পূর্বেই বলেছি যে, আমরা বাঙালিমাত্রেই ঐ একই বিলেতি ক্ষরে মাথা মুড়িয়েছি। শুধু কারো মাথায় কাকপক্ষ অবশিষ্ট, কারো মাথায়-বা শুধু টিকি; যাঁর যেটকু অবশিষ্ট আছে, তিনি সেইটেই স্বদেশীয়তার ধজাম্বরপ আস্ফালন করেন। এ ব্যাপারে আমাদের ইগবগ-দলের মন ভারি করবার কোনো কারণ নেই। ইউরোপীয় সভ্যতার সংস্পর্শে আমাদের জাতি যদি কোনো স্থায়ী সফল লাভ করে থাকে তো সে মনে, আর যা যা ক্ষণস্থায়ী কুফল লাভ করেছে, সে বাহ্য আচারব্যবহারে। মোটামুটি ধরতে গেলে এ ব্যাপারের লাভলোকসানের হিসাবটা ঐরূপ দাঁড়ায়। সেই আচার-ব্যবহারের বিজাতীয়তা আমাদের মধ্যে যেমন স্পষ্ট এবং জাজল্যমান হয়ে উঠেছে, এমন আর অন্য কোনো শ্রেণীর লোকের মধ্যে হয় নি। সকলেই অল্পবিস্তর বিলেতি মধু পান করেছেন, কিন্তু পুরো নেশা শুধু আমাদেরই ধরেছে। বিদেশী বন্ধুর বড়ো বস্তা আমরা মাথায় বহন করছি, অপরে পটলিপাঁটলা নিয়ে চলেছে। আমরা যদি আমাদের মাথার সে ভার নামাতে পারি, তা হলে অপরের পক্ষে তাদের মাথার সে ভার ঝেড়ে ফেলা কঠিন হবে না। এই ঘদেশীয়তার কথা শুধু দেশের কথা নয়, এ ঘরেরও কথা। বাঙালি যখন নিজের সমাজ ছাড়ে, তখন সেইসঙ্গে নিজের স্বভাব ছাড়ে না। ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে; অর্থাৎ সেখানেও অপরের পায়ের চাপ না পেলে তার দিন চলে না। আমাদেরও স্বভাব তাই। নিজের সমাজের চাপ থেকে বেরিয়ে এসে বিদেশী সমাজের পায়ের চাপ আমরা পিঠে তুলে নিই। বাঙালিজাতকে পিটে গড়া হয় নি। আমরা ঢালাই হতে ভালোবাসি। এক ছাঁচ থেকে বেরোলে আমরা অন্য ছাঁচে না পড়লে ঠাণ্ডা হই নে। অনুকরণ আমাদের স্বাভাবিক। এবং অনুকরণে যেহেতু শুধু উপকরণ সংগ্রহ করা যায়, কিন্তু কিছুই আত্মসাৎ করা যায় না, সেই কারণে আমরা বিলেতি সভ্যতার উপকরণে আমাদের দৈনিক জীবন নিতান্ত ভারাক্রান্ত করে তুলেছি। আমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো অস্থি-মজ্জায় অনুভব করেছেন যে, বিলেতি সভ্যতার কুলিগিরির মজুরি পোষায় না। কিন্তু দু-একজন ছাড়া মুখ ফুটে সে কথা বলতে বড়ো কেউ সাহসী হন নি। দেশীয় সমাজের রীতিনীতির অধীনতার মধ্যে, কার্যের না হোক, চিন্তার স্বাধীনতা আছে। যার মন আছে, তার সামাজিক আচার-ব্যবহার সঘধে স্বাধীনভাবে চিন্তা করবার এবং মতামত ব্যক্ত করবার অধিকার আছে; কিন্তু বিলাতের অনুকরণে যে বাঙালি ঘর বাঁধে, তার একল-ওকল দুলে যায়। আমাদের মধ্যে যার মন যত ঢিলে, তার সাহেবিয়ানার আঁটাআঁটি তত বেশি। ইউরোপীয় সভ্যতার প্রাণ কোথায় যে বুঝতে পারে না, সে তার সর্বাঙ্গে হাতড়ে বেড়ায়। আমরা অনেকে একটা খোরপোশর বন্দোবস্ত করতে বিলেত যাই, সুতরাং বিলেতি সভ্যতার যে শুধু খাওয়া-পরার অংশটা আয়ত্ত করতে চেষ্টা করব, এর আর আশ্চর্য কি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, যে আরামের লোভে আমরা সর্বস্ব খোয়াতে বসি, সেই আরামই আমাদের জোটে না; দেশীয় সমাজের চালচলন শৈশব হতে অভ্যস্ত বলে সেদিকে মন দিতে হয় না, ঠিক ঠিক জিনিসটে অবলীলাক্রমে করে যাই; কিন্তু বিদেশী চালচলন সম্বন্ধে আমাদের অনেকেরই একটা বয়সে কেচেগণ্ডষ করতে হয়। একটু বয়েস হলে একটি বিদেশী ভাষা আয়ত্ত করা যেমন কষ্টসাধ্য, একটি বিদেশী সমাজের হাজারো-এক খুঁটিনাটি আচার-ব্যবহার আয়ত্ত করাও তেমনি কঠিন। বিলেতি সভ্যতার সম্মুখে বাঙালি-সাহেবের আচল টানতে টানতে প্রাণ যায়। খানায়-পোশাকে যাঁরা সভ্যতা খোঁজেন, তাঁদের খানার-পোশাকের কায়দা-কানুন কস্ত করতে নাস্তানাবুদ খানেখারাপ হতে হয়। যাঁরা মাছিমারা নকল করতে চান, তাঁদের নিত্য দেখতে পাই, অক্ষরের পর অক্ষর ধরে বিদেশী হালচাল অভ্যেস করতে প্রাণান্ত-পরিচ্ছেদ হচ্ছে। অন্যকে বানান করে পড়তে শুনলে মায়াও করে, বিরক্তিও ধরে। সাধারণ ইবঙ্গের প্রতিও আমাদের ঐ মনোভাব। কাবো কারো বা বিলেতি সভ্যতার বর্ণপরিচয় হয়েছে, কিন্তু অর্থবোধ হয় নি। এতদ্দেশীয় মুসলমান মহিলার কোরানপাঠের মতো তাঁদের সভ্যতাচর্চার পরিশ্রমটা বৃথা যায়।
সংস্কারবশত হিন্দুসমাজের প্রতি যাঁদের প্রাণের টান আছে, অথচ শিক্ষাবশত যাঁরা সংস্কারমাত্রেরই অধীন নন, যাঁদের ধারণা যে ইউরোপের শিষ্য হওয়া এবং দাস হওয়ার ভিতর আকাশপাতাল প্রভেদ, যাঁরা বিলেতি আচার-ব্যবহার কতকপরিমাণে অবলম্বন করেন–হয় বুদ্ধির দ্বারা পরীক্ষা করে, নয় জীবনে পরীক্ষা করবার উদ্দেশ্যে—এক কথায় যাঁরা শ্যাম এবং কুল, দুইই রাখবার চেষ্টা করেন, তাঁরা আহেল বিলেতি ইগবগদের মতে কেন্দ্রভ্রষ্ট। বাদ-বাকি যাঁরা নিজের নিজের ব্যাবসা ব্যতীত অপর কোনো বিষয়ে কিঞ্চিন্মাত্র মনোপ্রয়োগ করাটা বুদ্ধিবৃত্তির বাজে-খরচ মনে করেন, তাঁরাই বুদ্ধিমান। কেন্দ্রভ্রষ্ট?-কোথাকার কোন সমাজের, কোন, কেন্দ্রভ্রষ্ট? এ প্রশ্ন করলে সকল বুদ্ধিমানই নিরুত্তর। পড়ানো-কাকাতুয়ার কপচানো বলির মতো যদি তাঁদের কথা নিরর্থক না হয়, যদি তাঁদের বক্তব্যের ভিতর মনের কার্য কিছু প্রচ্ছন্ন থাকে তো সে মনোভাব এই—তাঁরা প্রত্যেকেই এক-একটি কেন্দ্র, তাঁদের কাছ থেকে যে যতটা তফাত, সে ততটা কেচুত, ততটা উন্মার্গগামী। বিলেতফেরত-পাড়ায় প্রতি গৃহ একটি সৌরজগৎ; হয় কতা নয় গহিণী সেই জগতের কেন্দ্র; পরিবারের আর-সকলে গ্রহ-উপগ্রহের মতো তারই চারি পাশে পাক খায়, এখানে-সেখানে দু-একটি ধমকেতুও দেখা দেয়। আমাদের কারো গহ, হিন্দুগহের একটি পরিবতিত যুগপৎ পরিবর্ধিত ও সংক্ষিপ্ত সংস্করণ মাত্র; কারোবা গৃহ বিলেতি গহের একটি নিকৃষ্ট ফোটোগ্রাফ মাত্র। আমরা কেউ-বা বিদেশীয়তাব দু-চার সিঁড়ি ভেঙেছি, কেউ-বা একলফে বিলেতি সভ্যতার মন্দিরের চড়ার উপরিথিত ত্রিশালের উপর গিয়ে চড়ে বসেছি।।