অতীতের সঙ্গে বর্তমানের প্রবল সংঘর্ষে যে অমৃত ও হলাহল উত্থিত হয়েছে, ইউরোপের সকল জাতির দেহ ও মনে তার অল্পবিস্তর প্রভাব স্পষ্ট লক্ষিত হয়।
বর্তমান যুগের সর্বপ্রধান সমস্যাই এই যে, কি উপায়ে সভ্যসমাজের দেহ এই বিষমুক্ত করা যেতে পারে।
.
৪.
এ সমস্যা অতি গুরুতর সমস্যা। কেননা, এক পক্ষে যেমন ইউরোপের সভ্যজাতিদের মনে যুদ্ধ করবার প্রবৃত্তি কমে এসেছে, অপর পক্ষে তাদের জীবনে পরস্পর যুদ্ধ করবার নূতন কারণেরও সৃষ্টি হয়েছে। এই কারণে ইউরোপের মুখে শান্তিবচন এবং হাতে অস্ত্র।
সকলেই জানেন যে, শিল্প ও বাণিজ্যই হচ্ছে ইউরোপীয় সভ্যতার প্রধান আশ্রয়স্থল। শিল্পবাণিজ্যের সাহায্যে অন্নবস্ত্রের সংস্থান করার অর্থ হচ্ছে নিজের পরিশ্রমে জীবিকা অর্জন করা; আর যুদ্ধের দ্বারা অর্থ সংগ্রহ করার অর্থ হচ্ছে পরের পরিশ্রমের ফল উপভোগ করা। এ দুটি মনোভাব সম্পূর্ণ বিপরীত। এই কারণেই সকল দেশে সকল যুগেই দেখা যায় যে, ক্ষত্রিয় বৈশ্যকে অবজ্ঞা করে এবং বৈশ্য ক্ষত্রিয়কে ভয় করে। যে জাতির অধিকাংশ লোক শিল্পবাণিজ্যে ব্যাপৃত, সে জাতির যুদ্ধে প্রবৃত্ত না থাকাই স্বাভাবিক।
তার পর, শিল্পবাণিজ্যের পক্ষে যুদ্ধের ন্যায় ক্ষতিকর ব্যাপার আর নেই। যুদ্ধ যে মানুষের সকল কাজকর্ম সকল বেচাকেনা একদিনেই বন্ধ করে দেয়, তার প্রমাণ তো আজ হাতে-হাতেই পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং, যুদ্ধ জিনিসটি ইউরোপীয়দের স্বার্থের বিরোধী। আর-এক কথা, হার্বাট স্পেনসর প্রমুখ দার্শনিকেরা আশা করেছিলেন যে, বর্তমান ইউরোপের বৈশ্যসভ্যতা পৃথিবীতে চিরশান্তি স্থাপন করবে। তাঁদের বিশ্বাস ছিল যে, বাণিজ্যের যোগ পৃথিবীর সকল জাতির সখ্যসূত্রে পরিণত হবে। এই অন্নবস্ত্রেরে অবাধ আদানপ্রদানের ফলে প্রতি জাতির কাছেই বসুধা কুটুম্ব হয়ে উঠবে। এই কারণে এই শ্রেণীর দার্শনিকদের মতে ক্ষত্রিয়যুগের অপেক্ষা বৈশ্যযুগের সভ্যতা মানব-ইতিহাসের উন্নত স্তরের সভ্যতা। হার্বার্ট স্পেনসরের এই আশা যে কবিকল্পনা ব্যতীত আর কিছুই নয়, তার প্রমাণ আজ পাওয়া যাচ্ছে। আজ দেখা যাচ্ছে যে, আগে যেমন রাজ্য নিয়ে রাজায়-রাজায় লড়াই করত, আজ তেমনি বাণিজ্য নিয়ে জাতিতে-জাতিতে লড়াই করছে এবং এ লড়াই অতি ভীষণ এবং অতি নিষ্ঠুর। কারণ আগে মানুষ হাতে যুদ্ধ করত, এখন কলে যুদ্ধ করে। এই কারণেই বর্তমান যুদ্ধ নিতান্ত অমানুষী ব্যাপার, কেননা বাহুবলের ভিতর মনুষ্যত্ব আছে কিন্তু যন্ত্রবলের ভিতর নেই। কিন্তু এ সত্ত্বেও এ কথা সত্য যে, বৈশ্যসভ্যতা যুদ্ধের অনুকূল নয়, কেননা যুধ বৈশ্যধর্মের প্রকৃতিবিরুদ্ধ।
.
৫.
ইংলণ্ড এবং ফ্রান্স যে আত্মরক্ষা ব্যতীত অপর কোনো কারণে যুদ্ধ করাটা অকর্তব্য মনে করে সে বিষয়ে সন্দেহ করবার কোনো বৈধ কারণ নেই। ইউরোপের নবযুগের নবসভ্যতার যথার্থ উত্তরাধিকারী হচ্ছে এই দুটি দেশ। ইংরেজ ও ফরারি উভয়েই ক্ষত্রিয়যুগ উত্তীর্ণ হয়ে বৈশ্যযুগে এসে উপস্থিত হয়েছেন। সুতরাং এদের দেহে রণসজ্জা থাকলেও মনে খাঁটি মিলিটারিজম নেই। অপর পক্ষে জর্মানি হচ্ছে যুদ্ধপ্রাণ; মিলিটারিজম জর্মানির যুগপৎ ধর্ম ও কর্ম। বর্তমান জর্মানির এরূপ মনোভাবের জন্য দায়ী জর্মানির পূর্বইতিহাস।
প্রায় আটশত বৎসর ধরে ইউরোপে জর্মানজাতির কোনোরূপ প্রভুত্ব ছিল না, তার কারণ জর্মানরা এই দীর্ঘকালের ভিতর একটি জর্মানরাজ্য কিংবা একটি জর্মানজাতি গড়ে তুলতে পারে নি। যে কালে ইংলণ্ড ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ স্বাতন্ত্র্য এবং স্বরাজ্য লাভ করেছিল, সে কালে জর্মানি শত শত পরস্পরবিরোধী খন্ডরাজ্যে বিভক্ত ছিল। এ কতকটা জর্মানির কপালের দোষে, কতকটা তার বুদ্ধির দোষে। জর্মানি সমগ্র ইউরোপের সম্রাট হবার দুরাশা হৃদয়ে পোষণ করত বলে স্বদেশেও একরাট হতে পারে নি।
কোনো কোনো বৌদ্ধদেশে দুটি করে রাজা থাকেন; একজন প্রকৃতিপুঞ্জের আত্মার প্রভু, আর-এক জন দেহের। মধ্যযুগের প্রথম ভাগে সমগ্র ইউরোপীয় মানবকে এইরূপ দুই ছত্রের অধীন করবার চেষ্টা করা হয়েছিল। পোপ ইউরোপের ধর্মরাজের পদ এবং জর্মানরাজ দেবরাজের পদ অধিকার করে বসেছিলেন। ইউরোপ একটি মহাদেশ এবং ইউরোপীয়েরা নানা বিভিন্ন জাতীয়, সুতরাং ঐহিক কিংবা পারত্রিক কোনো বিষয়ে একজাতি হওয়া যে তাদের পক্ষে অসম্ভব, এ কথা পোপও স্বীকার করেন নি, জর্মান-সম্রাটও স্বীকার করেন নি। জর্মানজাতি যে ইউরোপের অন্যান্য জাতি হতে মনে ও চরিত্রে পধক, এ সত্য উপেক্ষা করবার ফলে জর্মানি ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ল। স্বদেশ এবং জাতির উপর কোনোরূপ একাধিপত্য না থাকলেও জর্মান-সম্রাট তাঁর সম্রাট-পদবী এবং সাম্রাজ্যের আশা ত্যাগ করতে পারলেন না, এবং স্বজাতিকে নিয়ে একটি স্বরাজ্য গঠন করবার চেষ্টামাত্রও করলেন না। এই কারণে জর্মানজাতির পূর্বে কোনোরূপ রাষ্ট্রশক্তি ছিল না। অথচ জর্মানজাতির ভিতর কি দেহের কি বুদ্ধির কি চরিত্রের কোনোরূপ বলের যে অভাব ছিল না—জর্মান কাব্যে দর্শনে শিপে সংগীতে ধর্মে ও কর্মে তার প্রকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। ফলে জর্মানির মহাপরিষেরা লৌকিকরাজ্যের আশা ত্যাগ করে চিন্তারাজ্য অধিকার করাই নিজেদের কর্তব্য বলে মেনে নিলেন। সম্ভবত জর্মানজাতির ইতিহাস অদ্যাবধি ঐ একই পথ অনুসরণ করে চলত, যদি নেপোলিয়ন জর্মানজাতিকে আকাশ থেকে টেনে মাটিতে ফেলে পদদলিত না করতেন। ১৮০৬ খৃস্টাব্দে জেনার যুদ্ধে পরাজিত এবং লাঞ্ছিত হবার পর জর্মান মাত্রেরই এ জ্ঞান জন্মাল যে, জর্মানির খণ্ডরাজ্য-সকলকে একত্র করে একটি যুক্তরাজ্যে পরিণত না করতে পারলে জর্মানজাতির পক্ষে অস্তিত্ব রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।