কিন্তু হর্ষ কিছুতেই বড় ভাইকে টপকে সিংহাসনে চড়ে বসতে সম্মত হলেন না।
৮.
শোকবিমূঢ় ভ্রাতৃদ্বয় কিংকর্তব্য স্থির করতে পারছেন না, এমন সময় রাজ্যশ্রীর সংবাদক নামক পরিচারক এসে উপস্থিত হয়ে নিবেদন করলে
যেদিন অবনীপতির মৃত্যুর সংবাদ এল, সেই দিনই দুরাত্মা মালবরাজ গ্রহবর্মাকে বধ করে রাজ্যশ্রীর পায়ে বেড়ি পরিয়ে কান্যকুজের কারাগারে নিক্ষেপ করেছে।
এ-সংবাদ শুনে রাজ্যবর্ধমের হৃদয়ে শোকাবেগের পরিবর্তে রোষাবেগ স্থান লাভ করলে, ও তিনি হর্ষকে সম্বোধন করে বললেন—
এ রাজ্য তুমি পালন করে। আমি আজই মালবরাজকুলের ধ্বংসের জন্য যাত্রা। করছি। একমাত্র ভণ্ডি দশ সহস্র অশ্ব-সৈন্য নিয়ে আমার অনুসরণ করুক।
হর্ষও এ কথা শুনে বললেন, আমিও তোমার অনুগমন করতে প্রস্তুত–
যদি বাল ইতি নিতরাং তহি ন ত্যাজ্যোহস্মি। অশক্ত ইতি ক্ব পরীক্ষিতোহস্মি। কিন্তু রাজ্যবর্ধন এ পরীক্ষা করতে স্বীকৃত হলেন না, বালক হর্ষকে ত্যাগ করে একাই যুদ্ধযাত্রা করলেন।
এর ক দিন পরেই কুন্তল নামক অশ্ববার এসে সংবাদ দিলে যে, রাজ্যবর্ধন মালব-সৈন্যের উপর জয়লাভ করবার পর–
গৌড়াধিপেন মিথ্যোপচারোপচিতবিশ্বাসং মুক্তশস্ত্ৰমেকাকিনং বিশ্রং স্বভবন এব ভ্রাতরং ব্যাপাদিতম্–
ঐ গৌড়াধিপের নাম শশাঙ্ক। এ সংবাদ শুনে প্রভাকরবর্ধনের বৃদ্ধ সেনাপতি হর্ষকে বললেন—
কিং গৌড়াধিপেনৈকেন। তথা কুরু যথা নান্যোহপি কশ্চিদাচরত্যেবং ভূয়ঃ।
হর্ষদেব উত্তর করলেন—
শ্রূয়তাং মে প্রতিজ্ঞা
পরিগণিতৈরেব বাসরৈনির্গৌড়াং করোমি মেদিনীম্।
তার পর অবন্তি নামক মহাসন্ধিবিগ্রহকারককে আদেশ করলেন যে, উদয়াচল হতে অস্তগিরি পর্যন্ত সকল দেশের সকল রাজাদের কাছে এই মর্মে ঘোষণাপত্র পাঠাও যে—
সর্বেষাং রাজ্ঞাং সজ্জীক্রিয়ন্তাং করাঃ করদানায় শস্ত্ৰগ্ৰহণায় বা।
এর পরেই তিনি মান্ধাতা-প্রবর্তিত দিগ্বিজয়ের পথ অবলম্বন করলেন।
৯.
হর্ষদেব হাতিঘোড়। লোকলস্কর নিয়ে দিগ্বিজয়ে বহির্গত হবেন, এমন সময়–
ভণ্ডিরেকেনৈব বাজিনা কতিপয়-কুলপুত্ৰপরিবৃতে রাজদ্বারমাজগাম।
ভণ্ডির পরিধানে মলিন বাস আর সর্বাঙ্গ শত্রুশস্ত্রে ক্ষতবিক্ষত। হর্ষ ভণ্ডির কাছে প্রাতৃমরণবৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করলেন এবং ভণ্ডিও আগাগোড়া সকল কথা বললেন। তার পর নরপতি জিজ্ঞাসা করলেন, রাজ্যশ্রীর অবস্থা কি? ভণ্ডি উত্তর করলেন, রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর দেবী রাজা শ্রী কুশস্থলে গুপ্ত কর্তৃক গৃহীত হন, পরে বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে সপরিবারে বিন্ধ্যারণ্যে প্রবেশ করেছেন, এ কথা আমি লোকমুখে শুনেছি, এবং তার খাজে বহু লোক পাঠিয়েছি; কিন্তু তারা কেউ ফিরে আসে নি।
এ কথা শুনে হর্ষ বললেন, অন্য লোকের কি প্রয়োজন? অন্য কর্ম ত্যাগ করে যেখানে রাজ্যশা আছেন সেখানে স্বয়ং আমি যাব, আর তুমি সৈন্যসামন্ত নিয়ে গৌড়াভিমুখে গমন করো।
এর পর হর্ষ মালবরাজকুমার মাধবগুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে বিন্ধ্যারণ্যে প্রবেশ করলেন, এবং বৌদ্ধভিক্ষু দিবাকর মিশ্রের আশ্রমে রাজ্যশ্রীর সাক্ষাৎ পেলেন। যখন হর্ষ দিবাকর মিশ্রের আশ্রমে উপস্থিত হলেন তখন রাজ্যশ্রী চিতায় প্রবেশ করতে উদ্যত হয়েছেন। হর্ষ ও দিবাকর মিশ্র তাকে আত্মহত্যা থেকে নিরস্ত করলেন। রাজা বৌদ্ধভিক্ষুণীর ধর্মে দীক্ষিত হবার জন্য দিবাকর মিশ্রের কাছে প্রার্থনা জানালেন। দিবাকর মিশ্র সে প্রার্থনা মঞ্জুর করতে স্বীকৃত হলেন না দু কারণে। প্রথমতঃ রাজ্যশ্রীর বয়স অল্প, দ্বিতীয়তঃ সে শোকগ্রস্ত। তার পর হর্ষ যখন ভগ্নীকে কথা দিলেন যে, তিনিও ভ্রাতৃমরণের প্রতিশোধ নিয়ে পরে কাষয়বসন ধারণ করবেন, তখন রাজ্যশ্রী সে কটা দিন অপেক্ষা করতে স্বীকৃত হলেন।
এইখানেই বাণভট্টের হর্ষচরিত শেষ হল।
১০.
বাণভট্ট যে কেন এইখানেই থামলেন, তা আমাদের অবিদিত, এবং তা জানবারও কোনো উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে আমরা শুধু নানারূপ অনুমান করতে পারি, কিন্তু সেসব অনুমানের হর্ষচরিতে কোনো অবসরও নেই, সার্থকতাও নেই। তবে যে কারণেই হোক, তিনি যে আট অধ্যায়কে অষ্টাদশ করেন নি, এ আমাদের মহা সৌভাগ্য। কারণ, ও-ধরনের লেখা এর বেশি আর পড়া অসাধ্য। ইংরেজিতে বলে life is short; সুতরাং আর্ট যদি অতি লম্বা হয় তো এক জীবনে তার চর্চা করে ওঠা যায় না।
সে যাই হোক, বাণভট্ট হিস্টরি লেখেন নি, লিখেছেন হর্ষের বায়োগ্রাফি। জীবনচরিত লেখবার আর্ট একরকম portrait paintingএর আর্ট। এ আর্টের বিষয় বা ঘটনা নয়। এর একমাত্র বিষয় হচ্ছে একটি মানুষ। মানুষের বাইরের চাইতে অন্তরই জীবনচরিত-লেখকের মনকে বেশি টানে। ফলে এর থেকে সেকালের রাজারাজড়াদের ইতিহাস উদ্ধার করা অসম্ভব।
হর্ষ যে দিগবিজয় করেছিলেন তার প্রমাণ তিনি ‘সকল উত্তরাপথেশ্বর’ হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর দিগ্বিজয়ের বিবরণ হর্ষচরিতে নেই, হিউয়েন সাংএর ভ্রমণবৃত্তান্তেও নেই।
হর্ষচরিত থেকে আমরা এই মাত্র জানতে পাই যে, প্রভাকরবর্ধন লাট সিন্ধু গান্ধার ও মালবদেশের রাজাদের শত্রু ছিলেন এবং তার মৃত্যুর পরেই মালবরাজ কান্যকুক্ত আক্রমণ করে গ্রহবনাকে বধ করেন। কিন্তু এ মালবরাজ যে কে, হর্ষচরিতে তার নাম নেই। ভণ্ডি বলেছেন গুপ্তনামা, এর বেশি কিছু নয়।
রাধাকুমুদবাবু প্রমাণ পেয়েছেন, এ গুপ্ত হচ্ছে দেবগুপ্ত, এবং তিনি ছিলেন হর্ষের সহচরদ্বয় মাধবগুপ্ত ও কুমারগুপ্তের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। রাজ্যবর্ধন একে পরাভূত ক’রে কান্যকুজরাজ্য উদ্ধার করেন, এবং হর্ষ এই ভগ্নীপতির সিংহাসন অধিকার করেন।