১১
এখন, এই ভণ্ডি নামক ব্যক্তিটি কে? তিনি যে হর্ষবর্ধনের প্রধান সেনাপতি ও মন্ত্রী ছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। রাজবর্ধনের মৃত্যুর পর যখন অপরাপর মন্ত্রীরা হর্ষকে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করতে ইতস্ততঃ করছিলেন, তখন ভণ্ডির পরামর্শেই তারা বালক হর্ষকে রাজা করেন। মালবরাজের বিরুদ্ধে রাজ্যবর্ধন যখন যুদ্ধযাত্রা করেন, তখন ভণ্ডিই দশ সহস্র অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে। তাঁর অনুগমন করেন এবং সে-যুদ্ধে জয়লাভ করেন। রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর ভণ্ডিই হর্ষের আদেশে গৌড়াধিপ শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যান। সুতরাং তিনিই যে হর্ষদেবের friend, philosopher and guide ছিলেন, এরূপ অনুমান করা অসংগত নয়। এই কারণেই ভণ্ডি লোকটি কে, জানবার জন্য কৌতূহল হওয়া ঐতিহাসিকের পক্ষে স্বাভাবিক।
বাণভট্ট এইমাত্র বলেছেন যে, ভণ্ডি যশোবতীর ভ্রাতুস্পুত্র। কিন্তু যশোবতী যে কার কন্যা ও কার ভগ্নী, সে বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ নীরব।
রাধাকুমুদবাবু বলেন যে, যশোবতী হুনারি যশোবর্মনের কন্যা। যশোেবন। যে-সে রাজা নন। ঘূনরাজ মিহিরকুলকে যুদ্ধে পরাভূত করে তিনি ভারতবর্ষ নিতুন করেন, এবং এক দিকে ব্ৰহ্মপুত্র হতে পশ্চিমসমুদ্র ও আর-এক দিকে হিমালয় হতে মহেন্দ্রপর্বত পর্যন্ত সমগ্র ভারতবর্ষের সম্রাট হন। যশোবতী এ হেন রাজচক্রবর্তীর কন্যা হলে বাণভট্ট সে কথা গোপন করতেন না। আর যশোবর্মনের পুত্র শিলাদিত্যই নাকি ভণ্ডির পিতা, যে রাজার বিরুদ্ধে ল’ড়ে ভণ্ডি ও রাজ্যবর্ধন জয়লাভ করেন। রাধাকুমুদবাবু যা বলেছেন, তা হতে পারে। কিন্তু এ বংশাবলী আকে মেলে না। যশোবন হূন নিপাত করেছিলেন ৫২৮ খৃস্টাব্দে আর হষের জন্ম হয় ৫৯০ খৃস্টাব্দে; সুতরাং বিয়ের সময়ে যশোবতীর বয়সে কত ছিল? সেকালে রাজারাজড়াদের ঘরের মেয়েদের কোন্ বয়সে বিয়ের ফুল ফুট৩, তা রাজ্যশ্রীর বিবাহ থেকেই জানা যায়। সুতরাং ভণ্ডি যে যশোবমণের পৌত্র, এ অনুমান প্রমাণাভাবে অসিদ্ধ।
১২.
তারিখ না থাকলে ইতিহাস হয় না। সুতরাং ভারতবর্ষের ইতিহাস জানা একরকম অসম্ভব, কারণ সংস্কৃত সাহিত্য তারিখছুট। সেইজন্যই আমাদের দেশের কোনো ব্যক্তির অথবা কোনো ঘটনার তারিখ জানতে হলে বিদেশে যেতে হয়। চীনে লেখকদের মহাগুণ এই যে, তাদের সকলেরই মহাকালের না হোক, ইহকালের জ্ঞান ছিল। ভাগ্যিস হিউয়েন সাং এ দেশে এসেছিলেন, তাই আমরা হর্ষবর্ধনের সঠিক কালনির্ণয় করতে পারি। উক্ত চৈনিক পরিব্রাজকের ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে ও কতকটা ইন্সক্রিপশনের সাহায্যে আমরা জানি যে, হর্ষ জন্মেছিলেন ৫৯০ খৃস্টাব্দে, রাজা হয়েছিলেন ৬০৬ খৃস্টাব্দে, আর তার মৃত্যু হয়েছিল ৬৪৮ খৃস্টাব্দে।
তারিখ বাদ দিয়ে ইতিহাস হয় না, একমাত্র প্রাগৈতিহাসিক ইতিহাস ছাড়া। কিন্তু তাই বলে ইতিহাস মানে প্রাচীন পঞ্জিকামাত্র নয়; এমনকি, রাজরাজড়ার জীবনচরিতও নয়। আমরা একটা বিশেষ দেশের, বিশেষ কালের, বিশেষ সমাজের মতিগতি সব জানতে চাই। কিন্তু সে জ্ঞান লাভ করবার মালমসলা হর্ষচরিতেও নেই, হিউয়েন সাংএর ভ্রমণবৃত্তান্তেও নেই। রাধাকুমুদবাবু হর্ষচরিত লিখেছেন Rulers of India নামক সিরিজের জন্য। সুতরাং হর্ষের শাসনপদ্ধতি সম্বন্ধে তাকে একটি পুরো অধ্যায় লিখতে হয়েছে। কিন্তু এ অধ্যায়টি তাকে এই অনুমানের উপরে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে যে, হর্ষযুগের রাজশাসন তার পূর্ববর্তী গুপ্তযুগের অনুরূপ; সুতরাং তিনি এ বিষয়ে যে বিবরণ দিয়েছেন, তা গুপ্তযুগের বিবরণ–যদিও হর্ষের রাজ্য গুপ্তরাজ্যের মত নিরুপদ্রব ছিল না। হিউয়েন সাংকে বহুবার চোরডাকাতের হাতে পড়তে হয়েছিল, কিন্তু ফা-হিয়েনের কেউ কেশস্পর্শ করে নি। হর্ষের পূর্বে দেশ অরাজক হয়ে পড়েছিল, আর হর্ষের মৃত্যুর পর আবার অরাজক হয়েছিল। ইতিমধ্যে যে তিনি দেশকে সম্পূর্ণ সুশাসিত করতে পারেন নি, এতে আর আশ্চর্য কি?
১৩.
আমি পূর্বে বলেছি যে, রাধাকুমুদবাবু তার হর্ষচরিত লিখেছিলেন রুলস অব ইণ্ডিয়া নামক ইংরেজি সিরিজের দেহ পুষ্ট করবার জন্য। এ সিরিজের নামাবলী পড়ে মনে হয় যে, ভারতবর্ষের শাসনকর্তা কখনো ভারতবাসী হয় না, হয় শুধু বিদেশি। একমাত্র অশোক এ দলে স্থানলাভ করেছেন। ফলে অশোক যে বিদেশি, তাই প্রমাণ করতে এক শ্রেণীর পণ্ডিতেরা উঠে-পড়ে লেগেছেন। রাধাকুমুদবাবু হর্ষকেও এই ছত্রপতি রাজাদের দলভুক্ত করেছেন। সুতরাং দু দিন পরে হয়তো শুনব যে, অশোক যেমন পারসিক, হর্ষ তেমনি হূন। হর্ষের মাতুলপুত্র হচ্ছেন ভণ্ডি, এবং হূন ভাষার পণ্ডিতরা বলেন যে, ভণ্ডি নাম হূন নাম। তা যদি হয় তো হর্ষের মাতৃকুল যে হূন-কুল, এ অনুমান করা ঐতিহাসিক পদ্ধতি-সংগত।
যদি ধরে নেওয়া যায় যে, অশোক সমুদ্রগুপ্ত ও হর্ষ তিনজনই স্বদেশি রাজা ছিলেন, তাহলে এ তিনজন যে কি করে রাজা থেকে মহারাজাধিরাজ হয়ে উঠলেন, তার একটা হিসেব পাওয়া যায়।
ভারতবর্ষ চিরকালই নানা খণ্ডরাজ্যে বিভক্ত ছিল; অর্থাৎ ইংরেজি ভাষায় যাকে বলে ইউনিটারি গবর্মেন্ট, এত প্রকাণ্ড দেশে সে জাতীয় গবর্মেন্ট স্বাভাবিক নয়। যখনই কোনো প্রবল বিদেশি শত্রুর হাত থেকে ভারতবাসীদের পক্ষে আত্মরক্ষা করবার প্রয়োজন হয়েছে, এবং যে রাজা সে বহিঃশত্রুর কবল থেকে ভারতবর্ষকে উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছেন, তখনই তিনি, সমগ্র ভারতবর্ষের না হোক, উত্তরাপথের সম্রাট হয়েছেন। গ্রীক সম্রাট আলেকজান্দারের ভারতবর্ষের ব্যর্থ আক্রমণের অব্যবহিত পরেই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য-রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন, এবং অশোক হচ্ছেন তার পৌত্র। সমুদ্রগুপ্তের পুত্র চন্দ্রগুপ্ত শকারিবিক্রমাদিত্য। এবং যেকালে দেশ থেকে হূন-পশু বহিষ্কৃত হয়, সেই কালেই হর্ষবর্ধন সকল উত্তরাপথেশ্বর হয়ে উঠেছিলেন। যবনদের হাত থেকে দেশ রক্ষা করবার জন্য মৌর্যবংশের প্রতিষ্ঠা। শকদের কবল থেকে পশ্চিমভারত উদ্ধার করবার ফলেই গুপ্তবংশের প্রতিষ্ঠা। আর হূন-হরিণ-কেশরী বলেই হর্ষ দেশের পরমেশ্বর হয়েছিলেন। অর্থাৎ একমাত্র বিদেশিই ভারতবর্ষের ruler হয় না–বিদেশির হাত থেকে যে দেশরক্ষা করতে পারে, সেও সেকালে ভারতবর্ষের ruler হত। মেধাতিথি আর্যাবর্ত নামক দেশের এই বলে পরিচয় দিয়েছেন–