বাংলাদেশে ১৯৩৯ সংবতে বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রথমে মূল হর্ষচরিত প্রকাশ করেন। উক্ত গ্রন্থের বিজ্ঞাপনে তিনি লিখেছেন–
বাণভট্ট হর্ষচরিত নামে গদ্য গ্রন্থ লিখিয়াছিলেন, ইহা আমি পূবে অবগত ছিলাম না।
এর থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, অপর কোনো পণ্ডিতই অবগত ছিলেন না। আর বোধ হয়, সহজবোধ্য নয় বলেই বাংলার পণ্ডিতসমাজে এ গ্রন্থের পঠন-পাঠন ছিল না। এ গ্রন্থ যে দুষ্পাঠ্য, তার প্রমাণ, বিদ্যাসাগর মহাশয় আরও বলেছেন যে, হর্ষচরিতের ‘অনায়াসে অর্থবোধ জন্মে না।‘ শুধু বাংলার পণ্ডিত কেন, অন্য প্রদেশের পণ্ডিতদেরও ঐ একই মত। মহাকবিচূড়ামণি শংকর, হর্ষচরিতের সংকেত নামক যে ব্যাখ্যা লিখেছেন, তা এই বলে শেষ করেছেন–
দুর্বোধে হর্ষচরিতে সম্প্রদায়ানুবোধত্।
গূঢ়ার্থোন্মুদ্রণাং চক্রে শংকরো বিদুষাং রুতে।।
অর্থাৎ হর্ষচরিতের ব্যাখ্যাও আমাদের জন্য লেখা হয় নি, লেখা হয়েছিল ‘বিদুষাং কৃতে’; ফলে এ মহাপুরুষের চরিত ‘শ্রোতুং’ আমাদের কৌতূহল থাকলেও সে কৌতূহল চরিতার্থ করবার সুযোগ আমাদের ছিল না।
৩.
আমাদের মহা সৌভাগ্য এই যে, উক্ত উভয় গ্রন্থই ইংরেজিতে ভাষান্তরিত হয়েছে, এবং সেই দুখানি ইংরেজি অনুবাদের সাহায্যে শ্ৰীযুক্ত রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় একখানি নব-হর্ষচরিত রচনা করেছেন।
তাঁর রচিত হর্ষচরিত আমরা অবলীলাক্রমে পড়তে পারি, কিন্তু তিনি অবলীলাক্রমে এ গ্রন্থ রচনা করেন নি। বহু পরিশ্রম করে তাকে তা রচনা করতে হয়েছে। প্রথমতঃ, বাণভট্টের ইংরেজি তরজমাও সুপাঠ্য নয়। তার পর বাণভট্ট লিখেছিলেন কাব্য, সুতরাং সমস্ত কাব্যখানিই তাঁর মনঃকল্পিত কি না, এ বিষয়ে সন্দেহের অবসর আছে। কেননা, স্বয়ং বাণভট্টই তার রচিত কাদম্বরীর গোঁড়াতেই লিখেছেন যে—
অলব্ধবৈদগ্ধ্যবিলাসমুগ্ধয়া ধিয়া নিবন্ধেয়মতিদ্বয়ী কথা।
অর্থাৎ যদিচ তাঁর কোনোরূপ বৈদগ্ধ্য ছিল না, তবুও তিনি শখের বশীভূত হয়ে কাদম্বরী নামক ‘অতিদ্বয়ী’ কথা একমাত্র মন থেকে গড়েছেন। অতিদ্বয়ী কথা’র অর্থ সেই কথা যা বাসবদত্তা ও বৃহৎকথাকে অতিক্রম করে। এ হেন চরিত্রের লেখকের কোনো কথার উপর আস্থা রেখে ইতিহাস লেখা চলে না, কেননা, ইতিহাসের কথা মনগড়া কথা নয়। অথচ বাণভট্টের কথা প্রত্যাখ্যান করাও চলে না। কারণ, হর্ষের বালচরিত একমাত্র বাণই বর্ণনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে রাধাকুমুদবাবুকে বাণভট্টের প্রতি কথাটি যাচিয়ে নিতে হয়েছে। ইংরেজি ভাষায় যাকে inscription বলে, তাই হচ্ছে ইতিহাসের কষ্টিপাথর। হর্ষের বিষয়ে ইসক্রিপশনও আছে, আর সেইসব ইন্সক্রিপশনের সাহায্যে তিনি যাচিয়ে দেখেছেন যে, বাণভট্টের হর্ষচরিত অক্ষরডম্বর হলেও কেবলমাত্র ধ্বনিসার নয়। তার প্রায় প্রতি কথাই সত্য, সুতরাং নির্ভয়ে এ কবির কাব্য ইতিহাসের ভিত্তিস্বরূপ গ্রহণ করা যেতে পারে। আর হিউয়েন সাংএর কথা যে ইতিহাস, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই; কেননা, তার ভ্রমণবৃত্তান্তকে কোনো হিসাবেই কাব্য বলা চলে না। ও-গ্রন্থ হচ্ছে একাধারে হিস্টরি ও জিয়োগ্রাফি।
৪.
রাধাকুমুদবাবু তার নব-হর্ষচরিত রচনা করেছেন ইংরেজি ভাষায়; আমি সেই গ্রন্থের সংক্ষিপ্তসার বাংলা ভাষায় লিপিবদ্ধ করবার চেষ্টা করব। কিন্তু প্রথমেই একটু মুশকিলে পড়েছি। সেকালে অজ্ঞাতকুলশীল কোনো কবি বলেছেন–
হেম্নো ভারশতানি বা মদমুচাং বৃন্দানি বা দন্তিনাং
শ্রীহর্ষেণ সমর্পিতানি গুণিনে বাণায় কুত্ৰাদ্য তৎ।
যা বাণেন তু তস্য সূক্তিবিসরৈরুট্টঙ্কিতাঃ কীর্তয়-
স্তাঃ কল্পপ্রলয়েহপি যান্তি ন মনাষ্মন্যে পরিম্নানতাম্। (সুভাষিতাবলী ১৮০)
এ শ্লোকের নির্গলিতাৰ্থ হচ্ছে এই যে, শ্রীহর্ষ বাণভট্টকে যে-ধনদৌলত দিয়েছিলেন, আজ তা কোথায়? অপর পক্ষে বাণভট্ট শ্রীহর্ষের যে কীর্তিকলাপ উট্টঙ্কিত করেছেন, তা কল্পান্তেও ম্লান হবে না।
শ্রীহর্ষ বাণভট্টকে কি সোনারুপে হাতিঘোড়া দিয়েছিলেন, সে বিষয়ে ইতিহাস নীরব। কিন্তু বাণ যে হর্ষের বিশেষ কিছু কীর্তিকলাপ বর্ণনা করেছেন, তাও নয়। হর্ষচরিত একখানি অদ্ভুত বই। এই অষ্টাধ্যায়ী ইতিহাসের প্রথম দু অধ্যায় বাণচরিত, আর শেষ দু অধ্যায় হর্ষচরিত। বাণভট্ট রাজসভায় উপস্থিত হয়ে প্রথম এই কথা বলে আত্মপরিচয় দেন—
ব্রাহ্মণোহস্মি জাতঃ সোমপায়িনাং বংশে বাৎস্যায়নানাম্।
তার পর আছে নিজের গুণকীর্তন। এ কবির নিজের আভিজাত্য ও বিদ্যার এতদূর গর্ব ছিল যে, তিনি ঐ ক্ষুদ্রকায় গ্রন্থের অনেক অংশ নিজের বংশের ও নিজের কথায় ভরিয়ে দিয়েছেন। ও-কাব্য থেকে রাজচরিত উদ্ধার করা ঢের বেশি লোভনীয় ও সহজ। কিন্তু সে লোভ এখন আমি সংবরণ করতে বাধ্য, নইলে হর্ষচরিত লেখা হবে না। বারান্তরে বাণচরিত বর্ণনা করব, কারণ, তা করা আমার আয়ত্তের মধ্যে। বাণচরিত লিখতে কোনো চৈনিক গ্রন্থ কিংবা শিলালিপির সাহায্য নিতে হবে না।
৫.
কথাসাবিঘাতেন কাব্যাংশস্য চ যোজন।
এ জ্ঞান সংস্কৃত কবিদেরও ছিল। তবে বাণভট্ট বোধ হয় মনে করতেন যে, হর্ষচরিতের কথায় কোনো রস নেই, তাতে যা কিছু রস আছে, সে তাঁর লেখায়। সুতরাং উক্ত গ্রন্থে কথাবস্তু অতি যৎসামান্য।
অপর পক্ষে রাধাকুমুদবাবু লিখেছেন ইতিহাস। সুতরাং বাণভট্টের রচনার ফুলপাতা বাদ দিয়ে তার কথাবস্তুর উপরই তার হর্ষচরিত রচনা করতে হয়েছে। আর-এক কথা : বাণভট্ট যখন হর্ষচরিত শেষ করেছেন, তখন হর্ষের ম্যাটি কুলেশন দেবার বয়স হয় নি। সুতরাং সে-চরিতের অন্তরে ঐতিহাসিক মাল অতি কম, আর কাব্যের মসলাই বেশি। অথচ এ গ্রন্থ উপেক্ষা করে হর্ষচরিতের প্রথম ভাগ লেখা অসম্ভব। আমি রাধাকুমুদবাবুর পদানুসরণ করে শ্রীহর্ষের বাল্যজীবন বাংলায় বলব, শুধু বাণভট্টের যেসব কথা তিনি ইংরেজি ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন, আমি সেসব যথাসম্ভব বাণভট্টের নিজের কথাতেই বলব। এ কথা শুনে ভয় পাবেন না। হর্ষচরিত অতি দুর্বোধ হলেও বাণভট্ট কাজের কথা অতি সংক্ষেপে সহজবোধ্য সংস্কৃত ভাষাতেই বলেন। তা ছাড়া এ লেখার গায়ে একটু সেকেলে গন্ধও থাকা চাই।