পুরাকালে ভারতবর্ষে শ্ৰীকণ্ঠ নামে একটি দেশ ছিল, এবং সেই দেশে স্থাণ্বীশ্বর নামক জনপদের রাজবংশে শ্রীহর্ষ জন্মগ্রহণ করেন। এ বংশ পুষ্পভূতির বংশ বলে বিখ্যাত। এই বংশে প্রভাকরবর্ধন নামে একটি রাজা নিজবাহুবলে নানা দেশ জয় করে পরমভট্টারক উপাধি লাভ করেন। তিনি ‘প্রতাপশীল’ এই অপর নামেও বিখ্যাত। তিনি হয়ে উঠেছিলেন–
হূনহরিণকেশরী সিন্ধুরাজজ্বরো,
গুর্জরপ্রজাগরঃ গান্ধারাধিপগন্ধদ্বিপকূটপাকলঃ
লাটপাটপাটচ্চরঃ মালবলক্ষ্মীলপরশুঃ।
বাণভট্ট এসব শব্দযোজনা সত্যের খাতিরে কি অনুপ্রাসের খাতিরে করেছেন, বলা কঠিন।
৬.
যদিও তাঁর কথা সত্য হয় তো সে সত্য অনুপ্রাসের ভারে চাপা পড়েছে। প্রভাকরবর্ধন হনহরিণের কেশরী, সিন্ধুরাজের জ্বর, গুঞ্জরের অনিদ্রা, গান্ধাররাজরূপ গন্ধহস্তীর পিত্তর, লাটচোরের উপর বাটপাড়, ও মালবলক্ষ্মীলতার কুঠার। অর্থাৎ উপরি-উক্ত রাজ্য সব তিনি জয় করুন আর না করুন, ও-সকল রাজ্যের রাজারা তার ভয়ে কম্পান্বিত ছিল। বলা বাহুল্য, এসব দেশ উত্তরাপথের পশ্চিমখণ্ড।
শ্রীহর্ষ প্রভাকরবর্ধনের দ্বিতীয় পুত্র। তিনি ৫৯০ খৃস্টাব্দে মহারানী যশোবতীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তার জ্যেষ্ঠভ্রাতা রাজ্যবর্ধন তার চাইতে বছর চারেকের বড়, এবং তার ভগ্নী রাজ্যশ্রী বছর দুয়েকের ছোট।
বাণভট্ট কাদম্বরীর রাজকুমার চন্দ্ৰাপীড় কোথায়, কি কি শাস্ত্রে, কি ভাবে শিক্ষাদীক্ষা লাভ করেছিলেন, তার লম্বা বর্ণনা করেছেন; কিন্তু হর্ষবর্ধনের শিক্ষাদীক্ষার বিষয়ে তিনি একেবারে নীরব। শুধু রাজকুমারদ্বয়ের কে কে অনুচর ছিলেন, সেই কথা বাণ আমাদের বলেছেন।
রাজ্যশ্রীর জন্মের পর প্রভাকরবর্ধন, রানী যশোবতীর ভ্রাতুস্পুত্র–
ভণ্ডিনামানমনুচরং কুমারয়োরপিতবান্।
এই ভণ্ডিই ক্ষেত্রে, কি মন্ত্রণাগৃহে, প্রথমে রাজ্যবর্ধনের পরে শ্রীহর্ষের প্রধান সহায় ছিলেন।
কিছুকাল পরে প্রভাকরবর্ধন মালবরাজের পুত্র কুমারগুপ্ত ও মাধবগুপ্ত নামক ভ্রাতৃদ্বয়কে কুমারদ্বয়ের অনুচর করেছিলেন। এই মাধবগুপ্তই পরে হর্ষবর্ধনের অতি অন্তরঙ্গ মুহৃৎ হন।
কুমারগুপ্ত ও মাধবগুপ্ত যে hostage স্বরূপে প্রভাকরবর্ধনের নিকট রক্ষিত হয়েছিলেন, এ রকম অনুমান করা অসংগত নয়। কারণ, প্রভাকরবর্ধন ছিলেন মালবলক্ষ্মীলতার পরশু।
কিন্তু ভণ্ডি কে? তিনি ছিলেন রানী যশোবতীর ভ্রাতুস্পুত্র। কিন্তু যশোবতী কার কন্যা, সে বিষয়ে বাণভট্ট সম্পূর্ণ নীরব; যদিচ তিনি রাজারানীদের কুলের খবর বিশেষ করে রাখতেন।
৭.
কালক্রমে রাজ্য বিবাহযোগ্য হলেন। যখন তার বিবাহ হয়, তখন তিনি বালিকা কিংবা কিশোরী, বাণভট্ট সে কথা খুলে বলেন নি। কিন্তু তিনি যা বলেছেন, তার থেকে অনুমান করা যায় যে, একালে সারদা আইনে সে বিবাহ বাধত।
একদিন প্রভাকরবর্ধন বাহকক্ষস্থ কোনো পুরুষ কর্তৃক গীয়মান বক্ষ্যমাণ আর্যাটি শুনলেন—
উদ্বেগমহাবর্তে পাতয়তি পয়োধরোন্নমনকালে।
সরিদিব তটমনুবর্ষ বিবর্ধমানা সুতা পিতরম্।।
এই গানটি শোনবামাত্র তিনি যশশাবতীকে সম্বোধন করে বললেন–
দেবি তরুণীভূত বৎসা রাজ্যশ্ৰীঃ।
অতএব আর কালবিলম্ব না করে ওর বিবাহ দেওয়া কর্তব্য।
এর পরেই প্রসিদ্ধ মৌখরী-বংশের তিলকস্বরূপ কান্যকুজের রাজা অবন্তিবর্মার জ্যেষ্ঠপুত্ৰ গ্ৰহবর্মার সঙ্গে রাজ্যশ্রীর বিবাহ হল। এ বিবাহ খুব ঘটা করে দেওয়া হয়েছিল, কেননা বাণভট্ট খুব ঘটা করে তার বর্ণনা করেছেন। দুঃখের বিষয়, বিবাহ-উৎসব ও বিবাহমণ্ডপের সাজসজ্জার বর্ণনা ভালো বোঝা যায় না। বিবাহমণ্ডপ–
স্ফুরদ্ভিরিন্দ্ৰায়ুধসস্রৈরিব সংছাদিতম্।
কিসের দ্বারা?–
ক্ষৌমৈশ্চ বাদরৈশ্চ দুকুলৈশ্চ লালাতন্তুজৈশ্চাংশুকৈশ্চ নেত্রৈশ্চ
নির্মোকনিভৈরকঠোররম্ভাগর্ভকোমলৈনিশ্বাসহাযৈঃ স্পর্শানুমেয়ৈর্বাসোভিঃ।
এসব জিনিস কি? টীকাকার বলেন, বস্ত্রবিশেষ; অভিধানেও এর বেশি কিছু বলে না। তবে আমরা এই পর্যন্ত অনুমান করতে পারি যে, ‘বাদর’ খদ্দর নয়, কেননা, বাদরের রূপ ইন্দ্রধনুর, আর তা ফুয়ে উড়ে যায়, নাহয় তো দেখতে সাপের খোলসের মত আর অকঠোররম্ভাগৰ্ভকোমল। সংক্ষেপে এসব কাপড় এত মিহি যে, তারা কেবলমাত্র স্পর্শানুমেয়। এ বর্ণনা থেকে এইমাত্র জানা যায় যে, হর্ষযুগের ভারতবর্ষ মোটা ভাত মোটা কাপড়ের দেশ ছিল না। বাণভট্টের হর্ষচরিত থেকে, রাজারাজড়াদের না হোক, অন্নবস্ত্রের ইতিহাস উদ্ধার করা সহজ।
এর কিছুদিন পরে রাজা প্রভাকরবর্ধন হনপশুদের বধ করবার জন্য রাজ্যবর্ধনকে উত্তরাপথে পাঠিয়েছিলেন। হর্ষবর্ধনও হিমালয়ের উপকণ্ঠে বাঘভালুক শিকার করতে গেলেন। বলা বাহুল্য যে, হর্ষদেব–
স্বল্পীয়োভিরেব দিবসৈনিঃশ্বাপদারণ্যানি চকার।
এমন সময়ে তিনি খবর পেলেন যে, প্রভাকরবর্ধন কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি রাজধানীতে ফিরে এলেন, এবং পরদিনই তার পিতার মৃত্যু হল ও রানী যশোবতী সহমরণে গেলেন।
তার পর রাজ্যবর্ধন দেশে ফিরে এসে কনিষ্ঠ ভ্রাতা হর্ষকে রাজ্যভার গ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন; কারণ, পূর্ব হতেই সংসার ত্যাগ করবেন বলে তিনি মন স্থির করেছেন, উপরন্তু পিতৃশোক তাকে একান্ত কাতর করে ফেলেছে। রাজ্যবর্ধন স্পষ্টই বললেন যে–
স্ত্রিয়ো হি বিষয়ঃ শুচাম্। তথাপি কিং করোমি। স্বভাবস্য সেয়ং কাপুরুষতা বা স্ত্রৈণং বা যদেবমাস্পদং পিতৃশোকহুতভুজো জাতোহস্মি।