পৌষ ১৩২১
————-
১. “নূতনে পুরাতনে”, ‘নারায়ণ’, অগ্রহায়ণ ১৩২১।
২. “হিন্দুর প্রকৃত হিন্দুত্ব”, অগ্রহায়ণ ১৩২১।
বর্তমান সভ্যতা বনাম বর্তমান যুদ্ধ
বর্তমান যুদ্ধের কার্যকারণ সম্বন্ধে ইউরোপে যদি কোনো বাজে কথা কিংবা অসংগত কথা বলা হয় তাতে আশ্চর্য হবার কোনো কারণ নেই, কেননা মানুষে যখন যুগপৎ ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, মনে যখন রাগ ও দ্বেষই প্রাধান্য লাভ করে তখন তার পক্ষে বাক্যের সংযম কতক পরিমাণে হারানো স্বাভাবিক।
ঘরে ডাকাত পড়লে তার সঙ্গে মিষ্ট এবং শিষ্ট আলাপ করা সম্ভবত দেবতার পক্ষে স্বাভাবিক, মানুষের পক্ষে নয়; এবং ইউরোপের লোক দেবতা নয়, মানুষ।
কিন্তু এই যুদ্ধে ব্যাপারটি আমাদের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে বিচার করবার বিশেষ কোনো বাধা নেই। আমরা ও-জালে জড়িয়ে পড়ি নি; এখন পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে এ ব্যাপারের যা-কিছু যোগ আছে সে শুধু তারের–নাড়ির নয়।
ইউরোপে সুরাসুর মিলে যে ভবসমুদ্র মন্থন করেছেন তার ফলে অমৃতই উঠুক আর হলাহলই উঠক, তার ভাগ আমরাও পাব; কিন্তু সে ভবিষ্যতে। সে বস্তু পান করবার পূর্বেই আমাদের দৃষ্টিবিভ্রম হবার কোনো কারণ নেই। বরং এই অবসরে আমরা যদি ব্যাপারটি ঠিক ভাবে দেখতে ও বুঝতে শিখি তা হলে এর ভবিষ্যৎ ফলাফলের জন্য আমরা অনেকটা প্রস্তুত থাকব।
এই সমরানলে যে বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতার অগ্নিপরীক্ষা হয়ে যাবে সে কথা সত্য। কিন্তু বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতার অর্থ যে কি, সে বিষয়ে দেখতে পাই অনেকের তেমন স্পষ্ট ধারণা নেই। এমন-কি, কেউ কেউ এই উপলক্ষে ইউরোপীয় সভ্যতার প্রতি নিতান্ত অবজ্ঞা প্রকাশ করতে কুণ্ঠিত হচ্ছেন না।
আমার মতে ইউরোপের প্রতি অবজ্ঞার কথা আমাদের মুখে শোভা পায় না। এ অবশ্য রুচির কথা; সুতরাং এ ক্ষেত্রে মতভেদের যথেষ্ট অবসর আছে। মনোভাব প্রকাশ না করলেই যে, সে ভাব মন থেকে অন্তর্হিত হয়ে যায় তা অবশ্য নয়। অথচ এ কথাও সম্পূর্ণ সত্য যে, আমরা মুখে কি বলি, তার চাইতে আমরা মনে কি ভাবি তার মূল্য আমাদের কাছে ঢের বেশি; কেননা সত্যের জ্ঞান না হলে মানুষে সত্য কথা বলতে পারে না।
প্রথমত কি স্বদেশী, কি বিদেশী, কি নবীন, কি প্রাচীন কোনো সভ্যতাকেই এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া চলে না।
একটি বিপুল মানবসমাজের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে ওরকম এক-তরফা ডিক্রি দেওয়ার নাম বিচার নয়। বহু মানবে বহু দিন ধরে কায়মনোবাক্যে যে সভ্যতা গড়ে তুলেছে তার ভিতর যে মনুষ্যত্ব নেই, এ কথা বলতে শুধু তিনিই অধিকারী যিনি মানুষ নন। অপর পক্ষে চরম-সভ্যতা বলে কোনো পদার্থ মানুষে আজ পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারে নি এবং কখনো পারবে না। কেননা, পৃথিবী যেদিন স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠবে সেদিন মানুষের দেহমনের আর কোনো কার্য থাকবে না, কাজেই মানুষ তখন চিরনিদ্রা উপভোগ করতে বাধ্য হবে। অন্তত পৃথিবীতে এমন কোনো সত্যতা
আজ পর্যন্ত হয় নি যা একেবারে নির্গুণ কিংবা একেবারে নির্দোষ। কোনো একটি বিশেষ সভ্যতার বিচার করবার জন্য তার দোষগণের পরিচয় নেওয়া আবশ্যক, মনকে খাটানো দরকার। যখন আমরা আলস্যে অভিভূত হয়ে হাই তুল তখনই আমরা তুড়ি দিই, সুতরাং আমরা যখন তুড়ি দিয়ে কোনো জিনিস উড়িয়ে দিতে চাই তখন আমরা মানসিক আলস্য ব্যতীত অন্য কোনো গুণের পরিচয় দিই না। এ সত্য অবশ্য চিরপরিচিত; কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, পৃথিবীতে যা চিরপরিচিত তাই চির-উপেক্ষিত।
.
২.
ইউরোপের বর্তমান সভ্যতার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ এই যে, যে মনোভাবের উপর সে সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত এই মহাসমর হচ্ছে তার স্বাভাবিক পরিণতি; কেননা এ যুগে ইউরোপ ধর্মপ্রাণ নয়, কর্মপ্রাণ। সে দেশে আজ আত্মার অপেক্ষা বিষয়ের, মনের অপেক্ষা ধনের মাহাত্ম ঢের বেশি। শিল্প-বাণিজ্যের পরিমাণ-অনুসারেই এ যুগে ইউরোপের জাতীয় শ্রেষ্ঠত্বের পরিমাপ করা হয় এবং সে দেশের লোকের বিশ্বাস যে, মানবের ভ্রাতৃভাব নয় ভ্রাতৃবিরোধই হচ্ছে ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভ্যুদয়ের একমাত্র উপায়। অতএব এই যুদ্ধ হচ্ছে ইউরোপের আজ একশো বৎসরের কর্মফল।
এ অভিযোগের মূলে যে কতকটা সত্য আছে তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু কতটা, তাই হচ্ছে বিচার্য।
আমরা মানবসভ্যতাকে সচরাচর দুই ভাগে বিভক্ত করি; প্রাচীন ও নবীন। কিন্তু পৃথিবীতে এমন-কোনো বর্তমান সভ্যতা নেই যা অনেক অংশে প্রাচীন নয়। যেমন আমাদের বর্তমান সভ্যতা কিংবা অসভ্যতা এক অংশে প্রাচীন হিন্দু, এবং আর-এক অংশে নব্য ইউরোপীয়, তেমনি ইউরোপের বর্তমান সভ্যতা আট-আনা নতুন হলেও আট-আনা পুরনো। সুতরাং এই যুদ্ধের জন্য ইউরোপের নবমনোভাবকে সম্পূর্ণ দায়ী করা যেতে পারে না, বরং তার পূর্বসংস্কারকেই এর জন্য দোষী করা অসংগত হবে না।
মানুষে-মানুষে কাটাকাটি-মারামারি করা যদি অসভ্যতার লক্ষণ হয় তা হলে বলতে হবে ইউরোপের বর্তমান যুগের অপেক্ষা মধ্যযুগ টের বেশি অসভ্য ছিল। সে যুগে যুদ্ধপার্বন বারো মাসে তেরো বার হত এবং সে কালের মতে ও-কার্যটি নিত্যকর্মের মধ্যে গণ্য ছিল। মধ্যযুগকে ইউরোপীয়েরা কৃষ্ণযুগ বলেন, কিন্তু আসলে সেটি রক্তযুগ। আমরা আমাদের বর্তমান মনোভাববশতই যুদ্ধকাৰ্যটি হেয় মনে করি, প্রাচীন মনোভাব থাকলে শ্রেয় মনে করতুম। ইউরোপের নবযুগ অবশ্য এক হিসাবে যন্ত্রযুগ, কিন্তু তাই বলে মধ্যযুগ যে মন্ত্রযুগ ছিল, তা নয়। যে হিসাবে মধ্যযুগ ধর্মপ্রাণ ছিল সে হিসাবে নবযুগ ধর্মপ্রাণ নয়। সে হিসাবটি যে কি, তা একটু পরীক্ষা করে দেখা আবশ্যক।