অসংখ্য দার্শনিক বৈজ্ঞানিক ঐতিহাসিক অধ্যাপক প্রভৃতি চিরজীবন প্রাণপণে চেষ্টা করেও এ ব্রত উদযাপন করতে পারেন নি; কিন্তু আজ প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে বিসমার্ক দুটি যুদ্ধের সাহায্যে জর্মানজাতির প্রাণের আশা ফলে পরিণত করেছিলেন। বিসমার্ক অস্ট্রিয়াকে পরাভূত করে উত্তর-জর্মানির এবং ফ্রান্সকে পরাভূত করে দক্ষিণ-জর্মানির যোগসাধন করেন। বিসমার্ক বলতেন যে, রক্ত ও লৌহের রসান দিয়ে তিনি ভাঙা জর্মানিকে জোড়া দিয়েছেন। সুতরাং যুদ্ধের দ্বারা যে রাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে, যুদ্ধের দ্বারাই তার রক্ষা এবং সুখের দ্বারাই তার উন্নতি সাধন করতে হবে–এই হচ্ছে নবজর্মানির দৃঢ়ধারণা।
যুদ্ধকার্য অপ্রিয় হলেও আত্মরক্ষার্থ যে তা করা কর্তব্য এ বিষয়ে ইংরেজ ফরাসি প্রভৃতি ইউরোপের অগ্রগণ্য জাতির মধ্যে কোনো মতভেদ নেই। জর্মানদের সঙ্গে আর-সকলের প্রভেদ এইখানে যে, জর্মানির কর্তৃপক্ষদের মতে জাতীয় উন্নতির পথ পরিষ্কার করবারও একমাত্র উপায় হচ্ছে তরবারি।
জর্মানির যোদ্ধাদলের মুখপাত্র জেনারেল বেয়ারনহার্ডি অতি স্পষ্টাক্ষরে দুনিয়ার লোককে জর্মান রাষ্ট্রনীতির মূলকথা জানিয়ে দিয়েছেন। সে কথা এই—
জর্মানজাতি গত ত্রিশ-চল্লিশ বৎসরের মধ্যে শিল্পবাণিজ্যে যে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে তার থেকেই প্রমাণ হয় যে, কি বাহুবলে, কি বুদ্ধিবলে সে জাতির সমকক্ষ দ্বিতীয় জাতি পৃথিবীতে নেই। জর্মানির শ্রীবৃধি তার বাণিজ্যবিস্তারের উপর নির্ভর করে। যদিচ ভবের হাটে কেনাবেচার জন্য জর্মানজাতিই হচ্ছে জ্যেষ্ঠ অধিকারী তবুও এ ক্ষেত্রে সকলের শেষে উপস্থিত হওয়ার দরুন সে আজ সর্বকনিষ্ঠ, কেননা পৃথিবীর সকল হাটবাজার আজ অপরের সম্পত্তি। পরের হাটে কেনাবেচা করার অর্থ পরভাগ্যোপজীবী হওয়া; সুতরাং এ পৃথিবীতে আত্মপ্রতিষ্ঠা করবার জন্য জর্মানি অপরের সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নিতে বাধ্য। যুদ্ধ ব্যতীত অপর কোনো উপায়ে জর্মানির পক্ষে তার জাতীয় স্বার্থসাধন করা অসম্ভব। অতএব মিলিটারিজম হচ্ছে নবজর্মানির একমাত্র ধর্ম।
জেনারেল বেয়ারনহার্ডি যে স্পষ্টবাদী সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দস্যুতাকে ধর্ম বলে প্রচার করতে লোকে সহজেই কুণ্ঠিত হয়। ওরূপ মনোভাব প্রকাশ করতে হলে অপর দেশের লোকে অনেক বড়ো বড়ো নীতির কথায় তাকে চাপা দেয়।
কিন্তু জর্মান-রাজমন্ত্রী কিংবা জর্মান-রাজসেনাপতির পক্ষে এ বিষয়ে কোনোরূপ কপটতা করবার প্রয়োজন নেই। জর্মানির রাজগুরুপুরোহিতেরা যে নবশাস্ত্র রচনা করেছেন, জর্মানির রাজ-পুরুষদের রাজনীতি সেই শাস্ত্রসংগত।
জর্মান বৈজ্ঞানিকদের মতে ডারউইনের আবিষ্কৃত ইভলিউশনের নির্গলিতার্থ হচ্ছে—জোর যার মুলুক তার। প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘন করলে মানুষে শুধু মৃত্যুমুখে পতিত হয়। জীবনটা যখন একটা মারামারি-কাটাকাটি ব্যাপার, তখন যে মারতে প্রস্তুত নয় তাকে মরতে প্রস্তুত হতে হবে—এই হচ্ছে বিধির নিয়ম। ইভলিউশনের এই ব্যাখ্যা, নীটশে-নামক একটি প্রতিভাশালী লেখক সমগ্র জর্মানজাতিকে গ্রাহ্য করিয়েছেন। নীটশের মতে দয়া মমতা পরদুঃখকাতরতা প্রতি মনোভাব মানসিক রোগ ব্যতীত আর কিছুই নয়, কেননা এ-সকল মনোভাবের প্রশ্রয় দেওয়াতে মানুষের প্রকৃতি দুর্বল হয়ে পড়ে; এবং দুর্বলতাই হচ্ছে পৃথিবীতে একমাত্র পাপ এবং সবলতাই একমাত্র পণ্য; শক্তিই হচ্ছে একাধারে সত্য শিব ও সুন্দর। ইউরোপীয় মানব যে এই সহজ সত্য ভুলে গেছল তার কারণ ইউরোপ খৃস্টধর্ম নামক রোগে জর্জরিত। খৃস্টধর্ম যে এশিয়ায় জন্মলাভ করেছে তার কারণ, এশিয়াবাসীরা দাসের জাতি, সুতরাং তাদের সকল ধর্মকর্ম দাসমনোভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই এশিয়ার ক্যানসার ইউরোপের দেহ হতে সমূলে উৎপাটিত করতে হলে অস্ত্রচিকিৎসা ব্যতীত উপায়ান্তর নাই। ইউরোপের নবযুগের সাম্য মৈত্রী প্রভৃতি মনোভাব ঐ প্রাচীন রোগের নূতন উপসর্গ মাত্র। সুতরাং ফরাসি ইংরেজ প্রভৃতি যে-সকল জাতির দেহে এই-সকল রোগের লক্ষণ দেখা যায়, তাদের উচ্ছেদ করা জর্মান ক্ষত্রিয়দের পক্ষে একান্ত কর্তব্য। নীটশের এই মত জর্মান জাতির মনে যে বসে গেছে, তার কারণ নীটশে কালি-কলমে লেখেন নি, তার প্রতি অক্ষর বাটালি দিয়ে খোদা।
জর্মান-পণ্ডিতদের মত, কেবলমাত্র জাতীয় স্বার্থের জন্য নয়, লোকহিতের জন্যও, জর্মানির পক্ষে দিগ্বিজয় করা আবশ্যক। জেনারেল বেয়ারনহার্ডি বলেন–
জর্মান লেবার এবং জর্মান আইডিয়লিজমের প্রচার ব্যতীত মানবজাতির উদ্ধার হবে না। সুতরাং যেমন তরবারির সাহায্যে পৃথিবীসুদ্ধ লোককে জর্মান মাল গ্রাহ্য করাতে হবে, তেমনি ঐ একই উপায়ে জর্মান-তত্ত্বকথাও গ্রাহ্য করাতে হবে। এই হচ্ছে জর্মানির বিধিনির্দিষ্ট কর্ম।
এ স্থলে জর্মান-আইডিয়ালিজমের অর্থ কাণ্ট প্রভৃতির দর্শন নয়; কেননা, বেয়ারনহার্ডি কাণ্ট প্রমুখ দার্শনিকদের অতি অবজ্ঞার চক্ষে দেখেন। বেয়ারনহার্ডির মতে এই-সকল বাহ্যজ্ঞানশুন্য বিষয়বুদ্ধিহীন দার্শনিকদের অমার্জনীয় অপরাধ এই যে, তারা বিশ্বমানবের কাছে শান্তির বারতা ঘোষণা করেছিলেন। জর্মানি আজ তাই তার নব-আইডিয়ালিজম, প্রচার করতে বদ্ধপরিকর হয়েছেন। আধ্যাত্মিক জগতের নব্যপীদের সার কথা এই যে, বৈশ্যসভ্যতায় মানুষের মনুষ্যত্ব নষ্ট করে। বৈশ্যযুগে মানুষ আরামপ্রিয় ও ভোগবিলাসী হয়ে পড়ে। মানুষ বিষয়প্রাণ হলে তার মনের শক্তি ও আত্মার শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতা যে আত্মার অপেক্ষা দেহকে প্রাধান্য দেয় তার বিশিষ্ট প্রমাণ এই যে, মানবজীবনকে যতদূর সম্ভব নিরাপদ করে তোলাই এ সভ্যতার লক্ষ্য। ভয় না থাকলে ভক্তি থাকে না, অথচ বর্তমান সভ্যতা জনসাধারণকে রাজভয় দস্য,ভয় ও মৃত্যুভয় এই ত্রিবিধ ভয় থেকে মুক্ত করেছে। অন্নবস্ত্রের সংস্থান করা অবশ্য জীবনধারণের জন্য আবশ্যক, কিন্তু অর্থকেই জীবনের সার পদার্থ করে তুললে মানুষ অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ে। সুতরাং মানুষের মনুষ্যত্ব রক্ষা করবার জন্য সামাজিক জীবন আবার বিপদসংকুল করে তোলা দরকার। এ যুগে এক যুদ্ধ ব্যতীত অপর কোনো উপায়ে সে উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে না। অতএব ইউরোপীয় সমাজকে পুনর্বার ক্ষত্রিয় শাসনাধীন করা আবশ্যক; কেননা বৈশ্যবধি যুদ্ধের প্রতিকল। এবং ইউরোপের রাজনীতি ক্ষাত্রধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষমতা একমাত্র জর্মানির আছে; কেননা জর্মানির বৈশ্যশূদ্রের আজও কোনোরূপ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নেই। সুতরাং অর্ধরাজ্যের উচ্ছেদ করে পৃথিবীতে ধর্মরাজ্যের সংস্থাপন করবার ভার জর্মানির হাতে পড়েছে। এই কারণে যুদ্ধ করা জর্মানির পক্ষে সর্বপ্রথম কর্তব্য। জর্মানির নব-মিলিটারিজমের প্ররোচনাই এই যুদ্ধের সাক্ষাৎকারণ।