বৌদ্ধধর্মের মতো খৃস্টধর্মেরও ত্রিরত্ন আছে–সে হচ্ছে খৃস্ট ধর্ম ও সংঘ; এবং খৃস্টিয়ান মাত্রেই নামমাত্র এই তিনের শরণ গ্রহণ করেন। কিন্তু যুগভেদে এই তিনের মধ্যে এক-একটি রত্ন সর্বাপেক্ষা মহামূল্য হয়ে ওঠে।
প্রথম যুগে (Primitive Christianity) খৃস্টিয়ানের পক্ষে খৃস্টই ছিল শরণ্য। মধ্যযুগে খৃস্টের স্থান খৃস্টসংঘ অধিকার করেন এবং ইউরোপের মনোরাজ্যে একাধিপত্য স্থাপন করেন; সে সংঘ সে আধিপত্যের ভাগ খৃস্টকেও দেন নি, ধর্মকেও দেন নি। প্রায় একহাজার বৎসর ধরে খৃস্টসংঘ মানবের বুদ্ধি ও আত্মাকে সমান অভিভূত করে রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, সাংসারিক হিসাবেও এই সংঘ ইউরোপের রাজরাজেশ্বর হয়ে উঠেছিলেন। এই সংঘ মানুষের তনু মন ধনের উপর এই অসীম প্রভুত্ব অক্ষম রাখবার জন্য ধর্মের নামে কত যে অধর্মযুদ্ধের প্রবর্তন করেছেন তার প্রমাণ মধ্যযুগের ইতিহাসের পাতায় পাতায় পাওয়া যায়।
এই সংঘের ধর্ম ও খৃস্টধর্ম এক বস্তু নয়। সুতরাং এই সংঘের দাসত্ব হতে মুক্তিলাভ করে ইউরোপের যে ধর্মজ্ঞান লুপ্ত হয়েছে এ কথা বলা চলে না। বরং পূর্বের অপেক্ষা বর্তমানে ইউরোপীয়দের যে ধর্মবুদ্ধি (conscience) অধিক জাগ্রত হয়ে উঠেছে তার প্রমাণ ইউরোপের সকল আইনকানুনে সকল সমাজব্যবস্থায় পাওয়া যায়।
মধ্যযুগের অন্ধ কারাগার আপনি ভেঙে পড়ে নি; মানবমনের একটির পর আর-একটি তিনটি প্রবল ধাক্কায় তার পাষাণপ্রাচীর বিদীর্ণ হয়েছে; সে তিন হচ্ছে ইতালির রেনেসাঁস, জর্মানির রিফরমেশন এবং ফ্রান্সের রেভলিউশন।
গ্রীস ও রোমের প্রাচীন সভ্যতার স্পর্শে ইতলি যেদিন নবজীবন লাভ করলে সেইদিন ইউরোপে নবসভ্যতার সূত্রপাত হল। এই প্রাচীন সাহিত্যের আবিষ্কারের সঙ্গে মানুষ নিজের শক্তি ও বাহিরের সৌন্দর্য আবিষ্কার করলে। মানুষ বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডকে নিজের চোখ দিয়ে দেখতে এবং নিজের বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে শিখলে। মানুষের পক্ষে তার এই নব-আবিস্কৃত অন্তর্নিহিত শক্তির চর্চাই তার প্রধান কর্তব্য হয়ে উঠল। যে প্রকৃতিকে ইউরোপীয়েরা হাজার বত্সর ধরে বিমাতা মনে করে আসছিল, তাকে তারা সেবাদাসীতে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়ে উঠল। এই নবজীবন শিল্পে বিজ্ঞানে কাব্যে ইতিহাসে বিকশিত হয়ে উঠল। এক কথায় নবজীবন লাভ করে মানুষের চোখ-কান ফুটল এবং হাত-পায়ের খিল খুলে গেল।
এর পরবর্তী যুগে জর্মানি বাইবেলের আবিষ্কারের সঙ্গে নিজের আত্মারও আবিষ্কার করলে; মানুষে এই সত্যের পরিচয় পেলে যে, ধর্মের মূল তার নিজের অন্তরে, ধর্মযাজকের মুখে নয়। খৃস্টের ধর্মের পরিচয় লাভ করে মানুষে খৃস্টসংঘের সংস্কারের জন্য উৎসুক হয়ে উঠল। জর্মানির এই নবসংস্কারের গুণে ইউরোপের মানবশক্তি আবার অন্তর্মুখী হল। মানুষ আত্মদর্শনের জন্য লালায়িত হয়ে উঠল।
এই রেনেসাঁসের ফলে ইউরোপে মানুষের কর্মবুদ্ধি এবং এই রিফরমেশনের ফলে তার ধর্মবুদ্ধি মুক্তিলাভ করলে; কিন্তু তার সামাজিক জীবনের বিশেষ কোনো পরিবর্তন ঘটল না।
তার পর ফ্রান্সের বিপ্লবের ফলে ইউরোপীয় মানব মধ্যযুগের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থেকে মুক্তিলাভ করে জীবনেও স্বাধীনতা লাভ করলে। সুতরাং ইউরোপের নবযুগের সভ্যতায় মানুষ তার মনুষ্যত্ব ফিরে পেলে, হারাল না। যে মনোভাবের উপর এ সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত তা শান্তির পক্ষে অনুকূল বই প্রতিকুল নয়। সামাজিক স্বাধীনতা যে সামাজিক মৈত্রীর প্রতিবন্ধক নয়, তার প্রমাণ এই ধেই পাওয়া যায়। আজ দেখা যাচ্ছে যে, ইউরোপের এক-একটি জাতি যেন এক-একটি ব্যক্তিস্বরূপ হয়ে উঠেছে; মধ্যযুগে এরূপ একজাতীয়তার ভাব মানুষের কল্পনারও অতীত ছিল।
.
৩.
আমি পূর্বে বলেছি যে, কোনো যুগের কোনো সভ্যতা একেবারে নির্দোষ কিংবা একেবারে নির্গুণ নয়। ইউরোপের মধ্যযুগের সপক্ষে যে কিছু বলবার নেই, তা নয়। অন্ধকারেরও একটা অটল সৌন্দর্য আছে এবং তার অন্তরেও গুপ্তশক্তি নিহিত থাকে। যে ফল দিনে ফোটে, রাত্রে তার জন্ম হয়—এ কথা আমরা সকলেই জানি। সুতরাং নবযুগে যে-সকল মনোভাব প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে তার অনেক গলির বীজ মধ্যযুগে বপন করা হয়েছিল। কিন্তু নবযুগের আলোক না পেলে সে-সকল বীজ বড়োজোর অঙ্কুরিত হত, তার বেশি নয়।
ইউরোপের নবসভ্যতার আলোক সুর্যের আলো নয় যে, তা কেউ নেবাতে পারে না। এ আলো প্রদীপের আলো, আকাশ থেকে পড়ে নি, মানুষে নিজহাতে রচনা করেছে; সুতরাং ইউরোপের নিশাচররা এ আলো নেবাবার বহু চেষ্টা করেছে। মধ্যযুগের সঙ্গে পদে-পদে লড়াই করে নবযুগকে অগ্রসর হতে হয়েছে। রিফমেশনকে আত্মরক্ষার জন্য প্রায় দেড়শো বছর অবিরাম যুদ্ধ করতে হয়েছে। ফরাসিবিপ্লব আত্মরক্ষার জন্য যে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়, তা ইউরোপময় ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতা সাম্য ও মৈত্রী’র মন্ত্রে দীক্ষিত নেপোলিয়ন সমগ্র ইউরোপকে প্রায় নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন। স্বাধীনতার অবতার পরের স্বাধীনতা অপহরণ করা, মৈত্রীর অবতার পরের শত্রুতা করা এবং সাম্যের অবতার যে ইউরোপের একেশ্বর হওয়া তাঁর জীবনের ব্রত করে তুলেছিলেন, এ কথা মনে করলে মানবসভ্যতা সঙ্গে হতাশ হয়ে পড়তে হয়। কিন্তু আমরা আজ একশো বছর পরে নেপোলিয়নের এই বিরাট দস্যুতার বিচার করে দেখতে পাই যে, তার সুফল হয়েছে এই যে, ফরাসি রাজনৈতিক ব্যবস্থা সমগ্র ইউরোপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; আর তার কুফল হয়েছে এই যে, সেইসঙ্গে নেপোলিয়নের মিলিটারিজমও সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।