আমি পূর্বে বলেছি যে, আমরা সকলে মিলে জীবনের সকল ক্ষেত্রেই, হয় ইউরোপীয় নয় আর্য সভ্যতার তরজমা করবার চেষ্টা করছি, কিন্তু ফলে আমরা তরজমা না করে শুধু নকলই করছি। নকল করার মধ্যে কোনোরূপ গৌরব বা মনুষ্যত্ব নেই। মানসিক শক্তির অভাববশতই মানুষে যখন কোনো জিনিস রপান্তরিত করে নিজের জীবনের উপযোগী করে নিতে পারে না, অথচ লোভবশত লাভ করতে চায়, তখন তার নকল করে। নকলে বাইরের পদার্থ বাইরেই থাকে, আমাদের অন্তর্ভূত হয় না; তার দ্বারা আমাদের মনের এবং চরিত্রের কান্তি পুষ্ট হয় না, ফলে মানসিক শক্তির যথেষ্ট চর্চার অভাববশত দিন-দিন সে শক্তি হ্রাস হতে থাকে। ইউরোপীয় সভ্যতা আমরা নিজেদের চারিপাশে জড়ো করেও সেটিকে অন্তরঙ্গ করতে পারি নি; তার স্পষ্ট প্রমাণ এই যে, আমরা মাঝেমাঝে সেটিকে ঝেড়ে ফেলবার জন্য ছটফট করি। মানুষে যা আত্মসাৎ করতে পারে না তাই ভস্মসাৎ করতে চায়। আমরা মুখে যাই বলি নে কেন, কাজে পব-সভ্যতা নয়, পশ্চিম-সভ্যতারই নকল করি; তার কারণ ইউরোপীয় সভ্যতা আমাদের চোখের সম্মুখে সশরীরে বর্তমান, অপরপক্ষে আর্য সভ্যতার প্রেতাত্মামাত্র অবশিষ্ট। প্রেতাত্মাকে আয়ত্ত করতে হলে বহু সাধনার আবশ্যক। তাছাড়া প্রেতাত্মা নিয়ে যাঁরা কারবার করেন তাঁরা সকলেই জানেন যে, দেহমুক্ত আত্মার সম্পর্কে আসতে হলে অপর-একটি দেহতে তাকে আশ্রয় দেওয়া চাই; একটি প্রাণীর মধ্যস্থতা ব্যতীত প্রেতাত্মা আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন না। আমাদের সমাজের প্রাচীন দেহ আছে বটে, কিন্তু প্রাণ নেই। শব প্রেতাত্মা কর্তৃক আবিষ্ট হলে মানুষ হয় না, বেতাল হয়। বেতাল-সিদ্ধ হবার দুরাশা খুব কম লোকেই রাখে; কাজেই শুধু মন নয়, পঞ্চেন্দ্রিয়ারা গ্রাহ্য যে ইউরোপীয় সভ্যতা আমাদের প্রত্যক্ষ রয়েছে, সাধারণত লোকে তারই অনুকরণ করে। অনুকরণ ত্যাগ করে যদি আমরা এই নব-সভ্যতার অনুবাদ করতে পারি, তাহলেই সে সভ্যতা নিজস্ব হয়ে উঠবে, এবং ঐ ক্রিয়ার সাহায্যেই আমরা নিজেদের প্রাণের পরিচয় পাব, এবং বাঙালির বাঙালিত্ব ফুটিয়ে তুলব।
তরজমার আবশ্যকত্ব স্থাপনা করে এখন কি উপায়ে আমরা সেবিষয়ে কৃতকার্য হব সেসম্বন্ধে আমার দু-চারটি কথা বলবার আছে।
সাধারণত লোকের বিশ্বাস যে, কথার চাইতে কাজ শ্রেষ্ঠ। এ বিশ্বাস বৈষয়িক হিসাবে সত্য এবং আধ্যাত্মিক হিসাবে মিথ্যা। মানুষমাত্রেই নৈসর্গিক প্রবত্তির বলে সংসারযাত্রার উপযোগী সকল কার্য করতে পারে; কিন্তু তার অতিরিক্ত কর্ম-যার ফল একে নয় দশে লাভ করে, তা-করবার জন্য মনোবল আবশ্যক। সমাজে সাহিত্যে যা-কিছু মহকার্য অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার মূলে মন-পদার্থটি বিদ্যমান। যা মনে ধরা পড়ে তাই প্রথমে কথায় প্রকাশ পায়, সেইকথা অবশেষে কার্যরূপে পরিণত হয়; কথার সক্ষশরীর কার্যরপ স্থূলদেহ ধারণ করে। আগে দেহটি গড়ে নিয়ে, পরে তার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টাটি একেবারেই বৃথা। কিন্তু আমরা রাজনীতি সমাজনীতি ধর্ম সাহিত্য সকল ক্ষেত্রেই ইউরোপীয় সভ্যতার প্রাণের সন্ধান না করে শুধু তার দেহটি আয়ত্ত করবার চেষ্টা করায় নিত্যই ইতোনষ্টস্ততেভ্রষ্ট হচ্ছি। প্রাণ নিজের দেহ নিজের রূপ নিজেই গড়ে নেয়। নিজের অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তির বলেই বীজ ক্রমে বক্ষ-রূপ ধারণ করে। সুতরাং আমরা যদি ইউরোপীয় সভ্যতার প্রাণে প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারি, তাহলেই আমাদের সমাজ নবকবের ধারণ করবে। এই নবসভ্যতাকে মনে সম্পূর্ণরূপ পরিপাক করতে পারলেই আমাদের কান্তি পুষ্ট হবে। কিন্তু যতদিন সে সভ্যতা আমাদের মুখস্থ থাকবে কিন্তু উদরস্থ হবে না, ততদিন তার কোনো অংশই আমরা জীর্ণ করতে পারব না। আমরা যে, ইউরোপীয় সভ্যতা কথাতেও তরজমা করতে পারি নি, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ এই যে, আমাদের নূতন শিক্ষালব্ধ মনোভাবসকল শিক্ষিত লোকদেরই রসনা আশ্রয় করে রয়েছে, সমগ্র জাতির মনে স্থান পায় নি। আমরা ইংরেজি ভাব ভাষায় তরজমা করতে পারি নে বলেই আমাদের কথা দেশের লোকে বোঝে না, বোঝে শুধু ইংরেজি-শিক্ষিত লোকে। এদেশের জনসাধারণের নেবার ক্ষমতা কিছু কম নয়, কিন্তু আমাদের কাছ থেকে তারা যে কিছু, পায় না, তার একমাত্র কারণ আমাদের অন্যকে দেবার মত কিছু নেই; আমাদের নিজস্ব বলে কোনো পদার্থ নেই–আমরা পরের সোনা কানে দিয়ে অহংকারে মাটিতে পা দিই নে। অপরপক্ষে আমাদের পবিপুরুষদের দেবার মত ধন ছিল, তাই তাঁদের মনোভাব নিয়ে আজও সমগ্র জাতি ধনী হয়ে আছে। ঋষিবাক্যসকল লোকমুখে এমনি সুন্দর ভাবে তরজমা হয়ে গেছে যে, তা আর তরজমা বলে কেউ বুঝতে পারেন না। এদেশের অশিক্ষিত লোকের রচিত বাউলের গান কাউকে আর উপনিষদের ভাষায় অনুবাদ করে বোঝাতে হয় না, অথচ একই মনোভাব ভাষান্তরে বাউলের গানে এবং উপনিষদে দেখা দেয়। আত্মা যেমন এক দেহ ত্যাগ করে অপর দেহ গ্রহণ করলে পবদেহের অতিমাত্রও রক্ষা করে না, মনোভাবও যদি তেমনি এক ভাষার দেহত্যাগ করে অপর-একটি ভাষার দেহ অবলম্বন করে, তাহলেই সেটি যথার্থ অনুদিত হয়।
উপযুক্ত তরজমার গুণেই বৈদান্তিক মনোেভাবসকল হিন্দুসন্তানমাত্রেরই মনে অল্পবিস্তর জড়িয়ে আছে। এদেশে এমন লোক বোধ হয় নেই, যার মনটিকে নিংড়ে নিলে অন্তত এক ফোঁটাও গৈরিক রং না পাওয়া যায়। আর্যসভ্যতার প্রেতাত্মা উদ্ধার করবার চেষ্টাটা একেবারেই অনর্থক, কারণ তার আত্মাটি আমাদের দেহাভ্যন্তরে সষপ্ত অবস্থায় রয়েছে, যদি আবশ্যক হয় ততা সেটিকে সহজেই জাগিয়ে নেওয়া যেতে পারে। ঠিক কথাটি বলতে পারলে অপরের মনের বার আরব্য-উপন্যাসের দস্যদের ধনভাণ্ডারের বারের মত আপনি খুলে যায়। আমরা, ইংরেজি-শিক্ষিত লোকেরা, জনসাধারণের মনের দ্বার খোলবার সংকেত জানি নে, কারণ আমরা তা জানবার চেষ্টাও করি নে। যেসকল কথা আমাদের মুখের উপর আলগা হয়ে রয়েছে কিন্তু মনে প্রবেশ করে নি, সেগুলি আমাদের মুখ থেকে খসে পড়লেই যে অপরের অতরে প্রবেশ লাভ করবে, এ আশা বৃথা।