম যথার্থ ই সোনার কাঠি, যার স্পর্শে মনোজগতের শুষ্কতরুও পত্রেপুষ্পে মুঞ্জরিত হয়ে ওঠে, দর্শনও কাব্য হয়ে ওঠে। লোকভাষার উপর মৃতভাষার প্রভাব ও প্রভুত্ব যে কতটা দুরপনেয়, তারই প্রমাণস্বরূপ এ ব্যাপারের উল্লেখ করলুম। জমান। দেশে আজও এমন-সব পণ্ডিত আছেন, যাদের পাণ্ডিত্য ল্যাটিন ভাষাতেই লিপিবদ্ধ হয়, কিন্তু তার কারণ স্বতন্ত্র। শুনতে পাই, সে জাতির কোনো কোনো পণ্ডিত স্বভাষায় লিখলে সে লেখা এত জড়ানো হয় যে, তাঁরা নিজেই তা পড়তে পারেন না, অন্যে পরে কা কথা। কাজেই তাদের ল্যাটিনের শরণাপন্ন হতে হয়, কেননা সেই ভাষার প্রসাদে তাদের মনের ময়লা কেটে যায়। সে যাই হোক, আসল ঘটনা এই যে, ইউরোপের লোকভাষাসকল যেদিন ল্যাটিন ভাষার প্রভুত্ব হতে মুক্তিলাভ করে নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে শিখলে সেই দিন ইউরোপের মধ্যযুগের অবসান হয়ে নবযুগের সূত্রপাত হল। এক কথায় ইউরোপীয়দের মতে সেই শুভদিনে ইউরোপের মনের রাত কেটে গিয়ে সেখানে দিনের আলো দেখা দিলে।