যাঁরা তর্ক করতে প্রস্তুত, তাঁরা তর্কে হার মানতেও প্রস্তুত; কিন্তু তাঁদের সংখ্যা অত্যন্ত কম। অধিকাংশ ইঙ্গবঙ্গের মনোভাব এই যে, নগদ দামে নাহয় ধার করে দোনা কৌচ মেজ কিনব, এর মধ্যে আবার দর্শন-বিজ্ঞান কোথায়? নিজের কি আবশ্যক এবং নিজের কি মনোমত, সেটা ঠিক করতে সমাজতত্ত্ব আলোচনা করবার দরকার নেই। সুতরাং সাহেবিয়ানার সপক্ষে এরা হয় সুবিধা, নাহয় সুচির দোহাই দেন। যখন বিউটির দোহাই চলে না, তখন ইউটিলিটির দোহাই দেন; যখন ইউটিলিটির দোহাই চলে না, তখন বিউটির দোহাই দেন। যখন এ শ্রেণীর লোকেরা বিজাতীয় আচার-ব্যবহারের ইউটিলিটির ব্যাখ্যান শুর করেন, তখন মনে হয় এরা জন স্টুয়ার্ট মিলের কৃষ্ণপক্ষীয় সন্তান; আর যখন এরা বিলাতি ছিট, বিলাতি কারপেটের বিউটির ব্যাখ্যান শর করেন তখন মনে হয় অস্কার ওয়াইল,ডের মাসতুতো ভাই। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ এদের জিজ্ঞাসা করে যে, জেল কিংবা পাগলাগারদের অধিবাসী না হয়েও চুলের অবস্থা ওরকম কেন, এরা হেসে উত্তর করবেন আমরা কবি নই, কাজের লোক। এদের বিশ্বাস দো-অসিলা কুকুরের ল্যাজের মতো ইবঙ্গের চুল যত গোঁড়াঘেঁষে কাটা যায়, তার তেজ তত বৃদ্ধি হয়, তত রোখ বাড়ে। এবং এই বিশ্বাস Mill মিলের মতানুযায়ী। এদের রুচি সম্বন্ধেও এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। সুতরাং ইংরেজি আসবাবের আবশ্যকতা এবং সৌন্দর্য সম্বন্ধে দু-চার কথা বলা আবশ্যক।
বিদেশী রকমে ঘর সাজানোতে যে আমাদের কি পর্যন্ত অর্থের শ্রাদ্ধ হয়, তা তো সকলেই জানেন। অধিকাংশ ইঙ্গবঙ্গের পক্ষে ঠাট বজায় রাখতেই প্রাণান্তপরিচ্ছেদ হতে হয়। ধার-করা সভ্যতা রক্ষা করতে শুধু ধার বাড়ে। আমাদের এই দারিদ্রপীড়িত দেশে অনাবশ্যক বহব্যয়সাধ্য আচার-ব্যবহারের অভ্যাস করা আহাম্মকি তো বটেই, সম্ভবত অন্যায়ও; ক্ষমতার বহির্ভূত চাল বাড়ানো, গৃহ হতে লক্ষ্মীকে বিদায় করবার প্রশস্ত উপায়। তা ছাড়া বিদেশীর অনুকরণে বিদেশী কতুতে যদি গৃহ পণ করা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে, দেশের ধনে যদি বিদেশীর পকেট পূর্ণ করতে হয়, তা হলে হিতাহিতজ্ঞানসম্পন্ন ভদ্রসন্তানের পক্ষে সে অনুকরণ সর্বতোভাবে বর্জনীয়। ইউরোপে সাধারণ লোকের একটা ভুল ধারণা আছে যে, খাওয়া-পরার মাত্রা যত বাড়ানো যায়, জাতীয় উন্নতির পথ ততটা পরিষ্কার হয়। যদি আমার এত না হলে দিন চলে না এমন হয়, তা হলে তত সংগ্রহ করবার জন্য পরিশ্রম স্বীকার করতে হবে; এবং যে জাতি যত অধিক শ্রম স্বীকার করতে বাধ্য, সে জাতি তত উন্নত, তত সৌভাগ্যবান। কিন্তু ফলে কি দেখতে পাওয়া যায়? ইউরোপবাসীরা এই বাহুল্যচর্চার দ্বারা জীবন অত্যন্ত ভারাক্রান্ত করে ফেলেছে বলে কর্মক্ষেত্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এশিয়াবাসীদের নিকট সর্বত্রই হার মানছে। এই কারণেই দক্ষিণ-আফ্রিকা অস্ট্রেলিয়া আমেরিকা প্রভৃতি দেশে চীনে জাপানী হিন্দুস্থানী শ্রমজীবীদের বিরুদ্ধে নানা গহিত বিধিব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এশিয়াবাসীরা খাওয়া-পরাটা দেহধারণের জন্য আবশ্যক মনে করে, মনের সুখের জন্য নয়; সেইজন্য তারা পরিশ্রমের অনুরূপ পুরস্কার লাভ করলেই সন্তুষ্ট থাকে। এই সন্তোষ আমাদের জাতিরক্ষার, জাতীয় উন্নতির প্রধান সহায়। আমরা যদি আমাদের পরিশ্রমের ফলের ন্যায্য প্রাপ্য অংশ লাভ করতুম, আমরা যদি বঞ্চিত প্রতারিত না হতুম, তা হলে দেশে অন্নের জন্য এত হাহাকার উঠত না। আমাদের এ দোষে কেউ ‘দোষী করবেন না যে, আমরা যথেষ্ট পরিশ্রম করি নে। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, আমাদের পরিশ্রমের ফল অপরে ভোগ করে। আমাদের দেশে আজকাল শিক্ষিত লোকেরবিশেষত ইঙ্গবগ সম্প্রদায়ের মনোভাব এই যে, স্ট্যান্ডার্ড অব লাইফ বাড়ানো সভ্যতার একটি অঙ্গ। এ সর্বনেশে ধারণা তাঁদের মন থেকে যত শীঘ্ন দর হয় ততই দেশের পক্ষে মঙ্গল। উপরোক্ত যুক্তি ছাড়া জীবনযাত্রার উপযোগ ইউরোপীয় সরঞ্জামের সপক্ষে আর কোনো যুক্তি শুনেছি বলে তো মনে পড়ে না। তবে অনেকে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে বলে থাকেন, “আমার খুশি। আমাদের দেশের রাজা সমাজের অধিনায়ক নন। বিদেশী বিধর্মী রাজা এ দেশে কখনো সামাজিক দলপতি হতে পারেন না, সুতরাং আমাদের সমাজে এখন অরাজকতা প্রবেশ করেছে। যে সমাজে শান্ত আছে কিন্তু শাসন মানাবার কোনো উপায় নেই, সেখানে শাসন না মেনে যে কাজে কোনো বাইরের শান্তি নেই সে কার্যে যথেচ্ছাচারী হয়ে এরা যে নিজেদের বিশেষরুপে নিভীক স্বাধীনচেতা এবং পুরুষশাদল বলে প্রমাণ করেন, তার আর সন্দেহ কি। অবশ্য এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, এদের খুশি প্রভুদের খুশির সঙ্গে অক্ষরে-অক্ষরে মিলে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে বদলায়। সে তো হবারই কথা। এরাও সভ্য, তাঁরাও সভ্য, সুতরাং পরস্পরের মিল-সে শুধু সেয়ানায় সেয়ানার কোলাকুলি। যদি কেউ আমাকে বুঝিয়ে দিতে পারেন যে, চেয়ার টেবিল কোচ মেজ ইত্যাদি দেহ আত্মা রিবা মনের উন্নতির কিরূপে এবং কতদূর সাহায্য করে, তা হলে আমি তার কাছে চিরবাধিত থাকব, কারণ সত্যের খাতিরে আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, চৌকি কোঁচ অনেকটা আরামের জিনিস এবং আমরা অনেকেই অভ্যস্ত আরামভোগে বঞ্চিত হতে নিতান্ত কুণ্ঠিত। আমাদের সকলেরই পৃষ্ঠদণ্ড কিঞ্চিৎ কমজোর এবং ঈষৎ বক, সুতরাং আমরা পষ্ঠের একটা আশ্রয়ের জন্য সকলেই আকাক্ষী। এবং আরাম-চৌকি এখন আমাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। যোগশাস্ত্রে বলে, সকলপ্রকার আত্মোন্নতির মূলে সরল পদণ্ড বর্তমান। সুতরাং যোগের প্রথম সাধনা হচ্ছে আসন অভ্যাস করা, পৃষ্ঠদণ্ড ঋজ করা। দাসজাতির দেহভঙ্গি মীলোকের মতে, সম্মুখ দিকে ঈষৎ আনমিত-অতিপ্রবদ্ধ যৌবনভারে নয়, অতি অভ্যস্ত সেলাম এবং নমস্কার-চর্চা বশত। আমাদের জাতীয় কুলকুণ্ডলিনী যদি জাগ্রত করতে হয় তা হলে আমাদের পিঠের দাঁড়া খাড়া করতে হবে, অনেক অভ্যস্ত আরাম ত্যাগ করতে হবে। সুতরাং একমাত্র দৈহিক আরামের খাতিরে বিদেশী আসবাবের প্রচার এবং অবাধন সমর্থন করা যায় না। সকলেই জানেন যে, জাপান ইউরোপের কাছে যা শিখেছে আমরা তা শিখি নি; কিন্তু খুব কম লোকেই জানেন যে, ইউরোপের কাছে আমরা যা শিখেছি জাপান তা শেখে নি। ফলে ইউরোপের সঙ্গে কারবারে জাপান নিজের শক্তি সঞ্চয় করেছে, ইউরোপের সঙ্গে কারবারে আমরা শুধু শক্তির অপচয় করেছি। এই কারণেই আমাদের জাপানের কাছে এই শিক্ষালাভ করতে হবে যে, ইউরোপীয় সভ্যতার কি আমাদের গ্রহণ করা উচিত এবং কি আমাদের বর্জন করা উচিত। এই বিষয়ে জ্ঞানলাভ করাটাই আমাদের সর্বপ্রধান দরকার, এবং জাপান ব্যতীত পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ আমাদের গুরু হতে পারে না, কারণ জাপান শুধু এ কঠিন সমস্যার মীমাংসা করেছে। খাওয়া-পরা-থাকা-শোওয়া সম্বন্ধে জাপান স্বদেশের সনাতন প্রথা ত্যাগ করে নি। বিলেতি আসবাব জাপানের ঘরে স্থান পায় নি। আজও সমগ্র জাপান মাদুরের উপর বীরাসনে আসীন।(১)