এই বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক মিলিটারিজম ইউরোপের বর্তমান সভ্যতার অনুবাদ নয়, প্রতিবাদ মাত্র। জর্মানির পরশ্রীকাতরতাই এর যথার্থ মূল, এবং এ মূল জর্মানির প্রাচীন ইতিহাস থেকে রস সঞ্চয় করেছে। জর্মানির বর্তমান উচ্চ আশার ভাষা নতুন হলেও তার ভাব পুরাতন। মধ্যযুগে জর্মানি একবার ইউরোপের সার্বভৌম চক্রবতীত্ব-পদ লাভ করবার চেষ্টা করে অকৃতকার্য হয়েছিল; আশা করি এবারেও হবে। জর্মানজাতির যথেষ্ট বাহুবল বুদ্ধিবল ও চরিত্রবল আছে, কিন্তু বিসমার্কের হাতে-গড়া জর্মান-সাম্রাজ্যের অন্তরে নৈতিক বল নেই; সুতরাং জর্মানির দিগ্বিজয়ের আশা দুরাশা মাত্র। এ যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক, ইউরোপের বর্তমান সভ্যতাকে এর জন্য দায়ী করা যেতে পারে না; কারণ মিলিটারিজম সে সভ্যতার গৃহশত্রু।
ইউরোপের সকল জাতির দেহেই এই মিলিটারিজম অল্পবিস্তর স্থান লাভ করেছে; একমাত্র জর্মানি তা পূর্ণমাত্রায় অঙ্গীকার করেছে। যা অপর সকল জাতির অন্তরে বাষ্পাকারে বিরাজ করছে জর্মানিতে তা জমে বরফ হয়ে গেছে। সুতরাং এই সমরানলে বরফের এই কাঠিন্যের অগ্নিপরীক্ষা হয়ে যাবে। যদি এই অগ্নিতে মিলিটারিজম ভস্মসাৎ হয় তা হলে যে কেবল অপরজাতি-সকলের মঙ্গল হবে শুধু তাই নয়, জর্মানিও পরিবর্ধিত না হোক, সংশোধিত হবে। যে জাতি মানবাত্মার সঙ্গে ইউরোপের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, যে দেশে কাণ্ট হেগেল গ্যেটে শিলার বীঠোভেন মোজার্ট জন্মলাভ করেছে, সে জাতির কাছে ইউরোপীয় সভ্যতা চিরঋণী। এই মিলিটারিজমের মোহমুক্ত হলে সে জাতি আবার মানবসভ্যতার প্রবল সহায় হবে।
মিলিটারিজম হেয় বলে বর্তমান বৈশ্যসভ্যতাই যে শ্রেয় এ কথা আমি বলতে পারি নে। কোনো সভ্যতাই নিরাবিল ও নিষ্কলুষ নয়, বৈশ্যসভ্যতাও নয়। তবে কোনো বর্তমান সভ্যতার দোষগুণ বিচার করতে হলে তার অতীতের প্রতি যেরূপ দৃষ্টি রাখা চাই, তার ভবিষ্যতের প্রতিও তদ্রূপ দৃষ্টি রাখা চাই। বর্তমান যে, অতীত ও ভবিষ্যতের সন্ধিস্থলমাত্র এ কথা ভোলা উচিত নয়। বর্তমানের যে-সকল দোষ স্পষ্ট লক্ষিত হচ্ছে ভবিষ্যতে তার নিরাকরণ হবার আশা আছে কি না, এ সভ্যতা স্বীয় শক্তিতে স্বীয় রোগমুক্ত হতে পারবে কি না, এই হচ্ছে আসল জিজ্ঞাস্য। আমার বিশ্বাস, বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতার সে শক্তি আছে। সে যাই হোক, বৈশ্যসভ্যতার রোগ সারাবার বৈধ উপায় হচ্ছে মন্ত্রৌষধির প্রয়োগ–জর্মানির অস্ত্রচিকিৎসা নয়।
অগ্রহায়ণ ১৩২১